তুমি থেকে যাও আমি রেখে দিব পর্ব-১০+১১

0
268

#তুমি_থেকে_যাও_আমি_রেখে_দিব
#পর্ব_১০
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

ঘড়ির কাটা পাঁচটা ছুঁই ছুঁই।অধরা কোনো রকম বাসা থেকে বেড়িয়ে চৌধুরী বাড়িতে চলে আসলো।গেটের সামনে আসতেই দেখলো দারোয়ান ঘুমিয়ে আছে।হাজার চেষ্টা করে’ও বাসার ভেতর প্রবেশ করতে পারলো না।বাধ্য হয়ে দারোয়ানকে বলল দরজা খুলে দিতে।দারোয়ান অধরা কে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেও প্রশ্ন করার সাহস পাই নাই সে।অধরা আস্তে করে বাসার ভেতর চলে গেলো।আহানের রুমের সামনে এসে নক করেই যাচ্ছে।কিন্তু আহানের দরজা খোলার নামে কোনো নাম-ই নেই।রেগে জোরে দরজায় বারি দিতে শুরু করলো।আহান বিরক্ত হয়ে,এসে দরজা খুলে দিলো।সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।রান্নার করার লোকেরা অধরা কে দেখে ফেলছে।কি জানি কি মনে করলো।অধরাকে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকালো আহান।চিৎকার করতে যাবে।তখনি অধরা আহানের মুখ চেপে ধরে।

–একদম ষাঁড়ের মতো চিল্লাবেন না।আমি শুধু আপনার বাবার সন্মান রক্ষা করার জন্য এসেছি।বলল অধরা।

–হয়েছে আর ভালো সাজতে হবে না।আমি জানি তুমি আবার আসবে।এত বাড়ির বউ হয়েছো।সুখের রাজ্য ছেড়ে কেউ কোনোদিন যেতে চায়।এই কয়েক ঘন্টার জন্য নাটক করে কি হলো।বলল আহান।

–আপনার সাথে আমি পরে কথা বলছি।দেখি সরুন আমার ব্যাগ টা কোথায় আমার জামা কাপড় সব নিয়ে এসেছে।বলেই খুঁজতে লাগলো।আলমারির এক কোণে চোখ যায় অধরার সেখানে গিয়ে।নিজের একটা জামা বের করে।সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়।আহান অধরার কান্ড দেখছে খালি।চোখে একরাশ ঘুৃম।একটু পরে অধরা একবারে গোসল করে বের হলো।আহান ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।কি সাহস মেয়েটার,এই সাত সকাল বেলা কেউ গোসল করে।ভাবতে’ই আহানের পুরো শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠলো।

–এই মেয়ে তুমি এই সাত সকাল বেলা গোসল করলে।তোমার শীত লাগলো না।

–কিসের শীত আমার সেই গরম লাগছে।মনে হচ্ছে আবার গোসল করে আসি।

–আমার রুম থেকে বের হয়ে গিয়ে গোসল করো।আমার রুমে তোমার কোনো জায়গা নাই।

–কাল সারারাত মশা জ্বালিয়েছে।এখন আপনি জ্বালাবেন না।আমার অনেক ঘুম পেয়েছে,আমাকে দয়া করে ঘুমোতে দেন।

–কি মিসেস অধরা বাসর রাতে শেষমেষ মশা আপনাকে আদর করে ছেড়ে দিলো।

–তাহলে কি করবে জামাই আদর করার কথা ছিলো।জামাই আদর করে নাই।তাই মশাই আমাকে আদর করে দিয়ে গেছে।বলেই জিভে কামড় দিলো অধরা।

অধরার কথায় আহান কেমন জানি লজ্জা পেলো।আর কোনো কথা বলল না।বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।আর অধরাকে বলল একদম আমার বিছানায় শুবে না।বলেই ঘুমিয়ে গেলো।অধরার রাতে ঘুম হয় নাই ভালো করে।অধরা ফ্লোরে বসে আহানের বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে গেলো।এত ঝগড়া করার সময় নেই।ঘুমটা আগে দরকার।বলেই ঘুমিয়ে গেলো।

