দখিনা বারান্দায় তুমি আমি পর্ব-০২

0
398

#দখিনা বারান্দায় তুমি আমি
#আফসানা_মিমি
|দ্বিতীয় পর্ব |

‘ মাইয়া মানুষের এরম উড়চন্ডী স্বভাব ভালা না। আইজ যদি পুলাডা না থাকতো তইলে কী হইতো?’

‘ঠিকই কইছোস ময়না, দেখলি না! আরেকটুর জন্য জঙ্গলে পড়ে নাই? এমন বৃষ্টির দিন বাইরে বাইর হওয়ার দরকার কী ছিলো।’

‘ বড়লোকগোর ব্যাপার স্যাপার। চল বস্তিতে যাই। সাপগুলোর উপর আজ মেলা দখল গেছে। হা’লা’র কদম আলীর লাইগ্গা আমগোর ব্যবসা লাটে উঠছে।’

কর্ণধারে দুই মহিলার কথোপকথন আসছে। শরীরে শক্তি নেই বললেই চলে। বৃদ্ধ লোকটি দোকানের পিছনে, কারোর সাথে কথা বলছে। কিছুক্ষণ আগে আমার কাছে আসতেই পা দিয়ে আঘাত করি পুরুষাঙ্গে। মোচড়ে যায় লোকটি। বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে,’ শালি, শক্তি দেখাস আমার সাথে? দাঁড়া আজ তোর এমন অবস্থা করব না! যেন কাউকে মুখ দেখাতে না পারিস।’

ফুঁপিয়ে কান্না করছি। মুখে স্কচটেপ আটকানো। উম উম শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ করতে পারছি না। বৃষ্টির বেগ কমেছে। মহিলাদের কথায় আশার আলো খুঁজে পেলাম। দোকানের পুরোনো বেড়ায় পা দ্বারা আঘাত করতে লাগলাম আর মুখ দিয়ে উম উম শব্দ। যেন কেউ বুঝতে পারে আমি বিপদে আছি।

‘ তুই শব্দ হুনছোস ময়না?’

‘ হয় আফা। বেড়ার হেইপাশে কেউ আছে। তয় দোহান দেইখা মনে হইতাছে মেঘের লাইগা বন্ধ!’

স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি দুই মহিলার কথোপকথন। আবারও শব্দ করলাম। এবার মহিলাদের হাঁক কানে আসলো,
‘ কেডা এইহানে। ডর দেহান কেন? আমরা বেঁদের দল দেইখা আমগোর মনে ডর নাই নাকি? বাইর হোন কইতাছি।’

কান্না করছি। মুখ দিয়ে উম উম শব্দ করছি যেন বুঝতে পারে বিপদে আছি।
‘ কেউ বিপদে পড়ছে রে ময়না। কাপড়ের পুঁটলি নিচে রাখ, কাগজ উঠা।’

চোখের সামনে থেকে কাগজ উঠানো হলো। দুই মহিলারা বেঁদের দলের দুইজন। বিস্ময়কর চোখে তাকিয়ে আছে দুইজন। আমাকে বাঁধা অবস্থায় দেখে আঁতকে ওঠেন। একজন মহিলা বলে উঠেন,

‘ কি রে মাইয়া! তোরে বাঁইধা রাখছে ক্যাডা!’

‘ ওই কেরে এখানে?’

মহিলার উচ্চ আওয়াজের কথা শুনে দোকানের পিছন থেকে বৃদ্ধ লোকটি বেরিয়ে আসে। বেঁদের দলের দুজনকে দেখে নাক মুখ কুঁচকে ফেলে,

‘ তোদের এখানে কি, বাইদ্দার দল! নিজের কাজে যা। দেখিস না দোকানে কাগজ নামানো! দোকান এখন বন্ধ। এখন কিছু বিক্রি করব না।’

‘ ওরে বুইড়া শয়তান। দুইদিন পরে কবরে যাবি তবুও তোর শরীরের জ্বলন কমে না?’

