দ্বিতীয় সূচনা পর্ব-৭+৮+৯

0
484

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৭
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

প্রশ্নের জবাবে যদি নীরবতা পালন করা নামক কোনো খেলা থাকত তবে অয়নন্দিতা নিজের জন্য অনেক সাফল্য বয়ে আনতে পারত। কোনো মানুষ এতটা চুপচাপ থাকে? ফারহান ভাবে, বন্দনা অনেক কথা বলত। এমনও সময় গেছে বন্দনা সারারাত বকবক করে গেছে আর ফারহান নাক ডেকে ঘুমিয়েছে। এ নিয়ে কত যে ততর্কবিতর্ক হতো তাদের মধ্যে। যা বলার মতো না।
অয়নন্দিতাকে আবারও প্রশ্ন করে ফারহান।
‘আচ্ছা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তার প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এটা জানেন?’
‘কেন জানব না?’
‘আমার তো মনে হয় জানেন না। প্রশ্ন করলে চুপচাপ থাকেন আবার প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে হবে সেই ভয়ে পালিয়ে যান। এটা কেমন?’
‘আপনি যা ভাবছেন তা নয় কিন্তু।’
‘আমি তেমন ভাবি না। আবার যা ভাবি তা কিন্তু সত্যি হয়ে যায়। যাই হোক, আমায় ওইভাবে সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে দেখছিলেন কেন?’
ভাবাভাবি পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু সন্দেহভাজন দৃষ্টির কথা বলেই ঝামেলায় ফেলে দেওয়া হলো অয়নন্দিতাকে। এখন আর নীরব থাকা চলবে না। নীরব থাকার জন্য শুরুতেই জ্ঞান দিলেন। অয়নন্দিতা বলে,
‘সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে দেখিনি। চোখ পড়ে গিয়েছিল শুধু।’
‘বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আপনার তাকানোর স্টাইলটাই অন্যরকম ছিল।’
‘আপনি সিগারেট টানছেন আর ফোনে কী যেন দেখছিলেন। তাই ভাবলাম, এত রাতে সিগারেট কেন টানছেন আর ফোনেই বা কী দেখছে এত মনোযোগ দিয়ে।সেটাই ভাবছিলাম আর কি?’
‘ম্যানেজমেন্টে না পড়ে গোয়েন্দা বিভাগে পড়াশোনা করলে ভালো হতো।’
‘মানে?’
‘কিছু না। তা আপনার হাতের ব্যথার কী অবস্থা? কেমন বোধ করছেন এখন?’
‘মোটামুটি ভালো।’
‘গুড। মেডিসিন খাচ্ছেন তো ঠিকমতো।’
‘জি।’
‘আপনার বান্ধবীর নাম শাম্মি। রাইট?’
‘জি।’
‘মেয়েটা ভালো। আপনাকে খাইয়ে দিল দেখলাম। মেডিসিনও খুলে দিল।’
‘শাম্মি আর আমি মাধ্যমিক থেকেই এক সাথে।’
‘তাহলে তো বেশ গভীর বন্ধুত্ব।’
‘জি।’
‘এবার ঝটপট একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো। এতরাতে না ঘুমিয়ে ব্যালকনিতে কী করছেন?’
‘রুমে যখন শুয়েছিলাম তখন সমুদ্রের গর্জন কানে লাগছিল। কান পেতে শুনছিলাম, ভীষণ ভালো লাগছিল। তাই ভাবলাম শুধু কানে না শুনে দুচোখ দিয়ে দেখেও আসা যাক। তাই ঢেউ দেখতে বের হলাম।’
‘এর আগে কখনও আসেননি এখানে?’
‘নাহ। আপনি এসেছিলেন?’
‘হ্যাঁ। তখন বন্দনা ছিল সাথে। এখন আর আসা হয় না। কারণ, বন্দনা নেই।’
ফারহানের মুখে বন্দনা নামটা শুনে অয়নন্দিতা তার ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফারহানের দিকে তাকায়। প্রশ্ন করে,
‘বন্দনা কে?’
‘বন্দনা হলো আ,,,,,,,,,’
বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যায় ফারহান। ভাবে এত কথা জিজ্ঞেস করার উনি কে? আর সে-ই বা কেন প্রশ্নের উত্তর দিতে যাবে। অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ুন — এই বলে ফারহান উল্টো পথে পা বাড়ায়। অয়নন্দিতা বিষ্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর একা-একাই বলে,
‘মাথায় সমস্যা আছে মনে হয়। পাগল কোথাকার?’
ফারহান কিছুটা সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। অয়নন্দিতার বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে।
‘ইয়া মাবুদ, শুনে ফেলল নাকি। লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমীন। অয়নন্দিতা, এই লোক পেছনে ফিরার আগেই রুমে ঢোক।’
অয়নন্দিতা আর এক সেকেন্ডও সেখানে দাঁড়ায়নি। এক দৌড়ে উড়ে গিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকে যায়। দরজা লাগিয়ে মনে-মনে বলে, বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছি। উফফ,,,,,,