আটটার দিকে আশরাফুল চৌধুরী অধরার নানিকে ফোন দিলো।কিন্তু অধরার নানি ফোন তুললেন না।কাজে ব্যস্ত ছিলেন।কিছুয় ভয় কাজ করছে।সবাই যদি অধরাকে না দেখে সবাইকে কি উত্তর দিবে।আশরাফুল চৌধুরী অবাক করে দিয়ে।তিতির আহান আর অধরাকে নিয়ে নিচে আসলো।আশরাফুল চৌধুরীর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।মেয়েটা সত্যি খুব দায়িত্ববান।ঠিক তার কথা রেখেছে।মানুষ জন এসে ভরে গেছে পুরো বাসায়।সবাই নতুন বউকে দেখে যাচ্ছে।বিকেলের দিকে অধরার নানিরা আসলেন অধরাকে নিয়ে যেতে।সবাই খাওয়া দাওয়া করে।সন্ধ্যা বেলা বিদায় নিলেন।আত্নয়ী স্বজন প্রায় সবাই চলে গেছে।দু-এক জন আছে।সকাল হলে বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিবে।আহান প্রথমে যেতে রাজি না হলে,বাবার রাগ দেখে বাধ্য হয়ে অধরাদের বাসায় গেলো।রাত আটটার দিকে অধরাদের বাসায় এসে পৌঁছালো।রাতে খাওয়া দাওয়া করে যে যার মতো রুমে চলে আসলো।আহান আগেই অধরার বিছানায় বসে বসে ফোন ঘাটছে।

–একটু নামুন তো।আমি বিছানার গোছাবো।তারপরে আবার বসবেন।

–আমি পারবো না।আমার পায়ে ব্যাথা করছে।আহান চৌধুরী তোমাদের বাসায় এসেছে।এটাই তোমাদের ভাগ্য ভালো।আবার আমাকে নামতে বলছো।

অধরা বিরক্ত হয়ে বিছানার উপরে গিয়ে বসলো।ফোন হাতে নিতেই দেখলো আকাশ ফোন দিয়েছিলো।কোনো কথা না বলে আকাশকে ফোন দিলো।রিং হতেই আকাশ ফোন ধরে বলল।

–আপাই তুই কোথায় ছিলি।আমি তোকে কতবার ফোন দিয়েছি।তুই ধরিস নাই কেনো।আপাই তুই শহরের গিয়ে আমাদের ভুলে গেলি।জানিস আপাই আজ আমাদের রেজাল্ট দিয়েছে।আমি ফাস্ট হয়েছি।আমার স্কুলে বেতন আঁটকে গেছে।স্যার বলেছে সাতদিন এর মধ্যে বেতন পরিশোধ করতে না পারলে। আমাকে স্কুল থেকে বের করে দিবে।আমার কি পড়াশোনা করা আর হবে না আপাই।বাবাও অসুস্থ।আমাদের হসপিটালে থাকতে হয়।আমি হসপিটালে থেকে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়েছি।জানিস আপাই রোদের মধ্যে হেঁটে যেতে আমার অনেক কষ্ট হয়।এভাবে হাজারো অভিযোগ করেই যাচ্ছিলো আকাশ।অধরার চোখের কোনো পানি এসে জমা হয়েছে।

–আকাশের আপাই থাকতে।আকাশের পড়াশোনা কখনো বন্ধ হতে পারে।তুই চিন্তা করিস না।আমি তোর জন্য টাকা পাঠিয়ে দিব।তোর আর হেঁটে যেতে হবে না।আমাদের বাবা খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।তোর আপাই খুব তাড়াতাড়ি তোর কাছে আসছে ভাই।

–আপাই সত্যি তুই আসবি।তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়।তোকে ছাড়া আমার একদম ভালো লাগে না।আম্মু সারাদিন আমাকে বকে।

–আমি আসলে আর বকতে পারবে না।আপাইয়ের ওপরে ভরসা করিস না আকাশ।

–হ্যাঁ আমি আমার থেকে-ও বেশি তোকে ভালোবাসি আপাই।

–তাহলে কথা না বলে এবার ফোনটা মায়ের কাছে দে।

অধরার মা ফোন হাতে নিয়ে বলল।

–একদম লাই দিয়ে ওকে মাথায় তুলবি না।দিন দিন ওর আবদার বেড়ে যাচ্ছে।এত জেদ আসে কয় থেকে ওর।গরীবের ঘরে জন্ম নিয়েছে।কষ্ট ওর করতেই হবে।তুই কি টাকার ব্যবস্থা করতে পেরেছিস।না পারলে বলে দে।আমি বাড়িটা বিক্রি করে দিব।

–আম্মু তুমি পাগল হয়ে গেছো।আকাশকে আমি কখনো কোনো কিছুর অভাব বুঝতে দিব না।তুমি এতটা রেগে যাচ্ছো কেনো।আমাকে তিনটা দিন সময় দাও আমি আসছি।টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে।

