তোমার আমার চুপকথা পর্ব-০২

0
292

#তোমার_আমার_চুপকথা
#২য়_পর্ব

“আপনি বরং কাল সকলকে বলে দিবেন আমার সাথে আপনার ব্রেকআপ হয়ে গেছে। একেবারে কঠিন ব্রেকআপ যাকে বলে, কারণ হিসেবে আমার উপর-ই দোষ চাপিয়ে দিয়েন। আমি প্রতারক, ঠগ, টক্সিক ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার আপত্তি নেই। আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে আমিও দুঃখী দুঃখী মুখে বলবো, “আমার পক্ষে উনাকে ভালোবাসা সম্ভব হচ্ছিলো না৷ কারণ আমি আমার পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে পারবো না”৷ ঠিক আছে রাইয়ান সাহেব?”

আত্মিকার কথায় হতভম্বের মতো চাইলো রাইয়ান। কয়েকপলের জন্য মস্তিষ্ক যেনো শূন হয়ে গেলো। বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আত্মিকার শ্বেত মুখশ্রীর পানে। কন্ঠ যেনো আটকে আসছে। খুব বড় একটা ধাক্কা লাগলো যেনো তার। নিজেকে অতি কষ্টে সামলালো। উদগ্রীব স্বরে বললো,
“মানে?”
“আমি কি হিব্রু ভাষা ব্যাবহার করলাম? বাংলাতেই তো বললাম”
“সেটা নয়, কিন্তু এতো বড় সিদ্ধান্তের কারণটি কি?”

রাইয়ানকে খুব বিভ্রান্ত দেখালো। সে বাহিরে যেমন ই হোক ভার্সিটির সীমানার ভেতরে ভীষণ গুছানো মানুষ। একটা আলাদা ভাব তার চালচলন, বচনভঙ্গিতে। নিজের গাম্ভীর্য প্রকাশে চশমাটিও সে ভার্সিটিতে পরে। এতে নাকি বেশ ভাব গুরুগম্ভীর ব্যাপার আসে। কিন্তু আজ তার সেই বানোয়াট গাম্ভীর্য, গোছানো ব্যাক্তিত্বের মুখোশটি যেনো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তাকে প্রচন্ড অস্থির এবং দিশাহীন দেখাচ্ছে। অথচ এমনটা হবার ই কথা নয়। তাকে দেখে যে কেউ বলবে সত্যি সত্যি তার প্রিয়তমার সাথে তার বিচ্ছেদ হচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটি মোটেই এমন নয়। আর “বড় সিদ্ধান্ত”— নামক শব্দটি এখানে মোটেই খাটে না। আত্মিকা অবাক স্বরে বললো,
“রাইয়ান সাহেব আপনি উত্তেজিত কেনো হচ্ছেন?”
“উত্তেজিত হবার মতো কি ঘটনা নয়? আপনি এমন একটা সিদ্ধান্ত একা একা নিতে পারেন না”
“এখানে একসাথে সিদ্ধান্ত নেবার মতোও কিছু হয় নি। একটা মিথ্যের ইতি টানতে নিশ্চয়ই গোলমিটিং বৈঠক ডাকবো না আমি”

আত্মিকার কন্ঠ যতটা শান্ত, রাইয়ানের অবস্থা ততটাই অশান্ত। সে রীতিমত অস্থির হয়ে উঠেছে। দুই হাত ঘষছে। ঘাড় ঘষছে, বারবার রুক্ষ, শুষ্ক ফাঁটা ঠোঁট জিহ্বা দিয়ে ভেজাচ্ছে। খুবই উত্তেজনার স্বীকার সে। নিজেকে অতিকষ্টে শান্ত করে শুধালো,
“কিন্তু কারণটা কি? আমি তো আপনার সাথে কখনোই খারাপ ব্যাবহার করি নি”
“কারণটা আপনি নন, আবার কোথাও না কোথাও আপনি-ই। আমি ক্লান্ত মুলত। মিথ্যের জের টানতে আমি ক্লান্ত। আপনার শুভাকাঙ্খীদের প্রশ্নের বানে আমি ঝাঝরা। উপরন্তু আপনার প্রতি মোহগ্রস্থ মানুষের সংখ্যা তো কম নয়। আসতে যেতে নিজের সামর্থ্য ব্যাখ্যা করতে করতে আমি ক্লান্ত, শ্রান্ত, বিরক্ত। এতো প্রশ্নের সম্মুখীন হব জানলে আমি এই সম্পর্কে পা-ই রাখতাম না। এই দুদিন আগের কথা। আপনার একজন শুভাকাঙ্খী আমাকে ফোন করে কি কান্না, আমি কেনো আপনার প্রেমিকা এইটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমি পারছি না রাইয়ান সাহেব। আমি আপনার মতো এতো মানুষের দৃষ্টির মধ্যমনি হতে চাই না। আমার এতো ভীড় পছন্দ না, এতো গুলো চোখ আমাকে প্রতিনিয়ত তাদের বিচ্ছিরি মাপদন্ড দিয়ে মাপবে ভাবতেই আমার বিরক্ত লাগে”
“কে ফোন করেছে, নাম বলুন তার। আমি কথা বলবো তার সাথে”

