তোর নামের রোদ্দুর ২ পর্ব-১৫

0
591

#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ১৫

-ডুবে ডুবে জল খাও হুম?

রুমে টেনে এনে দরজা লাগিয়েই যীনাত আপু কথাটা বললো।কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম আমি।পরপরই আব্বুর চেহারাটা মনে পরতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমার।যীনাত আপু এগিয়ে এসে গলার পেন্ডেন্টটা ধরে বললো,

-মাশাল্লাহ্!ভাইয়ের আমার চয়েজ আছে বলতে হবে।

আমি একটু সরে দাড়ালাম।মাথায় আব্বুর চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।উনি ওভাবে কেনো বসে ছিলেন?যীনাত আপু সামনে দাড়িয়ে বললো,

-শুদ্ধর শ্যামাপাখির মুখ শ্যামলা না হয়ে কালো হয়ে আছে কেনো?আজ বুঝি অপেক্ষার রোদ্দুর শেষ হয়ে কালো মেঘের প্রেমের বর্ষন ছিলো?

-এখানে কি কি ঘটেছে আপু?

-ম্ মানে?

-মানে শেহনাজ মন্জিলে আজ…

-তোর আর শুদ্ধের ব্যাপারে নানুমনি সবাইকে সবটা বলেছে।

আতকে উঠলাম আমি।সবটা?আংটি পরানো সহ রেজেস্ট্রির সবটাই সবাইকে বলে দিয়েছে দীদুন?তবে তো আব্বু প্রচন্ডভাবে রেগে আছেন আমি নিশ্চিত।উনি চাননি বলেই এতোদিন কোনো কথা হয়নি।আজ শুদ্ধ ভাইয়ার জন্য সবটা সামনে এসে গেলো,তার উপর এই রেজেস্ট্রির বিষয়টা…এ নিয়ে আব্বু কোনোদিন ক্ষমা করবেন না শুদ্ধকে।আমি চিনি ওনাকে।এরপর কি হবে তবে?উফ্!আর ভাবতে পারছি না।মাথা ফেটে যাচ্ছে যেনো আমার।চুলগুলো উল্টে ধরে বেডে বসে পরলাম।যীনাত আপু বললো,

-ওমন করছিস কেনো তুই ইনসু?মানলাম আংটি পরানোর সময় কেউ তোর মতামত নেয়নি বলে তোর রাগ হয়েছিলো।এটাই স্বাভাবিক।কিন্তু এখন?এখন তো সবটা বদলেছে ইনসু।তুই তো জানিস শুদ্ধ কেমন পাগলের মতো ভালোবাসে তোকে।তাহলে এমন করছিস কেনো?তুই চাস না এই সম্পর্কটা এগোক?

অবিশ্বাসের পাহাড় নিয়ে ভ্রুকুচকে তাকালাম ওর দিকে।সম্পর্কটা এগোক মানে?

-এখন ওভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস?শোন ইনসু!এবার তোর মতামতের বাইরে কিছুই হবে না।আমরা সবাই আছি তোর সাথে।তুই যদি না চাস,এই সম্পর্কটা সত্যিই আর এগোবে না।তবে শুদ্ধকে হার্….

-জাস্ট আ মিনিট!স্ সম্পর্কটা এ্ এগোক মানে?

-লে!এই মেয়ে?তুই এই আংটি পরেই আজাদ ম্যানশন যাবি?সবাই যখন সবটা জেনেই গেছে,তাই তোকে আর শুদ্ধকে ইসলামী রীতিনীতি মেনে,অফিসিয়ালি বিয়ের বাধনে বেধে সেজোমামা সেজোমামী তাদের ঘরের বউমা করে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করেছে।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।হয়তো নানুভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকীর পরপরই।এমনটাই কথা হয়েছে আজ শেহনাজ মন্জিলে।দীদুনসহ সবাই মত দিয়েছে তোদের বিয়েতে।

মনের গহীনের সুখপায়রাগুলো যেনো ডানা ঝাপটে উঠলো।যা শুনলাম তা কি আদৌও সত্যিই শুনলাম আমি?এটা সত্যিই ঘটবে আমার জীবনে?বিশ্বাস হচ্ছে না।কিছুতেই না।কাপাকাপা গলায় বললাম,

-এ্ এসব ক্ কি বলছো তুমি যীনাত আপু?

