তৃ-তনয়া পর্ব-১৮+১৯+২০

0
473

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১৮
(নূর নাফিসা)
.
.
অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একসময় আগমন ঘটলো কানন রাজার। রানী এক পলক তাকালো রাজার দিকে। অনেক কিছুই বুঝতে চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না! রাজার মুখখানা এমন গম্ভীর কেন! চোখ জোড়াও কেমন যেন লাল হয়ে আছে!
নাহিদা বিছানা ছেড়ে নেমে দাড়ালো। মেহেদী দরজা লক করে এগিয়ে এলো তার দিকে। দৃষ্টি যেন তার নিভু নিভু! ঝাপসা চোখে দেখছে লাল টুকটুকে পরীকে। একটা হাত বাড়িয়ে নাহিদার মুখখানা চেপে ধরে মাতাল কণ্ঠে বললো,
– কোন পাগলে ধরেছিলো আমাকে, যে তোকেই সেদিন নিয়ে যেতে হলো ভার্সিটি থেকে! একটা ভিখারিনী বোবা মেয়েকে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন ছিলো, আমার কাজ হাসিল করার জন্য! লাইফটার মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিস তুই! না তোকে দেখতো আমার আব্বু আম্মু, আর না আজ আমাকে বিয়ে করতে হতো!
মেহেদী কথা বলার সাথে সাথে পুষ্পরেণুর সুভাসকে হার মানিয়ে ভেসে এলো বিশ্রী সুবাস! যেটা নাহিদার কাছে অসহ্যকর! সে মেহেদীকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পিছিয়ে গেলো এবং বললো,
– এসব কি! এমন করছেন কেন আপনি! এমন বিশ্রী গন্ধ কেন আপনার সাথে! আপনি কি মদ্যপান করে এসেছেন?
নাহিদার ধাক্কায় মেহেদী পড়ে যেতে নিয়েও হেলেদুলে সোজা হয়ে দাড়ালো। এতোক্ষণ ঠিকঠাক ভাবে হেটে এলেও আস্তে আস্তে তার দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। সে নিজ মুখে আঙুল দিয়ে নাহিদাকে চুপ থাকতে ইশারা করে ফিসফিস করে বললো,
– হুশশশ! আস্তে বলো। এ কথা যেন বাইরে না যায়। আব্বু আম্মু জানতে পারলে গলা কেটে দিবো তোমার! মাইন্ড ইট! হোয়াটএভার, থ্যাংক ইউ সো মাচ। বিয়ের জন্য ত্রিশ হাজার টাকা পেয়েছি আমি। আজকে একটুখানি, এইটুকু ছোট্টো একটা পার্টি করে এলাম, আগামীকাল ফুড়ুৎ করে উড়াল দিবো টেকনাফ টু তেতুলিয়া।
মেহেদী নাহিদার কাছে এগিয়ে এসে গলার নেকলেস স্পর্শ করে বললো,
– এই, এগুলো কি অরিজিনাল গোল্ড? অনেক টাকা হবে না বিক্রি করলে?
নাহিদা তার হাত ঝাটকা দিয়ে সরিয়ে দিলো। এ কি দেখছে সে আর এ কি শুনছে! আদৌ কি এগুলো সত্য ঘটছে তার সাথে, নাকি স্বপ্ন! এটা কিভাবে সম্ভব! শেষ পর্যন্ত একটা মাতাল জুটলো তার ভাগ্যে! মেহেদী শেরওয়ানীর টপার বোতামটা খুলতে খুলতে বললো,
– এনি ওয়ে, তোমার জিনিসের প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই আমার। বউ আছো বউয়ের মতোই থাকবে। গার্ল ফ্রেন্ড হতে এসো না আবার। আমার সাথে বাড়াবাড়ি করতে আসবে ধাক্কা মেরে ছাদ থেকে ফেলে দিবো। মাইন্ড ইট।
এসব পাগলের প্রলাপ শুনতে একটুও ভালো লাগছে না নাহিদার! জীবনটা স্বাপ্নিক মনে হচ্ছে শুধু। এসব হয়তো স্বপ্নে ধরা দিচ্ছে তার সামনে!
মেহেদী তার ভাবনা কাটিয়ে বিছানার দিকে যেতে যেতে আবার বললো,
– এই মেয়ে, শোনো। আমার বিছানায় ঘুমাতে পারবে না। এই যে দেখো। এই বিছানায় আমি থাকবো আর এই পাশেরটায় তুমি থাকবে। ক্লিয়ার? আব্বু আম্মুর কানে যেন না যায় এসব। তাহলে রাতে ভুত হয়ে গলা টিপে মেরে দিবো।
নাহিদা তার আঙ্গুলের ইশারায় খাটের দিকে তাকালো। ডানে বামে আঙুল নাড়িয়ে এক বিছানাকেই মাতাল মেহেদী দুইটা দেখাচ্ছে। কথা বলার পর বেল্ট না খুলেই পা নাড়িয়েছে জুতা খুলার জন্য। না পেরে জুতাসহই ধপাস করে বালিশে শুয়ে পড়লো। হাত বাড়িয়ে মোটা চাদরটাও টান দিলো। মাত্র এক কোনা এটেছে তার দেহে! বাকিটা ভাজের ভাজই রয়ে গেছে!
নাহিদা ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়লো। স্তব্ধ তার প্রান, আর নিস্তেজ দেহ! কপালে লিখন কি আর বদলাতে পারবে কেহ! কেউ স্বপ্ন দেখেছিলো তাকে নিয়ে লাখো স্বপ্নের নৌকায় করে ভেসে যাবে সীমান্ত ছাড়িয়ে অফুরন্ত চলমান স্রোতে! কিন্তু সে করেছিলো তাকে হেলা, বিশ্বাস ছিলো ভাগ্যের পরিহাস হয়তো মিলিয়ে দিবে যোগ্য পথিক। যে কিনা স্বপ্ন বাস্তব করতে জানবে। দিনে দিনে ক্ষণে ক্ষণে জীবনের মুহুর্তগুলোকে রাঙিয়ে দিতে জানবে! ডানাকাটা পরী বানিয়ে তাকে ভুবনে কদম ফেলে উড়তে শেখাবে! ভালোবেসে, ভালোবেসে, ভালোবাসায় পূর্ণ করে দিবে তার ক্ষুদ্র ভুবন!
