তোমার আমার চুপকথা পর্ব-০৩

0
272

#তোমার_আমার_চুপকথা
#৩য়_পর্ব

রাইয়ানের ঘরে তিনবার কড়া নাড়লো আরশিয়া। চারবারের মাথায় অবশেষে মহাশয় দরজা খুললো। কিন্তু দরজা খুলতেই চোখ কপালে উঠলো আরশিয়ার। এটা ঘর নাকি সিগারেটের গুদাম বুঝে উঠতে পারছে না। সেই সাথে বিধ্বস্ত রাইয়ানকে দেখে আরোও হতভম্ব হলো সে। বিভ্রান্ত স্বরে বললো,
“এ কি অবস্থা?”

ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই কাশি উঠলো আরশিয়ার। পুরোঘর ঘন সাদা ধোঁয়ায় ডুবে আছে। নিকোটিন পোঁড়ার ঝাঁজে গলা জ্বলছে আরশিয়ার। সরু চোখে রাইয়ানের দিকে চাইলে সে হাত দিয়ে ধোঁয়া তাড়ানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু তাতে আরশিয়ার ভ্রু দ্বিগুন কুঞ্চিত হলো। কড়া স্বরে বললো,
“হাত দিয়ে পি.টি না করে দরজা জানালাগুলো খুলো। ঘর তো নয় সিগারেটের আরদ বানিয়ে রেখেছো। সাংবাদিক ঠিক বলে, ইউ আর টু মাচ। সে তো আমাকে আসতেই দিচ্ছিলো না, এক কথা, “কোন দেশের হনু হয়েছে যে তাকে নিজে যেচে এসে বিরিয়ানি খাওয়াতে হবে। সে ম’রু’ক গে”। আমি বিরোধিতা করলাম, আমার একমাত্র দেবর। হোক চাচাতো, দেবর তো। ম’র’বে কেনো। আগে যদি জানতাম তুমি এখানে ঘরে আগুন ধরানোর প্রকল্প করছো, আমি মোটেই আসতাম না। রীতিমত দমকল ডাকার পরিস্থিতি করে রেখেছো”

আরশিয়ার কড়া স্বরে নতমস্তক হয়ে গেলো রাইয়ানের। ধীর স্বরে বললো,
“সরি”

তারপর দ্রুতগতিতে জানালার, বারান্দার গ্লাস খুললো সে। আরশিয়া বসলো বিছানায়। তার সরু চোখ দেখছে রাইয়ানকে। ছেলেটিকে বিয়ের পর অবধি খুব নিখুতভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে সে। পুরুষ হিসেবে নিতান্ত পরিপাটি সে। খুব গুছিয়ে কথা বলে, হাস্যরসে ভরপুর ব্যাক্তিত্ব। কিন্তু আজ যেন তার মাঝে সব কিছুই গোলমেলে। আরশিয়া পা গুটিয়ে বসতে বসতে বললো,
“ঘটনা কি রাইয়ান? আজ এমন দেবদাস দশা কেনো তোমার?”

আরশিয়ার হঠাৎ প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো যেনো রাইয়ান। খানিকটা ভ্যাবাচেকাও খেলো সে। আমতা আমতা করে বললো,
“না না, ভাবি। তুমি ভুল বুঝছো”
“তোমার মতো ছাত্রদের প্রতিদিন পড়াই। তাদের মুখ দেখেই অনুমান করতে পারি তাদের মনে কি চলছে! এখন বলো না, তুমি এক্সপেরিমেন্ট করছিলে। সিগারেটের ধোঁয়া দিয়ে কিভাবে ঘর জ্বা’লা’নো যায়?”

রাইয়ান চুপ করে রইলো। আরশিয়া তার মৌনতা নিপুনভাবে পর্যবেক্ষণ করলো। তারপর ঠাট্টার স্বরে বলল,
“আমাকে বলতে পারো। আমি তোমার থেকে বয়সে অনেক বড় হতে পারি কিন্তু এসব ব্যাপারে বেশ কুল। তোমার ভাইয়ের মতো নই। তাই নিঃসন্দেহে আমাকে বলতে পারো। আমি কিন্তু সমাধান দিতে পারি”

রাইয়ান তখন মৌন। জিহ্বা দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভিজালো। দ্বিধাগ্রস্থ দেখালো তাকে। দৃষ্টি বিক্ষিপ্ত তার। আরশিয়া এবার উঠতে উঠতে বলল,
“না বলো, আপত্তি নেই। টেবিলে বিরিয়ানি রেখে এসেছি, খেয়ে নিও”

আরশিয়া যাবার জন্য তৎপর হলে, রাইয়ান বলে উঠলো,
“তোমাকে বললে তুমি কিছু মনে করবে না তো?”