রাইয়ানের অটপটে প্রশ্নে বেকুব হয়ে গেলো আত্মিকা। খেই হারিয়ে ফেললো কথার। বিরক্ত স্বরে বললো,
“এখন কি আপনি তাদের ফোন করে করে কথা বলবেন, কি বলবেন? র‍্যা’গ দিবেন? অদ্ভুত”
“এছাড়া আমি কি করবো? আপনি আমার সাথে সম্পর্ক ভাঙ্গতে চাচ্ছেন”
“নকল সম্পর্ক”
“আপনার কাছে সেটা নকল হতে পারে আত্মিকা, আমার কাছে নয়। বেশ, আপনার নকল সম্পর্ক চাই না। দরকার নেই, সত্যি সত্যি আমার প্রেমিকা হয়ে যান”

আত্মিকার বিস্ময় আকাশ ছুলো, ছেলেটি কি সত্যি পাগল। আত্মিকা কিছু বলার আগেই খপ করে তার হাতজোড়া নিজের হাতের মাঝে নিলো রাইয়ান। প্রগাঢ় স্বরে কাতর কন্ঠে বললো,
“আত্মিকা, আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। ট্রাস্ট মি, আপনি কখনো আফসোস করবেন না, কারণ আমি সেই সুযোগ আপনাকে দিবো না”

আত্মিকা বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রাইয়ানের দিকে। এতোটা মরিয়া তাকে এর পূর্বে কখনো দেখেছে কি না মনে পড়ছে না তার। রীতিমতো তার হাত কাঁপছে। কন্ঠ জড়িয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত হারানোর ভয় ছলকাচ্ছে। মুহূর্তের জন্য খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো আত্মিকা। হাতখানা আস্তে করে ছাড়িয়ে নিলো। মাটির দিকে তাকিয়ে বললো,
“কিন্তু আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না”
“কেনো? আমাকে ভালোবাসা যায় না?”

রাইয়ানের প্রশ্নের উত্তর নেই আত্মিকার কাছে। খুব অধৈর্য্য হয়ে বলল,
“আচ্ছা, আপনি বুঝতে কেনো চাইছেন না বলুন তো? আপনি খুব ভালো একজন মানুষ। হ্যা, প্রথমে আপনাকে আমার বিরক্ত লাগতো। এখন লাগে না। ভালোও লাগে। কিন্তু সেটাকে ভালোবাসা বলে না। আমার প্রতি আপনার যে অনুভূতি সেটাও ভালোবাসা নয়, ইনফ্যাচুয়েশন, ফ্লিং”