কিন্তু তার পরিবর্তে কি হলো আজ! এমন অনাকাঙ্ক্ষিত জীবন কেন তার সম্মুখে এসে দাড়ালো! এটাও কি সৃষ্টিকর্তার পরীক্ষা! অন্যান্য সমস্যা হলে না হয় মানিয়ে নেওয়া যেতো, কিন্তু মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে স্বামীর মর্যাদা কিভাবে দিবে!
নাহিদা দু’হাতে মুখে চেপে কান্না করতে লাগলো। বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত সবার মাঝে আনন্দ আর পুষ্পিত কাননের রানীর মাঝে মহাপ্রলয়! সে কি কখনো ভেবেছিলো বিয়ের রাতে তাকে এভাবে কান্না করতে হবে! ভেতরের সপ্ন, সুখ, শান্তি, ইচ্ছে, প্রেম যা ছিলো সব আজ মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার হয়ে শূন্যে মিশে গেছে!
বেশ কিছুক্ষণ কান্না করে নাহিদা অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। মেহেদীকে নড়াচড়া করতে দেখে তার দৃষ্টি সজাগ হলো। হাতের পিঠে নিরবে অশ্রু মুছে নিলো। তার বাবা নিশ্চয়ই জানতো না ছেলেটা এমন। তাহলে তো আর তাকে বিয়ে দিতো না এখানে! বাবা কিভাবে জানবে ছেলের বাবা-মা ই তো জানে না! না, কোনো হট্টগোল বাধতে দিবে না নাহিদা। কাউকে কিছু জানাবে না। তাহলে উনারা খুব কষ্ট পাবে! কাউকে কষ্ট পেতে দিবে না। নিজের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টাকে ঢেলে দিবে লোকটাকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে। বিয়ের আগেই তো শ্বশুর বলেছিলো ছেলেটাকে সংসারের প্রতি আকৃষ্ট করতেই এখন বিয়ে করাতে চাইছে। তাহলে নাহিদা এখন সেই প্রচেষ্টাই করবে, তাকে সজ্জিত সংসারের প্রতি আকৃষ্ট করতে। কে জানে সফল হবে কি-না! না, সংশয়ে থাকলে চলবে না। সফল হোক বা না হোক, চেষ্টা করবেই।
ভাবতে ভাবতে আবারও অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। নাহিদা তা হাতের আঙ্গুল দ্বারা মুছে নিলো এবং উঠে দাড়ালো। শীতকাল আসতে চলেছে, দিনে স্বাভাবিক থাকলেও রাতে ঠান্ডার প্রভাব পড়ে আবহাওয়াতে। মেহেদীরও হয়তো ঠান্ডা লাগছে কিছুটা, তাই এমন নড়াচড়া করছে। আর ঘুমের মধ্যে থেকে বারবার ভাজ করা চাদরটার কোনা টেনে যাচ্ছে। নাহিদা এগিয়ে এসে পা থেকে জুতা খুলে দিলো। জুতার ময়লায় বিছানা ময়লা করে ফেলেছে! জুতা জোড়া রুমের একপাশে রেখে আবার মেহেদীর কাছে এলো। চাদরের কোনাটা তার কাছ থেকে ছাড়িয়ে সম্পূর্ণ ভাজ খুলে তার উপর ছড়িয়ে দিলো। বালিশটা একটু টেনে মাথাটা বালিশের মাঝামাঝিতে এনে দিলো। সুইচ বোর্ড খুঁজে লাইটটা অফ করে নাহিদা জানালার পাশে এসে দাড়ালো। ইচ্ছে থাকলেও গ্লাস খুললো না। শুধু পর্দাটা সড়িয়ে দিলো। সাথে সাথেই কক্ষে রূপালী চাঁদের আলো ছিটিয়ে পড়লো। বাইরের পরিবেশটা খুব শান্ত, শুধু গাড়ি চলাচলে যতটা অশান্ত হওয়ার কথা ততটুকুই। ক্ষীণ চাঁদের আলোয় জানালার বাইরে দেখা যাচ্ছে ছোট বড় ভবন আর ভবন। সে কত তলায় আছে তা জানা নেই। তবে আনুমানিক ধারণা করে নিলো তিন বা চার তলায় তার বর্তমান অবস্থান। কেননা গাড়িগুলো অনেকটা নিচে দেখা যাচ্ছে। বিয়ে বাড়ি, প্রথমে হৈ-হুল্লোড় থাকলেও কখন যে সেটা নিরিবিলিতে পরিনত হয়েছে সেই খেয়ালই নেই নাহিদার। হয়তো এখন মাঝরাত! সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন। শুধু নববধূর চোখেই ঘুম নামক শব্দটা হারাম হয়ে গেছে! আনমনে বাইরে তাকিয়ে থাকার এক পর্যায়ে কারো গোঙানির আওয়াজ ভেসে এলো কানে! হঠাৎ করেই সেই আওয়াজ পরিনত হয়ে গেছে “ওফ্ফ! আহ!” শব্দে! নাহিদা সুইচবোর্ডের পাশে এসে লাইট অন করে দেখলো। মেহেদী দু’হাতে মাথা চেপে ধরে এমন শব্দ করছে আর এপাশ থেকে ওপাশে নড়েচড়ে ছটফট করছে! নাহিদা দ্রুত পায়ে হেটে পাশে এসে বসলো। মেহেদীর মাথায় হাত রাখতে চেষ্টা করে বললো,
– কি হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন?
তার কথায় মেহেদীর কোনো জবাব নেই। থাকবে কিভাবে সে এখনো ঘুমের ঘোরে ও মদ্যপানের কারণে মাতাল! চোখ বন্ধ রেখেই শুধু মাথার চুল টানছে, দু’হাতে মাথা চাপ দিচ্ছে আর ছটফট করছে। নাহিদার যতটুকু ধারণা, মেহেদীর মাথা ব্যথা করছে। হয়তো ব্যথা সহ্য করতে পারছে না, তাই এমন ছটফট তার মাঝে! সে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে খুজতে লাগলো কোনো ব্যথার ওয়েনমেন্ট রাখা আছে কি-না। কিন্তু এমন কিছুই খুজে পেলো না। সে লাগেজের কাছে এসে লাগেজ খুললো। দেখলো সেখানে তেল জাতীয় কিছু রাখা আছে কিনা। খুজতে খুজতে পেয়েও গেলো। সেটা নিয়ে আবার বিছানায় এসে বসলো। মেহেদীর মাথাটা স্পর্শ করতেই মেহেদী ছটফটিয়ে ঝটপট বালিশ ছেড়ে নাহিদার কোলে মাথা রাখলো এবং নাহিদাকে দু’হাতে জড়িয়ে রেখে তার পেটে মুখ গুজে রাখলো। ঘটনা এতো তারাতাড়ি ঘটেছে যার ফলে নাহিদার শরীর কেপে উঠেছে! যেন বিদ্যুৎ শক লেগেছে তার দেহে! সে যেন এক মুহূর্তের জন্য কম্পিত পাথর হয়ে গেছে! মেহেদী মাথা ব্যাথার যন্ত্রণায় নাহিদাকে আরও বেশি জড়ো করে নিচ্ছে। যেন তার মাঝে সে মিশে যেতে চাইছে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ও একটুখানি শান্তির খোঁজে! নাহিদার পেটের উপর থেকে শাড়ি সরে গেছে আর স্পর্শ পড়েছে মেহেদীর জ্বিভ ও উষ্ণ ঠোঁটের। অত:পর দাতের আঘাতও পড়ে গেছে। নাহিদা সাথে সাথেই তার চুল আকড়ে ধরলো। যে মুখে মদ স্পর্শ করেছে সেই মুখের স্পর্শে নাহিদার ভেতরে সৃষ্টি হয়েছে এক অসহ্য যন্ত্রণার! সে তার মাথাটা সরানোর চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না।পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অসহায় লাগছে আজ নিজেকে। কান্না করতে ইচ্ছে করছে খুব, কিন্তু সেটাও যেন নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাকে! সে ধৈর্যের বাধ বেধে রেখে নিজেকে শক্ত করতে চেষ্টা করলো। অত:পর হাতে তেল নিয়ে মেহেদীর মাথায় মেসাজ করতে লাগলো। চুলে হালকা টান ও বিলি কেটে দিতে দিতে নিরবে অশ্রু ফেলতে লাগলো। এতোক্ষণে যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে মেহেদীর ছটফট বন্ধ হয়ে গেছে। তাকে শান্তভাবে থাকতে দেখে নাহিদা বুঝে গেছে সে শান্তি পেয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে পড়েছে। কেননা তার হাতের বাধনও হালকা হয়ে গেছে। তবুও নাহিদা বসে বসে বিলি কাটতে লাগলো তার মাথায়।
এক সময় ভেসে এলো আযানের ধ্বনি। ফজরের আজান পড়ে গেছে। আযান শেষ হতেই নাহিদা বালিশটা ঠিক করে রেখে মেহেদীর মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে দিলো। তার উপর চাদরটা ভালোভাবে দিয়ে সে বিছানা ছেড়ে নেমে গেলো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে একবার দেখে নিলো তার বধূ বেশ! হতভাগী বধূ যার প্রথম রাত কাটে মাতাল স্বামীর সেবাযত্ন করে! সে মাথা থেকে দোপাট্টা সরিয়ে নিলো অত:পর একে একে সব গহনা শরীর থেকে ছাড়িয়ে নিলো। সবশেষে ছাড়ালো মায়ের গড়ে দেওয়া বালা জোড়া। জহিরুল ইসলাম নিষেধ করেছিলো যেন কোনো কিছুই না দেয়। উনার মতে নিয়াজ উদ্দিনের অতিরিক্ত কোনো খরচ করার প্রয়োজন নেই, যা দেওয়ার তারাই দিয়ে ঘরে তুলবে নববধূকে। কিন্তু মায়ের গিফট তো মা দিবেই। নাজিয়ার মতো তাকেও এক জোড়া বালা গিফট করেছে রুমানা বেগম।
নাহিদা গহনা খুলে রেখে পেটের উপর থেকে শাড়িটা সড়িয়ে দেখলো, রক্ত জমাট বেধে লাল হয়ে আছে পেটের একটা অংশ। মেহেদীর একটা কামড়ই যথেষ্ট ছিলো রক্ত জমাট বাধিয়ে দেওয়ার জন্য। সে লাগেজ থেকে জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো গোসলের জন্য। আর যাইহোক, দেহে মদ্যপায়ী মুখের স্পর্শ নিয়ে নামাজ পড়তে পারবে না সে।

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১৯
(নূর নাফিসা)
.
.
নাহিদা গোসল সেড়ে নামাজ পড়ে নিলো। মেহেদী বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। নাহিদা আবার এসে দাড়িয়ে রইলো জানালার পাশে। এবার গ্লাস খুলে দিয়েছে। প্রভাতের মৃদু বাতাস দেহে শীতল স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে। সূর্য উদয়ের সময় হয়ে গেছে, পূর্বাকাশে লালিমার ঝলক দেখা যাচ্ছে। মানুষের কোলাহল হয়তো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠবে কিছুক্ষণের মধ্যে। আর যানবাহন! সে তো দিন নেই, রাত নেই, শহরের পরিবেশকে সর্বদা অশান্ত করে রাখতে প্রস্তুত! একের পর এক লাইন ধরে ছুটে চলে ডানে বামে আর থেমে থেমে বাজিয়ে যায় হর্ন!
সূর্য উদয়ের একটু পরেই নাহিদার কানে শব্দ এলো,
– ওফ্ফ! ঘুমাতে এসেও শান্তি নেই! এই মেয়ে, গ্লাস খুলে রেখেছো কেন! পর্দা টানো!
