দ্বিতীয় সূচনা পর্ব-১০+১১+১২

0
442

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_১০
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

মুখোমুখি বসে আছে ফারহান এবং অয়নন্দিতা। বেশ অস্বস্তি হচ্ছে অয়নন্দিতার। এভাবে কোনো পুরুষ মানুষের সঙ্গে এর আগে কখনও রেস্টুরেন্টে বসেনি সে। মূলত এটাই অস্বস্তির কারণ। ফারহান ম্যানুকার্ড দেখছে আর অয়নন্দিতা আড়চোখে ফারহানকে দেখছে। ভাবছে, এই লোকটার মতলব কী হতে পারে? এই লোক কেন তাকে এখানে নিয়ে এলো? লোকটাকে একটু সন্দেহও হয় তার।
ফারহান ম্যানুকার্ড দেখে কনফিউজড। ঘড়িতে একবার নজর দিলেন প্রায় দুটো বাজতে চলল। বলা যায় এখন লাঞ্চ আওয়ার। লাঞ্চ আওয়ারে কফি খেলে ব্যাপারটা জমবে না। লাঞ্চ করাই অতি উত্তম। কিন্তু কী খাবে, কী অর্ডার করবে সেটা নিয়েই কনফিউজড সে। নিজের জন্য হলে সে চাইনিজ অর্ডার করে দিত কিন্তু সাথে আছে আরেকজন। একে তো অপরিচিত, যদিও পরিচিত কিছুটা। তার উপর সোনায় সোহাগা হবু বউ। তিনি কী খাবেন কে জানে।
ম্যানুকার্ড অয়নন্দিতার দিকে এগিয়ে দিতে-দিতে বলল, ‘এইযে মিস অয়নন্দিতা, কী খাবেন দেখুন। দেখে অর্ডার করুন।’
‘আমি বাসায় গিয়ে খাব। আপনি আপনার মতো অর্ডার করুন।’
এই মুহুর্তে অয়নন্দিতাকে গবেট মনে হচ্ছে। যদিও কাউকে মুখের উপরে গবেট বলা সাজে না তাই চুপ হয়ে যায় ফারহান। নিজেকে যথেষ্ট সংযত রেখে বলল,
‘এখন তো আর সকাল নেই। এখন লাঞ্চ আওয়ার। রেস্টুরেন্টে বসেছি। লাঞ্চ না করে কফি খেলে লোকজন বলবে আমি গরীব। মেয়ে পটানোর জন্য রেস্টুরেন্টে ঢুকিয়েছি।’
‘কোন লোকজন বলবে এইসব ফালতু কথা।’
‘বলবে বলবে। কত লোকজন আছে বলার। এদের খালি চোখে দেখা যায় না। অণুবীক্ষণযন্ত্র লাগে এদের দেখতে।’
‘এইসব কী বলেন আপনি?’
‘চাইনিজ খান আপনি?’
‘জি।’
‘ওকে। তাহলে নো কথাবার্তা। চাইনিজ অর্ডার করে দেই।’
ফারহান খাবার অর্ডার দিয়ে অয়নন্দিতার দিকে তাকায়। মেয়েটা ভীষণ অস্বস্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। নাকের নিচের দিকটা ঘেমে গেছে। অয়নন্দিতার ভয় দেখে ফারহানের বেশ ভালোই লাগছে। গলায় সামান্য খাকাড়ি দিয়ে ফারহান বলে ওঠে,
‘আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি ভয় পাচ্ছেন।’
‘নাহ তো। ভয় কেন পাব?’
‘মনে হচ্ছে।’
ফারহানের এমন প্যাচানো কথা অয়নন্দিতার বুঝে আসছে না। সে বুঝতেও চায় না। বার কয়েক ঢোক গিলে ফারহানের দিকে তাকায় অয়নন্দিতা। ফারহান তখন জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। অয়নন্দিতা ভাবছে তাকে বলতে হবে। বলতে হবে যে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। হুট করেই সব ঠিক হয়েছে। ফারহান পানি খেতে-খেতে অয়নন্দিতাকে প্রশ্ন করে,
‘কিছু নিয়ে ভাবছেন নাকি?’
অয়নন্দিতা মুখ তুলে তাকায় ফারহানের দিকে।
‘নাহ তেমন কিছুই ভাবছি না।’
‘মনে হচ্ছে ভাবছেন।’
‘আপনার কি সবই মনে হয়?’
‘সব মনে হয় না। কিছুটা মনে হয়।’
‘আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি।’
‘বলে ফেলুন।’
‘আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’
‘তাই নাকি! এত দ্রুত?’
‘জি। ট্যুর থেকে যেদিন এলাম। তার পরদিনই মেহমান এসেছিলেন। এরপর কথা বলে ডেট ফিক্সড হলো।’
‘দাওয়াত দেওয়ার ভয়ে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। আপনি তো দেখছি বেশ কিপটা।’
‘জি না। সেইসব কিছুই না।’
‘আপনার বর কী করেন?’
‘শুনেছি ব্যবসা করেন। পারিবারিক ব্যবসা।’
‘নাম কী। ছবি আছে?’
এটাই তো মুশকিল। অয়নন্দিতা তো নাম জিজ্ঞেস করেনি। আর ছবিও তো নেই। এমনিতে মামার কাছ থেকে শুনেছে ছেলে নাকি বেশ স্মার্ট। তবে বয়স একটু বেশি। এই মুহুর্তে মাথায় যেটা এসেছে সেটাই বলে দেয় অয়নন্দিতা।
‘ছবি তো নেই। নামও জানি না। তবে মামা দেখেছেন। মামা বলেছেন, যাকে দেখেছে তিনি স্মার্ট আছেন। তবে বয়স একটু বেশি। অনেকটা আপনার মতো।’
অয়নন্দিতার কথা শুনে ফারহানের কাশি উঠে যায়। অয়নন্দিতা এটা কী বলল? বয়স বেশি! একটু বেশি! তাও তার মতো! তার মানে কি, তার বয়স বেশি!
‘এক্সকিউজ মি, আমাকে দেখলে বোঝা যায় যে আমার বয়স বেশি।’
‘একটু বেশি বলেছি।’
‘ওই একটুই কি বেশি নাকি?’
‘ভুলেও বরের সামনে বলতে যাবেন না যে তার বয়স বেশি। নয়তো কানের নিচ বরাবর মারবে।’
‘গায়ে হাত তুলবে?’
‘তুলতে কতক্ষণ।’