আত্মিকার কথায় চোয়াল শক্ত হলো রাইয়ানের। শক্ত কণ্ঠে বললো,
“আপনি কি করে জানেন?”
“কি জানেন আপনি আমার সম্পর্কে?”
“আপনার পছন্দের রঙ নীল, আপনার একাকীত্ব ভালো লাগে। কফি খেতে গেলে তিতোভাবের জন্য নাক শিটকান। চা দিনে অন্তত পাঁচ কাপ খান। সকালে উঠলে আপনার ব্রেইন ফ্রিজ হয়ে থাকে। তখন আপনি বারান্দাতে দাঁড়িয়ে থাকেন, আপনার মেঘলা আকাশ পছন্দ। কিন্তু বৃষ্টির সময় বের হতে নাক শিটকান। বৃষ্টির পানি সহ্য হয় না। ঠান্ডার বাতিক আছে। কিন্তু বৃষ্টির দিনে বারান্দায় এককাপ ধোঁয়া তোলা চায়ের সাথে হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস পড়তে ভালো লাগে আপনার। আপনার প্রিয় উপন্যাস “রুপা”। বোনদের মাঝে আপনি ই সবচেয়ে শান্ত। কিন্তু সবচেয়ে বেশী নাক উচু। মানুষের ভীড় থেকে একশ হাত দূরে পালান। অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটলে আপনার ভালো লাগে না। কিন্তু সেই অনাকাঙ্খিত জিনিসটি যদি আপনাকে মুগ্ধ করে তাহলে আপনার ওই গালদুটো লাল হয়ে যায়। মানুষের সাথে আপনি কথা বলতে পছন্দ এজন্য করেন না কারণ আপনাকে কথা হাতড়াতে হয়। তাই এড়িয়ে চলেন সবাইকে। আমাকেও একারণেই প্রথমদিকে বিরক্ত লাগতো। কারণ আমি অনেক বেশী কথা বলি, যার বিপরীতে কি বলবেন আপনি খুজে পান না। তবুও বলবেন আত্মিকা আমি আপনাকে জানি না?”

আত্মিকা চুপ করে রইলো। রাইয়ানের জেদের কাছে আজ যেন পরাজিত লাগছে নিজেকে। রাইয়ান এবার একটু কাছে এলো। খুব আলতো করে ছুঁলো আত্মিকার গাল। খুব আস্তে বললো,
“আমি আপনার সম্পর্কে জানি আত্মিকা, আরোও জানতে চাই। আপনার চুপকথাগুলো পড়তে চাই। আমি আগেও বলেছি, হ্যা, আমার ভালোবাসার সংজ্ঞা আপনার ভালবাসার সংজ্ঞা থেকে আলাদা। কিন্তু সেটা আমার জন্য এভারেস্ট জয়ের মতো আনন্দের অনুভূতি”
“আপনি অনেক অসাধারণ ব্যাক্তিত্ব রাইয়ান। অসাধারণ ব্যাক্তিত্বদের দূর থেকে দেখতে হয়। ছুঁতে গেলেই ঝলসে যেতে হয়। আমি খুব সাধারণ, আমি আপনার ওই বিশাল মোহগ্রস্থ মানুষের স্রোত পার করতে পারবো না”
“এখানে আমার কি দোষ। কেউ আমাকে ভালোবাসলে তো আমার কোনো দায়বদ্ধতা নেই”
“হ্যা, সেটাই আপনাকে বুঝাতে চাচ্ছি। কেউ আমাকে ভালোবাসলে আমার কোনো দায়বদ্ধতা নেই”

রাইয়ান থমকে গেলো। স্তব্ধ হয়ে গেলো মুহূর্তের জন্য। হাত সরিয়ে নিলো সে। চোয়াল কঠিন হলো। শানিত স্বরে বলল,
“আপনি যেতে পারেন”

আত্মিকা দাঁড়ালো না। ছোট্ট একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। এতোদিন সে এটাই চাইতো, মুক্তি চাইতো এই মিথ্যের থেকে। কিন্তু কেনো বুকটা ফাঁকা লাগছে। কেনো মনে হচ্ছে, কিছু একটা যেনো হারিয়ে ফেললো। খুব দূর্বল অংশতে শূন্যতা ছেয়ে গেলো যেন হৃদয়ের। মাঠের পাশ থেকে হাটছিলো তখন ই একটি কণ্ঠস্বর কানে এলো,
“আত্মিকা কেমন আছো?”

পিছনে ফিরতেই চোখ ছোটছোট হয়ে গেলো তার। এই মানুষটি। কেবলমাত্র এই মানুষটির জন্যই সব কিছু হয়েছে। ইসমাইল ভাই, ভার্সিটির সবচেয়ে বিরক্তিকর মানুষ। সে প্রেমে পড়ে না এমন মেয়ে বোধহয় এখনো তৈরি হয় নি। সব মেয়েরাই তার চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হয়। এই মানুষটিকে এড়াতেই এক স্বচ্ছ বিকেলে মিথ্যে বলেছিলো রাইয়ান। সেই মিথ্যেকে আগুনের গোলার মতো ছড়িয়ে দিয়েছে এই মহাশয়। তার হাস্যজ্জ্বল মুখখানা দেখলেই গা জ্বলে উঠে যেনো আত্মিকার। কিন্তু এখন কিছুই করা যাবে না। কারণ তাদের চোখাচোখি হয়েছে। ইসমাইল সামনে দাঁড়াতেই মেকি হাসি মুখে ঝুলালো সে,
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। কিছু বলবেন ইসমাইল ভাই?”
“নাহ, তোমার সাথে অনেক দিন কথা হয় না তাই ডাকলাম”
“ওহ, তাহলে আমি এখন যাই? আমার একটু কাজ আছে”
“প্রোগ্রামে থাকবে না? জেনারেল সেক্রেটারির গার্লফ্রেন্ড তুমি?”
“কোনো বাধ্যবাধকতা আছে?”