রাইয়ানের কথায় বাঁকা হাসলো আরশিয়া। বুকে হাত বেধে বললো,
“বলে ফেলো ঘটনা কি”

রাইয়ান একটু সময় নিলো। কথা গুছালো। চোখে মুখে উদ্বিগ্নতা। খুব ধীর স্বরে বললো,
“আমি না প্রেমে পড়েছি। কঠিন প্রেম।“
“লোহার মতো শক্ত?”
“বলতে পারো। লোহার চেয়েও কঠিন কিছু থাকলে তাই। আসলে মেয়েটিকে প্রথম একটি অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম। সেই থেকেই এক অব্যক্ত ভালোলাগা কাজ করলো। মেয়েটি খুব হাসে না, খুব কথা বলে না। আমার থেকে একেবারেই বিপরীত। আমি যত ভীড় ভালোবাসি, সে তত ভীড় থেকে পালায়। একঘন্টায় আমার কথার বিপরীতে গুনে গুনে দশটা কথা বলার পর ই তার বিরক্ত ধরে। তবুও সেই মেয়ের প্রেমে পড়লাম। তার মাঝে কিছু একটা আছে জানো, যা আমাকে বিশ্রী ভাবে আকর্ষণ করে। আমার মনে হয় সে আমার মনের খোড়াক”
“তাহলে সমস্যাটি কি?”

রাইয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“সে আমাকে ভালোবাসে না। প্রথম যখন তাকে প্রেম নিবেদন করেছিলাম। খুব কাঠকাঠ গলায় আমাকে রিজেক্ট করে দিয়েছিলো। ভাগ্যের জোর ই বলতে পারো, ঘটনার প্রেক্ষিতে সে আমার গার্লফ্রেন্ড হয়ে গেলো। নকল গার্লফ্রেন্ড। ভাবলাম, এই সুযোগে বন্ধুত্ব তো হবে। তার কঠিন হৃদয় গলবে তো। কিন্তু গললো না। এখন সে আমার সাথে এই নকল সম্পর্ক রাখতে চায় না। আচ্ছা ভাবি, আমি কি ছেলে কি হিসেবে খারাপ? নাকি প্রেম করার জন্য অযোগ্য?”
“হুম, কঠিন সমস্যা দেখছি। আচ্ছা, নকল সম্পর্কটা আসল সম্পর্ক হয়ে গেলেই তো হলো”
“না, সে আমাকে ভালোবাসে না”
“তাহলে বলবো তুমি ডাহা ফেল। যেহেতু তোমরা একে অপরকে এতোদিন ধরে চিনো, তাহলে তোমার ভালোবাসাটা তার অনুভব করার কথা। যেহেতু তার স্বভাব খুব চাপা, সে হয়তো তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তুমিও নিজের ভালোবাসা অনুভব করাতেই পারো নি তাকে। নয়তো কোনো মেয়ে কেনো তোমাকে ভালোবাসবে না। মেয়েরা নিখুঁত ভালোবাসা দুর থেকে বুঝে ফেলে”
“কিন্তু আত্মিকা তো বুঝতেই চাচ্ছে না”

সাথে সাথেই জিভ কাটলো রাইয়ান। সে আত্মিকার কথাটা মোটেই বলতে চায় নি আরশিয়াকে। কিন্তু মুখ ফচকে বেরিয়ে পড়লো। আরশিয়া ভ্রু উচালো। হতবাক স্বরে বললো,
“আত্মিকা?”
“সরি ভাবি”

আরশিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিজের বোনকে হাড়ে হাড়ে চিনে সে। খুব হতাশ গলায় বললো,
“তোমার জন্য এক বালতি সমবেদনা রইলো। পৃথিবীতে এতো মেয়ে থাকতেও সেই টোস্ট বিস্কুটের প্রেমে পড়লে! আহারে! এখন নিজে যেচে পড়ে কুয়োতে ঝাপ মা/র/লে আমার করার কিছু নেই। শুধু বলবো, “অল দ্যা বেস্ট””
“ভাবি এভাবে বলো না। আমি আত্মিকাকে খুব ভালোবাসি”
“লাভ নেই। আসলে এখানে আত্মিকাকে আমি দোষ দিবো না। ও ছেলেবেলা থেকেই খুব ঘরকনে, ইন্ট্রোভার্ট। সেই খোলশ ছেড়ে ক্লাস টেনে পড়াকালীন একটা ছেলের প্রেমে পড়েছিলো। ছেলেটি খুব সুন্দর ছিলো। তাকে বেশ সুন্দর সুন্দর প্রেমপত্র দিতো। কিন্তু পড়ে জানা গেলো, তার প্রেম কর্পুরের মতো। বায়ুতে মিলিয়ে যায়। এরপর থেকেই এই প্রেমে পড়া ব্যাপারটি তার অপছন্দ। তোমার মতো মানুষদের থেকে দু ক্রোশ দূর থাকে। আমি অবাক হচ্ছি, সে তোমার সাথে বন্ধুত্ব করেছে। দেখো অধ্যাবসায় করে, যদি কাজে দেয়”

আরশিয়া উঠে দাঁড়ালো। রাইয়ানের মুখ ভোঁতা হয়ে গেলো। তার প্রেম কি তবে ব্যর্থ হলো। আত্মিকার প্রেমে পড়ার পর থেকেই আত্মিকার রাজত্ব হৃদয়ে। ফলে কল্পনাও করতে পারছে না আত্মিকা ব্যাতীত জীবন। এখন আবার সিগারেট ধরাবে রাইয়ান। বুকের যন্ত্রণা নিকোটিনের ধোঁয়াতে উড়াবে।

সিড়িঘরে দেখা মিললো পৃথুলের। চোখ মুখে চিন্তার চাপ। আরশিয়াকে দেখতেই দ্রুতপায়ে কাছে এলো সে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,
“আপনি ফোন না নিয়ে কেনো নেমেছেন আরশিয়া। আমি আপনাকে হন্নে হয়ে খুঁজছিলাম। একটু জানিয়ে আসবেন তো। আপনি জানেন না, আমার চিন্তা হয়”
“সেটা দেখতেই পারছি”

অতি পরিচ্ছন্ন মানুষ বিনা জুতোতেই ছুটে এসেছে। পৃথুল ঘুমোচ্ছিলো সেই ফাকে আরশিয়া নিচে এসেছিলো। আরশিয়া হাসলো। পৃথুলের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
“চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন? বউ পালালো কিনা?”
“মশকরা করবেন না”
“চলুন চা খাবো, চা চলবে? নাকি গ্রীন টি লাগবে”
“আমার আপনাকে লাগবে”

বলেই আরশিয়াকে কাছে টেনে নিলো সে। আরশিয়া আশেপাশে দেখে বলল,
“এটা না সিড়িঘর”
“আপনি আমার বউ”
“সাংবাদিক হয়ে এতো নির্লজ্জতা?”
“বউ এর ক্ষেত্রে সব সই”

পৃথুলকে বাঁধা দিলো না আরশিয়া। মানুষটির এই ভালোবাসাগুলোই মুগ্ধ করে তাকে_____

********

রাত গহীন। তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘরের সবাই। শুধু নির্ঘুম চোখ আত্মিকার। বারবার ফোনের দিকে চেয়ে আছে সে। অজানা প্রতীক্ষা। প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা যেনো বাজে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই বাজে অভ্যাস ই আজ নির্ঘুম রেখেছে তাকে। আত্মিকা কিছুটা উদ্বিগ্নও। মিথ্যে বলবে না সে, রাইয়ানের জন্যই সে চিন্তিত। সন্ধ্যার দিকে পারভেজ ভাই ফোন করেছিলেন। তার অতর্কিত ফোন অবাক করলো আত্মিকাকে। ফোন রিসিভ করতেই পারভেজের প্রশ্ন ছুড়লো,
“আত্মিকা, তোমার আশেপাশে রাইয়ান আছে?”
“কেনো ভাইয়া?”
“আর বলো না, রাইয়ান দুপুরের দিকে রেগে মেগে চলে গিয়েছে। ফোন ধরছে না সেই থেকে। এদিকে প্রোগ্রামে আমার বারোটা বেজে যাচ্ছে। আমি কি পারি বলো এতো কিছু হ্যান্ডেল করতে? সব ম্যানেজমেন্টে আমরা রাইয়ানের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু সেই বান্দাই নেই। মানা যায়?”
“না ভাইয়া, উনি আমার সাথে নেই”