-ঠিকই বলছি আমি।এতোক্ষন তো এই আলোচনায় হচ্ছিলো বাসায়।

-এতো তাড়াতাড়ি এসব…

-বলতেই পারিস,সেজোমামীর তর সইছে না।কে জানে,তার ছেলেটাও মনে মনে জ্বলছে,পুড়ছে।কারো নামের অপেক্ষার রোদ্দুরে।একটাই ছেলে কিনা তাদের!তাই….

মাথা নিচু করে নিলাম।এতো তাড়াতাড়ি,এভাবে সবটা হবে স্বপ্নেও অসম্ভব মনে হচ্ছিলো।আব্বুর কথা মনে পরলো আবারো।

-যীনাত আপু?আব্বু…

ও কিছুটা থেমে গেলো।জোর করে হেসে দিয়ে বললো,

-হ্যাঁ।কি?ছোটমামাও তো রাজি।আরে বাবা,মেয়ের বাবার অনুমতি ছাড়া মেয়ের বিয়ে হবে কিভাবে?আর তাছাড়াও,আংটি পরানোর সময় সেই তো প্রথম মত দিয়েছিলো তাইনা?

-কিন্তু আপু….

-কোনো কিন্তু পারোন্ত না!এখন শুধু তুই বল!বিয়েটা করবি?নাকি তাহমিনার আম্মুকে বলে…

আমি চোখ ছোটছোট করে তাকালাম ওর দিকে।আপু শব্দ করে হেসে দিয়ে বললো,

-আজ বুঝলাম,সেদিন কিভাবে তাহমিনার ওড়না ছিড়লো,চুল নষ্ট হলো,আর এ বাসায় কেনো ঢুকতে পারে নি!

মাথা আবারো নামিয়ে নিলাম আমি।আপু থুতনি উচু করে ধরে বললো,

-ওমা!এ যে লজ্জা পাচ্ছে!ইশ্ কি কিউট লাগছে তোকে ইনসু!গালদুটো অসম্ভব লাল হয়ে গেছে।মনে হচ্ছে সবেমাত্র কেউ তার হাফ ওয়াইফ উরফ এইচ ডব্লিউর গালে চুমো এটে দিয়ে গেছে।

অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে।ও জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে বললো,

-সরি,একচুয়ালি আমি আর ইমরোজ আগেই থেকেই জানতাম শুদ্ধ তোকে পছন্দ করে।আর বাদবাকি কাজিনসমাজ শুদ্ধর তোকে আংটি পরানোর কথাটা জানতো।সেদিন ইশান ভাইয়ার ওভাবে বলার পর দীদুন বলেছিলো আমাদের তোদের বিষয়ে।তোকে জানাতে বারন করেছিলো শুদ্ধ।এটাও বলেছিলো বড়দের কাউকে না জানাতে।ও নাকি ওর মতো করে সবাইকে সবটা জানাবে।তাই চুপ ছিলাম।

আসলে কি বলতো ইনসু?শুদ্ধর ভালোবাসার ধরনটা একটু আলাদা।ও চেয়েছিলো তোর চোখে ওর জন্য জেলাসি,ব্যস্ততা,কেয়ারিং এগুলো দেখতে।সকালবেলায় শুধুমাত্র তোর ঘুমন্ত চেহারাটা দেখবে বলে আমায় তুলে দিয়ে দরজায় দাড় করিয়ে রাখতো।বলতাম আমি,তোর এইচ ডব্লিউ,অধিকার আছে ওর কাছে থাকার,ফুল প্রাইভেসি দেবো।ও কি বলতো জানিস?শুধু হেসে বলতো,সবটা তোলা থাক।চলে যেতো তোর এলোমেলো চুলগুলো কানে গুজে দিয়েই।তোর একটুখানি ছোয়ায় ওর এক আকাশসম আনন্দ বাস করে ইনসু।তোর বইয়ের ভাজে রাখা চিরকুট,সেটা ওরই লেখা।প্রিয় আর তুমি সম্বোধনটা অতিকষ্টে নাকি লিখেছে বেচারা,তোকে একটু কনফিউজড্ করতে।তোর গলায় লেগেছিলো,এ কথাটা ওই বলেছিলো আমাকে।কোনো গলাটলা ধরে দৌড়াস নি তুই সেদিন!