আত্মিকার প্রশ্নে ভেবাচেকা খেলো ইসমাইল। কথা খুজে পেলো না যেনো। আত্মিকা খুব শান্ত স্বরে বলল,
“আসলে আমার কাজ আছে তো, তাই আজ থাকতে পারছি না। আসি কেমন?”

বলেই হাটা শুরু করলো সে। অপেক্ষা করলো না ইসমাইলের উত্তরের জন্য। ইসমাইল বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আত্মিকার যাবার পানে।

রাইয়ান এখনো আগের স্থানেই দাঁড়িয়ে আছে। মাথা যেনো ফেটে যাচ্ছে তার। খুব বিরক্ত লাগছে এই ধরণী। সব তছনছ করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটি কেনো বুঝে না তাকে! কেনো বুঝে না, সে পাগল হয়ে যাবে এই তীব্র, বেসামাল অনুভূতির জোয়ারে। তার অনুরাগ যে ফেলনা নয়।
“রাইয়ান, একটু লাইটের ভাইকে ফোন দে”

পারভেজের কথা যেনো কর্নপাত ই হলো না রাইয়ানের। সে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। পারভেজ কাছে এসে গায়ে ধাক্কা দিয়েই ঘোর কাটলো, বাস্তবে ফিরলো রাইয়ান। বিভ্রম কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে?”
“কখন থেকে বলছি, শুনিস নি নাকি? লাইটের ভাইকে ফোন দে। চেক করতে হবে”
“আমি বাড়ি যাচ্ছি। তোরা সামলে নে”
“মানে কি?”
“হিব্রু ভাষায় বললাম নাকি?”

পারভেজ অবাক হলো। রাইয়ান এমন বেখেয়ালি স্বভাবের নয়। কিন্তু আজ কি হয়েছে? অবাক স্বরে বলল,
“তুই গেলে গা অনুষ্ঠান উঠবে কি করে?”
“আমি কি করে বলবো তা?”
“মানে কি? এটা তোর দায়িত্ব”
“আমার একার দায়িত্ব? আর নেই মানুষ? ভাব এমন যেনো আমি ছাড়া ক্লাব অচল। হলে হবে। বন্ধ করে দে কাজ। আমার কিছু করার নেই”

বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো সে। পারভেজ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো। দায়িত্ববান ছেলেটিকে এমন বিভ্রান্ত, দিশাহীন কেনো লাগছে?

*******

সন্ধ্যের গন্ধ এখনো মিলিয়ে যায় নি। আযানের ধ্বনি এখনো গুঞ্জছে প্রকৃতিতে। শহরের ব্যস্ততা একটু রয়ে সয়ে এসেছে। ঘরের পরিবেশ উৎসব মুখর আরশিয়া বিরিয়ানি রান্না করেছিলো দুপুরে। কিন্তু তা খেতে যায় নি রাইয়ান। তাই নিজ হাতেই এসেছে সে বিরিয়ানি নিয়ে। রাইয়ানের মা রেহানা বেগমকে শুধালো,
“রাইয়ান কোথায় চাচী?”
“দেখো না কলেজ থেকে হুমড়ি তুমড়ি করে এসেই ঘর আটকে বসে আছে। খায় নি এখনো”

রেহানা বেগমের কথা শুনে কিছুটা চিন্তিত হলো আরশিয়া। ভাবুক স্বরে বললো,
“আমি দেখছি”

রাইয়ানের ঘরে তিনবার কড়া নাড়লো আরশিয়া। চারবারের মাথায় অবশেষে মহাশয় দরজা খুললো। কিন্তু দরজা খুলতেই চোখ কপালে উঠলো আরশিয়ার………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি