দিওয়ানেগি পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
436

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৩৭+২৮+৩৯
#M_Sonali

প্রায় এক দেড় ঘন্টা হলো বিছানার ওপর চুপচাপ বসে আছে মেহরিমা। দুহাতে মাথাটা চেপে ধরে নিয়ে আছে সে। মাথাটা যেন ভীষণ রকম ভার হয়ে আছে তার। নানারকম চিন্তায় মাথা ব্যথা করতে শুরু করেছে। মেহের আসার পর থেকেই নিজের রুমে সবকিছু গোছাতে ব্যস্ত। মেহেরিমা এখন পর্যন্ত কোন কাজে হাত পর্যন্ত দেয়নি। সে কি ভাবছে সেটা নিয়ে বেশ বিরক্ত হচ্ছে মেহের। কিন্তু কিছু বলছে না। এদিকে প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে ওর। তবে মুখে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। তাই চুপচাপ নিজের রুমটা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে গোছাচ্ছে। হঠাৎ দরজায় নক করার শব্দে ধ্যান ভাঙে মেহরিমার। সে বিছানা ছেড়ে উঠে দরজার কাছে যায়। জিজ্ঞেস করে কে এসেছে। বাইরে থেকে সরণ বলে উঠে,

“দরজা খোলো মেহরিমা। আমি এসেছি একটু দরকার আছে।”

মেহরিমার ভীষণ রাগ উঠে যায়। সে রাগি কণ্ঠে বলে ওঠে,

“আপনি আবার কেন এসেছেন সরণ? প্লিজ চলে যান। আমার কিছু ভালো লাগছে না। এখন আমি দরজা খুলবো না। আর হ্যাঁ নেক্সটাইম এখানে আসার আগে অবশ্যই আমার অনুমতি নিবেন। আমি চাইনা আমার বাড়িতে কেউ এভাবে আসা-যাওয়া করুক।”

“আচ্ছা ঠিক আছে আমি চলে যাব। আর নেক্সট টাইম আসার আগে অবশ্যই তোমার অনুমতি নিবো। কিন্তু এখন অন্তত দরজাটা একটু খোলো। কথা দিচ্ছি পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নেবো না তোমার থেকে।”

মেহরিমা ভীষণ বিরক্ত হলেও একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরজাটি খুলে দেয়। খুলে দিতেই দেখে দরজার সামনে ফ্লোরে দুই ব্যাগভর্তি বাজার এবং একটি চাউলের বস্তা নিচে রাখা। সেগুলো দেখে ভ্রু কুঁচকায় মেহরিমা। সরণ মৃদু হেসে বলে,

“আসলে আমি জানি তোমার ঘরে এখন খাবার বলতে কিছু নেই। আর তাছাড়া তুমি আসার সময় কিছু নিয়েও আসোনি। তাই এগুলো তোমার জন্য নিয়ে এলাম। এটা দিয়ে অন্তত এক মাসের মতো চলতে পারবে। আর গাড়িতে কিছু জামাকাপড় রাখা আছে। তোমার আর মেহেরের জন্য। সেগুলোও দিয়ে যাচ্ছি। তোমরা ওগুলো নিলে আমি ভিষন খুশি হবো।”

ওর কথার উত্তরে ভীষণ রেগে যায় মেহরিমা। রাগি দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

“দয়া দেখাতে এসেছেন? আমি কি আপনাকে একবারও বলেছি আমাদের জন্য এগুলো নিয়ে আসতে? কোন কিছুর দরকার নেই আমাদের। যে গুলো নিয়ে এসেছেন সেগুলো ফিরিয়ে নিয়ে যান। আর হ্যাঁ নেক্সট টাইম এ সবকিছু নিয়ে আসার আগে দুবার ভাববেন। কোন কিছু চাইনা আমাদের। আমরা যেমন আছি তেমনি থাকতে দিন। প্লিজ লিভ মি এলোন।”

কথাটি বলেই সরণকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওর মুখের উপর ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দেয় মেহরিমা।

তবুও ছ্যাঁচড়ার মত বেশ কয়েকবার ওকে ডাকতে থাকে সরণ। কিন্তু মেহরিমা ভিতর থেকে কোন উত্তর দেয়না। মেহের এসে দরজা খুলে দিতে চাইলে তাকে অগ্নিদৃষ্টি দেখিয়ে ভয় দেখিয়ে সরে যেতে বলে। সরণ বেশ কয়েকবার ডেকে সারা না পেয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রাইভারকে দিয়ে জিনিস গুলো ফেরত নিয়ে চলে যায়। মেহের বেশ রাগী ভাব নিয়ে মেহরিমার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

“এটা তুমি কি করলে আপু! ভাইয়া টা কত আশা করে আমাদের জন্য এত কিছু নিয়ে এসেছিল। আমার ভিষন খুধা লেগেছে। আর তুমি তাকে ফিরিয়ে দিলে? সরণ ভাইয়া কিন্তু ততটাও খারাপ নয় যতটা আলমির ভাইয়া ছিল।”

