নীল কণ্ঠ পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0
602

#নীল_কণ্ঠ💜
অন্তীম পর্ব
#সাদিয়া

পরদিন বিকেল বেলা….

কণ্ঠ ছাঁদের গাছগুলোতে পানি দিচ্ছে। শেষ রাতের দিকে কণ্ঠের হালকা জ্বর ছিলো বলে নীল আজকে ওকে অফিসে যেতে দেয় নি। যদিও কণ্ঠ অফিসে যেতে জেদ ধরেছিলো কিন্তু সবার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের কাছে তাকে পরাজিত হতে হলো। সারাদিন বাসায় বসে থাকতে থাকতে কণ্ঠ প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে গিয়েছে। এভাবে সারাদিন বসে বসে কাটানো যায়? এভাবে বসে বসে দিন কাটালে তো সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যাবে।

গাছে পানি দেওয়া শেষ করে কণ্ঠ রুমে আসলো। এসে দেখে নীল শার্ট চেঞ্জ করে টি-শার্ট পড়ছে। টি-শার্ট পড়ার সময় নীল কেমন যে মৃদু আর্তনাদ করে উঠছে। কণ্ঠ ভ্রু কুঁচকে নীলের দিলে এগিয়ে গিয়ে দেখলো নীলের বা হাত অনেকখানি ছিলে গিয়েছে।

–নীল! কেমন করে হলো এসব?

–ত..তুই?

–হ্যাঁ আমি। তোর হাত এভাবে কাট’লো কিভাবে?

–ও কিছু না সামান্য এক্সি’ডেন্ট।

–এ’ক্সি’ডেন্ট? কিভাবে করলি?
নীল আমতা আমতা করে বললো,
–আসলে ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছিলাম। তখনই হয়েছে এক্সি’ডে’ন্ট।

–তুই জানিস না ড্রাইভ করার সময় বা রাস্তা পার হওয়ার সময় ফোনে কথা বলা ঠিক না। তাহলে তুই কেন করলি এমন? দেখেছিস কত খানি কে’টে গিয়েছে। ইশশ কি অবস্থা হয়েছে হাতের।

–কই কি অবস্থা হয়েছে? অল্পই তো।

–এটা অল্প? আর কোথায় ব্যাথা পেয়েছিস দেখি। টি-শার্ট খোল।

নীল দুই হাত বুকের উপর আড়াআড়ি ভাবে রেখে বললো,
–ছিঃ কণ্ঠ তুই এমন? আমি কখনো ভাবি নাই তুই এমন আচরণ করবি আমার সাথে।

কণ্ঠ ভ্রু কুঁচকে তাকালো নীলের দিকে। সে আসলে বুঝার চেষ্টা করছে সে কেমন।
–কেমন আমি?

–তুই অতন্ত্য লুষু মনের একজন মহিলা।

কণ্ঠ এবার বোকার মতো তাকালো।
–আমার মতন একটা অবলা নিরিহ নিষ্পাপ ছেলেকে একা পেয় তুই আমার সুযোগ নিতে চাচ্ছিস?

কণ্ঠ নীলের কথা কটমট দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। নীল একটা মেকি হাসি দিলো। পুরুষ মানুষ যতই শক্তিশালী হোক না কেন সে তিনটা নারীর কাছে চিরকাল পরাজিত। মা, বউ, আর মেয়ে।
কণ্ঠ নীলের পুরো বডি সচেতন চোখে পরখ করে নিলো আর কোথাও ব্যাথা ট্যাথা পেয়ছে কি না। তারপর হাতের ক্ষ’তস্থান সেভলন দিয়ে পরিষ্কার করে সুন্দর করে বেন্ডেজ করে দিলো।
–আমি খাবার আনছি। খাবর খেয়ে মেডিসিন খেয়ে নিবি। আর একটা বাড়তি কথা যদি বলিস মা’ইর একটাও মাটিতে পড়বে না এই আমি বলে দিলাম।
নীল আর কোনো ত্যাড়ামি না করে সুন্দর করে খাবার খেয়ে নিলো। সাথে ঔষধও। যেহেতু সে বেশি ব্যাথা পায় নি তাই চিন্তারও তেমন কিছু নেই। দুই দিনে ক্ষ’ত শুকিয়ে যাবে।