দুই দিন পর৷
ট্যুর শেষ করে সবাই ফেরার পথে। অয়নন্দিতা বাসেই বসেছে শাম্মির সঙ্গে। এই দুইদিন তার জীবনে বেশ সুন্দর ছিল। না দেখা কিছু জিনিস দেখা হয়েছে। কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। সবার সঙ্গে কথা হয়েছে। সবাই এক সঙ্গে প্রতিটা মুহুর্ত এঞ্জয় করেছে। অয়নন্দিতার জীবন থেকে আনন্দ প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। প্রথমে বাবা মারা গেল। বাবার শোকে চল্লিশ দিনের মাথায় মা-ও চলে গেল। গত দুইটা বছর ধরে ওই এক মামা আর মামীর কাছেই থাকে অয়নন্দিতা। বড়ো ভাইয়ের মতো স্নেহ করে তার হাসান ভাইয়া। আর সে বড়ো বোনের মতো ভালোবাসে ছোটো ছোটো দুটো মামাতো বোনকে। সব মিলিয়ে মামা-মামীর কাছে খারাপ নেই অয়নন্দিতা। কিন্তু মা বাবার অভাব কি কখনও পূরণ হবে তার। কীভাবে-কীভাবে যেন দুইটা বছর পার হয়ে গেল। দুই বছরে চারটা ঈদও পার হয়ে গেল। যেই অয়নন্দিতার ঘুম ভাঙত মায়ের ভালোবাসার ডাকে সেই অয়নন্দিতার ঘুম ভাঙে এখন আজানের শব্দে। ঘুম থেকে উঠেই নামাজ পড়ে মামীর সঙ্গে রান্নাঘরে ঢোকে সে। যদিও মামী কখনও বলেননি তাকে যে অয়নি এটা কর, কিংবা ওটা কর। অয়নি মনে করে জগতে হয়তো তার মামীটাই একমাত্র ভালো মামী। যিনি মনে করেন তার তিন সন্তান না তার চার সন্তান। ফিরে গিয়ে মামীকে সব বলবে অয়নন্দিতা। এখানে কোথায় কী দেখেছে সব বলবে। মামীও খুশি হবে। নিজে হাত খিচিয়ে সবার জন্য টুকটাক জিনিসপত্র কিনেছে। বাসায় গিয়ে সবাইকে দিতে হবে। সব কিছুই প্ল্যান করে রেখেছে অয়নন্দিতা। দুই স্টুডেন্টের জন্য আচার নিয়েছে। ফিরে গিয়ে যখন টিউশনিতে যাবে তাদের আচার। এইসব কিছু ভাবতে-ভাবতে অয়নন্দিতা কখন যে শাম্মির কাঁধে ঘুমিয়ে যায় তা সে নিজেও,টের পায় না।
ফারহান অন্য গাড়িতে। শরীফের সঙ্গে আসছে। এই দুটো দিন তার কাছে ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক ছিল। এসেছিল ভালো লাগবে ভেবে৷ কিন্তু এসে যন্ত্রণা ভোগ করতে হলো। এই দুটো দিনে সে পদে-পদে বন্দনাকে মিস করেছে। সে যদি জানত এখানে আসলে তাকে বন্দনার স্মৃতি তাড়া করে বেড়াবে তবে সে কখনও এখানে আসত না। বাইরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে এইসবই ভাবছিল ফারহান। ঢাকা ফিরে কাজে মন দেবে সে। প্রয়োজন হলে দেশের বাইরে যাবে কাজের জন্য। তবুও কাজে লেগে থাকবে। তাহলে অন্তত বন্দনা আর তার স্মৃতি উভয়ে থেকেই রেহাই পাবে সে। নইলে সে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে।