অধরার মা রেগে কল কেটে দিলো।হাজার হলে-ও অধরার বাবা তার ভালোবাসার মানুষ।ভালোবাসার মানুষের এত কষ্ট কেউই সয্য করতে পারবে না।অধরার মায়ের ক্ষেত্রে’ও তার ব্যাতিক্রম নয়।শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে নিলেন অধরার আম্মু।

আহান ভ্রু কুঁচকে অধরার দিকে তাহালো।ফোনটা রেখেই অধরা একদম চুপচাপ হয়ে গেলো।সকালে অফিস যেতে হবে।তাই অধরা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল।আহান বোকার মতো অধরার দিকে চেয়ে রইলো।একটু পরে সে-ও ঘুমিয়ে গেলো।সকালে খাওয়া দাওয়া আহান চলে আসলো।অধরা থেকে গেলো।অধরা আর চৌধুরী বাড়িতে যাবে না।সকালে খেয়ে অফিসের উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পড়ল।অফিসে আসতেই সবাই কেমন করে তাকিয়ে আছে অধরার দিকে।আদিলের মন খারাপ।শুকনো মুখে অধরার দিকে তাকিয়ে আছে।মিমি রাগে ফুঁসছে।তার যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে অধরাকে এখনি শেষ করে দিলো।তবুও মুখে হাসি এনে অধরার দিকে এগিয়ে এসে বলল।

–নতুন বউ যে,বিয়ে না হতেই অফিসে আসলে।বলল মিমি।

–কোথায় লেখা আছে।যে,বিয়ে হলে অফিসে আসা যাবে না।মাস শেষে তো আমাকে এমনি এমনি বসিয়ে বেতন দিবে না।যা-ও নিজের কাজ করো।বলেই গটগট করে চলে গেলো অধরা।আদিল একগাদা ফাইল নিয়ে অধরার কেবিনে গেলো।

–আসতে পারি ম্যাডাম।

–আরে আদিল আপনি অনুমতি নেওয়া ধরলেন কবে।তবে এটা করা ভালো।

–তোমাকে শাড়িতে অনেক সুন্দর লাগছে অধরা।

–ধন্যবাদ কিছু বলবেন।

–এই ফাইল গুলোতে আহান স্যারের সাইন লাগবে।তিন দিন হলো এসে জমা হয়েছে।

–আচ্ছা আপনি রেখে যান।আমি স্যার কে দিয়ে সাইন করিয়ে রাখবো।আপনি এসে নিয়ে যাবেন।আদিল ভেতর রাখতে যাবে।তখনি তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে লাগলে অধরা ধরে ফেলে।

–কোনো সমস্যা আদিল।আপনি ঠিক আছেন।এসে থেকে দেখছি।আপনি কেমন জানি একটা হয়ে আছেন।আপনার হাত পা কাঁপছে কেনো।খাওয়া দাওয়া করেন নাই নাকি।

আদিল কিছু বলতে যাবে তখনি আদিলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে অধরার গালে কষে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় আহান।ঘটনা এত দ্রুত ঘটায় আদিল,অধরা দুজনেই হতভম্ব হয়ে যায়।আহান রেগে চিৎকার দিয়ে বললে।

–এটা কাজ করার জায়গা।নষ্টামি করার জায়গা না।নষ্টামি যদি করতে হয়।তাহলে অফিসের বাহিরে গিয়ে করবেন।

অধরা এক গালে হাত রেখেই বললো।

–এসব কি বলছেন।কি করেছি আমরা।

–লজ্জা করছে না বলতে।আবার বলছেন।

–স্যার আপনি ভুল বুঝছেন।আমি অধরা ম্যাডামকে ফাইল দিতে আসছিলাম।বলল আদিল।

–এসে নষ্টামি শুরু করে দিয়েছেন।আগে থেকেই আপনাকে আমার পছন্দ না।

–কি সব যা-তা বলছেন।একদম বাজে কথা বলবেন না।আমাদের নিয়ে বাজে কথা বললে একদম মেনে নিব না।বলল অধরা।

–তাই নাকি কি করবে শুনি।

–আচ্ছা আমরা যদি কোনো কিছু করে থাকি তাহলে আপনার কি।

–আমার কি মানে,আমার অনেক কিছু কারন তুমি আমার বউ।

বউ কথাটি শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় অধরা।কি বলবে বুঝতে পারছে না।তবু্ও তাকে নিয়ে বাজে কথা বলছে আহান,তার ধারনা যে ভুল তাকে প্রমাণ করে দিতেই হবে।অধরা আহানকে নিয়ে আহানের কেবিনে গেলো।তারপরে বলল।

