দখিনা বারান্দায় তুমি আমি পর্ব-০৩

0
366

#দখিনা বারান্দায় তুমি আমি
#আফসানা_মিমি
|তৃতীয় পর্ব |

প্রিয় তুমি,
শামুকের অভ্যন্তরীণ মুক্তদানা দেখেছ কী? স্বচ্ছ চকচকে থাকে। তোমার মনটাও ঠিক তেমন, স্বচ্ছ। তোমার নিজের প্রতি কতটুকু ধারণা আছে? তুমি কী জানো যে, তুমি মানুষটা কেমন! আমাকে জিজ্ঞেস করো! বলে দিবো। কেননা আমি তোমাকে কাছ থেকে অনুভব করেছি। অজানা ভাললাগার সাগরে ভেসেছি। জানি বলবে, পাগল হয়ে গেছেন কী? আমি বলব, হ্যাঁ। তোমার প্রেমে পাগল, শুধু পাগল না ভয়ংকর পাগল। তবে আমার পাগলামি তোমার চোখে বিরক্তির কারণ। তুমি ছোট, তোমার প্রতি আমার অনুভূতি একপক্ষীয়। দূরে সরে যাচ্ছি। পড়াশোনা করো, বড়ো হও। এই আমাকে আর পবে না তোমার বিরক্তির কারণ হতে। তবে শেষে বলব, আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ ললনা তুমিই তুমি।
ইতি,
তোমার আপনি

সময় গড়িয়েছে। রাস্তাঘাটে পরিবর্তন এসেছে। জায়গায় জায়গায় ইট পাটকেলের দালান কোঠা আকাশচুম্বি উঠেছে যেনো। ব্যস্তময় শহরের মানুষজনও ব্যস্ত। নিত্যদিনের কাজে যাতায়াত করতে করতে রোবট হয়ে গিয়েছে। প্রশান্তির জন্য খোলা জায়গার খোঁজ করে। ছুটির দিন পেতেই পরিজনদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে শান্তির নিশ্বাস ত্যাগ করে।

সময়ের সাথে সাথে দুহার চঞ্চলতা কমে গেছে। উড়ন্তপাখি হয়ে ঘোরাফেরা করা দুহা অনেকটাই লাজুক স্বভাবের হয়েছে তবে ভিতু নয়। অতীতের সেই ঘটনার পর থেকে নিজেকে সুরক্ষা করার কৌশল আয়ত্ত করেছে। আজ শুক্রবার। শহরের নিকটবর্তী স্থানে ঘুরতে এসেছে দুহা। বসে আছে শিউলি ফুলের গাছের নিচে। একা নয়, সাথে রয়েছে আরানের তিন বছর আগে ফেলে আসা চিঠি। তিন বছরে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। দুহার জীবনে আরান নামক মানুষটির অনুভূতি পূর্ণ চিঠি আর নুপুর স্মৃতি হিসেবে আছে। কিন্তু আরানের খোঁজ নেই। লজ্জায়, জড়তায় মামীকেও ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারে না দুহা। আগামীকাল দুহার কলেজের প্রথম দিন। এস এস সি পরীক্ষার পর দুহার ছোট্ট এক্সিডেন্ট হয়, পা ভেঙে যায়। বিছানায় শুয়ে থাকতে হয় ছয় মাস। যার কারণে পড়াশোনায় পিছিয়ে দুহা।

‘ কিরে দুহা! একা কি করছিস? নিশ্চয়ই চিঠি নিয়ে এসেছিস! তাই তো আমাকে খবর দেস নি।’

আরমান। দোহার ছোট বেলার বন্ধু। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত একসাথে পড়াশোনা করেছে। হাই স্কুল জীবনে দুজন বয়েজ, গার্লসে পড়েছে। এই কয়েক বছরে বন্ধুত্ব এক ফোঁটাও কমেনি, বরঞ্চ বেড়েছে। দুহার জন্য এক বছর কলেজে ভর্তি হয়নি আরমান।
‘ আজকের দিনটা আমার আর তার। তুই এখানে কী করছিস?’
আরমান আয়েশ করে বসে যায় দুহার পাশে। ব্যাঙ্গ স্বরে উওর দেয়,
‘ তোকে ছাড়া একা থাকি কী করে রে সই! তোর জন্য পুড়ে ছাই হয়েছে এ হৃদয়।’

