দখিনা বারান্দায় তুমি আমি পর্ব-০৪

0
350

#দখিনা বারান্দায় তুমি আমি
#আফসানা_মিমি
|চতুর্থ পর্ব

শ্রেণিকক্ষে পিনপতন নীরবতা। সকলের দৃষ্টি সম্মুখে দাঁড়ানো সুদর্শন মানবের উপর কিন্তু সুদর্শন মানবের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দুহার উপর। অবাক দৃষ্টি দুহার। একজন মানুষ কিভাবে এতটা পরিবর্তন হতে পারে! ভাবাচ্ছে দুহাকে। আরানের দৃষ্টিতে স্পষ্টত বুঝা যাচ্ছে দুহা একজন অপরিচিত মেয়ে। যাকে আজ প্রথম আরান দেখছে। এই তিন বছরে কী দোহা এতটাই পরিবর্তন হয়েছে যে আরান চিনতে পারছে না? প্রশ্ন তোলা রইলো দুহার।

সকল শিক্ষার্থীকে অনুকরণ করে দুহাও নিজ আসনে বসলো কিন্তু বিপত্তি ঘটলো আরানের কথায়।

‘ বসতে বলিনি। দাঁড়িয়ে থাকো পাঁচ মিনিট।’

নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দুহা। যেন সে মূর্তি মানবি, নড়াচড়া করার শক্তি নেই। একটু সময়ের জন্যও দুহার দৃষ্টি আরানের উপর থেকে সরেনি। আরান শিক্ষার্থীদের সাথে পরিচিত হতে ব্যস্ত।
আপনি যদি কারো দিকে অনেক সময় ধরে তাকিয়ে থাকেন তাহলে সেই মানুষ বুঝতে পারে। আরানের ক্ষেত্রেও তাই। আরানের পঞ্চ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থী অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আরান দুহার সামনে এসে দাঁড়ায়। ক্ষিপ্তস্বরে প্রশ্ন করে,

‘ নাম কি আপনার?’

দুহা অবাক,বিমূঢ়তা ঘিরে ধরেছে সর্বাঙ্গে। আরানের কথা কর্ণধারে পৌঁছাতেই অন্তর কেঁপে উঠছে। দুহার মনে প্রশ্ন, সত্যি কী আরান ভাইয়ার অচেনা আমি? উওর জানা নেই। দুহা নিজেকে সংযত করে প্রত্যুওরে বলল,
‘ আমার নাম দুহা।’

ভ্রু কুঁচকে এলো আরানের। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
‘ শুধু দুহা? আগে পড়ে কিছু নেই? মিস বা মিসেস?’

শ্রেণীকক্ষে হাসির রোল পড়লো। আরান ইঙ্গিত বুঝিয়ে দিচ্ছে দুহার বয়সের ব্যবধান। মাথা অনিমেষ নিচু হয়ে আসলো। আস্তে করে উওর দিলো,’ মিস দুহা। আমি অবিবাহিত।’

আরেক দফা হাসির রোল পড়লো পুরো কক্ষ জুড়ে। আরান সকলকে থামিয়ে দিলো। দুহার দিকে মনোনিবেশ করে শক্ত কন্ঠস্বরে বলল,
‘ মিস দুহা, আমি খুব কঠিন মানুষ। অন্যায় অপছন্দনীয়। আশা করি ভবিষ্যতে এমন ভুল করবেন না।’

দুহা মাথা দুলালো শুধু। পরক্ষণে আবারো আরানের ধমকানো কথা কর্ণধারে আসলো,
‘ বোবা নাকি আপনি, মিস দুহা। আমি মুখে কথায় বিশ্বাসী। মাথা নড়াচড়া করে কি বুঝাতে চাইছেন?’

প্রত্যুত্তর করল দুহা। ধরা গলায় উওর দিলো, ‘ আর এমন ভুল হবে না, স্যার!’