নাহিদা পেছনে ফিরে লক্ষ্য করলো সূর্যের সোনালী কিরণ জানালার গ্রিল ভেদ করে মেহেদীর চোখ বরাবর এসে পড়েছে। নাহিদা একটু চেপে দাড়ালো যাতে তার ছায়ায় মেহেদীর মুখে পড়া কিরণ ঢেকে যায়। মেহেদী বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। মাথা তার এখনো ঝিম ধরে আছে তাই ভারি ভারি লাগছে। বিছানায় থেকেই সে শেরওয়ানী খুলে ফেললো। অত:পর হেলেদুলে হেটে বাথরুমে চলে গেলো। নাহিদা বিছানার পাশে এসে ময়লা চাদরটা তুলে নিলো। অত:পর ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে আলমারির চাবি খুজতে লাগলো। কিন্তু পাওয়া গেলো না, কোথায় রাখে কে জানে! সে বাকিসব গুছিয়ে বসে রইলো। মেহেদী বাথরুম থেকে বেরিয়ে ওয়ারড্রব খুলে জামাকাপড় নিতে লাগলো। নাহিদা বিছানায় থেকে বললো,
– আলমারির চাবি কোথায় রাখেন?
– কেন?
– এক্সট্রা বেডশিট আছে? এটা ময়লা হয়ে গেছে।
– বাড়িতে না আসতেই বেডশিট ময়লা করে ফেলেছো!
– আমি করিনি। আপনি করেছেন।
– হোয়াট! আবার মুখের উপর তর্ক করো! আমি তো তোমাকে জেল ফাস দিচ্ছি না, দোষ আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছো কেন!
– আমি কারো উপর দোষ চাপাতে চাইছি না। আপনি রাতে জুতা পড়েই বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছেন। জুতার ময়লায় বিছানা ময়লা হয়ে গেছে।
– তাহলে তো দোষ জুতার!
– আমি তো কাউকেই দোষারোপ করছি না! শুধু একটা বেডশিট চাইলাম!
– বেডশিট থাকবে কাপড়চোপড়ের সাথে ওয়ারড্রবে, তুমি আলমারির চাবি চাইছো কেন! মতলব তো তোমার ভালো দেখছি না! টাকা কিন্তু আমি গণে রেখেছি, এক টাকা কম হলে তোমার খবর আছে।
– কি আযব কথাবার্তা বলছেন! আমি আপনার টাকা নিয়ে কি করবো। আলমারির চাবি চাইছি গহনাও তো রাখতে হবে! আর ওয়ারড্রবেই যদি সব কাপড়চোপড় রাখা থাকে তাহলে আলমারিতে কি থাকে!
– সেগুলো তোমাকে জানতে হবে না। আলমারির চাবি ওয়ারড্রবের ড্রয়ারে রাখা আছে, এখান থেকে নিয়ে আবার কাজ শেষে এখানেই রেখে দিবে।
মেহেদী আবার কাপড়চোপড় এলোমেলো করে তার কাঙ্ক্ষিত জামা খুজতে লাগলো। নাহিদা খুব অসহায় ভঙ্গিতে বললো,
– আপনি মদ্যপান কেন করেন? কি মজা পান এসব করে! এসব কি ঠিক! এগুলো তো হারাম। হারাম জিনিস কেন মুখে তুলেন!
– তাতে তোমার কি? তোমাকে বলেছি আমার শিক্ষক হতে! আমার কোনো ব্যাপারে নাক গলাবে না। বিয়ে হয়েছে বলে ভেবো না যা খুশি তাই বলতে পারবে! এসব বিয়ে টিয়েতে আমার কিছু যায় আসে না। আমাকে নিয়ে না ভেবে নিজেকে নিয়ে ভাবো। তোমার পথ তুমি দেখো আর আমার পথে আমি। আর আমার কোনো ব্যাপারে আব্বু আম্মুকেও জানাতে যাবে না। যদি জানিয়েছো তো, তোমার কি হাল করবো আমি ভেবে পাবে না!
মেহেদী জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। বিয়ে তো ভাগ্যের ব্যাপার। নসিবে যেটা লেখা আছে সেটা কি পেন্সিল কালির ন্যায় মুছে ফেলা যায়! পিতামাতা জানলেও তো কপাল চাপড়াবে যে, মেয়েকে নেশাখোরের ঘরে পাঠিয়েছে! না, এভাবে কষ্ট পেতে দিবে না পিতা মাতাকে। দেখা যাক ভাগ্যের পরিহাস শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে। নাহিদা চোখ মুছে ওয়ারড্রবের কাছে এলো। ওয়ারড্রব খুলতেই মনে হলো যেন ধোপার কাছে কেচে দেওয়ার জন্য বালতি ভর্তি কাপড় দিয়ে গেছে! এমন নাজেহাল অবস্থা করে রেখেছে ড্রয়ারের! বাকি ড্রয়ার খুলে দেখলো একই অবস্থা! একজন মানুষের এতো কাপড়চোপড়! তাও আবার এলোমেলো! নাহিদা চাবিটা নিয়ে যেমন ছিলো তেমনই লাগিয়ে দিলো ড্রয়ার। একটা ড্রয়ার শুধু পরিপাটি যেটাতে তার কাপড়চোপড় নেই। শুধু একটা কম্বল আর তিনটা বেডশিট আর একটা কাথা রাখা। নাহিদা, গোলাপি রঙের বেডশিটটা নিয়ে বিছানায় বিছিয়ে দিলো। সাথে ম্যাচিং কুশন কভার। অত:পর আলমারি খুললো সাথে সাথেই ধপাধপ্ দুইটা বাক্স পড়লো। নাহিদা ভয়ে পিছিয়ে গেছে! এসব কি রাখা আলমারিতে! সে নিচু হয়ে বাক্স ধরে দেখলো হালকা লাগছে। খুলে দেখলো একটা খালি অন্যটাতে পলিথিন জাতীয় প্যাকেটে মোড়ানো কিছু রাখা আছে। লেখা দেখে বুঝে নিলো এটা স্যুট সেটের প্যাকেট। বিয়ের জন্য শপিং করতে গিয়ে তো এটা কিনে নি! বাক্সের লোগো দেখে বুঝতে পারলো পার্সেল পাঠানো হয়েছে। স্যুট সেট বাক্সের ভেতর রেখে আলমারির কাছে এসে দেখলো লাগেজ ও ব্যাগ নিয়ে আলমারির ভেতর রেখে দিয়েছে! জুতাও সব রাখা আছে এখানেই। অন্যথায় জামাকাপড় কিছু নেই। ব্যাগ লাগেজ কি আলমারির ভেতরে রাখার জায়গা! এগুলো থাকবে সানশেডে! সেটাও তো নেই ঘরে! তবে আলমারি কিংবা ওয়ারড্রবের উপরও তো রাখা যেতো!