মনপ্রান জুরে শীতল হাওয়া বয়ে গেলো যেনো।যে মানুষটা এতোগুলো বছর পাগলের মতো ভালোবেসে এসেছে আমাকে,সত্যিই তবে তার ভালোবাসা পুর্নতা পাবে?তার ভালোবাসা?আমার নয়?তবে আমি কেনো এতোটা খুশি?কেনো মনে হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত সুখ আত্মসমর্পন করেছে আমার কাছে।এরই নাম কি কোনোভাবে ভালোবাসা?

-ওই বিয়ের কনে,দরজা খোল!

কিছুটা চমকে উঠলাম।তামিম ভাইয়ার গলা।যীনাত আপু বললো,

-এসেছে।তুই আগে জলদি ফ্রেশ হয়ে আয়।তারপর দরজা খুলবো।নইলে এরা একবার শুরু করলে…

অসহায়ভাবে তাকালাম ওর দিকে।ও একগাল হেসে বললো,

-দরজা তো খুলবোই আমি‌ বোনু!যে মেয়ে শুদ্ধর পাগল করা ভালোবাসা সহ্য করতে পারবে,সে এই দু একটা পচানি সহ্য করতে পারবে না?এভাবে ভয় পাচ্ছে?ইন্টারেস্টিং!

ফুস করে মুখ দিয়ে নিশ্বাস বের করলাম।ওয়াশরুমে গলার পেন্ডেন্টটা দেখেই শরীর জুড়ে শিহরন।আয়নায় সত্যিই শ্যামবর্নের গালটা লাল দেখাচ্ছে।চেন্জ করে বাইরে আসতেই চোখ কপালে আমার।দীদুন বেডে বসে।চারপাশে বাকি সবাই দাড়িয়ে দাত কেলিয়ে হাসছে।তাপসী আপু বেডে বসতে বসতে বললো,

-দেখেছো ইশান?সিফাতের বিয়ে খেতে এসে ইনসুর বিয়েটাও খাওয়া হয়ে যাবে।ব্যাপারটা দারুন না?তুমি এক কাজ কর।ও বাসায় জানিয়ে দাও,ঘরজামাই থাকছো তুমি।

হাসি শুরু।রিফাত ভাইয়া বললো,

-তোর মনে একটুও দয়ামায়া নেই ইনসু?এদিকে ইমরোজ ভাইয়া,তামিম ভাইয়া,আমি,সবগুলো একটা প্রেম অবদি করতে পারলাম না,তুই শুদ্ধকে সোজা বউ গিফট করছিস?

ইশান ভাইয়া বললো,

-এট লাস্ট শুদ্ধর এইচ ডব্লিউ এফ ডব্লিউ হবে।হাফ ওয়াইফ টু ফুল ওয়াইফ!

আমি চোখ বন্ধ করে হাত কচলে যাচ্ছি শুধু।কি‌ বলবো?বলার কি আছে?প্রতিটা কথায় শুদ্ধর নাম শরীরে অদ্ভুত এক শিহরন তুলে দিচ্ছে।ভেতরটা থেকে কেউ চেচিয়ে বলছে,” এই নামের রোদ্দুরে তুই পুড়তে শুরু করলি আজ থেকে ইনসু।প্রতিবার এই নামের সাথে নিজের ভেতরের তোলপাড় নিয়ে আজীবন বাচতে হবে তোকে।আজীবন”
ইমরোজ ভাইয়া বলে উঠলো,

-এরপর থেকে শেহনাজ মন্জিল আসলে শুদ্ধ আর আমার সাথে ঘুমোবে না,আই মিন আর আমাদের কাউকে সময় দেবে না।

এবার আমার মন চাচ্ছে এখন মাটির নিচে ঢুকে যাই।তাড়াহুড়োয় রুম থেকে বেরোনোর জন্য পা বাড়াতেই দীদুন বললো,

-মনে আছে তো ইনসু?তোর বাসরঘরে আমি বেডে থাকবো।আর তুই খাটের তলায় থাকবি কিন্তু!