–আপনি সিসি ক্যামেরা চেক করে দেখুন।সিসি ক্যামেরা চেক করে আহান নিজেই লজ্জায় পড়ে যায়।অধরা কোনো কথা না বলে আহানের কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায়।

–স্যার আপনি আসছেন না কেনো।আমার টাকা টা খুব তাড়াতাড়ি লাগবে।আমি গ্রামে যাব।আমি যদি আমার বাবাকে সুস্থ-ই করে তুলতে না পারি।তাহলে পরে টাকা নিয়ে আমি কি করবো।বলল অধরা।

–তোমাকে আমি অফিসে বা চৌধুরী বাড়ি থেকে টাকা দিতে পারবো না।টাকা নিতে হলে বাহিরে থেকে নিতে হবে।তুমি কলেজের সামনে আসো।আমি আসছি।বললেন আশরাফুল চৌধুরী।

অধরা অফিস থেকে বেড়িয়ে গেলো।কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।আহান অধরা কে সরি বলার জন্য আসছিলো।অধরাকে বেড়িয়ে যেতে দেখে সে-ও অধরার পিছু নিলো।

–এই তুমি অধরা না কেমন আছো।তোমাকে কতদিন পরে দেখলাম।বলল সানভি।

–আরে সানভি যে,কেমন আছো।কি অবস্থা তুমি শহরেই থাকো।

–হ্যাঁ আমি শহরে থাকি বিয়ে করছি।একদিন আমাদের বাসায় এসে ঘুরে যাবে।তুমি শহরে আসলে কি করে।সেই স্কুল জীবনে আমরা সবাই আলাদা হয়েছি।আর কারো সাথে দেখা নাই।কে কোথায় চলে গেছে।বলল সানভি।

–হুম আমি এখানে জব করি।

–ও আচ্ছা ভালো।এটা আমার কার্ড রাখো সময় করে একদিন আসবে।অধরা হাত বাড়িতে কার্ডটি নিলো।স্কুল জীবনের ফ্রেন্ড সানভি।কতদিন পরে দেখা।দূর থেকে সবকিছুই দেখছিলো আহান।রাগে চোখ লাল হয়ে গেছে।জোরে গাড়িতে একটা লাথি মেরে চলে গেলো আহান।সানভিও চলে গেলো।একটু পরে আশরাফুল চৌধুরী আসলেন।অধরার হাতে টাকা ধরিয়ে দিলেন।টাকা গুলো হাতে পেয়ে অধরার মনে হলো যেনো, তার প্রাণ ফিরে পেলো।তার মাকে ফোন করে জানিয়ে দিলো সে,বিকালে গাড়িতে উঠবে।অফিসে গিয়ে ছুটির এপ্লাই করবে।

অফিসে আসতেই আহান অধরার সামনে এসে দাঁড়ালো।

–কাজ রেখে কোথায় গিয়েছিলে।

–আমার একটু জরুরি একটা কাজ ছিলো।তাই গিয়ে ছিলাম।

–এভাবে কাজ করলে অফিসে আসার দরকার নেই।

–সরি স্যার আর হবে না।

–যতক্ষণ সময় বাহিরে ছিলে।তার থেকে দিগুন কাজ তোমাকে করতে হবে।বলেই আহান চলে গেলো।

চলবে…..

#তুমি_থেকে_যাও_আমি_রেখে_দিব
#পর্ব_১১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

বিকেল প্রায় হয়েই আসছে।সবাই আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে।যারা ওভার টাইম করে তারা শুধু থেকে গেছে।অধরা বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।কিন্তু আহান যতগুলো কাজ দিয়েছে।সারারাত কাজ করলে-ও শেষ হবে না।অধরা উঠে আহানের কেবিনের দিকে গেলো।

–আসতে পারি স্যার।বলল অধরা।

–হ্যাঁ আসুন।আপনার কাজ এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো।আপনি খুব ভালো কাজ করেন তো দেখছি।এতগুলো কাজ এত তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেললেন।কই দেখি আপনার ফাইল গুলো দেখান।আপনার হাত খালি কেনো।বলল আহান।