নাহিদা গুছাতে গিয়েও গুছালো না। এসব গুছাতে গেলে তার দিনের অর্ধেকটা সময় লাগবে! সে লাগেজ নামিয়ে জায়গা করে তার গহনা ও জামাকাপড় গুলো গুছিয়ে রেখে দিলো। অত:পর আলমারি লক করে টুল এনে দাড়িয়ে মেহেদীর লাগেজটা আলমারির উপর তুলে দিলো। আর তারটা নিচেই রেখে দিলো। কেননা আজ আবার লাগবেই। বাথরুম থেকে বেরিয়ে নাহিদাকে লাগেজ উপরে তুলতে দেখে মেহেদী বললো,
– এই, কি করছো এসব! এতো মাতব্বরি করতে বলছে কে! নামাও এটা!
– সমস্যা কি? এটা তো এখন প্রয়োজন পড়ছে না। আলমারিতে জায়গা ছিলো না আমার কাপড়চোপড় রাখার তাই এটা সরিয়ে দিলাম।
– নামাতে বলেছি নামাও! এটার প্রয়োজন আছে আমার। জায়গা না পেলে তোমার কাপড়চোপড় নিয়ে রাখো সেখানে!
নাহিদা বিরক্তি নিয়ে নামিয়ে দিলো। মেহেদী সেটা নিয়ে ওয়ারড্রবের কাছে রেখে দিলো। মাথা মুছে তারপর ওয়ারড্রব খুলে বেছে বেছে জামাকাপড় গুছাতে লাগলো লাগেজের ভেতর। সে কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিচ্ছে কেন! নাহিদার গত রাতের কথা মনে হলো। তাহলে কি সত্যিই আজ সে বেড়াতে চলে যাবে! আজ না বাড়িতে রিসিপশন প্রোগ্রাম! এখন কিছু জিজ্ঞেস করলেও তো আবার বকাঝকা শুরু করবে! তাই নাহিদা চুপচাপ তুলে রাখা বেডশিট নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। মেহেদী তার কাপড়চোপড়ও রেখে গেছে। নাহিদা রুমে এসে শেরওয়ানীটাও নিয়ে গেলো। বিশ্রী গন্ধ লেগে আছে জামাকাপড়ে! সব ধুয়ে দিলো। এতোক্ষণে মেহেদীর গুছানো শেষ। নাহিদা বাথরুম থেকে বের হতেই সে ব্রু কুচকে বললো,
– এসব কি? তোমার জামাকাপড় বারান্দায় রেখেছো কেন? এটা বস্তি এলাকা না যে, বারান্দায় কাপড় থাকবে! দ্বিতীয় বার দেখলে জানালা বাইরে সোজা নিচে চলে যাবে।
নাহিদা বারান্দার দিকে যেতে যেতে মনে মনে বললো, “নিজের আলমারি আর ওয়ারড্রবের ভেতরে বস্তি বানিয়ে রেখেছে সেটা কিছু না, বারান্দায় কাপড় নেড়ে দেওয়ায় দোষ হয়ে গেছে!”
তাকে বারান্দার দিকে যেতে দেখে মেহেদী বললো,
– আবার এগুলো নিয়ে কোথায় যাচ্ছো? একবার কি বললাম কানে যায়নি?
– তাহলে ভেজা কাপড় শুকাতে দিবো কোথায়! ছাদে যাবো?
– রুম থেকে বের হও।
– কি!
– রুম থেকে বের হতে বলেছি। রুম থেকে বেরিয়ে বা দিকে গিয়ে দেখবে বারান্দার মতো খোলামেলা একটা বড় রুম আছে। ওটাতে কাপড়চোপড় শুকাতে দিবে। এটা ভাড়াটে বাসা। ছাদে গেলে চুরি হতে পাচ মিনিট সময় লাগবে।
“এভাবে ধমকে বলার কি আছে, ষ্টুপিড লোক! ভালোভাবে বলা যায় না কথা!” নাহিদা বিরক্তি নিয়ে দরজার কাছে এসে থেমে গেলো। বাড়িতে কারা না কারা আছে, সকাল সকাল নতুন বউকে বালতি ভরে কাপড়চোপড় নিয়ে যেতে দেখলে কি না কি ভাববে বা বলবে কে জানে! তাই আবার পেছনে ফিরে বললো,
– আমি তো চিনি না কিছু। আপনি রেখে আসতে পারবেন?
– কি! আমি তোমার জামাকাপড় নিয়ে যাবো!
– আমার গুলো আজ এখানেই থাক। পরে আর রাখবো না। আপনার গুলোই নিয়ে যান। বাড়ি ভর্তি মেহমান। তাই বলছিলাম।
– মেহমান যেন গিলে ফেলবে!
মেহেদী তার হাত থেকে বালতি নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। মেহেদীর শেষ কথাটা শুনে কেন জানি তার হাসি পেলো! কিন্তু তেমন ভাবে হাসলো না। সে রুমের বারান্দায় এসে দাড়ালো। এখানে সোফা রাখা আছে। অবশ্য এটা সোফা না আরও কিছু তার জানা নেই! সে বসে পরীক্ষা করলো এটাতে বসতে কেমন মজা। সোফায় বসেছে না মেঝেতে বসেছে তার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে! কোনো কাঠ তক্তা কিছুই নেই। কাপড়ের মতো প্লাস্টিক দিয়ে মোড়ানো ফোম! বসলে সাথে সাথেই মেঝের সাথে যেন মিশে যাচ্ছে এমন মনে হচ্ছে! এর চেয়ে ভালো মাদুর বিছিয়ে মাটিতে বসা! গদি বলা যায় হয়তো এটাকে! একটা এক সিট, আরেকটা তিন সিটের। স্পেশাল গদি! সে আবার উঠে দাড়ালো। এটা থেকে। পাশে থাকা গোলাকৃতি টুলের উপর রাখা বাকা ফুলদানিটা একটু সোজা করে রাখলো। এমনি রুমে প্রবেশ করলো মেহতাজ। মুখে হাসি ফুটিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
– নতুন বউ বাসায় আসতে না আসতেই কাজে লেগে গেছে! হুম? মেহেদীকে দেখলাম কতো কাপড় নিয়ে যাচ্ছে!