কথাটি বলার সাথে সাথে মেহরিমা গর্জে উঠে বলে উঠলো,

“এক থাপ্পর দিয়ে মুখের সবগুলো দাঁত ফেলে দিবো মেহের। খবরদার না বুঝে উল্টোপাল্টা কথা বলবি না। মানুষকে কতটুকু চিনতে শিখেছিস তুই? আমি তোর বড় বোন এটা ভুলে যাস না। যেখানে আলমিরকে এতোটা বিশ্বাস করে, ভরসা করে, ভালোবেসে বিয়ে করার পরেও সে আমাকে এতো বড় ধোকা দিলো। সেখানে অন্য কাউকে এত সহজে কি করে বিশ্বাস করব আমি? আর সরণকে তো কখনোই নয়। যে সরণ কিনা এক সময় আমাকে বিয়ে করার জন্য আমার সাথে অনেক বাজে আচরণ করেছিল। খুন করার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিল। তাকে তো কখনোই আমার জীবনে কোনো প্রশ্রয় দিব না আমি। তাই তোকে এখনি বলে দিচ্ছি মেহের। খবরদার সরণের দিকে দয়া দেখাতে যাবি না। আর বেশি ভাইয়া ভাইয়া করবি না। এখন আমাদের দু বোনের আমরা দুজন ছাড়া অন্য কেউ নেই। শুধু আল্লাহ আছেন তায়ালার উপর ভরসা রাখ। তোর খিদে পেয়েছে! তুই রুমে যা আমি তোর খাবারের ব্যবস্থা করছি।”

মেহরিমার ধমকে আর কিছু বলার মত সাহস পায়না মেহের। এর আগে কখনোই তার বোন তাকে এভাবে থমকে কথা বলেনি। তাই চুপচাপ মাথা নিচু করে নিজের রুমে চলে যায় সে। ও চলে যেতেই মেহরিমা একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে যায় কিচেনে। সেখানে গিয়ে একটা একটা করে সবগুলো বক্স খুলে দেখে সে। শুধু চাউলের ড্রামে অল্প একটু চাউল আছে। আর তরকারির ঝুড়ির মধ্যে বেশ কয়েকটা আলু। যার মাঝে অল্প কিছু পঁচে গেছে। অল্প কিছু ভালো আছে। মেহরিমা একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চাউল নিয়ে ধুয়ে ভাত বসিয়ে দেয়। তারপর আলুগুলো সিদ্ধ তুলে দেয় আরেক চুলায়। ভাত রান্না করে আলুগুলো কোনমতে লবণ ও মরিচের গুড়া দিয়ে ভর্তা করে সেটা দিয়ে ভাত নিয়ে যায় মেহের এর কাছে। তারপর চাপা গলায় বলে,

“মেহের কষ্ট করে এখন এই খাবারটুকু খেয়ে নে বোন। আমি তোর জন্য ভাল খাবারের ব্যবস্থা করব। চিন্তা করিস না। যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে।”

মেহের চুপচাপ বিছানার ওপর বসেছিল। মেহরিমার কথা শুনে প্লেটের দিকে তাকিয়ে সেটা হাতে নেয় সে। খাবার টেবিলে রেখে হাত ধুয়ে খেতে শুরু করে। মেহেরিমা বেশ ভালো করেই জানে তার ছোটবোনটা এসব খাবার খেতে পারে না। তাকে এই খাবারটা দিয়ে যেন বুকটা পুড়ে যাচ্ছে তার। কিন্তু তবুও সে সরনের সাহায্য নেবে না। যেভাবেই হোক নিজেই কিছু করবে। আর আলমিরকে তো কখনোই ক্ষমা করবেনা সে। আজ তার জন্যই এই অবস্থা হয়েছে ওদের।

,
,
,
রাত প্রায় বারোটা বাজে।
মেহের ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ আগেই। ওর পাশেই লাইট অফ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে বসে আছে মেহরিমা। মাথাটা ঝিম মেরে আছে তার। নানা রকম টেনশনে যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে সে। কোনভাবেই বুঝতে পারছে না কি করবে। রাতে না হয় মেহেরকে শুধুমাত্র আলু ভর্তা করে খাইয়ে কাটিয়ে নিল। কিন্তু কাল সকাল থেকে কিভাবে চলবে তারা? ঘরে নেই বলতে কিছুই নেই। শুধু অল্পকিছু চাউল ছাড়া। যা দিয়ে হয়তো দুই থেকে তিন দিন চলবে। মেহরিমা বুঝতে পারছে না এখন কি করা উচিত তার। এত সহজে যে কোন চাকরি জুটবে না, সেটা বেশ ভালো করেই জানে সে। চাকরি খুঁজতে হলে বেশ কিছুদিন সময়ের দরকার। কিন্তু এ কদিন কি দিয়ে চলবে তারা?

