তৃ-তনয়া পর্ব-১৫+১৬+১৭

0
511

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১৫
(নূর নাফিসা)
.
.
নাজিয়ার কণ্ঠ শুনে রুমানা বেগম বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। আরাফ সালাম দিলো। তিনি নাজিয়া আরাফকে ঘরে যেতে বললেন। নাহিদাও আরাফকে দেখে সালাম দিলো। নাফিসার সাথে কথা না হওয়ায় আরাফ নাজিয়াকে বললো,
– নাজিয়া, তুমি না হয় থাকো এখানে। আমি চলে যাই। নাফিসা যেই রেগে আছে, তা শেষ হবে না মনে হচ্ছে।
– আমি থাকবো আর তুমি চলে যাবে!
– আমার তো কাল সকালে তাড়া আছে, আবার খাতা দেখা বাকি! এগুলো সম্পাদন করতে হবে না!
রুমানা বেগম বললো,
– আরাফ, তাহলে রাতে খেয়ে যাও। তুমি আসায় ভালো হয়েছে। তোমার সাথে কিছু কথাও আছে। তোমার বাবা নামাজ পড়ে আসুক, দেখা করে কথাবার্তা বলে যাও।
– আচ্ছা।
নাজিয়া বললো,
– আজান, পড়ে যাচ্ছে। মসজিদে যাবে? নাকি বাসায় জায়নামাজ দিবো?
– না, মসজিদেই যাবো।
– ওকে, যাও তাহলে।
আরাফ মসজিদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো। নাজিয়া নাহিদাকে বললো,
– নাহিদা তুই খেয়েছিস বাসায় ফিরে?
নাহিদা মলিন মুখে জবাব দিলো,
– হ্যাঁ, খেয়েছি।
– মা, তোমার এই মেয়ে দুইটা এমন কেন! আমাকে কি একটুও বুঝে না! তাদের মন ভালো করতে কি এখন পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবো!
– আপু!
– ডাকবি না আমাকে আপু বলে! খুব অভিমানী হয়ে গেছিস এক একজন! এতোটাই খারাপ আমি যে, আমার সাথে কথা বলতেও তোদের রুচিতে বাধা পাচ্ছে!
নাহিদা সাথে সাথেই নাজিয়ার গলা জড়িয়ে ধরলো। দুই বোনের চোখেই পানি! পাশে দাড়িয়ে আছেন রুমানা বেগম। মেয়েদের কর্মকান্ড দেখে কখনো খুব হাসি পায় আবার কখনো খুব রাগ হয়! তিনি চলে গেলেন কিচেনের দিকে। আরাফের জন্য একটু ভালো খাবারের আয়োজন করা দরকার। নাজিয়া নাহিদাকে ছাড়িয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বললো,
– যাও নামাজ পড় গিয়ে, আমি আসছি শিথিদের বাসা থেকে।
নাজিয়া বোরকা খুলে শিথিদের বাড়িতে চলে গেলো। ফুপুর সাথে দেখা হতেই সালাম দিয়ে কথা বললো। তার কণ্ঠ শুনা মাত্র শিথির রুমের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে! নাফিসার কথা জিজ্ঞেস করতেই ফুপু বললো শিথির সাথে তার রুমে বসে আছে। নাজিয়া দরজায় নক করলো কিন্তু দরজা খুলছে না। শিথির নাম ধরে ডাকতেই ভেতর থেকে উত্তর এলো,
– আপু, নাফিসা আমাকে ধরে রেখেছে। দরজা খুলতে দিচ্ছে না!
– নাফিসা, আপু দরজা খুলো। আমি কি চলে যাবো? আর কখনো কিন্তু আসবো না! নাফিসা! নাফিসা, তুমি এমন করলে যে ব’আপু টা খুব কষ্ট পায়! খুলবে না দরজা?
নাফিসা এবার শিথিকে ছেড়ে দিলো এবং শিথি এসে দরজা খুলে দিলো। নাজিয়া ভেতরে এলো। নাফিসা জানালার পাশে দাড়িয়ে আছে, গাল গড়িয়ে টুপটাপ পানি পড়ছে। দৃষ্টি তার মেঝের দিকে। নাজিয়া তার মুখটা ধরে উপরের দিকে তুলে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,
– সরি, কিউটিপাই! চেহারার একি অবস্থা করেছো! কান্না করে একেবারে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে! শিথি, দেখতো নাফিসাকে পুরো পেঁচার মতো দেখাচ্ছে না!
শিথি হাসলো আর নাফিসা গোমড়া মুখুই রয়ে গেছে! নাজিয়া আবার বললো,
– এই পচা মেয়ে! ব’আপু সরি বলেছি তো! আর কখনো মারবো না। একটু বকাও দিব না। এই যে কান ধরছি আমি।
নাজিয়া কানের কাছে হাত নিতেই নাফিসা টেনে নামিয়ে দিলো এবং কান্না করতে করতে গলা জড়িয়ে ধরলো। নাজিয়ার চোখে পানি থাকলেও মুখে ফুটে উঠেছে হাসি! কেননা তার বিশ্বাস ছিলো নাহিদার মতো নাফিসাও তাকে সামনে দেখলে বেশিক্ষণ রেগে থাকতে পারবে না। অবসান ঘটেছে নাফিসার ক্রোধের!
