তোমাতেই পরিপূর্ণ পর্ব-০১

0
1183

সূচনা পর্ব
#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

‘উফফ, স্যার দেখুন আপনিও কালো পাঞ্জাবী পরেছেন আর আমিও কালো শাড়ি পরেছি। ম্যাচিং ম্যাচিং। দেখেছেন স্যার, আপনার আর আমার মধ্যে কত মিল! এই জন্যই আমার ফ্রেন্ডরা বলে উই আর মেইড ফর ইচ আদার। মিলেছে তো ওদের কথা। এবার তাহলে আমার প্রপোসটা একসেপ্ট করুন, প্লীজ’

কথাটা শেষ হতেই নৈরিথ মিথির গালে সশব্দে চড় দিয়ে বসল। তারপর তার হাতে থাকা কাগজটা মিথির মুখের উপর ছুড়ে মেরে সে চেঁচিয়ে উঠল। বললো,

‘এই তোমার রেজাল্ট? দ্যাটস এনাফ, আমি আর পারবোনা। অনেক হয়েছে, অনেক করেছো তুমি। আমার পক্ষে আর এইসব সহ্য করা সম্ভব না। তোমার মতো একটা স্টুপিডকে পড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি তোমার মা বাবাকে বলে দিব, আমি আর পারছিনা, উনারা যেন উনাদের মেয়ের জন্য অন্য কোন টিচার খোঁজেন। আমি আর উনাদের মেয়েকে পড়াতে পারবো না।’

মিথি গালে হাত দিয়ে কাঁদতে আরাম্ভ করে। স্যার যে তাকে মেরেছে এই জন্য সে কাঁদছে না। সে কাঁদছে স্যার যে তাকে আর পড়াবে না সেই কষ্টে। মিথি তখন ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললো,

‘স-স্যার, প্লিজ!’

নৈরিথ ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,

‘নো মোর প্লিজ। এর আগেও তুমি অনেক প্লিজ বলেছো। আর কোন প্লিজ আমি শুনছি না। আমি তোমাকে আর পড়াচ্ছি না এটাই ফাইনাল।’

কথাটা বলেই নৈরিথ চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও আবার ফিরে এলো। মিথি তখন অপর পাশের চেয়াটায় বসে বসে কাঁদছে। নৈরিথ তখন টেবিলের উপর হাত রেখে মিথির দিকে কিছুটা ঝুঁকে এসে বললো,

‘আরেকটা কথা বলতে হবে আন্টি আংকেলকে। তোমাকে যেন শীঘ্রই উনারা বিয়ে দেন। দিন দিন খুব বিগড়ে যাচ্ছো তুমি।’

মিথি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,

‘আপনাকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে বিয়ে করবো না স্যার।’

নৈরিথের রাগ যেন তুঙ্গে উঠল। কষিয়ে মেয়েটাকে আরো একটা থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে তার। খুব কষ্টে নিজের রাগকে সংবরণ করে নৈরিথ হন হন করে বেরিয়ে গেল মিথির বাসা থেকে।

কষ্টে মিথির বুক ফেটে যাচ্ছে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। কেন? কেন, স্যার তার সাথে এমন করে? একটু ভালোবাসলে কি হয়? কোথায় লেখা আছে, কোনো স্যার তার ছাত্রীদের ভালোবাসতে পারবে না? বিয়ে করতে পারবে না? আছে কোথাও লেখা? নেই, পৃথিবীর কোন বইয়েই এই লেখা নেই। তাহলে কেন, কিসের ভিত্তিতে স্যার তাকে এই কথাটা বললো? কেন?

গা থেকে শাড়িটা খুলে ছুড়ে মারল বিছানার উপর। রাগে, দুঃখে, কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে তার। এত এত অপমান সহ্য করেও সে ঐ লোকটার পিছেই পড়ে আছে। শুধুমাত্র তাকে ভালোবাসে বলে। আর ঐ লোকটা একটুও তার ভালোবাসা বোঝে না। এত খারাপ কেন এই মানুষটা? এত পাষাণ কেউ হয় নাকি? একটুও মায়া দয়া নেই মনে। মিথি ঠোঁট উল্টে বসে বসে কাঁদে। হঠাৎ তার মনে পড়ল তার মা বাবার কথা। যেকোন সময় উনারা চলে আসতে পারেন। মিথি তাড়াহুড়ো করে আলমারি খুলে শাড়িটা ভেতরে রেখে একটা লং টি শার্ট আর প্লাজু পরে নেয়। তারপর চোখে মুখে পানি দিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে। কাউকে একটা কল লাগিয়ে মিথি কেঁদে উঠে বলে,

‘তোর ভাই আমাকে মেরেছে, নেহু।’

নেহা অবাক হয়ে বললো,

‘কি? ভাই তোকে মেরেছে? কেন, তুই কি এক্সেস কিছু করেছিলি?’