খাবার খেয়ে অয়নন্দিতাকে নিয়ে বের হয় ফারহান। পরবর্তী প্ল্যানিং অয়নন্দিতাকে নিয়ে শপিংয়ে যাবে। পছন্দ মতো কিছু কিনে দেবে। কিন্তু তা আর হলো না। অয়নন্দিতা এত জেদ ধরেছে। সে বাসায় যাবে। যাবে মানে যাবেই যাবে। অয়নন্দিতার জেদের কাছে হার মানতে হয় ফারহানকে।
গাড়ি অয়নন্দিতার বাসার সামনে এসে দাঁড়াতেই ফারহান অয়নন্দিতাকে বলতে শুরু করে,
‘অয়নন্দিতা, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই আমি?’
‘জি বলেন।’
‘আমি বিবাহিত। সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন না বন্দনা কে? বন্দনা আমার স্ত্রী। যদিও সে,,,
হঠাৎই ফোন আসে ফারহানের। ফোন রিসিভ করেই কথা বলে সে। মিনিট দুয়েক পর ফোন রেখে অয়নন্দিতার দিকে তাকায় সে।
‘আজ আর পুরোটা বলতে পারলাম না। যদি কখনও সময় হয় বলব। সবটা বলব৷ তখন বলবেন না যেন, যে আমি কথা লুকিয়েছি। আজ আসি।’
অয়নন্দিতা একটু চিন্তিত। চিন্তিত একটা কথা ভেবে। ফারহান বিবাহিত এটা তাকে জানানোর কী আছে৷ আর এখানে বলাবলির কী আছে। অয়নন্দিতা গাড়ি থেকে নামতেই ফারহান আরও একবার ডাক দেয় অয়নন্দিতা বলে। অয়নন্দিতা পেছনে তাকায়।
‘জি বলেন।’
‘বাসায় গিয়ে মামাকে জিজ্ঞেস করবেন আপনার বরের নাম কী? এরপর আমায় জানাবেন।’
অয়নন্দিতার কথার অপেক্ষা না করেই ফারহান তার গাড়ি স্টার্ট দেয়।
এদিকে অয়নন্দিতা কনফিউজড। ভাবছে, এই লোকের কি মাথায় সমস্যা আছে নাকি। সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অয়নন্দিতা। আজ মা-বাবাকে ভীষণ মনে পড়ছে তার। আজ হয়তো বাবা-মা বেঁচে থাকলে মামা-মামীকে তার বিয়ে নিয়ে ভাবতে হতো না। মনটা ভালো নেই, তারউপর আরও অবাক হয়েছে এটা শুনে যে, তার বরের নাম ফারহান। ফারহান শেখ৷ অয়নন্দিতা বুঝে সবটা গেছে। সেদিন ফারহানের বলা প্রতিটা কথার অর্থ এখন বুঝতে পারছে অয়নন্দিতা। তার মনে হচ্ছে, ফারহান হয়তো জেনে বুঝেই সবটা বলে গেছে তাকে। তার জন্যই বলেছে বরের নাম জিজ্ঞেস করতে।
‘লোকটা কত সাসপেন্স রেখে চলাফেরা করে।’
বলেই নিজের অজান্তে হেসে ওঠে অয়নন্দিতা। কিন্তু সে যে বিবাহিত এটা কি তার মামা আর ভাই জানে? জেনে শুনেই কি তবে একজন বিবাহিত লোকের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করে দিল? এতিম বলেই কি এই ভেদাভেদটা করে দিল?
পরমুহূর্তেই তার ভাবনায় আসে,
‘নাহ। মামা-মামী কখনও তো ভেদাভেদ করেনি। হয়তো ভেবেছে আমি এখানেই ভালো থাকব। হোক না বিবাহিত। ক্ষতি কি?
মনে পড়ে বন্দনার কথা। আচ্ছা বন্দনা কোথায়? সে কি মারা গেছে?
ফারহানকে এতটাও খারাপ লাগেনি অয়নন্দিতার। জীবনসঙ্গী হিসেবে সে সব দিক থেকেই পারফেক্ট। তার কথা বলার ভঙ্গীমা ভালো লাগে। সব দিক থেকে ভালো মনের মানুষ বলেই মনে হয়। ভাবছে, আল্লাহ পাক কী খেলাটাই না খেলেন৷ যেই মানুষটার সাথে প্রথম পরিচয় ব্যথার মাধ্যমে। কিছুদিন পর সেই মানুষটাই সারাজীবনের দায়িত্ব নিতে চলেছে। অবাক লাগে আল্লাহ পাকের লীলাখেলা দেখলে। বিয়েতে না করার মতো কোনো কারণ নেই অয়নন্দিতার। কোনো পিছুটানও নেই। যেখানে পিছুটান নাই সেখানে চলতেও বাধা নেই।
ফারহানের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করতেছে অয়নন্দিতার। কিন্তু ফোন নাম্বার নেই। মামা কিংবা হাসানের কাছে চাইলেই নাম্বার পাওয়া যায় কিন্তু সে চাইবে না। চট করেই মাথায় বুদ্ধি আসে, ফেসবুক। আইডি তো অবশ্যই আছে। একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে।
অয়নন্দিতার বেশি কষ্ট করতে হয়নি। শরীফের আইডিতে গিয়েই ফারহানের আইডি খুঁজে পেয়ে যায়। প্রোফাইল পিকচারে থাকা ছবিটা মাশা-আল্লাহ। ফারহানকে কালোতে বেশ মানায়। টাইমলাইন পাবলিক করা। টাইমলাইন ঘুরে রীতিমতো অবাক হয় অয়নন্দিতা। সোস্যাল সাইটে ফারহানের বেশ ভালো পরিচিতি আছে। ফারহান আর্টিকেল লেখে কয়েকদিন পর পর। সেই আর্টিকেলে বেশ ভালো রেসপন্স। টাইমলাইন স্ক্রল করতে গিয়ে একটা আর্টিকেলে চোখ আটকে যায় অয়নন্দিতার।
“স্বার্থপরতা,
ছেলেটা মেয়েটাকে নিখাদ ভালোবেসেছিল। তার ভালোবাসাকে পরিমাপ করার মতো কোনো যন্ত্র হয়তো এই দুনিয়ায় নেই। নিজের সব কিছু উজাড় করে দিয়ে তার ভালোবাসার জানান দিয়েছিল। কিন্তু একদিন সব বন্ধন ছিন্ন করে মেয়েটা উড়াল দিল। এতটাই দূরে চলে গেল যে ছেলেটা মেয়েটাকে আর খুঁজে পেল না। তারপর থেকেই ছেলেটা সৃষ্টিকর্তার কাছে মুক্তি চাইত। মুক্তির নেশায় পাগলাটে ছেলেটা নিজেকে শেষ করার সম্পূর্ণ ব্যবস্থাও করে ফেলে। কিন্তু মুক্তি নেওয়া আর হয়নি। অবশেষে সৃষ্টিকর্তা নিজেই তাকে মুক্তি দিয়ে দিলেন। ছেলেটা আজও তার সেই নিখাদ ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে আছে। মিথ্যা আশায় বুক বেধেছে।”