সেই থেকেই আত্মিকার চিন্তা। অনেকবার ফোনও হাতে নিয়েছিলো সে। ফোন করতে চেয়েছিলো অনেক বার। কিন্তু বারেবারেই ধারালো, নিষ্ঠুর মস্তিষ্ক বলে উঠে, ফোন দিচ্ছিস কেনো? তোর কে হয় সে? যা পারে করুক। সিগারেট খায় না নেশা করে তোর ভাবার কি দরকার? কিন্তু তবুও মনে উকি দিচ্ছে মানুষটির অতিরিক্ত সিগারেট টানার চিন্তা। আর না পেরে পানি খাবার জন্য খাবার ঘরে গেলো সে। অন্ধকারে হাতড়ে ফ্রিজ খুললো। পানি বের করার আগেই, তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে আনহা বললো,
“আজকাল ঠান্ডা পানিও খাওয়া শুরু করেছিস আপু?”

আনহার কণ্ঠ হৃদয় কাঁপিয়ে দিলো। ভুতের মতো এই অন্ধকারে বসেছিলো সে। আত্মিকা আতকে উঠলো। খুব কষ্টে হৃদয়ে চেপে রাখা ভয়টি দমিয়ে কর্কশ স্বরে বলল,
“এই ভুতের মতো ঘুরছিস কেনো?”
“আমি ঘুরছি নাকি তুমি ঘুরছো। রাত বাজে তিনটে, তুমি এখনো ঘুমাও নি। ব্যাপার কি আপু?”
“তুই ও তো ঘুমাস নি”
“আমি তো পড়ছিলাম”
“বই কই”

আনহা বত্রিশটা দাঁত বের করে হাসলো। সে মনে মনে পড়ে সেটা বলার প্রয়োজনীয়তা নেই। আত্মিকা কান মুললো তার। কঠিন স্বরে বলল,
“রুমে যা, ঘুমাবি এখন। যা”
“চোর পাহারা তুমি দিচ্ছো আর বকছো আমাকে। আমি তো পানি খেতে এসেছিলাম। তোমাকে ফ্রিজ খুলতে দেখে চিন্তা হলো। আমার যে বোন লেবুর শরবত খায় না, যে বোন ঠান্ডা পানি থেকে দশ কদম দূর থাকে সেই বোন আজ লেবুর শরবত বানাচ্ছে, ঠান্ডা পানি খাচ্ছে। তাই চিন্তা হলো”
“তোমার পাকনামি বন্ধ করো। যাও ঘুমাতে যাও”

আত্মিকার রামধমকে মিয়ে গেলো আনহা। ছুটলো নিজ ঘরে। আত্মিকা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ঠান্ডা পানির বোতলের দিকে। সত্যি সে বদলে গেছে নাকি এটা ঐ মানুষটির প্রভাব।

********

নীলাম্বরে তখন আসন্ন আশ্বিনা মেঘের পরদ। বাতাসে মিষ্টি শারদীয়া গন্ধ। কিন্তু বিষন্ন আত্মিকা। নির্ঘুম রাতে ক্লান্ত চোখ। নেত্রপল্লব ঝুঁকে আসছে ক্লান্তিতে। শ্রান্ত পা ক্লাসের দিকে এগুচ্ছে। পাশে বান্ধবী তাসনুভার বকবকানিও কর্ণকুহরে পৌছাচ্ছে না। কিন্তু পা আটতে গেলো একাডেমিক ভবনে পা রাখতেই। সামনের সৌম্য পুরুষটির গাঢ় চাহনী বিক্ষুদ্ধ করলো হৃদয়। তার রক্তিম চোখগুলো বলছিলো বিনিদ্র রাতের গল্প। অনেক প্রশ্ন জমা আত্মিকার। চোখাচোখি হতেই অধৈর্য্য আত্মিকা কিছু বলার প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু তাকে অবাক করে রাইয়ান পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আত্মিকা অবাক হলো। পাশ থেকে তাসনুভা প্রশ্ন ছুড়লো,
“তোদের মাঝে কি গন্ডগোল হলো কিছু? ঝগড়া?”

আত্মিকার বিশ্বাস হচ্ছে না। রাইয়ান সত্যি তাকে অদেখা করলো…………

চলবে