মিথি জোরে নাক টেনে বললো,

‘না শুধু বলেছিলাম আমার প্রপোজটা একসেপ্ট করতে। ব্যস এইটুকুতেই উনি ঠাস করে আমাকে চড় মেরে বসলেন। এত খারাপ কেন তোর ভাই? মন বলতে কি উনার কিছু নেই? একটা মেয়ে সেই কবে থেকে উনার পিছে পড়ে আছে, মানুষের তো একটু মায়াও হয়। কিন্তু উনার মধ্যে তো দয়া মায়ার কোন ছিটে ফোটাও নেই। সামান্য একটা কথাতে উনি আমাকে চড় মারলো? হাউ রুড হি ইস!’

নেহা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললো,

‘এইভাবে কেন বলতে যাস বলতো? জানিস তো ভাইয়া পড়ার ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস। আর তুই কি আর সময় পেলি না। পড়াতে গেলেই এসব কথা তুলতে হয়? অন্য সময়ও তো বলা যেত। আর বাই দ্যা ওয়ে ভাই এই ব্যাপারটা নিয়ে আগেই অবগত। এর আগে ও তো ভাইকে এত জ্বালিয়েছিস তা আজ হঠাৎ ভাইয়া এত কেন রেগে গেল যে তোকে ডিরেক্ট চড়ই মেরে দিল?’

মিথি তখন কাঁদো কাঁদো মুখে বললো,

‘আসলে টেস্ট পরিক্ষার রেসাল্ট দেখে আরো বেশি রেগে গিয়েছিল। তাই দুইটার শোধ এক চড়ে নিয়েছে। এখন তুই বল আমি কি করবো? তুই বলেছিলি তোর ভাইয়ের নাকি কালো রং পছন্দ তাই তোর ভাইয়ের জন্য আজ কালো শাড়ি পরেছিলাম। তাও উনি যদি একবার আমার দিকে তাকাতেন। আর এইদিকে আমি উনাকে কালো পাঞ্জাবীতে দেখে হা হয়ে গিয়েছিলাম। চোখের পলকই পড়ছিল না। কত ভালোবাসি উনাকে, আর এই লোকটা আমাকে পাত্তাই দেয় না।’

কথাটা বলে মিথি কাঁদতে শুরু করে। নেহা নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে। এ আর নতুন কিছু না। তাদের বন্ধুত্বের পর পরই মিথি তার ভাইয়ের প্রেমে পড়েছিল। সময়ের সাথে সাথে সেই প্রেম গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। এই নিয়ে দশ বারো বার মিথি তার ভাইকে প্রপোজ করেজে কিন্তু নৈরিথ কোনবারই তাকে পাত্তা দেয়নি। তার ভাইয়ের যে গার্লফ্রেন্ড আছে এমন কিছুও না। তাও সে যে কেন মিথিকে মেনে নিতে পারে না তা একমাত্র সেই জানে।

নেহা বললো,

‘আন্টি আংকেল এখনো আসেননি?’

‘না। ইশ, কত ভেবেছিলাম আম্মু আব্বু বাসায় নেই, স্যারকে বলবো যেন আজ একটু বেশি পড়ায়। আর এই সুযোগে বেটাকে আমি আরেকটু বেশি পটানোর সুযোগ পাবো। কিন্তু তোর ঐ খবিশ ভাই, আমার সব আশার উপর চড় বসিয়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। আর হুমকি দিয়ে গেছে আমাকে নাকি আর পড়াবে না। আরো বলেছে আম্মু আব্বুর কাছেও নাকি বিচার দিবে। আমার এখন কি হবে দোস্ত? মরা ছাড়া কি আমার আর কোন উপায় নেই?’

নেহা বিরক্ত কন্ঠে জবাব দিল,

‘হ্যাঁ, তুই মর। একটা চল্লিশা খেতে পারবো। আচ্ছা তোর চল্লিশা তে কোন জামাটা পরে আসা যায় বলতো? জামা পরবো নাকি শাড়ি পরবো? কোনটা বেশি মানামে?’

নেহার কথা শুনে মিথি রাগে ফুঁসে উঠে। চেঁচিয়ে উঠে বলে,

‘তোর ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ের ব্যবস্থা কর। নাহলে দুদিন পর তোর চল্লিশা মানুষ খাবে, বুঝেছিস?’

নেহাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না মিথি। ফট করে কলটা কেটে দিল। রাগ কষ্টের সাথে এক বিশাল অভিমান এসেও যোগ হলো তার মনে। হঠাৎ কি মনে করে সে তার ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়াল। নিজেকে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। আয়ানার দিকে তাকিয়ে আনমনেই সে বলে উঠল,

‘আমি কি দেখতে খুব খারাপ নৈরিথ? আমাকে কি একটুও ভালোবাসা যায়না? কি হয় একটু ভালোবাসলে? আপনি শুধু আমাকে এইটুকুনি ভালোবাসা দিয়ে দেখুন আমি আপনাকে এত্ত এত্ত ভালোবাসা ফিরিয়ে দিব। প্লীজ নৈরিথ, প্লীজ।’

মিথির চোখের কোণটা ভিজে উঠল। এত চেষ্টা করেও সে পারছে না। বার বার হেরে যাচ্ছে। না পারছে নৈরিথকে বোঝাতে, না পারছে নিজের মনকে বোঝাতে। কোনদিকই সামলে উঠতে পারছে না সে। যেন এক অজানা যন্ত্রণায় সে প্রতিনিয়ত কাতরাচ্ছে।
.

সন্ধ্যার পর মিথির মা বাবা বাসায় ফিরে। মিথির ছোট্ট ভাইটা দুদিন পর পর অসুস্থ হয়। তাকে নিয়েই উনারা হসপিটালে গিয়েছিল। মিথি ভাইকে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘আব্বু, ডক্টর কি বলেছেন? সব রিপোর্ট নরমাল তো?’

আতাউর সাহেব সোফাটায় বসলেন। শার্টের গলারটা হালকা ঝেড়ে বললেন,

‘হ্যাঁ মা, এখন সবকিছু নরমালই। কিছুদিন পর আবার যেতে বলেছেন। আর যা ঔষধ পত্র দিয়েছেন ঐ গুলোই এখন কন্টিনিউ করতে বলেছেন।’

মিথি এক চিলতে হাসল। ভাইটা যে তার প্রাণ। ভাইয়ের গালে চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। মিথির মা ফ্রেশ হয়ে এসে রান্নাঘরে গেলেন। মিথিও তার পিছে পিছে গেল। রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ফিচেল কন্ঠে ডাকল,

‘মা!’

মিথির মা চায়ের পাতিলে পানি বসাতে বসাতে বললেন,

‘হ্যাঁ, বল।’

মিথির কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কিছু কথা বলতে গিয়েও গলায় আটকে গিয়েছে তার। ঠোঁট দুটো কাঁপছে। হাত কচলাচ্ছে। সাহস পাচ্ছে না সে। চোখ মুখ ভয়ে চুপসে আছে। আমিরা খেয়াল করলেন, তার মেয়ে কিছু না বলেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তখন ব্রু কুঁচকালেন। বললেন,

‘কিরে কি বলবি বল?’

মনের সাথে যুদ্ধ করে হেরে গেল মিথি। পারলো না সাহস যুগাতে। মাথা নিচু করে বললো,

‘কিছু না মা।’

মিথি নিশ্চুপ হয়ে নিজের রুমে চলে গেল। আমিরা এক দৃষ্টিতে চেয়ে মেয়ের যাওয়া দেখল। কি হলো ওর? আমিরার মনটা খচখচ করে উঠল। মেয়েটার চোখ মুখ অন্যরকম লাগছিল। তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। মেয়েটার আজ কাল হুট করেই কি যেন হয়ে যায়। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর আবারও নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন।

মা বাবার রুমে বসে চা খাচ্ছে আর টিভি দেখছে মিথি। তার ছোট ভাইটা বাবার সাথে দুষ্টুমি করায় ব্যস্ত। মিথি একবার টিভি দেখছে তো আরেকবার ভাইয়ের দুষ্টুমি দেখে খিলখিল করে হাসছে। তখন হঠাৎই মিথির বাবার ফোনটা ভো ভো করে বেজে উঠল। আতাউর সাহেব কলটা রিসিভ করে বললেন,

‘হ্যাঁ নৈরিথ বাবা বলো!’

নৈরিথের কথা শুনতেই ভয়ে মিথির গলা শুকিয়ে উঠল। নৈরিথ কি তবে সত্যি সত্যিই তার মা বাবার কাছে বিচার দিবে? উনি কি সবকিছু বলে দিবে? মিথির ঠোঁট কামড়ে নিজেকে শক্ত করে। সে এবার নির্ঘাত শেষ। মায়ের একটা মারও মাটিতে পড়বে না। মিথির কান্না পাচ্ছে, ভীষণ কান্না। মনে মনে তখন সে বলে উঠে,

‘আপনি খুব খারাপ নৈরিথ, খুব খারাপ।’

চলবে..