কথাগুলো ভেবেই যেন মাথা আরো বেশি ব্যথা করছে মেহরিমার। সে এবার কপাল থেকে হাত সরিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাতটা সামনে আনে। তখনই তার নজর পড়ে হাতে থাকা আংটিতে। এই আংটিটা বিয়ের রাতে আলমির ওকে দিয়েছিল। ওর কথা মনে পড়তেই রাগে যেন সারা শরীরে আগুন জ্বলে ওঠে তার। সাথে সাথে আংটিটা হাত থেকে খুলে ছুড়ে মারতে গিয়েও থেমে যায় সে। মনে মনে ভাবে এই আংটিটা বিক্রি করে চলতে পারবে অনেক দিন। ততদিনে একটি চাকরিও জোগার করে নিতে পারবে। কথাটি ভেবে মুখে হাসি ফুটে ওঠে তার। পরক্ষনেই আবার মুখটা গোমড়া হয়ে যায়।

মনে মনে ভাবে কখনো যদি আবার আলমির এসে এই আংটিটার দাবী করে! তাহলে কি উত্তর দেবে সে? সে কখনোই চায়না আলমিরের কোনো স্মৃতি নিজের সাথে নিয়ে বেড়াতে। ওকে মন থেকে শরীর থেকে সব জায়গা থেকে মুছে ফেলতে চায় সে। তাই আংটিটা ও নিজের কাছে রাখবে না। কিন্তু পরে যদি আবার আলমির এসে আংটির দাবি করে তখন কি উত্তর দিবে? এটা ভেবেই যেন আবারো মুখটা গম্ভীর হয়ে যায় তার। তখনই আবার একটি কথা খেয়াল হতেই মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে মনে মনে বলে কখনো যদি আলমির এসে আংটি ফেরত চায়। তখন সেও বলে দিবে তাকে গিফট করা সেই আংটিটা ফিরিয়ে দিতে। যেটা সে গিফট বক্স এ পেয়েছিল। সেটা তো আলমির রেখে দিয়েছে। মেহরিমা চিন্তা করে সকালে উঠেই এই আংটিটা বিক্রি করে দিবে সে।

যেই ভাবা সেই কাজ। সকালে উঠে মেহেরকে নিয়ে স্কুলে রেখে সে চলে যায় বড় একটি জুয়েলারির দোকানে। সেখানে গিয়ে আংটিটা দেখাতেই তারা বলে ওঠে, এটা অনেক এক্সপেন্সিভ একটি আংটি। এটার মূল্য কয়েক লক্ষ টাকা। মেহরিমা আংটিটা নিয়ে তাকে টাকা দিতে বলে। কিন্তু লোকটি জানতে চায় এত দামি আংটি সে কোথায় পেল? আর কেন বিক্রি করতে এসেছে। মেহরিমা কি বলবে বুঝে পায়না। শেষে নিজেকে কঠোর করে বলে ওঠে,

“এটা আমার স্বামী আমাকে দিয়েছিল। এখন তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই এটা আমি আর নিজের কাছে রাখতে চাইনা। আপনি এটা রেখে আমায় টাকা দিন।”

ওর কথার উত্তরে লোকটি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে। তারপর বলে,

“আপনি কি সত্যি বলছেন? এটা আবার চুরির মাল নয়তো?”

মেহরিমা এবার বড্ড রেগে যায়। রাগি গলায় ধমকের সুরে বলে ওঠে,

“আপনার এটা না নেওয়ার হলে নিবেন না। কিন্তু উল্টোপাল্টা কথা বলবেন না খবরদার বলে দিচ্ছি। আংটিটা ফেরত দিন আমি অন্য কোথাও বিক্রি করব। এটা আপনার নিতে হবে না। ঢাকা শহরে জুয়েলারির দোকানের অভাব নেই।”

লোকটি আংটিটার অনেক লোভে পরে যায়। তাই সে সাথে সাথে বলে ওঠে,

“সরি ম্যাডাম আমার ভুল হয়ে গেছে। এটা আমি রেখে দিচ্ছি। আর আপনাকে এর মূল্য দিয়ে দিচ্ছি।”

মেহরিমা আর কিছু বলে না। আংটি বিক্রির টাকাগুলো নিয়ে সোজা বাসায় ফিরে আসে। আলমারিতে টাকাগুলো ভালো করে তালা দিয়ে রেখে, সেখান থেকে কিছু টাকা নিয়ে চলে যায় বাজারে। প্রয়োজনিয় কিছু জিনিস কিনে নিয়ে আবারও সে বাসায় ফিরে আসে। দ্রুত সব কাজ শেষ করে দুপুরের জন্য রান্না বসিয়ে দেয়।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৩৮
#M_Sonali

১৫ দিন পর,
সোফার উপর বসে থেকে ল্যাপটপে কাজ করছে আলমির। আশেপাশে কোন দিকে নজর নেই তার। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন গার্ড। গত ১৫ দিনে দিলরুবা বেগম খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া আলমিরের সাথে একটা কথা ও বলে নি। যতটা সম্ভব ওকে এড়িয়ে চলেছে। তাতে আলমিরের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। সেটা তার আচরণ দেখেই বোঝা যায়। সে যেন কয়েকদিন হলো অনেক বেশি ব্যস্ত থাকতে শুরু করেছে। কিছু একটা করছে সে। এটা দিলরুবা বেগম বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারেন। কিন্তু এগিয়ে এসে কোন রকম প্রশ্ন করেন না। কারণ ওর প্রতি বড্ড বেশি অভিমান তার। রাগটাও প্রচুর। একমাত্র ওর কারনে মেহরিমার কাছে মাথা হেঁট হয়েছে দিলরুবা বেগমের।

সোফায় বসে আলমির যখন মনোযোগ দিয়ে কোন কাজে ব্যস্ত। তখনই বাইরে থেকে একজন গার্ড একটি লিটার নিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ায়। সেটা এগিয়ে দিয়ে বলে,