পড়ে কখন যে চোখ জোড়া বেয়ে খানিকটা পানি পড়ে যায় তা অয়নন্দিতা নিজেও জানে না। মনের অজান্তেই আর্টিকেলে একটা রিয়্যাক্ট দেয়। তার ঠিক পাঁচ মিনিট পরেই অয়নন্দিতার মেসেজ রিকুয়েষ্ট থেকে নোটিফিকেশন আসে।
অয়নন্দিতা এবার আর অবাক হয়নি। মেসেজ রিকুয়েষ্ট চেক করে দেখে ফারহানের আইডি থেকে মেসেজ এসেছে।
‘অনলাইনে আমায় খুঁজে পেতে এতটা সময় লেগে গেল? তবে আমি শিওর ছিলাম, আমায় খুঁজে নেবেন আপনি। মিলেও গেল।’
মেসেজটা দেখে অয়নন্দিতা মুচকি হেসে দেয়।

চলবে……………………….

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_১১
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

মামার চেঁচামেচি শুনে পাশের ঘর থেকে বের হয়ে আসে অয়নন্দিতা। সাথে হাসানও আছে। সেই সাথে আছে যে প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল সেই লোক। তাদের কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে ফারহান যে বিবাহিত এটা তারা আগে জানত না। হাসানও বেশ ক্ষেপে গেছে। সে লোকটাকে বলছে,
‘আপনি আমার বাবার বয়সী বলে কিছু বললাম না। আপনি আমাদের আগে কেন জানান নাই যে, ছেলে বিবাহিত। আগে বিয়ে করেছে একটা। আপনার কী মনে হয় আমরা টাকার খাইস্টা? যে টাকা দেখে বোনকে ঠেলে দিয়ে দিব।’
খাইরুল সাহেব বললেন,
‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করছিলাম ভাই। এটা কী করলেন? বিয়ের আর কয়েকদিন বাকি আর এখন আমার ছেলে জানতে পারে যে, ছেলের আগেও একটা বিয়ে হয়েছে। এটা কোনো কথা?’
লোকটা মাথা নিচু করে বসে আছে। আয়শা বেগমও সামান্য উত্তেজিত। এতক্ষণে তিনিও মুখ খুললেন,
‘ভাই, আপনি অয়নিকে দেখেছেন? আমার ভাগনি লাখে একটা। কোনোদিনও ওর নামে কিছু শুনছেন? ননদের মেয়ে বলে আমি ওরে এতটুকুও অবহেলা করিনি। এইযে আমরা ওর বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলাম, মেয়ে আমার উচ্চবাচ্য করে নাই। চুপচাপ মেনে নিয়েছে। এখন যদি শুনে ছেলে বিবাহিত, তাহলে ভাববে মামা-মামী হয়তো ইচ্ছা করেই ওকে এমন জায়গায় দিয়েছে। এটা কী করলেন ভাই? টাকা দিয়ে কী হয় ভাই?’
লোকটা কাচুমাচু স্বরে বলতে শুরু করলেন,
‘ভাবী, তারা মানুষ ভীষণ ভালো। আর আমিও জানি অয়নি মা কতটা ভালো মেয়ে। তাই তো,,,।’
হাসান চট করেই জবাব দেয়,
‘তাই আপনি ভেবেছেন বিয়াত্তা ছেলের সঙ্গে ওরে জুড়ে দেওয়া যায়। তাই না চাচা?’
‘বাবা, ভুল বুঝতেছ। আমিও চাই অয়নি মা ভালো থাকুক।’
‘এখন যদি বোন শোনে, তাহলে ওরে কীভাবে বোঝাব। এদিকে বিয়েটা ক্যান্সেল করাও কি পসিবল?’
খাইরুল সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
‘ভাই, আপনি তাদের বারণ করে দেন। বিয়ে হবে না। আমরা রাজি না। আর তাছাড়া তারাও মিথ্যুক। তারাও আমাদের কাছ থেকে লুকিয়েছে।’
‘নাহ ভাই। তাদের মিথ্যুক বলবেন না। তারা জানত যে আপনারা সব কিছুই জানেন। তারা আগেই আমাকে বলেছিল আমি যেন আপনাদের সব বলি। দোষটা আমারই। আমিই বলি নাই।’
‘যাই হোক। বিয়ে হবে না। তাদের না করে দেন।’
অয়নন্দিতা সব কিছুই বুঝতে পারে৷ একটা লোক বিবাহিত বলে যে সে অবিবাহিত মেয়ে বিয়ে করতে পারবে না এমন কোনো রীতি কোথাও নেই। আবার একজন বিবাহিত মেয়ের যে অবিবাহিত ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে না সেই রীতিও কোথাও নেই। তবে ভেদাভেদ কেন হবে। এটা অন্যায়। আবার খাইরুল সাহেব সহ বাকিদের রাগ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। তাদের জানানো হয়নি। তারা আগে থেকে জানলে হয়তো তখনই না করে দিত। অয়নন্দিতা বুঝতে পারছে যে এই বিয়ে উপলক্ষে তার মামার বেশ টাকা খরচ হবে যদিও তার বাবা-মা তার জন্য কিছু রেখে গেছেন। পাড়ায় মোটামুটি সবাই জানে যে, দশ তারিখ বিয়ে। কিন্তু এখন যদি শোনে যে, বিয়ে হবে না। বিয়ে ভেঙে গেছে। তাহলে, অনেকেই বাড়ি বয়ে এসে কথা শোনাবে। এসব ঝামেলা পোহাতে হবে আয়শা বেগম, খাইরুল সাহেব এবং হাসানকে। অয়নন্দিতা চায় না এরা কেউ মানুষের কটু কথা শুনুক। তাছাড়া ফারহানকে তার ভালো লেগেছে। আর ফারহান যে বিবাহিত এটা সে আগেই তাকে জানিয়ে দিয়েছে। বিয়েতে আর কোনো আপত্তি নেই। অয়নন্দিতা খাইরুল সাহেব সহ সবার সামনে এসে দাঁড়ায়। তাকে দেখে হাসান বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারা বুঝেছে যে, অয়নন্দিতা সব শুনেছে। হাসান হালকা হেসে বলে,
‘এর থেকেও ভালো প্রস্তাব আসবে অয়নি। তুই চিন্তা করিস না। মন খারাপ করিস না।’
লোকটা বিদায় নিতে চাইলে অয়নন্দিতা তাকে বসতে বলে। এরপর ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়ায়। মামা-মামীর মুখের দিকে তাকায় অয়নন্দিতা। খাইরুল সাহেবের মুখে অসহায়ত্বের ছাপ। অয়নন্দিতা তার মামাকে বলল,
‘মামা, এই বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আপনারা বিয়ের আয়োজন করেন। উনি বিবাহিত নাকি অবিবাহিত এইসব নিয়ে আর কথা না হোক।’
খাইরুল সাহেব, আয়শা বেগম, হাসান এরা তিনজনই অবাক। তারা যেই কারণে বিয়েতে না করে দিল। সেই কারণ নিয়ে অয়নন্দিতার আপত্তিই নেই। আয়শা বেগম বললেন,
‘অয়নি, মা তুই চিন্তা করিস না। আমরা এগুচ্ছি না আর।’
‘নাহ মামী। বিয়ের অর্ধেক আয়োজন শেষ। ওখানেও হয়তো আয়োজন চলছে। এখন যদি না করে দেওয়া হয় ব্যাপারটা বাজে দেখায়। আর তাছাড়া এই এলাকার মানুষও ভাববে আমার দোষ আছে। তাই বিয়ে ভেঙে গেছে। আমি নিশ্চয়ই চাইব না আমার জন্য আমার মামা-মামী, ভাই কথা শুনুক। আমার আপত্তি নেই।’
খাইরুল সাহেব অস্পষ্ট স্বরে বললেন,
‘অয়নি, মা রে।’
অয়নন্দিতা মামার সামনে এসে দাঁড়ায়। হাটু গেড়ে বসে।
‘মামা, ওনাদেরও তো দোষ নেই। হয়তো তারা জেনেছিল যে, আমাদের জানানো হয়েছে। এখন, ব্যাপারটা চাচা না জানালে তো তাদের দোষ না এটা। এ নিয়ে আর কথা না বাড়ানোই ভালো। আপনারা বিয়ের আয়োজন করুন।’
আয়শা বেগম বললেন,
‘কিন্তু মানুষ যখন শুনবে তখন তো উল্টো কথা বলবে।’
‘কী বলবে মামী? বলবে যে, মেয়ের বাপ-মা নাই দেখে মামা-মামী এমন জায়গায় বিয়ে দিয়েছে। এইটুকুই তো বলবে, তাই না? আমায় উষ্কাবে। দেখি না, কত উষ্কাতে পারে। এইসব নিয়ে ভেব না। বাদ দাও। বিয়ের বাকি আয়োজন করো।’
হাসান কিছু বলতে যাবে তখনই অয়নন্দিতা ভাইয়ের হাতটা ধরে।
‘আই এম ফাইন ভাইয়া। ট্রাস্ট মি। আই এম ফাইন। প্লিজ, বিয়েটা ভেঙে দিও না। আমি রাজি এই বিয়েতে। ব্যবস্থা করো। আর তোমার বউটাকে নিয়ে এসো। আর তো মাত্র এক সপ্তাহ। সে এসে আমার সঙ্গে শেষবারের মতো ঝগড়া করে নিক।’