চলবে……………………..

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৮
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

বাসায় ফিরে মামীর সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয় অয়নন্দিতা। যাওয়ার দিন থেকে শুরু করে আসার দিন পর্যন্ত সব গল্প করে সে। মামীও আনন্দ নিয়ে তার সব কথা শোনে। অয়নন্দিতার চোখ জোড়া দেখলে যে কারো মায়া লাগবে। আয়শা বেগম চাইলেও মেয়েটার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে পারেন না। তার বিবেক তাকে বাধা দেয়। নইলে আয়শা বেগমকে তার বাপের বাড়ি থেকে অনেক নানান তান বোঝানো হয়েছিল তিনি কারো কথা শোনেননি। তিনি জানেন এবং দেখছেন, অয়নন্দিতা দ্বারা তার সংসারে কখনও ক্ষতি হয়নি। তাহলে যার দ্বারা কোনো ক্ষতির সম্ভাবনাই নেই সেখানে তার সঙ্গে খারাপ আচরণ কেন করবেন তিনি। মেয়েটা এতিম বলেই তার মামা তাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। মেয়েটাও নিজের মায়ের শোক ভুলতে মামীর কাছে এসেছে। সবদিক চিন্তা করেই এই দুইবছরে কখনও তিনি অয়নন্দিতার সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলেননি।
গল্প করার ফাঁকে অয়নন্দিতা খেয়াল করে তার মামী তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। মায়া মাখানো হালকা হেসে অয়নন্দিতা প্রশ্ন করে,
‘মামী, এইভাবে তাকিয়ে আছো যে?”
অয়নন্দিতার কথায় চোখের পলক ফেলেন আয়শা বেগম।
‘তোকে দেখছিলাম।”
“আমার দেখার কী আছে?”
দুইদিন পর দেখছি তো। মনে হচ্ছে অনেকদিন পর দেখলাম।”
“কী যে বলো তুমি মামী। মামী জানো, ওইখানে রাতের বেলায় ঘুমোতে পারতাম না।”
“কেন রে?”
“সমুদ্রের গর্জনের শব্দে।”
“তাই বুঝি!”
”হ্যাঁ। জানো মামী, সমুদ্র দেখতে খুব সুন্দর। আর ঢেউগুলো, ঢেউগুলো আরও সুন্দর মামী।”
“তাই?”
“হ্যাঁ মামী।”
“মেডিসিনগুলো ঠিকঠাক মতো খেয়েছিলি?”
“হ্যাঁ। শাম্মি ছিল না সাথে, সে থাকলে আমার সব কিছুই সে দেখে রাখে।”
আয়শা বেগমের মনটা খচ-খচ করছে। অয়নন্দিতার অগোচরে তারা সবাই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কে জানে অয়নন্দিতা শোনার পর কী বলবে। অয়নন্দিতাকে জানানোর দায়িত্ব খাইরুল সাহেব আয়শা বেগমকে দিয়েছেন। আমতা-আমতা করে আয়শা বেগম অঅয়নন্দিতার মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘অয়নি, একটা কথা বলি তোকে?’
‘হ্যাঁ বলো।’
‘রাগ করতে পারবি না কিন্তু।’
‘তোমার কোনো কথায় কখনও রাগ করেছি আমি?’
‘নাহ। তা তো করিস না৷ তবে এবার করলেও করতে পারিস।’
‘কী হয়েছে গো মামী? সিরিয়াস কিছু?’
আয়শা বেগম বার কয়েক ঢোক গিয়ে সাহস সঞ্চয় করে বললেন,
‘অয়নি, তোর জন্য একটা প্রস্তাব এসেছে। তোর মামার শরীরটা তো দেখছিসই মা। ততটা ভালো না। তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা শুধু একটা ভালো মেয়ে চায়। তোর হাসান ভাইয়াও খোঁজ খবর নিয়েছে। ভালো পয়সাওয়ালা। মারে তুই আমাদের দায়িত্ব। তোর চাচা কিংবা ফুপুরাও তোকে দেখতে পারে না। আমরা কয়দিনই বা বাঁচবো। আর হাসানের বউকে তো চিনিসই। ওই শয়তান আজকেও দেখতে পারে না আমরা মরার পরে তো আরও দেখতে পারবে না তোকে। তাই ভাবছিলাম, আমরা থাকতে-থাকতে তোর একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারলে আমরা মরেও শান্তি পাব রে না।’
বিয়ের কথা শুনে মনটাই খারাপ হয়ে গেল অয়নন্দিতার। তার স্বপ্ন সে পড়াশোনা করবে। বড়ো চাকরি করবে। কিন্তু,,, আয়শা বেগম আবারও বললেন,
‘তোর যদি ছেলে পছন্দ না হয় আমরা এখানে এগুবো না মা। সবটাই তোর উপর নির্ভর করবে।’
অয়নন্দিতা এবারও চুপ। মাথাটা নিচু করে বসে আছে মামীর সামনে। আয়শা বেগম অয়নন্দিতার মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন আর সাথে বললেন,
‘ভাবিস না তুই এতিম বলে আমরা তোকে রাখতে পারছি না। এমন হলে এই দুই বছরও রাখতাম না। মামী কেমন এটা তুই ভালো করেই জানিস। তাই বলছি অমত করিস না মা।’
মামীর বলা কথাগুলো নিয়ে ভাবল অয়নন্দিতা। ঠিকই তো। আজ যদি মামা-মামী না থাকত তাহলে তার কী হতো। কোথায় যেত সে। মামা-মামী যা করবে নিশ্চয়ই তার ভালোর জন্যই করবে। আর তাছাড়া আজীবন তো এখানে থাকা যাবে না। একদিন না একদিন বিয়ে তো তাকে করতেই হবে৷ এইসব ভেবেই হ্যাঁ বলে দেয় অয়নন্দিতা।