নামাজ পড়বে সেই তাড়া দিয়ে সে নাফিসাকে মানিয়ে নিয়ে এলো বাড়িতে।
আরাফ নিয়াজ উদ্দিনের সাথেই বাড়ি ফিরেছে নামাজ শেষে। আরাফের সামনেও যাচ্ছে না নাফিসা। আরাফ কিছু জিজ্ঞেস করলেও তার উত্তর দেয়নি। নাজিয়া লক্ষ্য করেছে বিষয়টি কিন্তু কিছু বললো না। কেননা এমনিতেই এক অভিমান ভেঙেছে, এখন আবার কিছু বললে উল্টো রিয়েকশন এটাক্ট করবে! নিয়াজ উদ্দিন জানালেন আগামীকাল জহিরুল ইসলামের বাড়িতে যাবেন বিয়ের তারিখ পাকা করার জন্য আর আরাফকে সাথে যেতে হবে। আরাফ জানালো দুপুরের পর হলে যেতে পারবে, তাছাড়া তার পক্ষে সম্ভব না। নিয়াজ উদ্দিন দুপুরের পরই যাবেন, তবুও আরাফকে নিয়ে যাবেন। নাহিদা আরাফকে খাবারদাবার এনে দিলো। সবসময়ই সে যথাসম্ভব আপ্যায়ন করে আরাফ ও অন্যান্যদের। কিন্তু নাফিসা কাছও ঘেঁষে না। তার মতে দোষ একজন করলেও ফল ভোগ করবে সবাই! আরাফ বিয়ে না করলে নাজিয়াকে এমন পরিবারে যেতে হতো না সেটা নাফিসার ধারণা। তাই আরাফকেও অতটা মর্যাদা দেয় না!
খাওয়া শেষে আরাফ বিদায় নিয়ে চলে গেলো। নাজিয়া থেকে গেলো।
পরদিন আরাফ ও নাফিসার বাবা-মা মেহেদীর বাসায় গিয়ে বিয়ের দিন পাকা করে এলো। আর তিনবোন মিলে বাসায় গল্পসল্প, দুষ্টুমি, রান্নাবান্না! নাজিয়া নুডলস রান্না করে খাওয়ালো। অত:পর রাতের জন্য বিরিয়ানি রান্না করলো। আরাফসহ বাবা মা সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলো। আরাফ নাফিসাকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– নাফিসার মন কি ভালো হয়েছে?
নাফিসা জবাব না দিয়ে এড়িয়ে চলে গেলো আর আরাফের মন রক্ষার্থে নাহিদা হাসিমুখে জবাব দিলো,
– হুম, হয়েছে। তাইতো আপনার জন্য বিরিয়ানি রান্না করলো।
– তাই নাকি! সম্পূর্ণ রান্না কি নাফিসা করেছে নাকি একটু নাড়াচাড়া করেই রাধুনি নাম করেছে!
নাহিদা হেসে উঠে বললো,
– হুম, নাড়াচাড়াতেই রাধুনি! সবার নাড়াচাড়াই পড়েছে শুধু আর বাকি কাজ আপুর।
নাজিয়া শুনছে ও দেখছে তাদের। লোকটা সবসময় সকলের সাথে সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করে যায়! নাফিসাটা ইগনোর করে চলে গেলো অথচ একটুও মন খারাপ করলো না! কে বলেছে সে অসুখী! সে তো সবচেয়ে বেশি সুখী যে আরাফের মতো এমন একটা মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে! তাকে নিয়ে কতটা ভাবতে পারলে এখানে ছুটে আসে বোনদের রাগ অভিমান ডিশমিশ করার জন্য! কতটা আপন ভাবলে বাবা ডাকা মাত্র কাজকর্ম চাপিয়ে রেখে বারবার এসে হাজির হয়। নিজের একেবারে আপন মানুষটা যদি পাশে থেকে সবসময় সঙ্গ দিয়ে যায় তাহলে আর কি লাগে সুখী হতে! আর কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই।
নাজিয়াকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে আরাফ নাহিদার হাতে আইস্ক্রীমের বাটিটা দিয়ে বললো,
– নাজিয়া, তুমি কিন্তু আবার এটাতে ভাগ নিও না!এটা নাহিদা আর নাফিসার জন্য। তোমারটা না হয় আমার কাছে পাওনা থাকুক আপাতত।
নাজিয়া মুচকি হেসে বললো,
– এখনই কি চলে যাবে? নাকি রাতে?
– কেন, তুমি চলে যাবে?
– হুম, নাহিদার বিয়েতে তো আবার আসবোই। তাই আজ চলে যাবো।
– ওকে, তাহলে রাতেই যাই।
রাতে জামাই শ্বশুর মিলে বিরিয়ানির স্বাদ উপভোগ করলো সাথে বিয়ের আয়োজন নিয়ে গল্পসল্প হলো। নাজিয়া নিজ হাতে নাফিসাকে আইস্ক্রীম খায়িয়ে দিয়েছে। নাহিদাকেও খায়িয়েছে আবার তাদের ইচ্ছাতে নিজেও খেয়েছে। অত:পর রাতে আরাফের সাথে বাড়ি ফিরে গেছে।
সকাল থেকেই দেখছে আয়েশা বেগন কেমন মুড অফ! তার সাথে কথা বলছে না। নাজিয়া কি রান্না করবে, চা করে দিবে কিনা এমন কিছু জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পাচ্ছে না। তিনি নিজে নিজের কাজকর্ম করে কিচেন ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। নাজিয়া বুঝতে পেরেছে তার সাথে কথা বলতে চাইছে না। নিজে বকাঝকা করেই এখন নিজেই কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়েছে। তাই সেও আর কিছু বলে বিরক্ত করলো না। ভাত বসিয়ে দিয়ে আলফাজ সাহেবকে চা দিতে গেলো। তখন আলফাজ সাহেব কড়া ভাবে বললেন, আয়েশা বেগম তাকে কোনো রকম বকাঝকা করলে বা কোনো কিছু নিয়ে খোটা দিলে যেন সাথে সাথেই আলফাজ সাহেবকে জানায়। এবার নাজিয়া বুঝতে পারলো তার শ্বশুর নিশ্চয়ই বকাঝকা করেছে আয়েশা বেগমকে তাই এমন হয়ে আছেন তিনি! আরাফকে গোসল সেড়ে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে নাজিয়াও সেখান থেকে তাদের ঘরে এলো। এসেই আরাফের দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,
– তুমি বাবাকে ওসব বলেছো কেন! যা হবার হয়েছে, এগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি করার কোনো প্রয়োজন ছিলো। এখন তো আমাকে আরও দোষী করে দিলে। আম্মা কি ভাববে না, আমি তোমার কাছে নালিশ করে বাবার কাছে বকা খায়িয়েছি!