‘ গুড, বসুন।’

পুরোটা সময় দুহা মাথা নিচু করে আরানের কথা শুনছিল। আজ প্রথম দিন। পরিচয় পর্বের সাথে অল্প পড়া। সময় শেষ। ক্লাস থেকে বের হওয়ার আগে আরানের তীক্ষ্ম দৃষ্টি পড়ে দুহার উপর। আফসোস দুহা যদি একবার মাথা তুলে দেখতো তাহলে দুহার মনের লুকায়িত অনুভূতি দৌড়ে পালাতো।
———-

সাদা, নীল কম্বিনেশনে কলেজের পোশাক। ছুটি হয়েছে মাত্র। কলেজের সম্মুখের রাস্তায় যেন নীল পদ্ম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
‘ দুহা, এই দুহা।’

পিছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো দুহার নাম ধরে। আরমানের সাথে কথা বলছিল দুহা। ভরা রাস্তায় ছাত্র-ছাত্রী। কে কাকে ডাকছে ঠাওর করা কঠিন। দুহার চঞ্চল চোখ জোড়া খুঁজে চলছে কাঙ্খিত মানুষটিকে। অসম্ভবকে সম্ভব করা দুহার কাজ নয়। পেলও না। কিছুক্ষণ পর দুহার সম্মুখে একজন মেয়ে এসে দাঁড়ালো। পরিধানে কলেজের পোশাক, মাথার চুল দুই বিনুনি করা সামনের চুল ছোট বলে কপালে এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে। সেদিকে মেয়েটির খেয়াল নেই। হাসিমুখে দুহাকে দেখছে। হাত বাড়িয়ে দেয় দুহার দিকে এবং বলে,
‘ হাই, আমি এলমা। তোমার সাথেই পড়ি। পিছনে বসেছিলাম তাই দেখোনি আমাকে। তোমাকে অনেক ভালো লেগেছে। আমার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করবে না?’

দুহা হেসে ফেলল। কয়েক মিনিটে বুঝতে পারল এলমা নামক মেয়েটা বেশি কথা বলে। বাচাল নাম দিলে খারাপ হবে না।

‘ সব তো বলে দিলে, প্রশ্ন করার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।’

আরমানের চকচকে দৃষ্টি এলমার উপর। আগ বাড়িয়ে আরমানের প্রশ্ন,

‘ তুমি কী সিঙ্গেল?’

ভ্রু কুঁচকে আসে দুহার। কোণা চোখে আরমানের দিকে তাকায়। ছেলেটার চোখে লাল বাত্তি জ্বলছে। মিনমিন করে দুহা বলে, ‘ছেলেটা ফেঁসেছে।’

‘ আমি জন্ম থেকে সিঙ্গেল। দুহার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই। তুমি বাদে।’

‘ আমার আপত্তি নেই। তবে আরমান আমার বেস্ট ফ্রেন্ড এতটা খারাপ না। বন্ধুত্বের সুযোগ দিয়ে দেখতে পারো।’

‘ যথাআজ্ঞা, তবে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। নয়তো!’

দুই হাত ঘুসির মত দেখিয়ে ভয় দেখায় এলমা। এলমার কাছে সকলে একসাথে হেসে ওঠে।
তিনজন একসাথে হাঁটছে। কলেজ থেকে অনেকটা দূরে এসে পড়েছে। হঠাৎ এলমা বলে,’ বুট খাবে?’
আরমান,দুহা আশেপাশে তাকিয়ে বুট ওয়ালা খুঁজছে। কিন্তু আফসোস এই কড়া রোদে কোন মানুষের পদ ছায়াও নেই। আরমান ব্যঙ্গ স্বরে বলে,

‘ দুপুর বেলায় ভূতে কিলায়? বুট ওয়ালা কী আকাশ থেকে নেমে এসে বুট খাওয়াবে?’