সাতদিন পর….
দেখতে দেখতে চলে গেলো সাত দিন। এই সাত দিনে নীল কণ্ঠকে জ্বা’লিয়ে’ছে প্রচুর। নীল আর কণ্ঠের সম্পর্কও স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। এর সম্পূর্ণ ক্রেডিট অবশ্য নীলের। সে-ই তাদের সম্পর্কটাকে নতুন একটা পরিচয় দিয়েছে। এখন তাদের মধ্যে সব ঠিকঠাক। কিন্তু কেউ কাউকে তুমি বলে সম্মোধন করতে পারে না। তবে তারা চেষ্টা করছে। এত দিনের অভ্যাস কি আর সাত দিনে যায়?

রাফাতকে আজ হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে। সে এখন সুস্থ তবে দূর্বলতা আছে কিছু। ডাক্তার বলেছে প্যারা’লাইজড থাকার কারণেই এই দূর্বলতা। তবে তা প্রখর নয়। কণ্ঠ অফিসে আসার পথে রাফাতকে দেখে এসেছে। আর শৈবালকে বলে দিয়েছে রাফাতকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে। আর রাফাতের যেন কোনো অসুবিধা না হয় তা এনশিউর করতে।

কণ্ঠ নিজের কেবিনে বসে ল্যাবটপে কাজ করছে। তখন হন্তদন্ত হয়ে তার কেবিনে রিশা প্রবেশ করলো।
–ম্যাম..

–একি রিশা? তুমি হাঁপাচ্ছো কেন? কি হয়েছে?

–ম্যাম নীরা….

–নীরা? কি হয়েছে নীরার?

–ম্যাম নীরা পালিয়ে গেছে।

কণ্ঠ কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ রইলো। অতঃপর রিশাকে বললো নিজের কেবিনে যেতে। রিশাও কোনো কথা না বলে চলে গেলো। কারণ এখন হয়তো কণ্ঠের মাথা গরম হয়ে যাবে। আর হিং’স্র বাঘিনীর সামনে যত কম আসা যায় ততই মঙ্গল। রিশা চলে যাওয়ার মিনিট দুয়েক বাদে কণ্ঠের ফোনে কল আসলো। কণ্ঠ ফোনটা কানে ধরে কয়েকটা জোরে নিঃশ্বাস নিলো। অতঃপর বিনা বাক্যে ফোনটা কেটে দিলো। ল্যাবটপটা শাট ডাউন করে কণ্ঠ অফিস থেকে বেরিয়ে আসলো। আজকে সে নিজের মাকে অনেক মিস করছে। কণ্ঠ অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা মায়ের কবরের কাছে গেলো। মায়ের কবরের পাশে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে সে বাসায় চলে আসলো। কিছুই ভালো লাগছে না তার। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সেই সাথে ভয়। মূল্যবান কিছু হারানোর ভয়।

সন্ধ্যা তখনো হয়নি। কণ্ঠ উদাস মনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। যদিও তার মতন শক্ত মেয়ের উদাসীনতা মানায় না তবুও আজ সে উদাস! তার দৃষ্টি বিশাল আকাশে। আকাশে মেঘ জমেছে। সেই সাথে মেঘ জমেছে তার মনেও।
কণ্ঠ যখন উদাস চিত্তে মেঘলা আকাশ দেখতে ব্যস্ত তখন গেইট দিয়ে প্রবেশ করে নীলের গাড়ি। চুল আর শার্ট এলোমেলো হয়ে আছে। শার্টের এক হাতা কনুই অবদি গোটানো আরেক হাতা কবজি পর্যন্ত আছে।

নীল রুমে এসে দেখলো কণ্ঠ রুমে নেই। সে চেচিয়ে কণ্ঠকে ডাকলো। কণ্ঠ ছোট ছোট কদম ফেলে রুমে আসলো। নীলের চোখ দুটো অস্বাভাবিক লাল হয়ে আছে। কণ্ঠ আলতো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
–নীল? তুই কি রেগে আছিস?

নীল এবার কণ্ঠের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
–না সমস্যা নাই তুই রাগ কর। রাগ কি আমার বাপ দাদার সম্পত্তি নাকি সে তুই হতে পারবি না।

নীল ফোঁস ফোঁস করে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেললো।
–আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে আয়।

–কিন্তু তুই তো চা..

কণ্ঠকে কিছু বলতে না নিয়ে নীল খুব জোরে কণ্ঠের নাকে কামড় বসালো। কিয়ৎক্ষণ ছেড়ে দিলো।
–কি করলি তুই? আমার নাকে কেন কামড় দিলি?

–চা নিয়ে আয়। তারপর বলছি।
কণ্ঠ কোনো কথা না রান্না ঘরে চলে যায়। মিনিট দুয়েক বাদে সে চা নিয়ে ফিরে আসে। নীল ততক্ষণে চেঞ্জ করে নিয়েছে। কণ্ঠ চায়ের কাপটা এসে ঠাস করে সেন্টার টেবিলে রাখলো। নীল ভ্রু কুঁচকে তাকালো কণ্ঠের দিকে। সেন্টার টেবিল থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে তাতে চুমুক দিয়ে বললে,
–জানিস আজ আমার অফিসে নীরা না কিরা যে ওটা এসেছিলো

–ইট’স নীরা!

–তো আমার শ্বশুরের কি। জানিস ওই বেয়া”দব মেয়ে কি বলে?

কন্ঠের ভয় এবার গাঢ় হলো। তাহলে কি তার আর নীলের সম্পর্কের সমাপ্তি এখানেই? কণ্ঠ ভয়ে ভয়ে নীলকে জিজ্ঞেস করলো,
–কি বলে?

–বলে বিয়ের দিন তুই নাকি ওকে কিড’ন্যাপ করেছিলিস। আর এতদিন নাকি ও তোর এখানে বন্দী ছিলো।

–তা তুই কি বললি?

–বলি নি শুধু করেওছি।

–কি করেছিস?

–ঠা’ডিয়ে দুটো থাপ্প’ড় দিয়েছি ওই বেয়াদ’বটাকে।
কণ্ঠ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–মা’রলি কেন ওকে?

–আদর করার কথা ছিলো নাকি? আরো তো দুটো দিতে ইচ্ছে করছিলো। বে’য়াদব মেয়ে মানুষ একটা। আসছে আমার সুখের সংসারে আগুন লাগাতে।
কণ্ঠ নীলকে দেখছে। সে এক মনে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে আর নীরাকে বকছে। কণ্ঠ ভেবেছিলো নীলকে সব সত্যিটা বলে দেবে। কিন্তু এখন সে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলো। থাকুক না কিছু কথা আজানা। কিছু কথা গোপনে রেখে যদি জীবনে ভালো থাকা যায় সুখে থাকা যায় তাহলে তা গোপনে থাকাই শ্রেয়।

দুইদিন পর
কণ্ঠ আর নীল ছাঁদে বসে তারা দেখছে। কণ্ঠ নীলের কাঁধে মাথা দিয়ে রেখেছে। নীল এটা ওটা বলছে আর কণ্ঠ মন দিয়ে তা শুনছে। এমন সময় টুং করে কণ্ঠের ফোনে এসএমএস আসলো। কণ্ঠ দেখলে শৈবালের নম্বর থেকে এসএমএস। শৈবাল বলেছে নীরাকে ফ্লাইটে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাতার যেতেই তার পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হবে। কণ্ঠ যখন বলবে নীরার পাসপোর্ট তখন তাকে দেওয়া হবে। আর তখনই সে দেশে আসতে পারবে। নীরার দেশ ছাড়ার খবর পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কণ্ঠ। এই মেয়ে একেবারে ঝেঁকে বসেছিলো ঘাড়ের উপর। এখন সব শান্তি।