আরাফ লোশনের কৌটা হাতে নিতে নিতে বললো,
– আমাকে শুধু শুধু দোষারোপ করো না। আমি কিছু জানাইনি বাবাকে। সেদিন তোমাকে নিয়ে তোমাদের বাসায় যাওয়ার পর রাতে আশিক জানিয়েছে। আর সেসব শুনে বাবা মাকে বকাঝকা করেছে। সাবধান করে দিয়েছে তোমার সাথে কিংবা তোমার পরিবারের সাথে যেন কোনো দুর্ব্যবহার না করে। যাইহোক, আমার মতে ভালো হয়েছে। তোমার স্বাধীনভাবে চলার সুযোগ হয়েছে। তাছাড়া এখন আমি বলছি, তুমি এসব নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করো না। যার যেভাবে ইচ্ছে চলতে দাও। অন্যথা যদি তোমার সমন্ধে কাউকে কটু কথা বলতে শোনো তাহলে এক কান দিয়ে প্রবেশ করলে অন্য কান দিয়ে বের করে দিবে। অপ্রিয় ঘটনা দ্বিতীয়বার মাথায় আনবেই না। মানবে তো?
– হুম।
নাজিয়া আবার কিচেনে চলে গেলো।

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১৬
(নূর নাফিসা)
.
.
ক্লাস আজ শুরু হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু স্টুডেন্ট কম হওয়ায় হলো না ক্লাস। নাহিদা একটা ফ্রেন্ডের সাথে টুকটাক কথা বলে ভবনের দিকে যাচ্ছিলো। হঠাৎ করেই আশিক হাজির। সমান তালে হাটতে হাটতে বললো,
– কেমন আছো?
নাহিদা হাসিমুখেই জবাব দিলো,
– আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?
– আমিও আলহামদুলিল্লাহ। আমি তো ভেবেছি সেদিনের ঘটনার পর আর আমার সাথে কথাই বলবে না!
– এমন কিছুর কোনো মানেই হয় না। আপনার কোনো দোষ ছিলো বলে আমার অজানা। বাদ দেন ওসব!
– ওকে, তোমাকে একটা নিউজ দেওয়ার ছিলো।
– জ্বি, বলুন।
– ছাদে যাবে একটু? গেইট খোলা আছে।
– ছাদে কেন!
– এমনি। কেন তোমার কোনো তাড়া আছে এখন?
– না, নাফিসার কাছে যাচ্ছিলাম। জানার জন্য, তার ক’টা ক্লাস আছে আজ।
– আচ্ছা, তাহলে পরে যাও। তার তো ক্লাস চলছে এখন।
– ওকে, চলুন।
তারা দুজনেই ছাদে এলো। নাহিদা অনেক দিন আগে এসেছিলো এখানে বন্ধুদের সাথে। ছেলেমেয়েরা এখানে এসে দুষ্টুমি করে বলে গেইট বন্ধ থাকে। আজ আবার পরিষ্কার দেখাচ্ছে ছাদ। হয়তো কোনো কাজ করেছিলো। পাশের ভবনের গেইট আবার সবসময় খোলা থাকে। নাহিদা আশিককে বললো,
– বলুন, কি যেন বলবেন।
– আমার চাকরি হয়েছে।
– তাই নাকি! কিসের চাকরি!
– গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে।
– যাক, ভালোই। বেতন কত?
– কমই, চৌদ্দ পনেরো হাজারের মতো। পরে পদোন্নতিতে বাড়বে।
– সময় কতক্ষণ?
– ফিক্সড কোনো টাইম নেই। ঘুরাঘুরির ব্যাপার। যখন ইচ্ছে তখনই যেতে পারবো। দিন শেষে লেবারের কাজকর্মের নোট জমা দিবো।
– তাহলে খারাপ কি! চৌদ্দ পনেরো কম কিসে! আমার মতে ভালোই।
– খুশি হয়েছো তুমি?
– চাকরি করবেন আপনি আর আমাকে বলছেন আমি খুশি হয়েছি কিনা!
– না, মানে নিউজটা শুনে খুশি হয়েছো কি-না?
– হুম, সেটা তো অবশ্যই।
– কফি খাবে?
– বেতন পেয়ে গেছেন নাকি!
– আরে নাহ।
– চাকরির শুরুতেই কফির অফার! আগে চাকরি করুন, বেতন পান। নিজে সচ্ছলতায় পদার্পণ করুন। তারপর, আমেজ।
– অনেক ভালো বুঝো এবং বুঝাতে পারো তুমি। এজন্যই খুব ভালো লাগে তোমায় আর এজন্যই একটু বেশি ভালোবাসি।
এতোক্ষণ হাসিমুখে কথা বললেও এখন নাহিদার মুখটা মলিন হয়ে গেছে! তা দেখে আশিক নাহিদার একটা হাত ধরে তার দু’হাতে মাঝে নিয়ে বললো,
– বারবার এভাবে ফিরিয়ে দিচ্ছো কেন? আমি কি দেখতে খারাপ?
নাহিদা ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– না।
– আমার যোগ্যতা কি তোমার চেয়ে অনেক কম?
– না।
– আমি তো কোনো খারাপ কাজের সাথেও জড়িত নেই৷ তাহলে আমাকে ইগনোর করো কেন! আমার পরিবারের জন্য? যদি আমার পরিবার তোমাকে মেনে নিতে না পারে তাহলে তোমাকে নিয়ে আমি আলাদাভাবে বসত গড়ে তুলবো। আর আমার বিশ্বাস, শুধু মা ই অমত পোষণ করতে পারে, এছাড়া সবাই মেনে নিবে। নাহিদা তুমি একবার হ্যাঁ, বলো। আমি তোমার বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠাবো৷ তুমি যতদিন অপেক্ষা করতে বলবে আমি ততদিন অপেক্ষা করবো। তবুও তুমি বলো, আমার জীবনে যুক্ত হবে। বলো প্লিজ!