একদিন পর।
সন্ধ্যায় সব আয়োজন করা হয়। অয়নন্দিতাকে আজ দেখতে আসবে। ভাগ্যিস হাসানের বউটা তার বাপের বাড়ি গেছে। অবশ্য আয়শা বেগম সেই অনুযায়ী তাদের আসতে বলেন। তার ভাষ্যমতে হাসানের বউটা হারে হারামজাদা। এত শয়তানি তার মনের মধ্যে। যদি এখানে উপস্থিত থাকত তাহলে একটা না একটা আবল-তাবল বলতই। আয়শা বেগম হাসানকেও না করে দিয়েছে যেন, সে বউ নিয়ে না আসে।
অয়নন্দিতাকে পরিপাটি হয়ে থাকতে বলা হয়েছে। অয়নন্দিতাও মামীর কথানুযায়ী নিজেকে পরিপাটি করে রেখেছে। শাম্মিকে জানানো হলো না। সে চেয়েছিল জানাতে কিন্তু মামী বারণ করেন। তিনি বলেন, আগে সব ঠিক হোক। এরপর জানাবি৷ আগে জানালে বদ নজর পড়ে। পরে শুভ কাজ হয় না। সাত/পাঁচ বুঝিয়ে তাকে চুপ করিয়ে দেন আয়শা বেগম।
সাড়ে সাতটা নাগাদ তিন থেকে চারজন মানুষ খাইরুল সাহেবের বাসায় উপস্থিত হোন। নতুন মেহমানদের নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী আপ্যায়ন করেন খাইরুল সাহেব এবং আয়শা বেগম। কথাবার্তার এক পর্যায়ে রমজান শেখ বলেন,
‘মেয়েকে তাহলে নিয়ে আসুন। আমরা একটু দেখি।’
তার কথায় সুর মিলিয়ে রওশন বেগমও বলেন,
‘হ্যাঁ। এবার মেয়েকে নিয়ে আসুন।’