চিঠি ভাজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয় দুহা। হাস্যজ্বল মুখশ্রী দুহার। আরমান নিঃসন্দেহে একজন ভালো বন্ধু । এমনটাও নয় যে আরমান দুহাকে পছন্দ করে। অভিভাবক হিসেবে সবসময় পাশে থাকে।

‘ এত কাব্য কই থেকে আসে রে! আগামীকাল সকাল আমাকে এসে নিয়ে যাবি। এমনিতেই সব জুনিয়র, তুই পাশে থাকলে শক্তি পাবো।’

‘ সবসময় চেহারায় গাম্ভীর্যভাব আনা কী জরুরী দুহা?’

আরমানের প্রশ্নে দুহা নিশ্চুপ। শিউলি ফুল হাতে নিয়ে বলে,

‘ মেয়েদের চঞ্চলতা একটা সময় এসে ফুরিয়ে যায়। তাই বলে যে মেয়েরা হাসবে না, কথা বলবে না তা কিন্তু না। মেয়েরা সময় সাপেক্ষে নিজেকে উপস্থাপন করতে জানে।’

‘ হয়েছে তোর জ্ঞান দেওয়া? চল বাদাম খাই। আন্টি ফোন দিয়েছিল। তোকে ধরে বেঁধে বাসায় দিয়ে আসতে বলল।’

দুহা আর কিছু বলল না। আরমানের কথা শুনতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
———

দু তলা বিশিষ্ট ভবনের সামনে এসে দাঁড়ালো রিকশা। দুহা নেমে পড়লো সেখান থেকে। আরমানকে শত বলেও নামাতে পাড়লো না অগত্যা বাড়িতে একাই প্রবেশ করল।

দুহা বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। অন্যদিনের মত আজ বাড়ির পরিবেশ একদম নীরব। দুহার মায়ের কথা শোনা যাচ্ছে না আজ! দুহা সোফায় বসে চিন্তা করতে লাগলো মায়ের কথা।
‘ আপামনি কহন আইলেন। ম্যাডাম বাজারে গেছে। আপনারে কইছে কিছু খাইয়া বিশ্রাম করতে।’

‘ আপনাকে কতদিন বললাম খালা আমাকে আপামনি বলে ডাকবেন না, নাম ধরে ডাকবেন?’

‘আস্তাগফিরুল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ! মালিককে নাম ধরে ডাকে নাকি? না বাবা আমি এমন শিক্ষা পাই নাই। আপামণিরে আপামনি ডাকবো। নাম ধরে ডাকবো না। যাই আমার মেলা কাম আছে।’

এটা প্রতিদিনের রুটিন। শত হলেও রহিমা খালার আপামনি ডাকটা বন্ধ করা যায় না।

রাত হয়েছে। উজ্জ্বল আকাশের কালো আঁধার নেমেছে। আকাশে মিটমিট করে তারা জ্বলছে। আকাশ পরিষ্কার। দুহা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের তারা গুনার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। এমন সময় দোহার মায়ের ডাক কানে আসে। বারান্দা থেকে বের হতেই দুহার মা আদুরে কন্ঠ বলেন,

‘আমার মা টা এখানে কি খুঁজছে? আমার মা টার কী মন খারাপ?’

‘ না মা আমি ঠিক আছি। এমনি ব্যস্ত শহর দেখছিলাম। খেয়েছ কিছু?’

‘ তোকে ছাড়া আমি কখনো কিছু খেয়েছি? চল খেয়ে নিবো।’
‘ বাবা ফোন করেছিল?’
‘ তোর বাবার কথা একদম জিজ্ঞেস করবি না। বিদেশে গেলেই আমাদের ভুলে যায়।’

দুহা মাকে জড়িয়ে ধরে। এরপর চলে আসে খাবার টেবিলে। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব সেরে কলেজের ব্যাগ গুছিয়ে নেয় দুহা। বলা হয়নি, দুহার জীবনের চরম শত্রু হলো ঘুম, ঘুমের কারণে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয় সে। আগামীকাল কলেজের প্রথম দিন। দুহা চায় না, এই ঘুমের কারণে দুহার দিনটা খারাপ হোক।