– না।
আশিক রেগে গেছে এবার। সে আরও জোরে হাত চেপে ধরে বললো,
– সবসময় না কেন! আমি কোন দিক থেকে তোমার অযোগ্য বলো আমকে! কোনো দোষ তো দেখাতে পারছো না! শুধু এক বয়সের অযুহাত দিয়ে যাচ্ছো। সমবয়সী ছেলেমেয়েদের কি বিয়ে হয় না আর! সেখানে আমি তোমার থেকে বড়।
নাহিদা হাত ঝাটকা দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে আংটি পড়ানো আঙুলটা আশিকের চোখের সামনে তুলে ধরে বললো,
– দেখতে পারছেন এটা? বুঝতে পারছেন কিছু? আমি এনগেজড। আরও দেড় মাস আগে থেকে আমি এনগেজড। বিয়ের দিনও পাকা হয়ে গেছে আমার। আজ বা কালের মধ্যে বাবা আপনাদের বাসায় যাবে বিয়ের দাওয়াত করতে। ভাইয়া আপুর কাছে কি বাসায় কিছুই শুনেননি এতোদিনে? আমি তো ভাবতাম আপনি জানতেন তাই আর গত দিন গুলোতে তেমন পাগলামো করেন নি। কিন্তু সেদিন রাতে মেসেজ দেখে বুঝতে পারলাম আপনি হয়তো কিছুই জানেন নি। আপনাকে আমি আরও আগেই বুঝিয়েছিলাম সংসার এমনিতেই হয় না। নিজেদের বুঝ অবুঝের ব্যাপার আছে। যেটা বয়সের কারণে মানুষ পরিপূর্ণ প্রাপ্তি লাভ করতে পারে না। মেয়েরা অল্প বয়সে যেটা বুঝার ক্ষমতা রাখে ছেলেদের তুলনামূলক অধিক সময়ের প্রয়োজন সেই বুঝটা ধারণ করতে। বয়সের ডিফারেন্সে দুজনের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো থাকে। আর সেজন্যই বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের বয়সের পার্থক্য পাচ থেকে সাত বছরটা পারফেক্ট ধরে নেওয়া হয়। আর সেজন্যই আমি বয়সের অযুহাত দিয়ে এসেছি এতোদিন।
রিংটা দেখার পর ভেতরটা মুচড়ে গেছে! আশিক খুব শান্ত গলায় বললো,
– রিং কি আমার প্রপোজালের আগে পড়ানো হয়েছিলো?
– না।
– এই রিংয়ের মালিক কি পূর্ব পরিচিত?
– না।
– এতো সহজেই অচেনা লোকের হাতে রিং পড়ে নিলে!
– কেননা, আমার বাবামায়ের পছন্দ। বাবা চেয়েছে বিয়ে দিবে, আমিও রাজি হয়ে গিয়েছি।
আশিক অন্যদিকে ফিরে এক ব্যর্থতার নিশ্বাস ছাড়লো। নাহিদা এবার একটু নরম সুরে বললো,
– আপনার জন্য আমি যোগ্য ছিলাম না। এজন্যই এই অবস্থানে আমি। তাছাড়া যে আপনার জন্য যোগ্য তার অবস্থান হয়তো এখন হাই স্কুল বা ইন্টারমিডিয়েট লেভেলে আছে। আমি নিসন্দেহে বলতে পারি আপনি একজন ভালো মানুষ, ভালো চরিত্রের অধিকারী, মনটা খুবই সহজ সরল। আমি বিনা দ্বিধায় স্বীকার করি প্রেমিক হিসেবে আপনি শ্রেষ্ঠ। যে আপনাকে ভাগ্য করে পাবে সে দীপ্তিময় সুখ হাতের মুঠোয় পাবে। এজ এ ফ্রেন্ড, আমার একটা কথা মানবেন?
– নিচে যাও।
– আগে শুনুন, আপনার মনে গড়া স্বপ্নগুলোর জন্যও আমি দায়ী ছিলাম না। এমনকি আজ মন ভেঙে গেলেও সেখানে আমি দায়ী না। বন্ধুত্বের খাতিরে একটা অনুরোধ, কোনো কারণে নিজেকে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না কখনো। আল্লাহ খুব যত্ন করে আপনাকে আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আবেগের বশে সেই সৃষ্টিকে ধ্বংস করে দিবেন না কখনো। সৃষ্টি কর্তা খুশি হবে এমন কাজেই জড়িত থাকুন। ইনশাআল্লাহ, খুব ভালো কাউকে উপহার স্বরূপ পেয়ে যাবেন।
– নিচে যেতে বলেছি।
– আপনি এখানে দাড়িয়ে আছেন কেন?
আশিক নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে সাথে সাথেই কঠিন দৃষ্টি সরিয়ে তার আগেই পা চালালো। এই দৃষ্টিটা খুব খারাপ লাগলো নাহিদার কাছে। তবুও কিছু করার নেই, তার সাথে যে সম্পর্কটা বেমানান হয়ে যায় সেটা অনেক আগেই বুঝিয়েছিলো আশিককে। নাহিদাও এক দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে আশিকের পিছু পিছু নেমে এলো।
নাফিসা মাত্রই ক্লাস থেকে বেরিয়েছে। আশিকের সাথে নাহিদাকে সিড়ি দিয়ে নামতে দেখে সে এগিয়ে এসে বললো,
– এই লোকের সাথে কি করো! এদের সাথে কোনো কথাবার্তা নেই। কোনো নোট ও দিতে যাবে না কখনো। প্রয়োজন হলে যেন আমাদের পরিবার ছেড়ে অন্য কাউকে দেখে।
– নাফিসা! কি বলছিস এসব! চুপ থাক!