“স্যার এটা আপনার জন্য এসেছে।”

আলমির ল্যাপটপের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সে দিকে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে লেটার টা হাতে নিয়ে খুলে দেখে ওটা ডিভোর্স পেপার। মেহরিমা ওকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে। এটা দেখেও যেন ওর মধ্যে কোনরকম ভাবান্তর দেখা যায় না। সে স্বাভাবিক ভাবেই ডিভোর্স পেপার টা পাশে টেবিলের উপর রেখে আবারো ল্যাপটপে কাজ করতে শুরু করে। তারপর কিছুক্ষণ কেটে যেতেই ওর ফোনটা টুংটাং শব্দে বেজে ওঠে। সে ল্যাপটপের দিক থেকে চোখ সরিয়ে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। ওই পাশ থেকে কারো কথা শুনে সে ল্যাপটপটা রেখে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। দেরি না করে গার্ডদের নিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে যায়।

এতক্ষণ দূর থেকে সবকিছুই তীক্ষ্ণ নজরে দেখছিলেন দিলরুবা বেগম। উনি ওর কাজকর্ম ধরার জন্য ওকে চোখে চোখে রাখছে বেশ কয়েকদিন হল। তিনি আর দেরি না করে দ্রুত ওর পিছু পিছু ছুটে এলেন। ড্রাইভারকে বললেন আলমিরের গাড়ির পিছু নিতে। সে কোথায় যায় সেখানে নিয়ে যেতে। ড্রাইভার তার কথামতো আলমিরের গাড়ির পিছনে ছুটল। প্রায় ১৫ মিনিটের রাস্তা পেরিয়ে আলমির একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। এটা বাড়ির মত দেখতে হলেও ভিতরে আসলে একটা ক্লিনিক।

চারিদিকে অন্ধকারে ছেয়ে আছে। রাত প্রায় ১০ টা বাজে। দিলরুবা বেগম গাড়ির পিছনে অনেক দূরে গাড়ি থামালো। আলমির যেন বুঝতে না পারে সে জন্য যথেষ্ট দুরত্ব বজায় রাখলো সে। আলমির গাড়ি থেকে নেমে সোজা বাড়ির মধ্যে ঢুকে যায়। তারপর তৃতীয় তলায় একটি রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দুবার দরজায় টোকা দিতেই একজন নার্স এসে দরজাটা ভেতর থেকে খুলে দেয়। সে ভিতরে গিয়ে দেখে শেফালী বেগম এর জ্ঞান ফিরেছে। প্রায় একমাস হলো চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। ওনার বেঁচে থাকার কথা আলমির ছাড়া আর কেউ জানে না। শেফালী বেগম এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছে। আলমির রাগি দৃষ্টিতে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে দরজায় দাঁড়িয়ে। কোন রকম কথা বলে না সে। তারপর একপা একপা করে কাছে এগিয়ে যেতে থাকে। তখনই শেফালী বেগম ওর দিকে তাকায়। ওকে দেখেই যেন থমকে যান তিনি। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ওর দিকে। দু চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ে তার।

কিন্তু ওনার চোখের জল যেন আলমিরের মন গলাতে পারে না। সে আরও বেশি রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার মায়ের দিকে। তার কাছে এগিয়ে গিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

“কি ভেবেছেন আপনি, এত সহজেই মরে যাবেন? আমার পিছনে আমার’ই বউ এর সাথে হাত মিলিয়ে আমার ক্ষতি করে এতো সহজে মরতে পারবেন? আমি আপনাকে কখনোই মরতে দিবো না। আমার সাথে যে অন্যায় গুলো করেছেন তার সবকিছুর সাজা ভোগ করতে হবে আপনাকে। এত সহজে আপনার মৃত্যু নেই মিসেস শেফালী বেগম।”

ওর কথা শুনে শেফালী বেগম কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। অঝোরধারায় কাঁদতে লাগলেন। কান্নার শব্দ দীর্ঘ হলো তার। তাকে কান্না করতে দেখে আলমির কঠোর গলায় বলে উঠল,

“আপনার ঐ মিথ্যে চোখের জলে আলমিরের মন কখনই গলবে না। সত্যি করে বলুন কি উদ্যেশ্য আপনার? কেন আমাকে মারার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। আর মেহরিমা কে কোন উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলেন আমার বাসায়? কেন ওকে দিয়ে ভালোবাসার নাটক করিয়েছেন আমার সাথে?”