আত্মীয়স্বজন তেমন নেই। অয়নন্দিতার দুই খালা আর অন্য দুই মামা আর তাদের পরিবার এসেছেন। অয়নন্দিতার চাচা এবং ফুপুদের বলা হয়েছে। তারা বলেছেন, তারা আসলে বিয়ের অনুষ্ঠানে আসবেন। এর বেশি তেমন কথা বলেননি। অয়নন্দিতাও চায় না তারা আসুক। তাদের সঙ্গে হিসাবটা সে পরে বুঝে নিবে।
এখন টুকটাক ঘরের সব কাজই করে মিলি। হাসান একটু অবাক মিলির আচরণে। বাপের বাড়িতে কয়েকদিন থেকে এখানে আসার পর অনেকটাই বদলে গেছে সে। আগে যেখানে ভাতের প্লেটটাও সরিয়ে রাখত না এখন সব কাজ একা হাতে করে। আত্মীয়স্বজনদের খেয়াল রাখা থেকে শুরু করে রান্নাবান্নাতেও তার হাত পাকা। আরও অবাক করা কান্ড হচ্ছে সে এখন হাসানের সঙ্গেও উচ্চস্বরে কথা বলে না। জি, হ্যাঁ, ওহ, আচ্ছা এইসবের মাঝেই উত্তর দিয়ে দেয়।
আয়শা বেগম, খাইরুল সাহেব দু’জনেই বেশ অবাক মিলির আচরণে। মিলি আগে অয়নন্দিতাকেও দেখতে পারত না। সেই মিলি এখন অয়নন্দিতার খাবারটা পর্যন্ত তার ঘরে দিয়ে আসে। অয়নন্দিতাও বেশ অবাক। সে ভেবেছিল বিয়ের কথা শুনে সর্বপ্রথম খোঁচাটা তাকে মিলিই মারবে। হয়তো বলবে, বাহ বাহ, বড়োলোক জামাই পাইছ অবশেষে। কিন্তু নাহ, মিলি এইসব কিছুই বলেনি।
সব কাজ শেষ করে গোসল করে আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে চুল শুকাচ্ছে মিলি। হঠাৎ হাসানের ফোন বেজে ওঠে। দুইবার রিং হওয়ার পর মিলি ফোনের দিকে তাকায়। হাসান তখন বাথরুমে। আগে হাসানের ফোন বিনা কারণেই ঘাটত মিলি। এখন হাসানের ফোনে বিনা কারণে হাত পর্যন্ত দেয় না। উল্টো হাসান মিলির ফোন ঘাটলেও মিলি কিছুই বলে না। হাসান ভাবে এটা তার বউ না। অন্য কেউ মিলি সেজে এই বাড়িতে এসেছে৷
ফোন হাতে নিয়ে দেখে একটা নাম্বার। বাথরুমের সামনে গিয়ে দরজা নক করে মিলি।
‘হাসান, এই হাসান।’
‘হ্যাঁ বলো।’
‘ফোন আসছে দুইটা।’
‘কে ফোন করেছে?’
‘চিনি না। একটা নাম্বার। সেভ করা নাই তো।’
‘রিসিভ করে কথা বলো।’
‘তুমিই বলো।’
‘তুমি রিসিভ করো মিলি।’
‘এখনও কী শাওয়ার নিতেছ তুমি? এতক্ষণ লাগে?’
‘বাই দ্যা ওয়ে মিলি, একটা কথা বলি?’
‘বলো।’
হাসান টাওয়াল প্যাচিয়ে বাথরুমের দরজা খুলে দাঁড়ায়। মিলির হাত ধরে ঘুরিয়ে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নেয়। মিলির চুলগুলো সরিয়ে বলে,
‘চলো একসঙ্গে শাওয়ার নেই।’
‘মাথা নষ্ট হয়ে গেছে নাকি। ছাড়ো আমায়। আমার শাড়িটা ভিজে যাচ্ছে। আর দেখ কে ফোন করেছে?’
এরই মধ্যে আবারও ফোন আসে। হাসান ইশারায় মিলিকে বোঝায় যেন মিলি ফোনটা রিসিভ করে। সে এখন ব্যস্ত। সে তার বউকে আদর করবে। মিলি চোখ তাড়া মুখ তাড়া দিয়েও লাভ হয়নি। ততক্ষণে হাসান তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে। মিলি ফোন রিসিভ করে।
‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?’
ফোনের অপরপাশ থেকে জবাব আসে,
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। এটা হাসান সাহেবের নাম্বার না?’
‘জি। এটা হাসান সাহেবের নাম্বার। আমি ওনার ওয়াইফ বলছিলাম।’
‘ওহ আচ্ছা। হাসান সাহেব কি আশেপাশে আছেন?’
‘নাহ। ও তো শাওয়ার নিচ্ছে। আপনার পরিচয়টা জানতে পারি। তাহলে আমি হাসানকে বলব।’
‘আমাকে আপনিও চেনেন। চেনেন বলতে নাম শুনেছেন।’
‘জি, মানে!’
‘আমার নাম ফারহান।’
‘ফারহান,,,!’
মিলির মুখে নামটা শুনে হাসান মিলিকে ছেড়ে দেয়। একটু ইতস্তত হয়ে মিলির কান থেকে ফোন সরিয়ে নাম্বার চেক করে। নিজের উপর এখন বিরক্ত হয় হাসান। ফারহান তাকে গতকালকেও ফোন করেছিল কিন্তু সে মনের ভুলে নাম্বারটা সেভ করেনি। আর কিছুক্ষণ আগে সে মিলিতে ডুবে থাকায় নাম্বার দেখেনি।
হাসান মিলিকে কথা বলার জন্য ইশারা করে। মিলিও ইশারা বোঝে।
‘জি ফারহান ভাই। বলেন। এখন চিনতে পেরেছি। ভালো আছেন আপনি?’
‘জি আমি ভালো। আপনারা ভালো আছেন?’
‘জি আমরাও ভালো। আচ্ছা, আই এম এক্সট্রিমলি সরি। আমি চিনতে পারিনি তখন।’
‘ইটস ওকে। আচ্ছা, হাসান সাহেবের কতক্ষণ লাগতে পারে?’
‘একটু সময় লাগবে। কোনো প্রয়োজন। আমায় বলতে পারেন।’
‘একচুয়ালি আমার একজনের নাম্বার লাগত।’
‘জি কার নাম্বার বলেন। বাবার মাকি মায়ের?’
‘নাহ নাহ। আংকেলের নাম্বার আছে আমার কাছে। অয়নন্দিতার নাম্বারাটা লাগত একটু।’
মিলি হালকা হেসে বলে,
‘ওহ আচ্ছা। ঠিকাছে। আমি আপনার নাম্বারে টেক্সট করে দিচ্ছি। একটু অপেক্ষা করুন।’
‘অয়নন্দিতা কি বাসায় আছেন?’
‘জি জি। ও বাসাতেই। ঘুমোচ্ছে। সমস্যা নেই। আমি নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি।’
‘ধন্যবাদ।’
মিলি হেসে বিদায় নেয়। আর রাগান্বিত চোখে হাসানের দিকে তাকায়।
‘বোকা নাকি তুমি? নাম্বার সেভ করোনি কেন?’
‘একদম ভুলে গিয়েছিলাম। সব দোষ তোমার?’
‘আমি কী দোষ করলাম?’
‘এমন ভেজা চুলে সামনে এসে দাঁড়াও কেন? জানো না আমার কেমন কেমন লাগে।’
‘হাসান, তুমিও না।’
হাসান ঠোঁট বাঁকিয়ে মুচকি হেসে মিলিকে জড়িয়ে ধরে বাথরুমের দরজা আটকে দেয়।

তিন থেকে চারবার ফোন বাজার পর ঘুম ভাঙে অয়নন্দিতার। রাতের বেলা এত সুন্দর ঘুম হবার পরেও দিনের বেলায় এত ঘুম কীভাবে যে আসে, আল্লাহ পাক জানেন। অপরিচিত নাম্বার বলে আমলে নেয়নি অয়নন্দিতা। চোখ বুজতেই আবার ফোন বেজে ওঠে। এবার সত্যিই বিরক্ত অয়নন্দিতা। ফোন রিসিভ করে সে।
‘হ্যালো, কে বলছেন?’
গলা খাকাড়ি দেয় ফারহান। বলে,
‘এই পড়ন্ত বিকেলে ঘুমোচ্ছেন কী করে?’
‘কে আপনি?’
‘ফারহান বলছি।’
ফারহান নামটা শুনেই অয়নন্দিতার ঘুম দৌড়ে পালিয়ে যায়। শোয়া থেকে উঠে বসে সে। অয়নন্দিতা ভাবছে, তার নাম্বার কোথায় পেয়েছে কোথায়? তাই সরাসরি প্রশ্ন করে,
‘আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?’
‘কেমন আছি জিজ্ঞেস না করে নাম্বার কোথায় পেয়েছি প্রশ্ন করছেন। অদ্ভুত।’
‘সরি। কেমন আছেন?’
‘ভালো। আপনি?’
‘ভালো আছি।’
‘শুনলাম দু’হাত ভর্তি মেহেদী দিয়েছেন। মেহেদীতে রঙ এসেছে?’
অয়নন্দিতা এবার নড়েচড়ে বসে। গতকাল তার মেহেদী অনুষ্ঠান হয়েছিল। দুই হাতে মেহেদী পরেছে সে। সেই মেহেদীতে আজ গাঢ় রঙ এসেছে। কিন্তু এতকিছু ফারহান অবধি কে পৌঁছেছে। ভাবতে শুরু করে সে। তার ভাবনার শেষ হয় গতকাল রাতে গিয়ে। হ্যাঁ, গতকাল অনুষ্ঠানে সাজি এসেছিল। ফারহানের ছোটো বোন। সাজিকে নিয়ে যেতে ফারাশ এসেছিল। ফারাশ ফারহানের ছোটো ভাই। যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে সাজি আর ফারাশ তার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছে। তার মানে সাজি গিয়েই তার ভাইকে বলেছে। অয়নন্দিতা হালকা হাসে।
‘রঙ হয়েছে কি না নিজে এসে দেখে গেলেই তো পারতেন।’
‘আপনি কি চান আমি আসি?’
‘আমি চাইলেই বা কি? আমার সেই চাওয়াকে কয়জন পাত্তা দেয় বলেন। আমার নিজের বাবা-মা-ই তো আমার চাওয়াকে পাত্তা না দিয়ে চলে গেল। তাই এখন আর নিজস্ব কোনো চাওয়া পাওয়া নেই।’
‘ফোন হাতে নিয়ে বসার ঘরে যান।’
‘এখন?’
‘হ্যাঁ। এখন।’
বসার ঘরে অনেকেই বসে আছে। অয়নন্দিতা ঘুম চোখে ফোন কানে বসার ঘরে যায়। চুল গুলো ছাড়া। হলুদ রঙের থ্রিপিস পরা অয়নন্দিতার রুপ যেন চুঁইয়ে পড়ছে। দু’হাত লাল রঙা মেহেদীতে রঙিন হয়ে আছে। সবাই তখন চা খাচ্ছে। বসার ঘরে পা রাখতেই অয়নন্দিতার দিকে সবার চোখ পড়ে। অয়নন্দিতা বোকার মতো সবার দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই অয়নন্দিতার রুপের প্রশংসা করতে ব্যস্ত। কয়েকজন আবার মাশা-আল্লাহও বলে ফেলেছে৷ এদিকে আয়শা বেগম অয়নন্দিতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন,
‘কী ব্যাপার। আম্মাজানের ঘুম ভেঙেছে। আগামীকাল হলুদ। প্রিপারেশন নিতে হবে না?’
ফারহান ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে হাসছে। অয়নন্দিতা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ফারহানের হাশির শব্দ কানে লাগতেই তার বুকটা ধক করে ওঠে।
‘আপনি হাসছেন যে?’
‘আগামীকাল হলুদ সন্ধ্যা। আপনি কি জানেন, আগামীকাল আমরা দু’জন একত্রিত হবো?’
‘জানি। বলা হয়েছে আমায়।’
‘দ্যাটস গুড।’
‘আমায় বসার ঘরে আসতে বলার কারণ কি?’
‘এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গুনবেন। জোরে-জোরে গুনবেন যেন আমি শুনতে পাই।’
‘মানে কী?’
‘স্টার্ট করেন।’
অয়নন্দিতাও সবার সামনে এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গুনতে শুরু করে। মিলি পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে। মিলির পাশে দাঁড়িয়ে আছে রত্না। চাপা হেসে মিলিকে জড়িয়ে রেখেছে সেও। এদিকে সবাই অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে অয়নন্দিতার দিকে। অন্যদিকে হাসান প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাসানও হাসছে।
অয়নন্দিতা পাঁচ বলার সঙ্গে-সঙ্গে ডোরবেল বেজে ওঠে। ডোরবেলের শব্দে অয়নন্দিতা ভড়কে যায়। ফোন কানে নিয়েই সে প্রশ্ন করে,
‘কেউ হয়তো এসেছে।’
ফারহান বলে,
‘খুলে দেবেন না? দেখেন কে এসেছে?’
হাসানও পাশ থেকে বলে ওঠে, অয়নি দরজাটা খুলে দেখ তো কে এসেছে। আয়শা বেগম অয়নন্দিতাকে খুলতে না দিয়ে নিজে খুলতে গেলে মিলি তাকে চেপে ধরে।
‘আপনি কেন যাচ্ছেন মা। অয়নি তো দাঁড়িয়েই আছে সে-ই খুলে দিক। অয়নি খুলে দাও দরজাটা।’
অয়নন্দিতা ফোন হাতে নিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে অয়নন্দিতা এতটাই চমকে যায় যে, তার মুখ থেকে কথা পর্যন্ত বের হয়নি। ফারহান, স্ব-শরীরে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফারহানকে এখানে এভাবে কেউ আশা করেনি। আর অয়নন্দিতা, সে তো ভুলেও আশা করেনি। অন্যরা সবাই যখন জামাই দেখতে ব্যস্ত অয়নন্দিতা তখন ভাবনার ঘোরের মধ্যে আছে। অন্যান্য সবাই বলাবলি করছিল, জামাই দেখি বিয়ের আগেই হাজির। মাশা-আল্লাহ জামাই তো না যেন রাজপুত্র। কেউ কেউ বলছিল, বয়স তো বোঝাই যায় না। কে বলছে বয়স বেশি।
ফারহান তার চোখ থেকে ব্ল্যাক সানগ্লাসটা খুলে অয়নন্দিতার দিকে তাকায়। অয়নন্দিতার চোখ জোড়া তখন মুগ্ধ হয়ে ফারহানকেই দেখছে। ফারহান তখন একবার সবার দিকে তাকিয়ে বাসায় প্রবেশ করে। আয়শা বেগম ভীষণ খুশি। তিনি খাইরুল সাহেবকে ফোন করে বাসায় আসতে বলেন। ফারহানের পেছনে সাজিও আছে। সাজির হাতে একটা বক্স। ফারহান অয়নন্দিতার সামনা-সামনি দাঁড়ায়। অয়নন্দিতা তখনও ঘোরের মধ্যেই আছে। ফারহান ঠোঁট নেড়ে হেসে বলে,
‘মেহেদীতে তো ভালো রঙ এসেছে। তাহলে আমার এখানে আসাটা সার্থক হয়েছে। কী বলেন?’
অয়নন্দিতার চোখের পলক পড়ে।
‘আপনি এখানে!’
‘আপনি চাইলেন। আপনার চাওয়াকে পূর্ণ করে দিলাম।’
না চাইতেও অয়নন্দিতার চোখে পানি। অয়নন্দিতার চোখে পানি দেখে ফারহান খানিকটা বিচলিত। সে ভাবছে, সে কি কোনো ভুল করেছে নাকি যার কারণে মেয়েটার চোখে পানি জমেছে। সাজি পেছন থেকে তার ভাইকে বলছে,
‘ভাইয়া, এটা কি হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকব? ভাবীকে দেবে না?’
সাজির কথায় সবাই আরও চমকে যায়। আয়শা বেগমও অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। মিলি চা নাস্তার ব্যবস্থা করছে। ফারহান সাজির হাতে থাকা বক্সটা খুলে। অত্যন্ত সুন্দর একটা শাড়ি বের করে অয়নন্দিতার শরীরে জড়িয়ে দেয় তাও আবার সবার সামনে। ফারহানের এমন আচরণ দেখে সবার চোখ কপালে। সবার চোখ কপালে হলেও হাসানের চোখ ফোনে। সে এই সুন্দর মুহুর্তটা তার ফোনে বন্দী করে রেখেছে। রত্না পাশ থেকে ছবি তুলছে। অয়নন্দিতার নজর তখন নিচে মেঝের দিকে। শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে গেছে। ফারহানের চোখের দিকে তাকানোর মতো সাহস আর এই মুহুর্তে হচ্ছে না তার। ফারহানের নজর তখন শুধুই অয়নন্দিতাকে দেখছে।
‘আপনার সঙ্গে দেখাটা আমার একদম ভিন্ন হলেও আমাদের জীবন যে একই সুতোয় গাঁথা হবে তা বুঝতে পারিনি। শাড়িটা আমার নিজের পছন্দের। এটা পরেই কালকের অনুষ্ঠানে আমার পাশে আপনাকে দেখতে চাই।’