‘ টাকা লাগবো তোদের? টাকা দেই, বিদায় হো।’

‘বাঁইদা দেইখা কি আমগোর শরীরের সম্মান নাই? তোর মত শয়তনেল কাছে এই মাইয়ারে রাইখা যামু নাকি? মাইয়াডারে ছাইরা দে।’

‘ ছাড়ব না। নিজের জীবন বাঁচাতে চাইলে এখান থেকে দূর হো।

দেখতে পেলাম দুই মহিলা রেগে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খুঁজে নিল। শলার ঝাড়ু একজন মহিলার হাতে নিয়ে বুড়ো লোকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আরেকজন মহিলা এসে আমার হাতের বাঁধন আর মুখ থেকে স্কচটেব উঠিয়ে নেয়। ময়না নামক মহিলা ফুটন্ত চায়ের জন্য করা পানির পাত্র হাতে নেয়। আমাকে অভয় দিয়ে বলে,
‘ ভয় পাইয়ো না মাইয়া। বাইদা হইতে পারি, মাইনষের ক্ষতি করি না।’

কান্না থেমে গেছে। অন্তরে ভয় কাজ করছে। দুই মহিলা একসাথে আক্রমণ করছে বৃদ্ধ লোকটির উপর। ও মাগো, ও আব্বাগো বলে লোকটি চিৎকার করছে, কাতরাচ্ছে। গরম পানি লোকটির গোপনাঙ্গে অল্প অল্প করে ঢালছে মহিলাটি। রেগে থুথু ফেলে বলে,

‘ বুড়া বয়সে তোর নজর এখনো ঠিক হল না। আইজ তোর এমন অবস্থা করুম যেন এই মেশিন নিয়ে কারো সামনে যাইতে না পারোস। ঐ ময়না থামলি কেন?’

সহ্য করতে পারছি না। মাথা যন্ত্রণা করছে। আমাকে দুর্বল দেখাচ্ছে। মহিলা পি’টি’য়ে হাপাচ্ছে। আমাকে বাহিরে গিয়ে দাঁড়াতে বলে আবারো পি’টা’চ্ছে লোকটিকে।
——
অদূরে আরান ভাইয়ার মত কাউকে দেখতে পেলাম। মানুষটা আরান ভাইয়াই ছিল। ছাতা মাথায় আমার। নিকটে আসে। চোখে মুখে অস্থিরতা, চিন্তার ভাব স্পষ্ট। আমাকে ভেজা অবস্থায় দেখতে পেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। পর মুহূর্ত কিছু একটা ভেবে আমার দিকে আবারও তাকায়। আমার কাছে এসে চোখের পানি মুছে বলে,’ কি হয়েছে তোমার?’

ঐ সময়েদুজনের বেঁদের মহিলা দুজন বের হয়ে আসে। মাথার চুলগুলো শক্ত করে বেঁধে বলে,

‘ আপনি ওই পোলাটা না যে একটা মাইয়ারে বাঁচাইছে। মাইয়াটা ভালো আছে নি? দেখতাম তো কপাল ফাইট্টা র’ক্ত বার হইতাছে।কি হয়েছিল মাইয়াডার?’
মহিলার কথা শুনে আরন ভাইয়ার উত্তর,

‘মাথা ফেটে গেছিল। বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসেছি। আপনারা এখানে কি করছেন,ভেতরে কে?’

বৃদ্ধ লোকটির আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে ভিতর থেকে। দুজন মহিলা গর্জে ওঠেন। মুখের থুথু ফেলে বলেন,

‘ এক বুইড়া ব্যাটা মাইয়াটার ক্ষতি করতে চাইছিল। ভাগ্যিস আমরা সময়মতো আইয়া পড়ছিলাম। নাইলে মাইয়ার লাশ থাকত ওই পঁচা ডোবায়।’

বুঝতে পারলাম আমার দূর সম্পর্কের মামাতো বোনের বিপদে সাহায্য করেছে আরান ভাইয়া। তাইতো এত দেরী হল আমাকে খুঁজতে। আরান ভাইয়া চোখ বড় হয়ে যায়। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। ছাতা বন্ধ করে ছাতা হাতে নিয়েই ভিতরে চলে গেল। আরেকদফা মা’র’তে শুরু করে বৃদ্ধ লোকটিকে। ভিতর থেকে বৃদ্ধ লোকটি আর্তনাদ কানে ভেসে আসছে। দুই মহিলার মুখে হাসি। একজন মহিলাকে বলে উঠেন,