নাহিদা মুচকি হাসলো শুধু। মেহতাজ একটু বিস্মিত কন্ঠে বললো,
– একি! রাতে ঘুম হয়নি একটুও? চোখের নিচে কেমন কালচে ছাপ পড়ে গেছে! মেহেদী বাদড়টা ঘুমাতে দেয়নি নিশ্চয়ই!
– তেমন কিছু না। নামাজ পড়ে আর ঘুমাইনি। তাই হয়তো।
– নামাজ পড়েছো?
– হ্যাঁ।
এমনি রুমে প্রবেশ করলো মেহেদী। তাকে দেখে মেহতাজের উক্তি,
– কিরে, সারারাত জাগিয়ে রেখে গল্প করেছিস! এখন যে চোখের নিচে কালচে দাগ পড়ে গেলো। লোকে দেখবে আর লজ্জা দিবে!
– তাতে আমার কি! আমি কি কারো চোখে ধরে রেখেছি! আমি নিজেও রাত জেগে থাকিনি আর না কাউকে জাগিয়ে রেখেছি! আর লজ্জা দিবে কেন, তোমরা যেই মেকাপ করতে জানো! খোচা দিলে এক ইঞ্চি ডেবে যাবে! কালচে ছাপ আবার কিভাবে দেখা যাবে!
মেহেদী বলতে বলতে বালতি নিয়ে বাথরুমের দিকে চলে গেলো। তার কথায় এদিকে নাহিদার মনোক্তি, “আপনি জানবেন কিভাবে কাউকে জাগিয়ে রেখেছেন কিনা! অন্যের মনে কষ্ট দিয়ে ঘুম হারাম করে নিজে তো মাতাল হয়ে পড়ে ঘুমিয়েছেন।”
মেহেদীর কথায় মেহতাজ হেসে নাহিদার দিকে ঘুরে কাধে হাত রেখে নরম গলায় বললো,
– পরিবারকে মনে করে চিন্তা করেছো আর কান্না করেছো সারারাত, তাই না? দুশ্চিন্তা করো না। প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগেই, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। এক কাজ করো, আমি খাবার এনে দিচ্ছি। খেয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো। পার্লার কাছেই। একটু পর যাবো। ততোক্ষণে একটু ঘুমাও।
হয়েছে আর ঘুম! মেহতাজ খাবার এনে দিলে অল্প খেয়ে নিলো। আয়াশ দু একজন সাথে নিয়ে বিছানায় উঠে লাফাচ্ছে, ফুল স্পর্শ করে করে খেলা করছে। মেহতাজ এগুলো ছিড়তে নিষেধ করলো। কিন্তু তাদের বের করতে পারলো না রুম থেকে! এদিকে আবার আরিশা কোলে। নাহিদাও বললো সে এখন ঘুমাবে না।মেহতাজের ডাক পড়লে নাহিদা আরিশাকে কোলে নিলো। মেহেরুন ইসলাম এসে নাহিদার সাথে দেখা ও কথা বলে গেলেন। মেহেদীর চাচিরাও এসেছে রুমে, দেখা করতে। পার্লারে যাওয়ার পূর্বে বাকিটুকু সময় নাহিদা আরিশাকে নিয়েই কাটালো সাথে মেহমানদের সাথে টুকটাক দেখাসাক্ষাৎ।

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ২০
(নূর নাফিসা)
.
.
রিসিপশন প্রোগ্রাম করা হয়েছে কমিউনিটি সেন্টারে। যেটা তাদের বাসার কাছেই। বিকেলের দিকে নাহিদার বাড়ির লোকজন এসেছে। নাফিসা তো নাহিদাকে দেখে কতো উৎফুল্ল! যেন মনে হচ্ছে এক দিন নয়, বহু দিন পর তার সাথে দেখা হলো। নাহিদাও খুব খুশি তার পরিবারকে দেখে। নাফিসা মেহেদীর সাথেও টুকটাক কথা বলেছে। বাবার আদেশে সবার সাথেই কুশল বিনিময় করলো মেহেদী। আরাফের সাথে আসিফের ভালো ভাব জমে গেছে, যতটা মেহেদীর সাথেও হয়নি। হবেই কিভাবে! মেহেদী সেদিকে লক্ষ্য রাখলে তো! সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হলো সকল আয়োজন। সন্ধ্যায় নাহিদার পরিবারসহ মেহেদীর পরিবার বাড়ি ফিরে এলো। এখান থেকে নাহিদা ও মেহেদী আজ নাহিদাদের বাড়িতে যাবে। বাড়িতে ফিরতেই মেহেদী তার বাবাকে একপাশে নিয়ে গিয়ে বললো,
– আব্বু, সব তো শেষ হলো। আমি সকালেই ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে রেখেছি। এবার আমি যাই।
– হ্যাঁ, আব্বু। যাবেই তো। এতো তাড়া তোমার শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার। আর একটু সময় তো বাপের বাড়ি থাকো। তারপরই বিদায় দিচ্ছি।
– শ্বশুর বাড়ি মানে!
– মানে, এখন তুমি শ্বশুর বাড়ি যাবে।
– আবার শ্বশুর বাড়ি যাবো কেন! এটা কিন্তু কথা ছিলো না। বিয়ে করতে বলেছো, বিয়ে করেছি। ব্যাস।
– হ্যাঁ, অস্বীকার করছি কোথায়! বিয়ে তো এখনো শেষ হয়নি৷ আজ শ্বশুর বাড়ি যাবে, জামাই আদর পাবে, কার্যাদি সম্পন্ন হবে তারপর বেড়াতে যাবে। টিকেট আমি নিজেই বুক করে দিবো।
– আল্লাহ! আর কতো কার্যাদি! আব্বুর মাথায় একটু বুঝ দাও। তিন কবুল বললেই বিয়ে শেষ। এতো কার্যাদি সম্পন্ন করতে হয় না!
– আল্লাহ তোমার কথা কিভাবে শুনবে আব্বু, তুমি নামাজ পড়ো?
– ধ্যাৎ! সেদিন কাজী অফিসে বিয়ে সেড়ে এলেই হতো! তাহলে তো আজ আর এতো এতো কার্যাদি সম্পন্ন করতে হতো না!