সবার কথার মান রাখতেই ফারহান আর সাজি বসার ঘরে বসে। ফারহানের লাইফস্টাইল অনুযায়ী এখানকার বসারঘর বেশ ছোটো। সোফাটাও তার চোখে একদমই সামান্য। কিন্তু মানুষগুলোর মন অনেক নিষ্পাপ। ফারহান যেখানে-সেখানে বসার মানুষ না। যা তা খায়ও না সে তবুও আজ সে সবার সঙ্গে বসে নরমাল একটা কাপে চা খাচ্ছে। এর একটাই কারণ, এই মানুষগুলোকে ফারহানের মনে ধরেছে।
অতীতের খাতায় যারা ছিল তাদেরও তো এমন করেই ভালোবেসেছিল ফারহান। বিশেষ করে বন্দনা। আজ আর বন্দনা নেই। যদি বন্দনা থেকে যেত তবে হয়তো এদের সঙ্গে আর কোনোদিনও দেখা হতো না। এই কারণে বন্দনাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত কি না ভেবে পাচ্ছে না ফারহান।
পর্দার আড়ালে থেকে অয়নন্দিতা ফারহানকে দেখছে। চুপচাপ বসে চা খাচ্ছে আর সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছে। এই লোকটাকে মনে ধরেছে। ভাবছে, হুট করেই লোকটার জীবনে তার অনুপ্রবেশ ঘটতে চলেছে। অনধিকার চর্চা করতে করতে একদিন অধিকার চর্চাও হয়ে যাবে। সেদিন আর বেশি দূরে নয়।
ফারহান সবার সঙ্গে কথা বলার মাঝখানেই কী মনে করে যেন সামনের দিকে নজর দেয়। আর তখনই অয়নন্দিতা পর্দার আড়াল থেকে সরে যায়। ফারহান বুঝতে পেরে মুচকি হেসে চায়ের কাপে চুমুক দেয়।