–সরি স্যার।এতগুলো কাজ একদিনে করা সম্ভব না।স্যার আজকে আমার গ্রামের বাড়ি যাওয়ার কথা।এর জন্য আমি ছুটির এপ্লাই’ও করেছি।আপনি দেখুন।প্লিজ স্যার আজকে আমাকে ছুটি দিয়ে দিন।আমি এসে আপনার সব কাজ করে দিব।কোনো অজুহাত দেখাবো না।

–কাজ শেষ না করলে আপনাকে এক মিনিট এর জন্য ছুটি দেওয়া হবে না।বলল আহান।

–স্যার একটু বোঝার চেষ্টা করেন।আমার হাতে বেশি সময় নেই।আমার তাড়াতাড়ি যেতে হবে।না হলে আমার বাবার ক্ষতি হয়ে যাবে।আজ কয়টা দিন হলো বাবা হসপিটালে ভর্তি আছে।অপারেশন না করলে আমার বাবাকে বাঁচাতে পারবো না।

–আপনি আমার বস নাকি আমি আপনার বস।

–সরি স্যার।

–নিজের কাজে যান।

–স্যার আমাকে যেতে দিন।আমি ফিরে আসার পরে আপনি যা বলবেন।আমি তাই করবো।

–তোমাকে আমি যেতে বলেছি।আমাকে বিরক্ত করবে না একদম।বলল আহান।

অধরা আহানের হাঁটুর কাছে গিয়ে বসে বলল।

–আপনি একটু বোঝার চেষ্টা করেন।আজকে আমার যাওয়া’টা খুব জরুরী।আমার বাবার অপারেশনটা যত তাড়াতাড়ি হবে।আমার বাবা তত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।আমার হাতে সত্যি সময় খুব কম।

–অন্য ছেলেদের সাথে দেখা করার সময় তো ঠিকি থাকে।আপনি যদি এখনি না যান।তাহলে আমি সিকিউরিটিকে দেখে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে আমার রুম থেকে বের করবো।

অধরা কিছু না বলে চুপচাপ আহানের কেবিন থেকে বেড়িয়ে আসলো।নিজের কেবিনে এসে হাতের সামনে থাকা পানির গ্লাসটা টুকরো টুকরো করে ফেললো।রাগে পুরো শরীর কাঁপছে অধরার।এত ভালো করে বলল তবু্ও শুনলো না।

রাত বাজে নয়টা।অধরা ফোন হতে নিয়ে দেখে ১৮৬ বার ফোন দিয়েছে তার মা।কাজের চাপে ফোনের কাছেও যেতে পারে নাই সে।নিশ্চয় তার মা তার জন্য অপেক্ষা করছিলো।অধরা তার মাকে ফোন করতে যাবে।তখনি আহান আসে।

–হয়েছে আজকে আর কাজ করা লাগবে না।বাসায় চলে যাও।কালকে এসে বাকি কাজ করবে।অধরা আহানের কথার কোনো উওর না দিয়ে,নিজের ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেলো।

অধরার এত তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে যাওয়ার দিকে আহান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।অধরা সোজা কাউন্টারে গেলো।বাস ধরে গ্রামে চলে যাবে।যেতে যেতে সকাল হয়ে যাবে।কাউন্টারে অপেক্ষা করছে অধরা।একটু পরে গাড়ি আসলো।অধরা গাড়িতে বসে তার নানিকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলো।আজকে সে,বাসায় যাবে না।বলেই কল কেটে দিলো।একটু পরে আশরাফুল চৌধুরী ফোন দিলেন।

–তুমি একা যেতে পারবে।আমাকে বলতে আমি’ও তোমার সাথে যেতাম।বললেন আশরাফুল চৌধুরী।

–আপনি কি করে জানলেন।আমি গ্রামে যাচ্ছি।

–বাবা হয় আমি তোমার।মেয়ের এতটুকু খোঁজ খবর রাখবো না।একা যেতে পারবে তো।নাকি আমি আসবো।

–এতরাতে আপনাকে আসতে হবে না স্যার।আমি যেতে পারবো।

–আচ্ছা আমি সকলে যাব।তুমি চিন্তা করো না।কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবে।আমি রাত জেগে অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।তুমি যতক্ষণ না গ্রামে পৌঁছাবে।আমার শান্তি নেই।

–আচ্ছা ঠিক আছে স্যার।একদম চিন্তা করবেন না।আপনি ঘুমিয়ে পড়েন।আমি পৌঁছে গিয়ে আপনাকে ফোন দিব।বলে’ই ফোন রেখে দিলো।