নাহ্!আর সম্ভব না।দৌড় লাগালাম আমি।কিন্তু দরজাতেই আটকে গেলাম।আব্বু দাড়িয়ে।নিজেকে সামলে মুখে হাসি টানলাম।ততক্ষনে রুমের ভেতরের সবাইও হাসাহাসি থামিয়েছে।আব্বুর হাত ধরে বললাম,

-ভেতরে আসুন না?

-কথা ছিলো তোমার সাথে।

আমি ভেতরে সবার দিকে তাকালাম।সবাই উঠে যেতে উদ্যত হলে দীদুন বললো,

-বলতে পারো ইয়াদ।এখানে সবাই পরিবারের সদস্যই তো।আর তাছাড়া সবাই কতো আনন্দ করছে দেখছোই।এখন বলাটা জরুরি?

আব্বু একটা শ্বাস ফেলে বললেন,

-তোমরা আড্ডা দাও।

আমি হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসলাম তাকে।সবাই কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে বসলো।দীদুন আর যীনাত আপু অবশ্য স্বাভাবিক।আমি সবারদিক তাকিয়ে নরম স্বরেই বললাম,

-তোমরা এসো।

সবাই উঠে যেতে লাগলো।দীদুনও দাড়িয়ে একপলক আব্বুর দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো।আমি আব্বুর বুকে মাথা রেখে বললাম,

-এবার বলুন,কি বলবেন?

আব্বু কিছুক্ষন চুপ থেকে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-তোর ভালো চাই আমি ইনসু।

-আমি জানি।

উনি চুপ রইলেন।আবারো বললাম,

-কি বলতে এসেছিলেন আপনি?

-মা রে,তোকে খুব ভালোবাসি আমি।বিশ্বাস কর,কোনোদিনও তোর জন্য এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবো না যাতে তোর কোনো ক্ষতি হয়।

এতোক্ষনে বুঝলাম।দু বছর আগে আংটি পরানোর পর যে অভিমানটা দেখিয়েছিলাম,বিয়ে নিয়েও তেমনটা করবো এমন ভয় পাচ্ছেন আব্বু।তাকে আরেকটু জরিয়ে ধরে বললাম,

-এটাও আমি জানি।আর তাই,আই প্রমিস,আজীবন আপনার সব মতামতকে সম্মান করবো আমি।

উনি মাথায় চুমো খেলেন আমার।হাসি ফুটলো মুখে।কিন্তু একটা ছোট প্রশ্ন এতোদিনে,প্রথমবারের মতো মন মস্তিষ্কে জ্যাম লাগিয়ে দিচ্ছে।এতো সুখ কোথায় রাখবো আমি?

-অনেক হয়েছে!অনেক হয়েছে!এবার সব বেরোও এই রুম থেকে!আমার বউয়ের সাথে আমারও কিছু কথা আছে গাইস!কুছ তো রেহেম কারো!

শুদ্ধর গলা শুনে শ্বাস থেমে গেলো আমার।অনুভুতিশুন্য হয়ে মাথা তুলে দরজায় তাকালাম।সে হাতের ঘড়িটা লাগাতে আর হুইস্টলিং করতে ব্যস্ত।আব্বুর দিকে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলাম সেও শুদ্ধর দিকেই তাকিয়ে। বিবেকবোধ জাগ্রত হয়ে কটাক্ষ করে বলে উঠলো,

“এর পাগলামিগুলোতে সত্যি তুইও পাগল হয়ে যাবি ইনসু।মিলিয়ে নিস।বিয়ের পর আজাদ ম্যানশন না,পাবনা মেন্টাল হসপিটালে তোদের দুটোর সংসার হবে!শোনা যাবে,এসব পাগলামির জন্য তোদের দুই পরিবার পাগল হতে বসেছে।আর একসময় হেডলাইনে খবর আসবে চিকিৎসাধীন দুই পাগল মিলে হাসপাতালের চিকিৎসকসহ সুস্থ্য লোকজনদেরও পাগল করে দিয়ে পালিয়েছে!তাদের লক্ষ্য এখন পুরো বাংলাদেশ।
হোয়াট আ লাভ স্টোরি!তালিয়াআআআআআ!”

#চলবে….

[ভুলত্রুটি মাফ করবেন🙏]