ওর কথার উত্তরে শেফালী বেগম নিজের চোখের জল মুছে নিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলেন। কিন্তু শরীর এতটাই দুর্বল যে তিনি সেটা পারলেন না। পাশ থেকে নার্স এসে তাকে উঠে বসতে সাহায্য করতে চাইলে আলমির তাকে রাগি চোখে ইশারা করে বাইরে যেতে বলল। সে বাইরে চলে গেলে শেফালী বেগম শুয়ে থেকে কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বললেন,

“তুই আমাকে ভুল বুঝছিস বাবা আলমির। সাথে ঐ নিশ্পাপ মেয়ে মেহরিমাকেও। ওই মেয়েটার কোন দোষ নেই। ও অনেক ভালো একটি মেয়ে। তোকে বড্ড ভালোবাসে ও। তুই ওকে ভুল বুঝিস না আলমির। তাহলে অনেক বেশি পস্তাবি।”

“আমি ওর হয়ে আপনার ওকালতি শুনতে চাইনি। যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটার উত্তর দিন। কেন করছেন এসব কোন স্বার্থ লুকিয়ে আছে এর পিছনে? আমার বাবার জীবনটাকে ধ্বংস করেছেন। ছোট ভাইটাকে ও মেরে ফেলেছেন। এখন আমার আর আমার দিদুনের পিছু কেন পড়ে আছেন? মেহরিমা কে কেন পাঠিয়ে ছিলেন, আমাদের সব খবরা খবর নিতে তাই না?”

“চুপ কর আলমির, চুপ কর। এমন কিছু বলিস না যার জন্য পরে অনেক পস্তাতে হয়। আমি হয়তো আর বেশিক্ষণ থাকবো না। তাই তোর ভুল গুলো ঠিক করে দেওয়ার একটা সুযোগ দে।”

কথাগুলো বলে জোরে জোরে হাঁপাতে থাকে শেফালী বেগম। কিন্তু ওনার অবস্থা দেখেও যেন বিন্দু পরিমাণ মায়া হয় না আলমিরের মনে। সে ঘৃণার দৃষ্টিতে অন্য দিকে চোখ সরিয়ে নেয়। বাইরে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সবকিছুই শুনছিলেন দিলরুবা বেগম। তিনি আর দেরি না করে দ্রুত রুমের মধ্যে ঢুকে পড়েন। শেফালী বেগম এর কাছে এগিয়ে গিয়ে তার মাথার কাছে বসেন। তার মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না করে দিয়ে বলেন,

“মা শেফালী, কেমন আছো তুমি? কত বছর পর তোমাকে দেখছি। কখনো কল্পনাও করিনি তোমাকে এ অবস্থায় দেখতে পাবো। আমি জানি তুমি নির্দোষ। তোমার প্রতি সে বিশ্বাস আছে আমার। ওকে কিছু বলতে হবে না। ও তো মানুষ নয় ও একটা পাথর। তুতি আমাকে বল। আমি সব কথা শুনব।”

শেফালী বেগম দুচোখের পানি ঝরঝরিয়ে ছেড়ে দেন। কান্না যেন বাদ মানছে না তার। দিলরুবা বেগমের হাতটি নিজ হাতে চেপে ধরে কান্না করতে করতে ভেঙে ভেঙে বলেন,

“আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন মা। আমি আপনার ভালবাসার যোগ্য নই। আপনি আমাকে নিজের মায়ের চাইতেও বেশি ভালবাসা দিয়েছেন। কিন্তু সেই আমি আপনাদের সকলের সাথে প্রতারণা করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিন।”

দিলরুবা বেগম মাথায় হাত বুলায়। ওনাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন,

“তুমি আমাকে বল কি হয়েছিল সেদিন? কেন এমন করেছিলে তুমি? আমি তোমাকে বিশ্বাস করি শেফালী।”

এতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনছিল আলমির। কেন জানেনা তার বাধা দিতে ইচ্ছে করছে না ওনাদের। তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনে যাচ্ছে। শেফালী বেগম এবার একে একে সব কিছু বলতে শুরু করল তার শাশুরিকে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওনার ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তবুও একের পর এক সবকিছু বলে গেলেন তিনি। যে সব কথা মেহরিমা কে বলেছিল। সাথে মেহরিমা যে কতটা রিস্ক নিয়েছে আলমিরকে বাঁচানোর জন্য। সবকিছুই বললো সে। সব শুনে যেন অবাকের শীর্ষে পৌঁছে গেলেন দিলরুবা বেগম। তার চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হল। দুচোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। কি বলবেন বুঝতে পারছেন না তিনি। আলমির দূরে দাঁড়িয়ে থেকে সব কথাই শুনেছে। তার চোখ থেকেও অশ্রু ঝরছে। সে এবার কাছে এগিয়ে আসে। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে,

“যদি এগুলো সত্যি হয়, তাহলে মেহরিমা আপনাকে ছুরি মারল কেন? আমি নিজের চোখে দেখেছি মেহরিমা আপনাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে। আপনি রক্তাক্ত অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে ছিলেন। আর ওর হাতে রক্তাক্ত ছুড়ি ছিলো।”

শেফালী বেগম এর কথা বলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তবুও তিনি নিজের কষ্টকে দমিয়ে রেখে জোর করে বললেন,