তেতে ওঠে এলমা। ভেংচি কেঁটে বলে,
‘ বেশি কথা একদম অপছন্দ। চুপ থাকলে বুট পাবে, নয়তো ভাগো।’

আরমান ভদ্র বাচ্চার মত ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করে আছে। দুহা হেসে উঠলো। চিন্তিত স্বরে বলল,

‘ কোথায় পাবে বুট?’
‘ চোখ বন্ধ করো দুজন। এক থেকে দশ পর্যন্ত গননা করো। বুট হাতে আপনা আপনি চলে আসবে।’

ভ্রু যুগল কুঁচকে আরমান প্রত্যুওরে বলল,

‘ বাচ্চা পাইছো আমাদের? আমরা এখন আঠারো বছরের বুড়া,বুড়ি।’

‘ আমার ষোল। এবার চোখ বন্ধ করো।’

এলমার জিদের কাছে হার মানলো দুহা এবং আরমান। চোখ বন্ধ করলো। এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গননার মাঝেই কর্ণধারে টুংটাং শব্দ আসলো।
তিনজনের সামনে ভুট বিক্রেতা। মুখে গোফ, লম্বা দাঁড়ি, গায়ে সাদা গেঞ্জি, গলায় লাল গামছা ঝুলানো।
চোখে কালো চশমা। দুহা আজকে প্রথম চশমা ওয়ালা হকার দেখছে। বিষয়টা মজার। এলমার চোখমুখ চিকচিক করছে দুই বন্ধুকে জাদু দেখাতে পেরে। দশ টাকার করে তিন পুঁটলি কিনলো সবাই। দাম এলমা-ই দিলো। নাকচ করল না বাকী দুইজন। দুহার মনে হাজারো কৌতূহল। বুট ওয়ালাকে প্রশ্ন করল,
‘ আপনি কী কানা? চশমা পড়েছেন যে?’

কিছু বলছে না বুটওয়ালা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুহার পানে। পরপর দুইবার প্রশ্ন করে দুহা। পরিশেষে এলমার ধাক্কায় বুট ওয়ালার বুলি ফুটে।
‘ আমনে দেখতে পরীর লাহান সুন্দর।’

বোকা বনে যায় দুহা। আরমান মাথা চুলকায়। প্রসঙ্গ এড়াতে এলমা বলে ওঠে,
‘ জানো দুহামনি! এই স্টাইলিশ বুট ওয়ালা সব রকমের খাবার বিক্রি করে। ঝাল মুড়ি, ফুসকা,চটপটি , আইসক্রিম সব!’

অবিশ্বাসের চোখে তাকায় দুহা। ভালো করে পর্যবেক্ষণ করল বুটলার চেহারা। কিন্তু না, পরিচিত বলে মনে হচ্ছে না। দুহা বুট খাওয়ায় মননিবেশ করল। বুটওয়ালাকে সেখানে রেখে তিনজন হাঁটা ধরল সামনের দিকে। আজ হেঁটে হেঁটে গল্প করতে করতে বাসায় যাবে তিনজন। পিছনে ফেলে এসেছে হাসিমাখা মুখওয়ালা বুটওয়ালাকে। যে চশমা ঠিক করে ঝুড়িতে রাখা বুট কুটকুট করে খেতে ব্যস্ত।
———

কলেজ থেকে আসতে তিনটে বেজে গেলো দুহার। বাড়িতে প্রবেশ করতে রহিমা খালার আগমন ঘরে। দুহার ব্যাগ পত্র যথাস্থানে রেখে বলে,

‘ আফামনি কী খাইবেন? নুডুলস খাবেন নাকি একেবারে দুপুরের ভাত?’

‘ রহিমা খালা, মা খেয়েছে? আপনি খেয়েছেন?’