– অনেক থেকেছি চুপ। আর না। চুপ থেকে থেকেই আজ ত্যাজ্য হতে চলেছি। তুমি ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি কিছু।
আশিক তার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না। সে দ্রুত পায়ে হেটে চলে গেলো তার পথে। আর এদিকে নাহিদা নাফিসাকে চোখ রাঙিয়ে চুপ করতে বললো এবং তাদের গন্তব্যে যেতে লাগলো।
বিকেলে নিয়াজ উদ্দিন সাহেব একা নাজিয়াদের বাড়িতে গেল নাহিদার বিয়ের দাওয়াত দিতে। রুমানা যায়নি সাথে কেননা আয়েশা বেগম বিয়ের পর কখনো তাদের বাড়িতে আসেনি, তাই তিনিও যান না মেয়ের শ্বশুর বাড়ি। এদিকে মেহেদির বোন মেহেতাজ নাহিদা নাফিসাকে শপিং করার জন্য তাদের সাথে যেতে বলল। নাহিদা যেতে চাইনি তবুও মেহেতাজ জোর করলো যার ফলে যেতেই হলো। মেহেদীর বাড়ি থেকে শুধুমাত্র মেহেদী ও মেহেতাজ এসেছে মেহেদী ড্রাইভ করছে পাশে বসানো হয়েছে নাহিদাকে আর মেহেতাজ ও নাফিসা পেছনের সিটে বসেছে। সাথে দু বছরের আরিশা আছে। পেছনে বসে দুইজন গল্পেরঝুরি খুলে বসেছে আর এদিকে সামনে বসে নাহিদার খুব বোরিং লাগছে। না পারছে তাদের সাথে আড্ডা দিতে আর না পারছে মেহেদির পাশে বসে থাকার অস্বস্তি দূর করতে। তাই সে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে আনমনে বাইরে তাকিয়ে আছে আর মেহেদী একমনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। মেহতাজ বললো,
– তোমাদের এমন নিরবতার কারণ কি! আমরা আছি বলে লজ্জা পাচ্ছো! বেশি না, আর কিছুদিন অপেক্ষা কর। আমরা আর বসে নেই তোমাদের লজ্জা দিতে। আপাতত আমাদের সাথেই যুক্ত হয়েই নিরবতা ভেঙে ফেলো। কি বলো নাফিসা?
– হুম।
নাফিসা খিলখিল শব্দ করে হেসে উঠলো। নাহিদা লজ্জা পেলো তার কথায় আর মেহেদীর কোনো রিয়েকশন নেই। কিছুটা সময়ের মধ্যেই আরিশা নাফিসার সাথে ভালো ভাব জমিয়ে ফেলেছে। খেলায় মেতে উঠেছে তারা। শপিং যত তারাতাড়ি সম্ভব, সম্পাদন করে নিলো। রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে বিকেলে তারা বাড়ি ফিরে এলো। নাহিদা নাফিসাকে তাদের বাসায় রেখে তারা চলে গেলো। নাহিদার সাথে মেহেদীর তেমন কোনো কথা হয়নি। শুধু রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার করার সময় জিজ্ঞেস করেছিলো “কি খাবে”!
বাকিদের ধারণা তাদের সামনে কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে, কিন্তু নাহিদা অবাক হয়েছে। কেননা সে যেই মেহেদীকে চিনে সে চুপচাপ থাকার লোক না! তাহলে মেহেদী এতটা নীরব কেন!
দুদিন পর নাহিদা ভার্সিটি এসেছে ক্লাসও করবে, তার ফ্রেন্ডদেরও দাওয়াত করবে। ক্লাসে প্রবেশ করার সময় আশিকের সাথে দেখা হলে জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন আছেন, ভাইয়া?
আশিক কোনো জবাব না দিয়ে তাকে এড়িয়ে চলে গেলো। নাহিদা বুঝতে পেরেছে সে তাকে ইগনোর করছে। তার কাছে সেটা স্বাভাবিক মনে হলো। কেননা, ইগনোর করলেও এখন সবার জন্য সেটাই শ্রেয়। ক্লাসে মন বসলো না তার, ঘুরেফিরে সেই আশিককেই মনে পড়ছে! একটু পরপর দৃষ্টি তাকেই খুজছে! সে তখন এসেছিলো কিন্তু এখন ক্লাসে নেই কেন! নাহিদার মনে হচ্ছে আশিক তার জন্যই ক্লাসে আসেনি! চাইছে আশিকের ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে কিন্তু পারছে না! এসবের কারণ কি! সে কি তার ইগনোর করা মেনে নিতে পারছে না! না, মানতে হবে। এটা হতেই পারে! আহামরি কিছু না।
নিজেকে নিজেই বুঝ দিচ্ছে আবার নিজেই ভাবতে শুরু করেছে! অবশেষে বাকি ক্লাস না করেই নাফিসাকে রেখে চলে এসেছে বাসায়। কেননা তার মনযোগ হারিয়ে গেছে ক্লাস থেকে। বাসায় এসে নিজেকে অন্যান্য কাজে ব্যস্ত রাখছে আশিকের কর্মকাণ্ড ভুলতে। কাজে কাজে সেটার সফলতাও অর্জন করে ফেলেছে।

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১৭
(নূর নাফিসা)
.
.
কচ্ছপ গতিতে প্রহর কাটলেও বিয়ে বাড়ির লোকজন কাজে ব্যস্ত থাকায় মনে হয়েছে যেন অশ্ব গতিতে সময় পাড় হয়ে গেছে! দেখতে দেখতে চলে এসেছে বিয়ের দিন। দুদিন আগে থেকেই মানুষের আনাগোনা। নানা বাড়ির লোকজনসহ নাজিয়াও এসেছে দুদিন আগেই। এই প্রথম তার বাবার বাড়িতে বেশি সময় কাটানোর সুযোগ হলো। অন্যান্য দিন কেউ নিষেধ না করলেও পরিস্থিতির স্বীকারে তাকে অল্প সময় বাবামায়ের সাথে কাটিয়ে চলে যেতে হতো।
গায়ে হলুদের দিন সকালে নাস্তার পর আরাফ নাফিসাকে বললো,
– নাফিসা, লগনের সব আসবাব ঠিক করে রেখেছো? নাকি কিছুর টান আছে?