“চোখের দেখা সব সময় সত্যি হয় না আলমির। মেহরিমা আমাকে কেনো, কাউকেই স্বপ্নেও আঘাত করতে পারে না। ও বড্ড ভালো একটি মেয়ে। ওর মতো মেয়ে আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। সেদিন ওর কাছে সব কিছু বলার পর আমরা দুজন বসেছিলাম। হঠাৎ ওদের পিছনের দরজা দিয়ে একজন মুখোশ পরা লোক প্রবেশ করে। সে পিছনের দরজা কিভাবে খুললো আমরা জানি না। লোকটির সারা শরীর কালো কাপড়ে ঢাকা ছিল। চোখটাও দেখা যাচ্ছিল না। সে রুমে এসেই আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার পেটে ছুরি বসিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটে যায় যা আমরা কল্পনাও করিনি। লোকটা দেরি না করে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে চলে যায়। মেহরিমা চিৎকার করার সময়ও পায়নি। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। যতক্ষণে সব বুঝতে পারে, সে দ্রুত এসে আমার পেটের ছুড়িটা হাতে তুলে নেয়। আমি ব্যথায় চিৎকার করে উঠি। আর তখনই সেখানে আসিস তুই। তারপর আর আমার কিছু মনে নাই। ঐ মেয়েটার কোনো দোষ নেই। ও একদম নিশ্পাপ নির্দোষ একটি মেয়ে।”

কথাগুলো বলেই জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে শেফালী বেগম। তার অবস্থা ধীরে ধীরে বেগতিক হতে থাকে। আলমির সব শোনার পর কয়েকপা পিছনে গিয়ে দেওয়ালের সাথে আটকে যায়। ঠাস করে ফ্লোরে বসে পড়ে মনে মনে ভাবতে থাকে, মেহরিমার সাথে কি করেছে সে। কত বড় অন্যায় করেছে ওই নিষ্পাপ মেয়েটির সাথে।” তখনই খেয়াল করে শেফালী বেগম কেমন যেন করছেন। ওনার চোখ উল্টে যেতে থাকে। প্রচন্ড শ্বাস কষ্ট শুরু হয়। মুহূর্তের মধ্যে উনার অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যায়। দিলরুবা বেগম চিৎকার করে ডাক্তার ডাক্তার বলে ডাকতে থাকে। কিন্তু ডাক্তার আসতে আসতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শেফালী বেগম। দিলরুবা বেগম তা সহ্য করতে পারেন না। তিনি ও শেফালী বলে একটি চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে পরে যান।

ঘটনার আকস্মিকতায় যেন থমকে যায় আলমির। সে হাবলার মত তাকিয়ে থাকে উনাদের দুজনের দিকে। তারপর কান্না করতে করতে চিৎকার করে ডাক্তারকে ডাকতে থাকে। ডাক্তার এসে দ্রুত দুজনকে আলাদা করে। তারপর চেক করে বলে শেফালী বেগম মারা গেছেন। আর দিলরুবা বেগম এর অবস্থা ভীষণ খারাপ। ওনাকে দ্রুত চিকিৎসার ব্যাবস্থা করেন। জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতে থাকে ডাক্তার। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে দিলরুবা বেগমের জ্ঞান ফেরার বদলে ভীষণরকম শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আর সে ঐ অবস্থাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানান ওনার ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে। সাথে প্রেসার অতিরিক্ত হাই হওয়ায় মৃত্যু বরণ করেছেন তিনি।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৩৯
#M_Sonali

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছে মেহরিমা। অফিস যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে তার। ছোটখাটো একটি কম্পানিতে চাকরি জোগাড় করেছে সে। বেতন মাত্র ৮০০০ টাকা। তবুও কোনমতে চলে যাবে দু বোনের। ছোট্ট কোম্পানি হলেও অনেক কষ্টে যোগাড় করেছে সে এই চাকরিটা। এর চাইতে ভাল কিছু হয়তো পাওয়া সম্ভব নয় এখন। তাই এত টুকুতেই খুশি রেখেছে নিজেকে। মেহেরকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে তারপর নিজের অফিসে যাবে মেহরিমা। হঠাৎ ফোনের ক্রিংক্রিং শব্দে ধ্যান ভাঙে তার। ফোন হাতে নিয়ে দেখে অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। ধরবে কি ধরবে না ভাবতে ভাবতেই রিসিভ করে ফোনটা। কানের কাছে ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে আলমির কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে ডাক দেয় তাকে,

“হ্যালো মেহু!”

ডাকটা শুনতেই যেন বুকের মাঝে কেঁপে ওঠে মেহরিমার। সে কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থাকে। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে কোনরকম উত্তর না দিয়েই ফোনটা কেটে দিয়ে নাম্বারটা ব্লক করে দেয়। আলমির এর সাথে কথা বলতে চায় না সে। কখনোই না। কোন ভাবে তার প্রতি আর নিজেকে দুর্বল করতে চায় না। তাই আলমিরের সব নাম্বার ব্লক লিস্টে ফেলে রেখেছে। নতুন নাম্বার থেকে ফোন দেওয়ায় বুঝতে পারেনি সে। কিছুক্ষণ পর আবার অন্য নাম্বার থেকে ফোন আসে মেহরিমার কাছে। এবার আর মেহরিমা সাহস করে ফোনটা ধরে না। রাগ করে অফ করে রেখে দেয় ফোনটা। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দ্রুত নিজে তৈরী হয়ে মেহেরকে নিয়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে পরে। দরজা খুলে বাইরে বের হতেই দেখে গেটের সামনে সরণ দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি নিয়ে। মুখটা তার কাঁদো কাঁদো হয়ে আছে।