সকাল সাতটার দিকে অধরা গাড়ি থেকে নামলো।তারপরে তার মাকে একটার পরে একটা ফোন দিয়েই যাচ্ছে।কিন্তু তার মা ফোন তুলছে না।চিন্তায় পরে গেলো অধরা।হয়তো রেগে আছে তার মা।কোন হসপিটালে আছে তার বাবা।সে তা-ও জানে না।এখন কি করবে।সাত সকাল বেলা গাড়ি’ও পাওয়া যাচ্ছে না।তাই বাড়ির উদ্দেশ্য হাঁটা শুরু করলো অধরা।কেনো জানি ভেতরে ভয় কাজ করছে অধরার।পা যেনো এগোচ্ছে না অধরার।শরীর অবশ হয়ে আসছে।হয়তো রাতে ঘুম হয় নাই।তাই এমন হচ্ছে।রাস্তার একপাশে একটু বসে নিলো।তারপরে আবারা হাঁটা শুরু করলো।হাঁটছে আর তার মাকে ফোন দিচ্ছে।কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না।আটটার দিকে অধরা একটা গাড়ি পেলো।তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে পড়ল।ত্রিশ মিনিট গাড়ি চলার পরে।ছোট একটা গলির সামনে এসে গাড়িটা থেমে গেলো।

–আপা গাড়ি তো আর যাবে না।

–আচ্ছা মামা সমস্যা নেই।দশ মিনিটের রাস্তা আমি হেঁটে যেতে পারবো।বলে-ই ভাড়া দিয়ে হাঁটা শুরু করলো।আচ্ছা আজকে গ্রামের আশেপাশের মানুষ এত চুপ কেনো।সকাল হলেই সবাই চিল্লাচিল্লা শুরু করে দেয়।বাচ্চারা খেলাধুলা করে।বাচ্চাদের মা স্কুলে যাওয়ার জন্য বকে।লাঠি নিয়ে পেছনে পেছনে ছুটে।তাহলে আজ তাদের বাড়ির আশেপাশে এমন ফাঁকা লাগছে কেনো।একমাসে সবাই কি বদলে গেলো।দূর থেকে কারো কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।অধরা যতই এগোচ্ছে আওয়াজটা ভালো করে শুনতে পারছে।অধরা নিজের বাড়ির উঠান ভর্তি মানুষ দেখে অবাক হয়ে গেলো।উঠানের মাঝখানে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে কাউকে শুইয়ে রাখা হয়েছে।কাকে রাখা হয়েছে।আর এভাবে কান্নাই বা কে করছে।অধরা ভিড় ঢেলে ভিতরে গিয়ে তার মাকে কান্না করতে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলো।মনের ভেতরে ভয় কাজ করতে লাগলো।ভয়ে হাপ-পা কেমন জানি কাঁপছে।অধরা ধীর পায়ে তার মায়ের দিকে এগিয়ে গিলে বলল।

–কার কি হয়েছে মা।তুৃমি এভাবে কান্না করছো কেনো আম্মু।

তখনি অধরার মা অধরাকে দেখে রেগে অধরার চুলের মুঠি ধরে বলল।

–কালনাগিনী তুই কেনো এসেছিস।তোর শান্তি হয়েছে তো।আমি পারি নাই আমার ভালোবাসার মানুষকে বাঁচাতে।তুই তো বলেছিলে মনিরকে ঠিক করে দিবি।তাহলে সামান্য কয়টা টাকার জন্য কেনো আমার ওকে হারাতে হলো।তুই টাকার জোগার করতে পারিস নাই।আমাকেও জোগার করতে দিস নাই।আর দিবি বা কি করে।মনির তো তোর নিজের বাবা না।তাই কদর নেই।যদি নিজের বাবা হতো তাহলে ঠিক কদর থাকতো।তুই আমার মুখের সামনে থেকে সরে যা।আমি তোর মুখ দেখতে চাই না।তোর মা আমাকে বাড়ি ছাড়া করিয়েছে।তারপরে তার ছেলে-মেয়ে আমার ঘাড়ে বসিয়ে দিয়ে।পালিয়ে গেছে।আজ তোদের দুই ভাইবোনের জন্য আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেললাম।তোকে আজ মেরেই ফেলবো।বলেই অধরার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।কয়েকজন মহিলা এসে তাকে সরিয়ে নিলো।অধরার মা আবার এসে অধরার গলা চেপে ধরলো।আজ আমি যে ভাবে ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছি।তোকে মেরে ফেললে তোর মা বুঝতে পারবে ভালোবাসার মানুষ হারানোর যন্তনা কি।তখনি আকাশ ছুটে আসে।আকাশে দেখে মিনারা বেগম আরো রেগে গেলেন।মাটিতে পরে থাকা।লাঠি দিয়ে মারতে মারতে আকাশে মাটিতে শুয়ে ফেলছে।অধরা গিয়ে আকাশে ধরে ফেললো।কয়টা বারি অধরার গায়েও লাগলো।মিনারা বেগম একদম পাগল হয়ে গেছে।সবাই মিলে জোর করেও কিছু বোঝাতে পারছে না।