নাফিসা তার সাথে আগে থেকেই কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে তাই কোনো উত্তর না দিয়ে এখানেও ইগনোর করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো ঘর থেকে। যেটা নিয়াজ উদ্দিনের চোখে পড়ে গেছে! তিনি পেছন থেকে নাফিসাকে ডাকলেন। নাফিসাও খেয়াল করেনি অন্য রুম থেকে তার বাবা এই রুমে আসছে! সে তার বাবার কাছে এসে বললো,
– জ্বি বাবা?
– আরাফ কিছু বলেছে, তুমি শুনতে পাওনি? নাকি শুনেও না শোনার ভান করে চলে যাচ্ছো!
– শুনতে চাইছি না কিছু। সব কিছু ঠিকঠাকই আছে বাবা।
– আমি তোমাকে এমন কিছু জিজ্ঞেস করিনি। আরাফ জিজ্ঞেস করেছে। তুমি এমন ধাচের কথা বললে কেন? আরাফের সাথে এমন ব্যবহারই বা কেন করলে?
– বাবা, আমি কেমন ব্যবহার করলাম!
– তুমি তার কথা এড়িয়ে গেলে কেন? গতকালও দেখেছি নাহিদা আরাফকে খাবার এনে দিতে বলেছিলো আর তুমি সরাসরি নিষেধ করে দিয়েছো! তোমার মা বলেছে আমাকে, সেদিনও আরাফ ভালোমন্দ কিছু বললে তুমি কোনো জবাব দাওনি! এসব কি! কেমন ব্যবহার এগুলো!
– বাবা, উনারা এমন ব্যবহারই প্রাপ্য!
নাফিসা নিচু স্বরে বললো কথাটা কিন্তু নিয়াজ উদ্দিন ধমকে উঠলেন,
– আবার এমন কথা বলে বেয়াদব মেয়ে! ও তোমার বড় ভাই হয়। আর বড় ভাইয়ের সাথে কেমন আচরণ করা প্রয়োজন সেটা তুমি জানো না! ক্ষমা চাও আরাফের কাছে।
ধমকের সুর উচ্চ না হলেও তার বাবার দৃষ্টিতেই নাফিসা ভয় পেয়ে গেছে! সাথে সাথেই চোখ জলে টইটম্বুর! আরাফের কাছে ক্ষমা চাইতে বলায় নাফিসা একবার তার বাবার দিকে তাকাচ্ছে আবার আরাফের দিকে তাকাচ্ছে। আরাফ বুঝতে পারছে তিনি রেগে গেছেন। তাই সে থামানোর চেষ্টা করতে বললো,
– বাবা, থাক না। ও ছোট, বুঝে আর না বুঝে একটু রেগে আছে আমার উপর। এমন হতেই পারে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
– না, থাকবে কেন! এখনো কি বুঝার বয়স হয়নি! ভার্সিটিতে যাত্রা শুরু করে দিয়েছে আর কবে বুঝবে! কি হলো! এভাবে দাড়িয়ে আছো কেন! ক্ষমা চাও! কানে যাচ্ছে না কথা!
নাফিসার শরীর কাপিয়ে কান্না আসছে! মাথা নত করে রেখেছে সে। চোখ থেকে টুপটাপ পানি পড়ছে। বাবার রাগ দেখে মন চাইছে না তবুও মুখে অনেক কষ্টে উচ্চারিত হলো, “সরি, ভাইয়া।”
আরাফ কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। তারও কোনো ইচ্ছে ছিলো না নাফিসার মনটা এখন এভাবে খারাপ করার। সে তার আচরণ স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতো। কিন্তু নিয়াজ উদ্দিনের কথার উপর তো কথা বলতে পারবে না সে! নাফিসা আরাফকে সরি বলার পর এখানে দাড়িয়েই মাথা নিচু করে ফুপিয়ে কাদছে! নিয়াজ উদ্দিন বললেন,
– এর পর যেন কখনো কারো সাথে দুর্ব্যবহার করতে না দেখি। আর এটাও ভুলে যেও না, আরাফ তোমার বড় ভাই। নাজিয়ার আগে তাকে বড় ভাইয়ের মর্যাদা দিবে। আরাফসহ মেহমানদের যত্নাদিতেও যেন কোনো ত্রুটি না থাকে। লোকজন সারাজীবন তোমার বাড়িতে থাকতে আসবে না। যে কোন প্রয়োজনে আরাফকে জানাবে, মনে থাকে যেন। যাও।
নাফিসা যাওয়ার অনুমতি পেয়ে মুখ চেপে ধরে দৌড়ে তার মায়ের রুমে চলে এলো। দরজাটা ধপাস করে লাগিয়ে দিলো। খুব কান্না আসছে তার কিন্তু বাড়িতে মেহমান আছে কয়েকজন তাই প্রাণ ভরে কাদতেও পারছে না। মুখ চেপেই কান্না করে যাচ্ছে। এদিকে নিয়াজ উদ্দিন আরাফকে বললো, নাফিসাকে এমন আচরণ করার সুযোগ যেন দ্বিতীয়বার না দেয়। নাফিসা উল্টাপাল্টা কিছু বললে যেন উনাকে জানায়। নিয়াজ উদ্দিন বেরিয়ে গেলে আরাফ দ্রুত কিচেনের পাশে এলো। বাইরে থেকে নাজিয়াকে ডাকলে নাজিয়া তার কাছে এসে বললো,
– কি?
– নাফিসার কাছে যাও একটু। বাবা একটু বকাঝকা করেছে তাকে, কান্না করছে বোধহয়।
– বাবা বকাঝকা করেছে! কেন?