চলবে……………………….
#দ্বিতীয় সূচনা
#পর্ব_১২
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

‘কী যে সুন্দর লাগছে তোমায় অয়নি। মাশা-আল্লাহ।’
মিলির প্রশংসা শুনে নিজেকে আয়নায় দেখছে অয়নন্দিতা। হলুদে সাধারণত প্রায় সব কনেরাই হলুদ শাড়ি পড়ে। কিন্তু সে ব্যতিক্রম। তার শাড়িটা একেবারেই আনকমন। সাজির কাছ থেকে শুনেছে, ফারহান অলয়েজ ইউনিক ভাবে। তার সব কিছুই ইউনিক। শুনেছে, বন্দনাকেও নাকি সে সব সময় আনকমন রাখতে চাইত। বন্দনা তার জীবনে আসা থেকে শুরু করে সব কিছুই ছিল আনকমন। একটু বেশিই ভালোবেসেছিল সে বন্দনাকে। অয়নন্দিতা এখনও জানে না যে, তার ভাগের ভালোবাসাটুকুন সে পাবে কি না। মিলি আবারও বলে,
‘ফারহান সাহেবের পছন্দ আছে। বেছে-বেছে একেবারে বেস্ট শাড়িটাই চুজ করেছে তোমার জন্য।’
মিলির কথা শুনে মলিন হাসি দেয় অয়নন্দিতা। মিলি আরও বলে যে,
‘তোমার ইন্সট্রাকশন শুনতে-শুনতে পার্লারের মেয়েগুলোও বিরক্ত হয়ে গেছে। এমন করলে কেন?’
‘তুমি তো জানো ভাবী, আমার এইসব পার্লার টার্লার পছন্দ না। পার্লারে আমি যাই নিজস্ব কিছু প্রয়োজনে। এরপর বাকি সব আমি নিজেই করি। তাদের না বললে তারা আমায় একটা মেকাপের ডিব্বা বানিয়ে দিত।’
‘এখনও কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে তোমায়। মাশা-আল্লাহ। ফারহান সাহেব দেখা মাত্রই হা হয়ে থাকবে।’
অয়নন্দিতার মুখে আবারও মলিন হাসি। মিলি বুঝতে পারছে যে, অয়নন্দিতা কিছু একটা ভাবছে।
‘অয়নি, তুমি কি কিছু ভাবছ?’
‘ভাবছি সংসারটা করতে পারব তো?’
‘এইসব কী ধরনের কথা বলতেছ?’
‘আমার তো আবার কপাল ভালো না। এই যে দেখ, আব্বু-আম্মুর কি এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার কথা ছিল? চলে তো গেল আমায় ছেড়ে। আমার কপালে তো আবার সুখ সয় না।’
‘হায়াতের উপর কি কারো হাত থাকে বলো? ওইটার সঙ্গে এইটা কেন মেলাও। বাদ দাও না বোকা। আর সংসার করতে পারবে না মানে কী? দেখবে তুমি রাজরানী হয়ে থাকবে। তারা নাকি ভীষণ ভালো মানুষ। দেখবে তুমি ভীষণ সুখী হবে।’
মিলির কথার পরিপ্রেক্ষিতে মুচকি হাসে অয়নন্দিতা। তাকে এখন নিয়ে যাওয়া হবে শহরের আভিজাত্যপূর্ণ একটা সেন্টারে। সেখানকার আয়োজনে তার মামা আর ভাইয়ের যে বেশ ভালো টাকা খরচ হয়েছে এট বুঝতে পারছে সে। এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করছে নিজের ভেতরে। এখন মনে হচ্ছে, এত বড়ো পরিবারে সম্বন্ধ না করলেই পারত। অন্তত তাদের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে এত টাকা খরচ হতো না তাদের। হাসান গাড়ি পাঠিয়েছে তাদের জন্য। এই গাড়িতে করেই সেন্টারে যাবে তারা। গাড়িটা দেখে একটু অবাকই হয় অয়নন্দিতা। প্রশ্ন করে,
‘ভাবী, ভাইয়া হঠাৎ গাড়ি পাঠাল?’
‘আমরা যাব। তাই পাঠিয়েছে।’
‘কিন্তু গাড়িটা পেল কোথায়?’
‘টাকা থাকলে সব কিছুই পাওয়া যায় অয়নি। সব কিছুই পাওয়া।’
‘আমরা রিক্সা কিংবা সি এন জি করেও তো যেতে পারতাম।’
‘হয়তো পারতাম। কিন্তু ওইখণে তোমার শ্বশুরবাড়ির সবাই উপস্থিত। বউ সি এন জি কিংবা রিক্সা থেকে নামবে এটা তাদের কাছে ভালো লাগবে না। তাই তোমার ভাই উবার ভাড়া করেছে।’
‘বাড়তি কাজে টাকা কেন নষ্ট করছে তারা। তুমি কিছু বলোনি।’
‘ভালোই তো করেছে। বরং এর মতো ভালো কিছু আর হয় না।’
‘নাহ ভাবী। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিলে অনেক সমস্যা পড়তে হবে। ভবিষ্যতের কথাও ভাবা উচিত।’
‘ভবিষ্যৎ ভাবার জন্য আমরা আছি। তুমি নতুন জীবন নিয়ে ভাবো আপাতত।’
স্পষ্টই বোঝা গেল মিলি এই ব্যাপারে আর কথা বলতে ইচ্ছুক না। তাদের সবার চিন্তা অয়নন্দিতার নতুন জীবন নিয়ে৷ আর অয়নন্দিতার চিন্তা তার মামার পরিবার নিয়ে।