🍁
জীবনের খাতা থেকে কেটে গেলো অনেকগুলো দিন অনেকগুলো বছর। অনেক কিছু পাল্টেছে। হয়েছে যোজন বিয়োজন।
এক বিকেল বেলায় নীল আর কণ্ঠ বাগানে বসে গল্প করছে। এমন সময় তাদের দিকে দৌড়ে এলো পাঁচ বছর বয়সী একটা বাচ্চা মেয়ে। দৌড় দেওয়ার সময় তার ঝুঁটির চুলগুলো কি সুন্দর হাওয়ায় দুলছিলো।
–মা এভাবে দৌড়ে কেন আসলে? যদি পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেতে?

–আমি অনেক স্ট্রং গার্ল। আর স্ট্রং গার্লরা কখনো ব্যাথা পায় না।

–আচ্ছা। তা দৌড়াচ্ছিলে কেন?

বাচ্চাটি চোখের সামনের ছোট ছোট চুল গুলো পেছনে সরিয়ে দিয়ে বললো,
–আমি আয়ানের মাথা ফাটিয়ে দিয়ে এসেছি।
মেয়ের কথায় নীল ❝কিহ্!❞ বলে দাঁড়িয়ে পড়লো।
–তুমি আবারো এমন করেছো? বাবা তোমাকে মানা করেছি না এমন করতে?

–আমার কি দোষ? ও আমার চুলে টান দেয় কেন?

–চুলে টান দেয় বলে তুমি ওর মাথা ফাটিয়ে দিবা?

–ওর এত বড় সাহস ও ফুলের চুল ধরে টানে! ওর তো ভাগ্য ভালো যে ওর মাথাটা কেটে ফেলিনি।
বলেই হনহন করে বাচ্চাটি বাড়ির ভেতরে চলে গেলো।
অপরদিকে নীল মেয়ের যাওয়ার দিকে অসহায়ের মতন তাকিয়ে আছে। সামান্য চুল ধরে টান দেওয়ার অপরাধে এক নিরিহ নিষ্পাপ ছেলের মাথা ফাটিয়ে দিয়ে আসলে তার আদরে বা’দঁরে পরিনত হওয়া একমাত্র মেয়ে। এই মেয়ে একদম মায়ের স্বভাব পেয়েছে। কথায় কথায় রেগে যায়। আর শুধু মা’রা’মারি করে। নীল একবার কণ্ঠের দিকে তাকালো। সে আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে।
মা আর মেয়ে মিলে তার জীবনটা তেজপাতা সমতুল্য করে দিলো একেবারে। এর মাঝেই কণ্ঠ বললো,
–আমার দিকে তাকিয়ে না থেকে মেয়ের অভিমান ভাঙাও গিয়ে। নইলে আজ আর তোমার রক্ষে নেই। আমি তো তোমাকে ছাড় দেই কিন্তু মেয়ে আমার ছাড় দেওয়ার পাত্রী নয়।
কণ্ঠের কথায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীল চললো মেয়ের অভিমান ভাঙাতে। মেয়েটা তার অনেক অভিমানী। একটু কিছু হলেই বাবার উপর তার রাজ্যের অভিমান!

নীল নিজের পরিবার নিয়ে সুখে আছে। সুখে আছে রাফাত আর নীরাও। সকলে সুখে থাকুক এই কামনা করে আমাদের নীল-কণ্ঠের পরিসমাপ্তি।
~~সমাপ্ত~~