– ধৈর্যহীন পুচকে ছেলে আমার! ভদ্র ছেলের মতো বাপের মর্যাদা রক্ষা করো শ্বশুর বাড়ি গিয়ে। উল্টাপাল্টা আচরণ করে বদনাম করে এসো না আমার! যাও, কাপড়চোপড় নতুন করে গুছিয়ে নাও শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য।
– টিকেট কিন্তু তুমি বুক করে দিবে বলেছো।
– ওকে।
মেহেদী বিরক্তি নিয়ে চলে গেলো রুমের দিকে। রুমে এসে দেখলো মেহতাজ সহ তারা তিন বোন কথা বলছে আর নাহিদা কথার পাশাপাশি লাগেজ গুছিয়ে নিচ্ছে। মেহেদী আর ভেতরে প্রবেশ করলো না। দরজার সামনে দাড়িয়েই ভদ্রতার সুরে বললো,
– নাহিদা, একটু এসো তো।
নাহিদা এমন সুরে ডাকতে দেখে একটু অবাক হয়েই তার দিকে তাকালো। নাফিসা বলে উঠলো,
– ভাইয়া, আমরা বাইরে চলে যাবো?
– নাহ। তোমরা যাবে কেন।
মেহতাজ হেসে নাফিসাকে বললো,
– আরে আরে! আমার ভাইটাকে এভাবে লজ্জা দিচ্ছো কেন! এভাবে প্রত্যক্ষ লজ্জা দিতে হয়!
নাফিসা খিলখিল করে হেসে উঠলো। নাজিয়া ও মেহতাজের মুখেও লেগে আছে হাসি। মেহেদীর বিরক্ত লাগছে মেহতাজ তাদের সাথে যুক্ত হয়ে কেমন লজ্জা দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে! সে দরজার সামনে থেকে চলে এলো ছোট ছোট কদমে। একটু এগিয়ে এসে আবার পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো নাহিদা বেরিয়ে এসেছে। তাই সে দাড়িয়ে গেলো। নাহিদা তার কাছে এসে বললো,
– কি?
– সাথে সাথে এলে কি আমাকে এই কথাগুলো শুনতে হতো!
– এখন কি বলবেন কিছু? নাকি চলে যাবো?
– হুহ্! নিজের বাড়ির লোকজন দেখে যেন দাপট বেড়ে গেছে! জেনে রেখো, মোল্লার জোর মসজিদ পর্যন্তই।
– জানা আছে আমার। আরও কিছু বলবেন?
– বলা তো শুরু ই করলাম না!
– সেটাই তো জানতে চাইছি, শেষ করবেন কখন?
– রুমে যাও।
নাহিদা আবার তাদের রুমের দিকে পা বাড়ালে মেহেদী বললো,
– ওদিকে কোথায় যাচ্ছো? এই রুমে যেতে বলেছি।
নাহিদা আবার ফিরে এসে পাশের রুমে পদার্পণ করলো। এটা মেহতাজের রুম। নাহিদা প্রবেশ করার পরপরই মেহেদী রুমে এসে দরজা লক করে দিয়ে বললো,
– একদম মিথ্যে বলবে না, রিসিপশনের দিন কি ছেলেদের শ্বশুর বাড়ি যেতে হয়?
– আমি জানি, হয়।
– আচ্ছা, মনে করো এখন আমরা পালিয়ে কাজী অফিসে বিয়ে করে এসেছি। তাহলে তো রিসিপশন হতোই না, শ্বশুর বাড়িও যাওয়া হতো না। রাইট?
– হুম।
মেহেদী মুচকি হেসে নাহিদার মাথার চুল, দোপাট্টার পাড় ও টিকলি স্পর্শ করতে করতে বললো,
– গুড, তাহলে এবার তুমি সেটাই ভেবে নাও যে আমরা কাজী অফিস থেকে বিয়ে করে এসেছি। তাই এখন আমরা শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি না। তোমার যেতে ইচ্ছে করলে যাও, কিন্তু আমি যাচ্ছি না। আর আমাকে যেতে হবে না। এটা গিয়ে তোমার আব্বু আর আমার আব্বুকে বলে দিবে। কেমন?
– দুঃখিত। এখন যেহেতু তেমন কিছু হয়নি এবং বিয়েটা আনুষ্ঠানিকভাবে হয়েছে এবং রিসিপশনও হয়েছে তাহলে এখন এই কার্যটিও হবে। আমি কাউকে এর বিপরীতে কিছু বলছি না।
সাথে সাথেই মেহেদীর মুখে বিরক্তিকর ভাব নেমে এলো! সে ধমকের সুরে বললো,
– বের হও। যাও। এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে থেকে যাও।
– হুম। যাচ্ছি। আপনার কাপড়চোপড় কোনগুলো নিবো সেটা বলে দিন।
– কিছু গুছাতে হবে না। যাও।
– ওকে। পরে আবার আমাকে দোষারোপ করতে পারবেন না। ওবাড়িতে গেলে পড়নের জামাকাপড়ে নতুবা বাবার লুঙ্গী পড়ে ও খালি গায়ে থাকতে থাকতে হবে।
নাহিদা বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। নাহিদা রুমে আসার দুই মিনিট পর মেহেদী এসে বললো,
– দুইটা টিশার্ট, দুইটা শার্ট আর তিনটা জিন্স নাও। ওয়ারড্রব থেকে নিও না। ওই লাগেজ থেকে নাও।
নাহিদার কাছে এসে তুলনামূলক আস্তে বললেও বাকিদের কানে পৌছেছে। কেননা এতোটা আস্তে বলেনি। তা শুনে মেহতাজ বললো,
– মেহেদী তুই ক’দিনের সফরে যাচ্ছিস শ্বশুর বাড়িতে? মাত্র একদিনের জন্য এতো কিছু!
– একদিন!
নাজিয়া বললো,
– না, ভাইয়া। আপনার যতদিন ইচ্ছে ততদিন থাকতে পারবেন।
– তাহলে না গেলে হয় না?