– আরে আমারই ভুল হয়েছে। মনে ছিলো না সে যে আমার উপর রেগে আছে! আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম লগনের সব আসবাব ঠিক আছে কিনা, সে কোনো জবাব দেয়নি। সেটা বাবা লক্ষ্য করেছে, তাই এমন ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইতে বলেছে।
– তাহলে তো ঠিকই হয়েছে। একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে নাফিসা।
– এখন কি তুমিও বাড়াবাড়ি বলে চুপচাপ বসে থাকবে, নাকি যাবে তার কাছে!
নাজিয়া পাশে থাকা ড্রাম থেকে পানি নিয়ে হাত ধুতে ধুতে ব্যঙ্গ করে বললো,
– ইশ! দরদ কতো! উনার সাথে রূঢ় ব্যবহার করে অথচ উনারই দরদ উতলে পড়ে!
– হবে না! ছোট ভাইবোনের জন্য মায়া একটু বেশিই হয়৷ তুমিই কি কম রিয়েক্ট করো ছোটদের নিয়ে! তাছাড়া, বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান, সেখানে কান্নাকাটি করে একজন মুড অফ থাকবে সেটা কেমন দেখায়! কারো ভালো লাগবে সেটা!
– হয়েছে, যাচ্ছি আমি। তাছাড়া বাবা এমন মুড অফ থাকতেও দিবে না। এখন বকেছে তো কি হয়েছে, একটু পরেই দেখো মন ভালো করে দিয়েছে।
নাজিয়া নাফিসার কাছে এলো। প্রথমে দরজা খুলেনি, কিন্তু কয়েকবার ডাকার পর খুলে দিয়েছে। নাজিয়া ভেতরে আসতেই তাকে ধরে কান্না করতে লাগলো।
– নাফিসা! কি শুরু করেছিস এসব! বাসায় মেহমান আছে।
– আপু, বাবা আমাকে বকেছে কেন! আমার খুব কান্না পাচ্ছে! আমি কাদতেও পারছি না!
এই বলে নাফিসা হুহু করে কেদে উঠলো! নাজিয়া তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– আরে, এ কি শুরু করেছে পিচ্চিটা! চুপ। একদম কাদবি না। বেশ করেছে বাবা বকেছে। মাকে বললে তো মাইর লাগাতো! তুই এমন কেন করছিস তোর ভাইয়ার সাথে! দোষটা কি তার!
– তোমাকে বিয়ে করেছে সেটাই তো সবচেয়ে বড় দোষ! চোখের সামনে দেখছি তোমার দিনকাল কেমন কাটছে! দজ্জাল একটা শ্বাশুড়ি পড়েছে তোমার কপালে! উঠতে খোটা বসতে খোটা! সেদিনও শুনলে না কি বললো আমাদের পরিবার নিয়ে!
– চুপ! আস্তে! সেজন্য তোর ভাইয়ার সাথে এমন করবি! পরিবারে দুএকজন এমন থাকেই। তাই বলে কি কেউ সংসার ত্যাগ করে! এখানে তো তোর ভাইয়ার কোনো দোষ নেই। তাকে কি কখনো দেখেছিস আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে! এই বোকা মেয়ে, আমাকে নিয়ে এতো ভাবছিস কেন! আমি ভালো আছি, সুখেই আছি। শ্বাশুড়ি যেমন তেমন হোক, স্বামী ঠিক থাকলেই সেই মেয়ে সুখী। পৃথিবীতে বড় ভাগ্যবতী। তোর ভাইয়া আমার কাছে সবসময়ই ঠিক আছে। সে সবসময় আমার সাপোর্টার হয়ে, আমাকে ভালো রাখার চেষ্টা করে। আমি বেশ ভালো আছি তার কাছে। তুই ই দেখ না, ও কতটা ভালো ও ধৈর্যশীল ব্যক্তি! কতভাবে তুই ইগনোর করেছিস অথচ কিছু বলেছে তোকে আজ পর্যন্ত? একটুও মন খারাপ করেনি সে, এমনকি আমাকে বলেওনি কখনো যে, “তোমার বোনটা এমন কেন!” বরং আমার খুব রাগ হয় তোর উপর। লোকটা এতো কিছু করে আমাদের পরিবারের জন্য তবুও তুই এমন করছিস তার সাথে! দেখেছিস, বাবা যখন ডাকে তখনই চলে আসে। যখন আমি একটু কান্না করি বা মন খারাপ করি এ পরিবারের জন্য, তখনই আমাকে কিছু সময়ের জন্য হলেও বেড়াতে নিয়ে আসে। বাবা সঠিক লোকটাকেই পছন্দ করেছে আমার জন্য। নাফিসা, এভাবে কাউকে কষ্ট দেওয়া ঠিক না। ও কিছু প্রকাশ না করলেই কি, তোর আচরণে মনে ঠিকই কষ্ট পায়। দেখতো, নাহিদা কতো কেয়ার করে আর তোর কাছে সে একটু ভালো কথাও পায় না! ভালো ব্যবহারটা সবাই প্রত্যাশা করে নাফিসা। তুই ও করেছিস আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে। কিন্তু সেটা যথাযথ না পেয়ে তোর কত অভিমান। এখন আরাফও তো পাচ্ছে না তোর কাছে, তাহলে সে কি পারতো না অভিমান নিয়ে দূরে থাকতে, আমাকে সবসময় বাড়িতে আটকে রাখতে!