কলেজের সামনে আরমান এবং দুহা দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ এক বছর পর দুজনেই আবারো পড়াশোনায় মনোনিবেশ করবে। দুজনের মনেই ভীষণ আনন্দ। বিস্তৃত মাঠ পেরিয়ে কলেজের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো আরমান এবং দুহা। বারান্দায় নোটিশ বোর্ডে টাঙানো রোল দেখে নিজেদের শ্রেণীকক্ষ জেনে নিলো।

ক্লাস শুরু হতে এখনো ঢের সময় বাকি। নতুন কলেজ, নতুন পরিবেশ আরমান এবং দুহা ভাবলো প্রথমে ক্লাস রুমে গিয়ে বসবে তারপর আস্তে আস্তে সবার সাথে পরিচিত হবে। যেই ভাবা সেই কাজ।
মেয়েরা একপাশে ছেলেরা অপর পাশে। দুহা দ্বিতীয় বেঞ্চে জায়গা পেয়ে বসে পড়লো। কিছু কিছু মেয়ে এগিয়ে আসে কথা বলার জন্য। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি! কিছু সময় কথা বলার পর দুহার মনটা ভালো হয়ে যায়। কেননা যখন এরা শুনেছে দুহার এক বছর গ্যাপ গিয়েছে। তখন সকলে আরো সময় দিচ্ছে এবং দুহাকে পছন্দ করে ফেলেছে বন্ধু হিসেবে।

কলেজের ঘন্টা বেজে উঠলো। সবাই যার যার সিটে বসে পড়লো। কেউবা ফিসফিস করে গল্প করছে তো কেউ হাসাহাসি করছে। নিশ্চুপ দুহা আরমানের দিকে তাকিয়ে দেখে ছেলেদের সাথে ভালোই কথা বলছে।

একজন শিক্ষক প্রবেশ করেন, মুখে হাসি। সকলের উদ্দেশ্যে বলেন,

‘ আমাদের কলেজে তোমাদের স্বাগতম। আমি মোহাম্মদ রফিক। তোমাদের ক্লাস টিচার, তোমাদের বন্ধু, তোমাদের অভিভাবক, আমি তোমাদের গাইড করব এবং আমি তোমাদের শিখাবো। আমার সাথে সিনিয়র শিক্ষক আছেন প্রায় পাঁচজন এবং জুনিয়র আছেন মানে নতুন যারা এসেছেন তারা হচ্ছেন তিনজন। যাদের মধ্যে একজন এবছর মাস্টার্স শেষ করে কলেজে শিক্ষকতা হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। তোমরা জিনে খুশি হবে সেই শিক্ষক খুবই ভালো।
এখনো পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে ভার্সিটির প্রফেসর হবেন এটা স্বপ্ন। আমার ক্লাস প্রথম দ্বিতীয় ক্লাস ঐ শিক্ষকের। তিনি এখনও অনুপস্থিত আসবেন সময় মত।

প্রথম ক্লাস ভালোভাবেই কাটলো দুহার। ক্লাস রুমে আবারও কথন শোনা যাচ্ছে। ছেলেরা বেঞ্চের ওপর বসে হাসাহাসি করছে। দুহা মাথা নিচু করে খাতায় কিছু লিখছিল। হঠাৎ কারো কথা কর্ণধারে আসতেই থমকে যায়।

‘ শিক্ষক ক্লাসে প্রবেশ করলে দাঁড়াতে হয়। এই শিক্ষাটাও কী পাওনি?’

সকল শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে আছে একমাত্র দুহা ছাড়া। দাঁড়িয়ে যায় দুহা। ভয়ে সম্মুখে ফিরে তাকায়। দুহার চোখে বিস্ময়, অন্তরে অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছে। দুহি ভাবছে আদৌও কী সম্ভব! এ কাকে দেখছে দুহা? ভাগ্য কী এভাবেই সহায় হবে তা দুহার জানা ছিলো না। অস্ফুট স্বরে বলল,

‘ আরান ভাইয়া!’

চলবে…….