বিরাট আয়োজন। অনেকেই উপস্থিত হয়েছে। ফারহানের বন্ধুরা সবাই এক এক করে উপস্থিত হয়েছে। শরীফও এসেছে তার বউকে সাথে নিয়ে। অয়নন্দিতার পরিবারের সবাই এবং কিছু বান্ধবীরাও এসেছে। খাইরুল সাহেব কয়েকজনের সঙ্গে ফারহান অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে একটা মুখের। কখন আসবে সে, কখন আসবে? এই প্রশ্নটা তার মাথায় গিজগিজ করছে। এরই মাঝে তাকে অবাক করে সেখানে পা রাখল অয়নন্দিতা।
ফারহান খেয়াল করল, অয়নন্দিতাকে তার দেওয়া শাড়িটা পরে অপূর্ব লাগছে। এক কথা ভীষণ সুন্দর লাগছে তাকে। চারপাশ থেকে হইচই পড়ে গেছে বউ এসেছে বলে। ফারহান তাকিয়ে আছে অয়নন্দিতার কাছে। অয়নন্দিতাকে ফারহানের পাশে বসানো হয়েছে। কিছুক্ষণ পর অনুষ্ঠান শুরু হবে। শরীফ তাকিয়ে আছে দু’জনের দিকে। এখানে উপস্থিত সবার থেকে সে-ই বেশি খুশি। এতদিনে তার বন্ধুর একটা গতি হলো। একটা দুর্ঘটনায় একজন মানুষের সারাজীবন নষ্ট হতে পারে না। ফারহানের জন্য ভালো কিছুই অপেক্ষা করছিল। আজ সেই ভালো কিছুই তার একেবারে কাছে এসে পৌঁছেছে। শরীফ ভীষণ খুশি।
অয়নন্দিতার কানের কাছে এসে ফিসফিস শব্দে ফারহান কথা বলে।
‘সুন্দর লাগছে আপনাকে।’
ফারহানের মুখ থেকে নিজের সম্পর্কে প্রশংসা শুনে হালকা হাসে অয়নন্দিতা। প্রতিউত্তরে সেও বলে,
‘হোয়াইট পাঞ্জাবিতে আপনাকেও বেশ লাগছে।’
‘ধন্যবাদ।’
হালকা কথোপকথনের শেষে ফারহান ভাবছে অন্যকিছু। আজকের এই দিনটা সে আশা করেনি। একেবারেই আশা করেনি। এই দিনটা তার জীবনে না আসলেই পারত। তার মনে হচ্ছিল এই মুহুর্তে জীবন তাকে বলছে, দিনটি তোর জন্য অভিশাপ। পরক্ষণেই ভাবে, বন্দনার চলে যাওয়াটাই হয়তো এই দিনটির জন্য দায়ী। না সে তাকে ফেলে এইভাবে বহুদূরে চলে যেত না-ই এই দিনটি তার জীবনে আসত। এতকিছুর পরেও বন্দনার কথা, বন্দনার চলাফেরা, বন্দনার হাসি সে ভুলতে পারছে না। এইসব কিছুই তাকে চারপাশ থেকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। ভাবছে যদি অয়নন্দিতাকে এই মুহুর্তে জানানো হয় যে তার বর তারই সাথে বসে হলুদের অনুষ্ঠানে আগের বউকে কল্পনা করছে তখন কি অয়নন্দিতার অভিমান হবে নাকি সে কষ্ট পাবে? যত যা-ই হোক না কেন এইসব শুনে নিশ্চয়ই কোনো মেয়ে আনন্দিত হবে না।

অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দুটো। সবাই এক গাড়িতে এলেও ফারহান অয়নন্দিতাকে নিজের গাড়িতে করে নিয়ে আসে। ফারহানের উদ্দেশ্য ছিল কিছুটা সময় সে অয়নন্দিতার সঙ্গে কাটাবে। এবং সেটাই হলো।
ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চলছে আপন গতিতে। দু’জনেই চুপচাপ। অয়নন্দিতার গালে হাতে হলদেটে ভাব রয়ে গেছে। টিস্যু দিয়ে মোছার পর ফারহানের হাতেও হলদেটে ভাব রয়েছে। ফারহান অয়নন্দিতার দিকে আড়চোখে তাকায়। অয়নন্দিতাকে দেখে মনে হচ্ছে সে সহজেই কিছু বলবে না। এদিকে রাস্তাও ফুরিয়ে যাচ্ছে। ফারহান নিজ থেকেই প্রশ্ন করে,
‘অয়নন্দিতা নামটার আগে কী বসানো যায় বলুন তো?’
ফারহানের প্রশ্ন শুনে অয়নন্দিতা একটু হকচকিয়ে ওঠে।
‘জি?’
‘অয়নন্দিতা নামের মানুষটার নামের আগে কী বসানো যায়, মিস নাকি মিসেস?’
এবার অয়নন্দিতা একটু হাসে। ফারহান বেশ মজার ছলে কথা বলতে পারে।
‘যেটা বলে আপনি খুশি হোন।’
‘অয়নন্দিতা, আমার সঙ্গে সারাটা জীবন কাটাতে হবে আপনাকে যদি আমি বেঁচে থাকি তো। পারবেন তো সব সামলে নিতে?’
ফারহানের কথাটায় কীসের ইঙ্গিত ছিল সে বুঝতে পারছে না অয়নন্দিতা। কিন্তু যদি বেঁচে থাকি তো এই লাইনটা বুকে গিয়ে লেগেছে তার। বাবা-মায়ের পর আরও একজন প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয় তাকে ঘিরে ধরেছে। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে আল্লাহর কাছে একটাই প্রার্থনা করে সে, এই মানুষটার যেন কিছু না হয়। কখনও যেন কিছু না হয়।

চলবে……………………….