–আপাই জানিস।আমাদের বাবা আর নেই।কাল রাতে আমাদের বাবা মরে গেছে।তখন থেকে মা কেমন জানি করছে।আমাকে দেখতে পারছে না।আমি কাছে গেলেই আমাকে মারছে।আর বলছে তুই আর তোর বোন খুনি।মা নাকি আমাদের আসল মা না।আপাই মা এসব কি বলছে।কেনো বলছে আপাই।আমার না খুব কষ্ট হচ্ছে আপাই।

অধরা একদম বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে।কথা বলার শক্তি নেই তার।মিনারা বেগম তাকে এতগুলো মারলো একটাও তাকে আঘাত করতে পারে নাই।সে,নিজের কান,চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না।তার বাবা আর নেই।সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে।ঘুম ভাঙলেই স্বপ্নটা শেষ হয়ে যাবে।মনিরা বেগমের কান্না সবার কলিজা কাঁপিয়ে দিচ্ছে।অধরা এখনো মাটিতে বসে আছে।চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।কয়েকজন মহিলা এসে অধরাকে তুলে নিয়ে তার বাবার গেলো।বলল শেষ দেখা দেখে নিক।একটু পরে নিয়ে যাওয়া হবে।সবাই মিলে অধরাকে তার বাবার কাছে নিয়ে যেতেই অধরা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।বাবার পা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্না করে দিলো।

–ও বাবা তুমি এভাবে আমাদের একা রেখে চলে যেতে পারো না।এমনটা কথা ছিলো না।তুমি না বলেছিলে বাঁচলে।সবাই একসাথে বাঁচবো।আর মরলে সবাই একসাথে মরবো।আজ তাহলে এতটা নিষ্ঠুর কি করে হলে বাবা।ও বাবা উঠো না।তোমার কিছু হতে দিব না।আমি টাকা নিয়ে আসছি।তুমি সুস্থ হয়ে গেলে।আমাদের আবার সুখের সংসার গড়ে উঠবে।

সবাই অধরাকে ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করছে।কিন্তু অধরা এমন ভাবে আঁকড়ে ধরেছে কেউ ছাড়াতে পারছে না।কেউ কেউ বলছে।লাশের কাছে এসে কান্না করলে নাকি লাশের কষ্ট হয় ওকে সরিয়ে নিয়ে যান।অধরা বাবার পা কিছুতেই ছাড়ছে না।

–অধরা এভাবে কান্না করিস না মা।কেউ থাকতে আসে নাই।একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে।বাবার জন্য দোয়া কর।নামাজ পড়ে দোয়া করবি মা আয়া।বেশি বেশি কালেমা পড়বি চল মা।

–ও বাবা আমি আর তোমার কথার অবাধ্য হবো না।তুমি যা বলবে আমি তাই করবো।একবার ফিরে এসো বাবা।বাবা রে বাবা তুমি এতটা নিষ্ঠুর হতে পারো না।তুমি ছাড়া আমাদের আপন বলতে কেউ নেই বাবা।এতটা স্বার্থপর হয়ো না রে বাবা।

একদম পাগল হয়ে গেছে অধরা।চিৎকার করে কান্না করছে।অনেক কষ্ট করে সবাই অধরাকে সরিয়ে নিয়ে আসলো।কিন্তু আটকে রাখতে পারছে না।দৌড়ে দৌড়ে বাবার কাছে চলে আসছে।চিৎকার করতে করতে এক পর্যায়ে অধরার মুখ দিয়ে রক্ত উঠতে লাগলো।সবাই মিলে মাথায় পানি ঢালতে শুরু করলো কাজ হলো না।অধরা সেন্সলেন হয়ে গেলো।অধরার আঙুল চেপে ধরেও কেউ অধরার জ্ঞান ফেরাতে পারলো না।একটা গাড়ি ডেকে কাছের সরকারি হসপিটালে অধরাকে ভর্তি করলো।ডক্টর এসে অধরাকে স্যালাইন করে গেলো।এক ঘন্টা পরে অধারর জ্ঞান আসলো।জ্ঞান ফিরতে পাগলামি শুরু করে দিলো।সে এখানে কেনো।তার বাবার কাছে যাবে।তখনি ডক্টর এসে বলল।