নাফিসা মনযোগ দিয়েই শুনছিলো তার কথা। নাজিয়া চোখে পানি মুছে দিয়ে বললো,
– আমি জানি, আমার কলিজা দুইটা খুব ভালো বুঝে। কাউকে কষ্ট দেয় না কখনো। পরবর্তীতেও দিবে না সেটাও আমার বিশ্বাস। আরাফ বাবার কাছে ছেলের মর্যাদা পেয়েছে বিধায় খুব আনন্দিত। তুই একটু ফ্রী হয়ে যা, দেখবি তোর ভাইয়া আরও আনন্দিত হবে। তার ছোট ছোট বোন গুলো তাকে ভাইয়া বলে মানবে, পরামর্শ চাইবে। ছোটখাটো আবদার রাখবে। বোনেরা সবসময় হাসিখুশি থাকবে। একজন ভাইয়ের আর কি চাওয়ার থাকে, তুই বল! মানবি না আমার কথা?
নাফিসা মাথা নেড়ে হ্যাঁ জবাব দিলো। নাজিয়া মুচকি হেসে তার মাথায় চুমু দিয়ে বললো,
– যা এবার, কান্না করে বিয়ে বাড়িতে বন্যা সৃষ্টি করেছিস! নাহিদা তোকে আস্ত রাখবে না। গোসল হয়ে গেছে বোধহয়। পার্লারে যাবে তোকে নিয়ে।
নাফিসা চোখমুখ ভালোভাবে মুছে নাজিয়ার সাথে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। নিয়াজ উদ্দিন বাড়িতে এসেছেন। নাফিসাকে দেখে পকেট থেকে পাচটি সেন্টারফ্রুট বের করে নাজিয়ার দিকে ধরে বললো,
– নাজিয়া, রাখো এগুলো। বাচ্চারা কান্না করলে দিয়ে দিও।
নাফিসা ব্রু কুচকে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে খপ করে হাত থেকে সবগুলো নিয়ে বললো,
– হুহ্! ঢং! বাচ্চারা কান্না করলে দিবে আর আমি বসে বসে দেখবো! যেন আমার দাত নেই! জেনে রাখা দরকার, বাচ্চাদের এগুলো দিলে গিলে ফেলবে।
আরাফ বাসায় আনা বাজার দেখছিলো। নাফিসা কথা বলতে বলতে আরাফের কাছে এসে একটা সেন্টারফ্রুট ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– ভাইয়া সরি। আর সেন্টারফ্রুট খেতে না জানলে রেখে দিন। নাফিসা আছে খাওয়ার জন্য।
আরাফ অবাকও হলো আবার মুচকি হাসলোও! নাফিসার ফ্রেশ মাইন্ড দেখে অত:পর বললো,
– রাখারাখি নেই! দাত আমারও আছে।
কথাটা বলে সে প্যাকেট ছিড়ে মুখে দিয়ে ফেললো। নাজিয়া মুচকি হাসলো তাদের কান্ড দেখে। নিয়াজ উদ্দিনও মেয়ের মন ভালো দেখে মৃদু হেসে আবার কাজকর্ম দেখতে চলে গেলেন। নাফিসা আবার নাজিয়াকে একটা দিলো। ঘর থেকে নাহিদা দেখে ডাকাডাকি শুরু করে দিলো তাকে একটা দেওয়ার জন্য! তা দেখে নাফিসার নানান উক্তি! “নাহিদা হুলোবেড়াল! একটু পর তার বিয়ের লগন আর সে এখন সেন্টারফ্রুট চায়! লজ্জা করে না ছোট বোনের কাছে দুই টাকা দামের সেন্টারফ্রুট চাইতে!”
এতো উক্তি শুনে নাহিদা তাকে ধরে জোরপূর্বক সেন্টারফ্রুট নিয়েই ছাড়লো। অবশ্য নাফিসাই সেক্রিফাইস করেছে, তা না হলে একটু পারতো না তার সাথে!
সুষ্ঠুভাবে কেটে গেছে লগন। আরাফের বাড়ি থেকে আশিক ও তার মা বাদে বাকিরা উপস্থিত হয়েছে বিয়েতে। ঘরে ছেলে সন্তান না থাকায় আরাফকেই ছেলে বলে গ্রহণ করেছে নিয়াজ উদ্দিন। আরাফও কোনো দিকে ছেলের চেয়ে কম করে না এ পরিবারের জন্য। নাহিদার বিয়ের সব আয়োজন নিজ দায়িত্বে সম্পাদন করেছে আরাফ। কেননা শ্বশুর বাড়িতে ছেলের মর্যাদা পেয়েছে। যে কোনো বিষয়ে নিয়াজ উদ্দিন আরাফের পরামর্শ নিয়ে কাজ করে। বিয়ের পর আজ থেকে হয়তো মেহেদীও ছেলের মর্যাদা পেতে শুরু করবে। সেটা নিয়াজ উদ্দিনের বিশ্বাস।
.
পুষ্পে পুষ্পিত কক্ষ চারিধার। যেন কক্ষ নয়, এক পুষ্পিত কানন! সুবাসে সুবাসিত কক্ষে অন্তর্ভুক্ত বায়ুমন্ডল। সুবাসিত বায়ু অক্সিজেনের সাথে মিশ্রিত হয়ে গৃহীত হচ্ছে শ্বাসে আবার কার্বন ডাই অক্সাইড হয়ে ত্যাজ্য হচ্ছে প্রশ্বাসে! পুষ্প সুবাসে আচ্ছাদিত হয়ে কাননের মাঝামাঝিতে বসে আছে সুবাসিনী। অঙ্গে তার লাল বেনারসি, মনে তার আঁকাবাঁকা তরঙ্গ! লাল দোপাট্টা মাথায়, দেহ ঢাকা সোনার গহনায়। প্রকৃত রূপকে ঢেকে রেখে তার রূপে ফুটে উঠেছে এক কৃত্রিম সৌন্দর্য! বাইরে হৈ-হুল্লোড়, অন্দরে নীরবতা। ঘনীভূত হয়েছে নিশি, তা দূরীভূত করতে হয়তো জেগেছে বিশাল আকাশে এক টুকরো শশী। কাটছে না, কাটছে না তবুও কেটে যাচ্ছে প্রহর! রাজ্য আছে রানী আছে অপেক্ষা শুধু কানন রাজার!

চলবে।