‘ বুঝলি ময়না! মহিলাগোর গায়ের জোর কম না। আমরা মহিলারা চাইলেই দুনিয়া থেকে শয়তানদের ধ্বংস করতে পারি। তাইলেই এর ভতো পুরুষরা মাইয়াগো দুর্বল ভেবতো না।’

প্রায় বিশ মিনিট পর আরান ভাইয়া ফিরে আসেন। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে, শরীর থরথর করে কাঁপছে। আমি মাথা নীচু করে আছি, আর ফুঁপিয়ে কান্না করছি।
আরান ভাইয়া বেঁদের মহিলাদের হাতে পাঁচশত টাকা গুজে দিলেন এবং ধন্যবাদ জানালেন আমাকে বাঁচানোর জন্য।
————-

মামা মামীর সামনে বসে আছি মাথা নিচু করে। মামীর করুণ চাহনি কিন্তু মামার চাহনি শক্ত। আড়চোখে তাকাচ্ছে আরান ভাইয়ার দিকে। যেন আরান ভাইয়াকে এই ঘটনাথ জন্য দায়ী করছেন। কিছুক্ষণ পর মামার গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল,

‘ আজ যা করেছ, করেছ। ভবিষ্যতে যেন এমন ভুল আর না হয়। একা একা বাহিরে যাওয়ার প্রতিফল পেয়েছো তো!’

নিশ্চুপ হয়ে আছি। আড়চোখে আরান ভাইয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। তীক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

‘ হয়েছে আদিবের বাবা আর বকা দিবেন না। মেয়েটা বুঝতে পারেনি। ছোট মানুষ।’

‘ আজ যদি কিছু হয়ে যেত তাহলে আমি আপাকে কী জবাব দিতাম বলতে পারো তুমি? যাই হোক চোখে চোখে রাখবে দুহাকে। বাড়ির বাহিরে একা যেন বেরোতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখবে। আর যেখানে যাবে আরনকে সাথে পাঠাবে।’

মামা উঠে চলে গেলেন। রাগ করেছে, কষ্ট পেয়েছে অনেক। আমি তো একা যাইনি। দূর সম্পর্কের মামাতো বোনকে নিয়ে গিয়েছিলাম। আরান ভাইয়াও ছিল কিন্তু আমাকে বাঁচাতে পারেনি সেখানে আমার কি দোষ! মামীর দিকে তাকালাম করুণ স্বরে বললাম,

‘মামী বিশ্বাস কর! আমি একা যাইনি। আর পরিবেশটা কীভাবে যেন পাল্টে গেল। বৃষ্টির মধ্যে দৌঁড়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম বুঝতে পারিনি।’

টেবিলের উপর বিকট শব্দ হল। আরান ভাইয়া চেঁচিয়ে উঠলেন,

‘ ক্লাস এইটে পড়া মেয়ে এতটা বোকা হয়! বিষয়টা সত্যিই হাস্যকর। অন্ততপক্ষে নিজের সেফটির কথা ভাবতে পারে তো একজন মানুষ!’

‘ হয়েছে আরান আর বকবি না তুই। যা ঘরে যা।’

আরান ভাই চলে গেলেন কিন্তু যাওয়ার আগে চোখ রাঙিয়ে শাশিয়ে গেলেন আমাকে। যেন একা পেলে আস্ত চিবিয়ে খাবেন।

———-

মামা বাড়ি এসেছি আজকে ষষ্ঠ দিন। আগামীকাল চলে যাব। নাইনে ভর্তি হতে হবে। আমার বান্ধবীরা সবাই পাগল হয়ে গেছে হয়তো এই কয়েকদিনে। মামী এবং কাগজ-কলমের জন্য ঘৃণীত অতীত ভুলে গেছি। তবে একা যখন থাকি তখন মনে পড়ে।

উঠোনে দাঁড়িয়ে মোবাইল ঘাটছি। খুঁজে চলছি বৃষ্টির গান। সাউন্ড বক্সের গান ছেড়ে দিলাম,

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
পায়ে দিয়ে সোনার নূপুর
আঁকা বাঁকা মেঠো পথে,
কোন রূপসী হেঁটে যায়?

হাত পা ছড়িয়ে নাচছে কাগজ,কলম। নাচের পরিচালনা করছি আমি। অঙ্গভঙ্গি কীভাবে কী করতে হবে বলে দিচ্ছি। আগমন ঘটে আরান ভাইয়ার। বাঁকা ভঙ্গিতে বলে উঠে,

‘ এভাবে খালি পায়ে না নাচিয়ে সোনার নূপুর পায়ে পরিয়ে তারপর নাচাও। দেখতে সুন্দর লাগবে।’

‘আমার যা ইচ্ছা তা করব, আপনার কি?’

‘আমার তো কিছুই না। কিন্তু তোমার নূপুর পায়ে নাচ দেখতে ইচ্ছে করছে। কি করা যায় বলো তো?’

আরান ভাইয়ার কথা শেষ হতে হতে কাগজ-কলম একসাথে বলে ওঠে,

‘দুহা রানী নুপুরের তালে নাচ করবে, আরান ভাইয়া দেখবে।’

‘ ওরে পাকা রে! দুই ছেলেকে এসব শেখালো কে রে? এই দুহারানী তুমি কী শিখিয়েছ? যাই হোক ভালো করেছ। এবার চুপচাপ দাঁড়াও তো, তোমার পায়ে নুপুর পরিয়ে দেই। তারপর তোমার নাচ দেখি! একটা গান আছে না! নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক,পায়েল খানি বাজে, মাদল বাজে সেই সঙ্গেতে, শ্যামা মেয়ে নাচে।’

‘আমি নাচবো না।’
‘না নাচলে আবারও আপ্পা দিব। এবার কিন্তু কাগজ-কলমের সামনে দিব।’
আরান ভাইয়ার কথা শেষ হতেই কাগজ,কলমের একসাথে প্রশ্ন,

‘আপ্পা কি ভাইয়া?’

একজন পাগল আবোল তাবোল বলছে আর অপর দুইজন ছাগল তা গিলে যাচ্ছে এবং মগজে ঢুকিয়ে যাচ্ছে। রাগান্বিত দৃষ্টিতে আরান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলাম। দুই পায়ে নুপুর পরিয়ে দাঁড়ালেন ভাইয়া। মুখে জয়ী হাসি। এবার সাউন্ড বক্সেগান ছেড়ে দিলেন।
নাচ পারি না তবুও লেফট রাইট পায়ে ধরাম ধরাম শব্দ করে লাফিয়ে যাচ্ছি। একটু পর পর আরান ভাইয়া বলছেন,’ বাহ খুব সুন্দর নাচ তো! এমন নাচ আমি প্রতিদিন দেখতে চাই। এর জন্য কী করতে পারি সুন্দরী?’
রাগে জবাব দিলাম,

‘জাহান্নামে যান বদ বাদর!’

চলে আসলাম সেখান থেকে। আমি জানি আরান ভাইয়া আনন্দে হাসছে। ভয়ঙ্কর হাসিতে। যে হাসি দেখলে আমার গা জ্বলে যাবে।

রাত নয়টা বাজে। ব্যাগ পত্র গুছিয়ে আরান ভাইয়া হাজির। আমি মামা মামীর ঘরে বসে গল্প করছিলাম। আরান ভাইয়াকে তৈরি অবস্থায় দেখে মামী বলে উঠেন,

‘ আর কটা দিন থেকে গেলে কি হতো আরান? সময় কত তাড়াতাড়ি চলে গেল। আর কয়েকদিন থেকে যা
না!’
‘ফুপি অনেকদিন তো থাকলাম। বেশি থাকলে আবার মানুষ বলবে ফুফুর বাড়ি থেকে ছেলেটা টাকা উড়াচ্ছে। এসব শুনতে চাই না। আমি শহরে গিয়ে মেসে উঠব। সেখানেই থাকব।’

আরান ভাইয়ার চলে যাওয়া দেখে কিছু বললাম না। অন্তরে কেমন যেন কষ্ট অনুভব হচ্ছে। কেন হচ্ছে নিজেও জানিনা। তবে আরান ভাইয়ের চাহনি ছিল অন্যরকম, ছিল অনেক প্রশ্ন,অনেক কথা। আমাকে কিছু বলতে চায় যেন। তাকালাম না আর ভাইয়ার দিকে। মামাকে সালাম দিয়ে মামীকে জড়িয়ে ধরে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। পিছনে রেখে গেলেন প্রশ্নবিদ্ব এই আমাকে।

চলবে….