মেহরিমা থমকে দাঁড়ায়। একবার ভাবে সরণ কে জিজ্ঞেস করবে সে এভাবে কেন দাঁড়িয়ে আছে। পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে তাকে পাশ কাটিয়ে মেহেরকে নিয়ে চলে যেতে নেয় সে। তখনই পিছন থেকে সরণ ডেকে বলে ওঠে,

“মেহরিমা দিদুন আর আমাদের মাঝে নেই। চলে গেছে না ফেরার দেশে।”

কথাটি শুনে যেন সেখানেই পাথর হয়ে যায় মেহরিমার পা। মেহেরেরও একই অবস্থা। চমকে ওঠে পিছনে ঘুরে তাকায় দুজনেই। দেখে সরণের চোখে পানি টলমল করছে। ওদেরকে তাকাতে দেখে সরণ আবার বলে ওঠে,

“হ্যা মেহরিমা কাল রাতে দিদুন মারা গেছেন। স্টোক করেছেন তিনি। আজকে জোহর নামাজ পর উনার জানাজা ও কবর। তুমি যাবে না শেষবারের মতো দিদুনকে দেখতে?”

মেহরিমার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যায়। হাত-পা কাঁপতে শুরু করে তার। সে কাপা কাপা কন্ঠে ছল ছল চোখে জিজ্ঞেস করে,

“আ আপনি কী বলছেন এসব সরণ! দিদুন নেই মানে? এমনটা হতে পারে না।”

এতোটুকু বলতেই চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে মেহরিমার। মেহেরও কান্না করতে শুরু করেছে। ওরা দুজন দিদুনকে প্রচন্ড ভালোবাসে। দিদুনের আদর মাখা ডাক, স্নেহে মাখা ভালোবাসা কোনো কিছুই যে তারা ভুলতে পারেনি। সরণ ওদের কান্না করতে দেখে এগিয়ে এসে বলে,

“কান্না করো না তোমরা। চলো আমার সাথে। একটু পরেই দিদুন কে হয়তো নিয়ে যাবে কবর দেওয়ার উদ্দেশ্যে। শেষবারের মতো তাকে দেখে আসো তোমরা।”

মেহরিমা আর মেহের কোন রকম কথা বলেনা। সরণের কথা মত সোজা গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে। তারপর ওর সাথে রওনা দেয় আলমিরের বাসার উদ্দেশ্যে।

বাসার গেটের সামনে এসে গাড়ি থামতেই গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে গেটের মধ্যে চলে যায় মেহরিমা ও মেহের। সামনে থাকা লোকজনদের ঠেলে সোজা বাসার ভিতরে ঢুকে যায় তারা। বাসার ভিতর গিয়ে দেখে মসজিদের দুটি খাটিয়ায় সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা হয়েছে দুটি লাশ।

দুটি লাশের খাটিয়া দেখে বেশ অবাক হয় মেহরিমা। সেইসাথে বুকের মধ্যে চাপা কষ্ট ভর করে বসে তার। সে মৃদু পায়ে একপা একপা করে এগিয়ে যায় লাশ গুলোর কাছে। তাকে দেখে দুজন মহিলা এসে বাধা দিতে চাইলে দূর থেকে আলমির তাদের ইশারা করে সরে যেতে বলে। তারা থেমে যায়, মেহরিমা এতক্ষণ হল আসলেও আলমিরকে দেখে নি। কিন্তু আলমিরের নজর তারই দিকে। মেহরিমা খাটিয়ার সামনে গিয়ে বসে। একটি খাটিয়ার উপরের পর্দা কাপা হাতে সরাতেই দেখে সেখানে শেফালী বেগম এর লাশ। ওনার লাশ দেখেই ছিটকে পরার মত পিছিয়ে যায় সে। ততক্ষণে মেহের গিয়ে পাশের খাটিয়ার লাশের মুখের উপরের পর্দাটা সরিয়ে দেয়। সেখানে দিলরুবা বেগম এর লাশ।

দুজনেই কান্নায় ভেঙে পরে। মেহরিমা একবার দিলরুবা বেগম এর জন্য আর একবার শেফালী বেগম এর জন্য কান্না করতে থাকে। চোখের জল যেন কিছুতেই সামলে রাখতে পারছেনা সে। শেফালী বেগম এর সাথে মাত্র ২ দিনের পরিচয় হলেও তার প্রতি আলাদা একটি ভালোবাসা চলে এসেছিল মেহরিমার। তাকে মা বলে ডেকেছিলো সে। নিজের মায়ের জায়গায় ঠাই দিয়েছিলো তাকে। তাই কোনভাবেই তার মৃত্যুকেও মেনে নিতে পারছে না সে। নিজে চোখে দেখে ছিল তার ওপর আক্রমণ হওয়ার নির্মম দৃশ্য।
,
,
,
দুপুর ২:৩৫ মিনিট
বাসার এক কোনায় পড়ে থেকে কান্না করছে মেহরিমা ও মেহের। দিলরুবা বেগম ও শেফালী বেগম কে কবর দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে অনেকক্ষণ আগেই। এতক্ষনে হয়তো কবর দিয়ে চলে আসতে শুরু করেছে সবাই।