এমন প্রশ্নে নাহিদা মলিন মুখে তার দিকে তাকালো। এদিকে নাজিয়া হাসিমুখে বললো,
– সেটাও আপনার ইচ্ছে। তবে যে নীতি পালন করা হয় সে অনুসারে যেতে হয়।
– ওহ্।
মেহেদীর কল আসতেই সে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সব গোছগাছ করে তারা বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। তারা আজ নিজেদের গাড়িতে যাবে না। নাফিসারা যে গাড়ি রিজার্ভ করে এসেছে সে গাড়িতে যাবে। লাগেজ নিয়ে আগেই তুলে রাখা হয়েছে। মেহেদী রুমে এসেছিলো তার ফোনের চার্জার সাথে নিতে। নাহিদা জুতা চেঞ্জ করে নিলো। সেটা পড়ে হাটতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। দুজনেই একসাথে রুম থেকে বের হওয়ার সময় পেছন থেকে নাহিদা মেহেদীর ব্লেজার টেনে ধরলো। মেহেদী পেছনে ফিরে তাকাতেই নাহিদা ছলছল চোখে অসহায় ভঙ্গিতে বললো,
– দয়া করে আমার পরিবারের সাথে কোনো দুর্ব্যবহার করবেন না। আর ড্রিংকস যদি আপনার নিয়মিত অভ্যাস হয়ে থাকে তাহলে আজকের জন্য সেটা বাদ রাখুন প্লিজ।
মেহেদী কিছু বললো না তার প্রতুত্তরে। কথা শেষ হতেই সে নাহিদার হাতের দিকে তাকালো। তাই নাহিদা ব্লেজার ছেড়ে দিলো। মেহেদী তার আগেই বেরিয়ে গেলো। গতরাতের কথা সারাদিন মনে ছিলো না তার কিন্তু এখন খুব ভয় লাগছে! ওবাড়িতে গিয়েও যদি সে মদ্যপান করে! কেউ কিছু বললে যদি রেগে গিয়ে উল্টাপাল্টা বলে! তখন তো তার পিতামাতা অসম্মান বোধ করে কষ্ট পাবে! সেটা কিভাবে সহ্য করবে সে! এমন কিছু যেন না হয়, সেই প্রার্থনাই করে যাচ্ছে মনে মনে। মেহেদীর পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সন্ধ্যায় তারা বেরিয়ে পড়লো। আসা-যাওয়ায় বেশি সময় লাগে না। মাত্র পনেরো-বিশ মিনিটের পথ।
বাসায় ফিরে রুমানা বেগম চিতুই ও পুলি পিঠা বানাতে লেগে গেছেন। এখন সময় কম হওয়ায় আপাতত এই দুটোই। কাল বানাবে অন্যান্য। কেননা মেহেদীর পরিবারের বাকি সদস্যরা আসবে কাল। নাফিসা দুই ভাইয়ার ই যত্ন নিচ্ছে। তবে নতুন জামাইয়ের তুলনায় আরাফের যত্নটা বেশি। কেননা মেহেদী নিজ থেকে তেমন অতিরিক্ত কথাবার্তা বলছে না। আরাফের সাথেই নাফিসা গল্পসল্প বেশি করছে। আর মেহেদীর বন্ধুরা একের পর এক কল করে তাকে বকাঝকা শুরু করেছে। কেননা সে তাদের বলেছিলো আজ রেডি হয়ে থাকতে। কিন্তু আজও যাওয়া হলো না। সে শ্বশুর বাড়ি পড়ে আছে। বন্ধুরা নিজ থেকে তার শ্বশুর বাড়ি আসার দাওয়াত নিতে চাইলো কেননা সে একা পিঠার স্বাদ নিচ্ছে। অথচ মেহেদী ডিরেক্টলি নিষেধ করে দিলো তাদের। পিঠা খেতে হলে যেন দোকান থেকে কিনে খায়! তা নিয়ে তার বন্ধুরাও কিপটে বলতে লাগলো। তাদের মতে মেহেদী শ্বশুর বাড়ির খরচ বাচাতে চাইছে।
আরাফ চলে যেতে চেয়েছিলো থাকার জায়গার স্বল্পতার কারনে। নাফিসা নিষেধ করলো। সে, শিথির কাছে চলে যাবে। নাফিসা, শিথি ও আরাফের সাথে টুকটাক গল্প করতে করতে মেহেদী শ্বশুর বাড়িতে পিঠার আমেজ উপভোগ করলো। নাজিয়া নাহিদা মায়ের সাথে কাজে ব্যস্ত। নিয়াজ উদ্দিনও দুই ছেলের সাথে বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলেন। ঘুমানোর সময় নাফিসা শিথির সাথে চলে গেলো। আর তারা দুই বোন দুই রুম দখল।
মেহেদী পোশাক পাল্টে একটা টিশার্ট পড়ে নিলো। নাহিদা মশারি টানাতে টানাতে বললো,
– আপনার কিছু লাগবে? লাগলে বলুন।
– হ্যাঁ, লাগবে তো। আমার রুমটা লাগবে। আমার বেড টা লাগবে, কুশনটা লাগবে, আমার চাদরটা লাগবে।
– দুঃখিত। এসব কিছুই দিতে পারছি না আজকের জন্য। সামর্থ্যের ভেতরে থাকার মধ্যে কিছু প্রয়োজন হলে বলুন।
– সকাল সকাল মুক্তিটাই প্রয়োজন।
কথাটা বলেই মেহেদী কাথা টেনে শুয়ে পড়লো। নাহিদা আরও একটা কাথা নিয়ে লাইট অফ না করেই খাটের একপাশে শুয়ে পড়লো। মেহেদীর তো এখানকার কিছু চেনা নেই। যদি রাতে উঠতে প্রয়োজন হয় তাই লাইট জ্বালানোই রাখলো। তা দেখে মেহেদী বললো,
– এমনিতেই তো ঘুম হারাম করেছো। এখন কি ঘুমানোর চেষ্টাও করতে দিবে না!
– আমি আবার কি করলাম!
– লাইট অন থাকলে আমি ঘুমাতে পারি না।
– ওকে।
নাহিদা লাইট অফ করে দিয়ে শুয়ে পড়লো। দুদিন পর এখন তার দেহ ক্লান্তি শেষ করলো বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে। মেহেদীর আচরণ নিয়ে একটা ভয় ছিলো, সেটা থেকেও মুক্তি পেলো সে। নিজেকে চিন্তামুক্ত করে বিশ্রামে আনতে পেরে অনুভব করছে অপরিমেয় সুখ ও শান্তি। ক্লান্তি নাশে তাই চোখে ঘুম নামতেও বেশি সময় নেয় নি।

চলবে।