‘ ম্যাডাম আইসা খাইয়া আবার চলে গেছে অফিসে। আপনারে কইসে খাইয়া ঘুমাইযতেন, নইলে পড়তে বসতেন।’

‘ টেবিল সাজান খালা, আমি গোসল করে আসছি। একসাথে খাবো।’

খাওয়ার পর্ব সেরে দরজা আটকে দেয় দুহা। এক হাতে আরান ভাইয়ার চিরকুট, অপর হাতে নুপুর জোড়া। নুপুর জোড়া বিছানার উপর রেখে দুহা চিঠি হিতে নেয়। পুরো চিঠি আরো একবার পড়ে ভাবতে থাকে পূর্বের আরানের কথা এবং বর্তমান আরানের কথা। দুজনের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ কিন্তু একই। হয়তো সময়ের সাথে সাথে দুহাকে ভুলে গেছে।

দোহা একবার ইচ্ছা পোষণ করে চিরকুট খানা ছিঁড়ে ফেলবে। কিন্তু দোহার অনুভূতিরা দলা পাকিয়ে আসে। ছিড়ে না চিরকুট সযত্নে রেখে দেয় যথাস্থানে। এরপর নুপুর জোড়া পায়ে পরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ঘরের ভেতর। তারপর চলে যায় বারান্দায়।

ছোট্ট একটি দোলনা পাতা আছে বারান্দায়। মন খারাপ হোক বা মন ভালো। অসময় সেখানে বসে শহরের ব্যস্ততা দেখে দুহা। দূর-দূরান্তের উঁচু-নিচু দালানকোঠা দেখে। এটা নিত্যদিনের অভ্যাস। এখন তো আর খেলার বয়স নেই। এটা সেটা করে সময় কাটাতে হয় দুহার।

‘ দুহা, এই দুহা! এদিকে তাকাও! আমি এদিকে তোমার পিছনে?’

এলমার কণ্ঠস্বর। প্রথমে ভ্রম ভেবে দুহা মনোযোগ দেয় না কিন্তু পরমুহূর্তে এলমার কণ্ঠস্বর আরো বেশি শোনা গেলে দুহা এদিক সেদিক এলমার খোঁজ করে। পেয়েও যায়। দোলনার ঠিক পিছনে এলমাদের বিল্ডিং এবং সেখানের এক জানালায় এলমা দুহাকে ডেকে যাচ্ছে।
প্রায় বিশ হাত দূরত্বের বিল্ডিং খানা থেকে স্বর ভেসে আসছে। এলমাকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না শুধু চিৎকার শোনা যাচ্ছে।

দুহা হাত নাড়িয়ে হাই বলে। এদিকে এলমা আরো জোড়ে চিৎকার করে বলছে,’ বিকেলে আমি তোমার বাসায় আসবো,দরজা খুলে রেখো।’

মাথা নেড়ে হাত দিয়ে ইশারা করে হ্যাঁ বলে দেয় দুহা। এবং আনমনে হেসে ওঠে এলমার পাগলামি দেখে। মনে মনে ভাবে সত্যি মেয়েটা চমৎকার, চমৎকার চঞ্চল। এর সাথে থাকলে দুহা ঠিক আগের মত হয়ে যাবে।

——

ভেবেছিলাম দূরে চলে যাবো,
তোমায় ছেড়ে একা পথে হাঁটবো।
ভাগ্যে হয়তো তুমিই ছিলে!
তাইতো আবারও ফিরে এলে।
এইবার!
ছাড়বো না তোমার হাত,
শক্ত করে বাঁধবো বন্ধন
তুমি শুধু হবে, আমার আপনজন।

ডায়েরির উপর কয়েক লাইন লিখে দুহার হাস্যজ্বল মুখশ্রী মনে করে আরান। বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। জানালায় নিবদ্ধ করে আঁখি। মনে মনে বলে, ‘ এত সহজ না মিস দুহা! আগুনে পুড়তে হবে তোমাকে। যতটুকু জ্বলছি আমি ততটুকু তোমারও জ্বলতে হবে।’

চলবে………