একটু পরে দরজা দিয়ে প্রবেশ করে আলমির। ভীষণ বিধ্বস্ত দেখা যাচ্ছে তাকে। মুখটা শুকিয়ে একদম কালো হয়ে আছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ কষ্ট যাচ্ছে তার উপর দিয়ে। মেহরিমা এক নজর তার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। নিমিষে মুখটা গম্ভীর হয়ে আসে তার। চোখের জল মুছে মেহেরের দিকে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বলে,

“চল মেহের এখন আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে। এখানে আর থাকার সময় নেই। যার জন্য এসেছিলাম সে তো আমাদের ছেড়ে চলে গেছে সারা জীবনের মতো। এখানে থেকে আর কোন কাজ নেই। চল আমরা বাড়ি ফিরে যাই।”

কথাটি বলেই মেহেরের হাত ধরে ওকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। তারপর রওনা হয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। দরজার কাছাকাছি আসতেই আলমির তাদের পথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়ে। করুন দৃষ্টিতে মেহরিমার দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,

“কোথায় যাচ্ছ মেহু, আমাকে এভাবে একা ফেলে? তুমি চলে গেলে আমি কাকে নিয়ে থাকবো বল। আমি যে চারদিক থেকে শেষ হয়ে গেছি। বরবাদ হয়ে গেছি তোমায় ছাড়া।”

ওর কথার উত্তরে কিছু বলেনা মেহরিমা। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় সে। রাগে তার মুখটা বিষিয়ে আছে। সে আলমিরকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়। তখনই তার হাত চেপে ধরে আলমির। করুন গলায় বলে,

“প্লিজ মেহু আমাকে ছেড়ে চলে যেওনা। দিদুন আমায় ছেড়ে চলে গেছে। তুমিও যদি এভাবে ছেড়ে চলে যাও দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো আমি। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। ফিরে আসো।”

এতোটুকু বলতেই ঝাড়ি মেরে ওর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয় মেহরিমা। দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

“ভুল করেও আমার হাত ধরার চেষ্টা করবেন না মিস্টার আলমির। ভুলে যাবেন না আমি আপনাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছি। আপনার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই। এখানে আসার উদ্দেশ্য ছিল একমাত্র দিদুন। সেও আজ ছেড়ে চলে গেছে। তাই এখানে আর এক মুহূর্ত দেরি করতে চাইনা। ভুল করেও আমার পিছু নেওয়ার চেষ্টা করবেন না। ভেবে নেবেন দিদুনের মতো আমিও মরে গেছি আপনার জন্য।”

কথাটি বলেই ওকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেহেরের হাত ধরে নিয়ে সোজা বাসা থেকে বেরিয়ে এল মেহরিমা। সামনেই সরণ দাঁড়িয়ে ছিলো গাড়ি নিয়ে। কোনো কিছু চিন্তাভাবনা না করে সোজা গিয়ে সেই গাড়িতে উঠে বসলো তারা। তারপর রওনা হলো বাড়ির উদ্যেশে।

বাড়ির সামনে এসে নামতেই গাড়ি থেকে নেমে মেহের কে নিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে যাওয়ার জন্য রওনা হল মেহরিমা। তখনি সরণ তাদের থামিয়ে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

“তুমি কি এখনো আমার উপর রেগে আছো মেহরিমা? আমি সত্যিই বুঝতে পারছিনা, আমার ওপর তোমার রাগ করার কারণ। গত ১৫ থেকে ২০ দিনে তোমার সাথে কথা বলার জন্য কম চেষ্টা করিনি আমি। কিন্তু তুমি বার বার আমায় ইগনোর করছো কেনো? প্লিজ মেহরিমা একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমি তোমার বন্ধু হয়ে থাকতে চাই। তোমার সকল বিপদে তোমার পাশে থাকতে চাই। তুমি একা একটি মেয়ে হয়ে এ সমাজে বেচে থাকতে পারবে না। আমি তোমার ঢাল হয়ে পাশে থাকতে চাই।”

ওর কথার উত্তরে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে মেহরিমা। মাথা নিচের দিকে দিয়ে যতটা সম্ভব নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে সে। তারপর গম্ভীর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

“দেখুন সরণ আমি আজ কোন তর্ক করার মুডে নেই। আর না আছি কোন বাড়তি কথা বলার মুডে। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। আপনি এখন ফিরে যান। এ বিষয়ে আমরা পরে কথা বলব।”

কথাটা বলে চলে যেতে নিলেই সরণ আমার বলে ওঠে,

“তুমি এভাবে একা একটি মেয়ে হয়ে সমাজে চলতে পারবে না। মাথা উচু করে বাচতে হলে তোমার একজন বন্ধুর দরকার। আর সেই বন্ধুটা আমি হতে চাই। প্লিজ মেহরি,,,!”

এতটুকু বলতেই ওকে থামিয়ে দিয়ে মেহরিমা রাগি গলায় বলে উঠলো,

“আমি একা একটি মেয়ে মানুষ হলেও আমার সাথে আমার রব আমার আল্লাহ আছেন। তাই কোনো কিছুকেই পরোয়া করিনা। আমি একা থাকতে পারবো। নিজেকে সেফ করার মতো, সমাজে মাথা উচু করে বাঁচার মত শিক্ষা দিয়ে গেছেন আমার বাবা। আপনি ফিরে যান সরণ। আপনার কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই।”

চলবে,,,,,,,,,,,,,