–দেখুন আপনি অসুস্থ পাগলামি করবেন।আপনার ক্ষতি হয়ে যাবে।

–আমাকে এখানে কেনো আনা হয়েছে।আমি বাবার কাছে যাব।বলেই উঠলে লাগলে।একটা নার্স এসে অধরার হাতের স্যালাইন খুলে দিলো।তখন একটা মহিলা বলল।

–স্যালাইন টা খুলে নিলেন কেনো।মেয়েটার স্যালাইন টা দরকার ছিলো।

–সরি সরকারি জিনিস বাহিরে নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ।আপনি ওনাকে পরে আবার নিয়ে আসবেন।আমার আবার স্যালাইন করে দিব।এর মধ্যেই অধরা রাস্তার মধ্যে চলে গেছে।একট মহিলা দৌড়ে গিয়ে অধরাকে সরিয়ে নিয়ে আসলো।

বাসায় আসতেই অধরা তার বাবার মাথার কাছে গিয়ে কান্না করতে লাগলো।কান্না করছে আর পাগলের মতো বকেই যাচ্ছে।সবার চোখে পানি।এখন এদের কি বলে শান্তনা দিবে কারো মুখের কোনো ভাষা নেই।একদল মহিলা কোরআন পড়ছে।কয়েকজন কালেমা পড়ছে।মনিরা বেগম অবস্থা খারাপ।কয়েকবার বমিও করছে অতিরিক্ত চিৎকার করার জন্য।

একটু পরে আশরাফুল চৌধুরী,আহান,তিতির,তিতিরের স্বামী,মিসেস আফরোজা চৌধুরী,অধরার নানিও এসেছেন।আজ আর পারলেন না,মেয়ের ওপরে রাগ করে থাকতে।

অধরা তার বাবা পা জড়িয়ে ধরে কান্না করছে চিৎকার করে। সবাই বোঝাচ্ছে তবুও কাজ হচ্ছে না।একবার বাবা মাথার কাছে আসছে।আরেকবার পায়ের কাছে যাচ্ছে।তার একটাই কথা বাবা আমার কিছু চাই না।আমার কিছু লাগবে না।বাবা তুমি ফিরে এসো।অধরার এমন পাগলামি দেখে আহানের বুকে ভিষণ ভাবে ব্যাথা করতে শুরু করলো।কেনো এমন হচ্ছে সে নিজের জানে না।খুব কষ্ট লাগতে শুরু করলো।কালকের জন্য অনুশোচনা হতে লাগলো।কালে যদি অধরাকে আঁটকে না রাখতাম।আহানের ভাবনার মাঝে অধরার মা দৌড়ে এসে।অধরাকে মারতে শুরু করলো।অধরার চুল ধরে বলল।

–কালনাগিনী আমার স্বামী কে খেয়ে হয় নাই।তুই আর কাকে খাবি।কাকে খাওয়ার জন্য এখনো এখানে বসে আছিস।একদম আমার স্বামীর কাছে আসবি না।তুই মেয়ে নামের কলঙ্ক।সামান্য কয়টা টাকা জোগার করতে পারিস না বাবার জন্য।কাল যখন তোর বাবা মৃত্যু যন্তনাই ছটফট করছিলো।তখন তোর এই নাটক কই ছিলো। তোকে যখন পাগলের মতো ফোন করছিলাম।তখন তোর এই নাটকের কান্না কই ছিলো।তুই আর তোর ভাই আমার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যা।রুবিনা বেগমকে খুশির খবর টা দিয়ে দিস।সব থেকে বেশি খুশি উনি হবে।তুই আয় আমার সাথে।তোর মতো কুসন্তান কে কিছুতেই আমি আমার বাড়িতে রাখবো না।বলেই অধরার হাত ধরে টানতে টানতে সরিয়ে নিয়ে আসলো।অধরা কে ধাক্কা দিলো।অধরা পড়ে যেতে নিলে।আহান এসে অধরাকে ধরে নিজের সাথে মিলিয়ে নিলো।

চলবে…..