মেয়ে দেখার পর্ব চুকিয়ে তারা চলে যান। যাওয়ার আগে জানিয়ে দিয়ে যান যে, মেয়ে ভীষণ পছন্দ হয়েছে তাদের। এবার যেন এইপক্ষ থেকে ছেলেকে দেখতে যাওয়া হয়। খাইরুল সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। তিনি এবং তার অন্য দুই ভাই যাবেন। ছেলেকে দেখে আসবেন। এরপর সেখানেই দিনক্ষণ পাকা করে আসবেন।

এদিকে ফারহানের কানে এই খবর যাওয়া মাত্রই সে রেগেমেগে অস্থির হয়ে গেছে। সে চায়নি তার বিয়ে হোক। সে চায়নি বন্দনার জায়গা অন্য কেউ নিক। তাকে না জানিয়ে কেন মেয়ে দেখা হয়েছে। আবার মেয়ের পরিবারকেও দাওয়াত করা হয়েছে। কেন এত কিছু করেছে তারা। জিদের বসে কিছু জিনিসপত্র ভেঙে ফেলে ফারহান। রওশন বেগমও এক পর্যায়ে রাগান্বিত হয়ে যান। তিনি বলেন,
‘এই ফারহানের বাবা, উনাদের ফোন করো। এক্ষুনি ফোন করো। বলে দাও উনাদের আসতে হবে না। ছেলে চায় আমরা মরে যাই। আমরা দু’জন মরে গেলে তাহলেই ছেলের শান্তি হবে৷’
স্ত্রীর কথা শুনে রমজান শেখও রেগে যান। রেগে গিয়ে বলেন,
‘আগেই বলেছিলাম, ছেলেকে জিজ্ঞেস করে যাও। ছেলে এখন আমাদের চাইতেও বড়ো হয়ে গেছে। আমাদের পাত্তা দেওয়ার মতো সময় আছে নাকি ছেলের। এখন আমাদের মান-সম্মান চলে যাক। বাইরের মানুষের কথা শুনুক এই রমজান শেখ। ছেলের কী তাতে? বহুত সময় দিলাম তো ছেলেকে, কোনো লাভ হয়েছে? ছেলে তার কথাতেই আটকে আছে। আমাদের কোনো মূল্য আছে ওর কাছে?’
আজ বাবা এবং মা দু’জনকে একত্রে রেগে যেতে নিজের রাগটা বশে আনে ফারহান। একপাশে ফারাশ আর সাজি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এবার ফারহান বলে,
‘আমি একবারই বলেছিলাম যে, আমি বিয়ে করব না?’
রমজান শেখ বলেন,
‘হ্যাঁ। তা করবা কেন? অনেক বেশি সুখ দিয়ে ফেলছ না নিজের বাবা মা’কে। এত সুখ কি আমাদের কপালে সয় নাকি? তাই তো সুখে থাকলে ভূতে কিলায় আমাদের দু’জনকে। আর তোমাকে বলে দিচ্ছি রওশন, ফের যদি ছেলের বিয়ে নিয়ে তুমি আমায় বিরক্ত করেছ তো তোমার একদিন কি আমার একদিন। কথাটা মনে রাখবে।’
রমজান শেখ নিজের ঘরে চলে যান। রওশন বেগমও চোখের পানি মুছতে-মুছতে উপরে চলে যান। সাজি আর ফারাশ একে অপরের দিকে তাকায়। সাজি বলে ওঠে,
‘মায়েরও আর তর সয় না। ওইখানেই উনাদের বলে এসেছে যে মেয়ে পছন্দ হয়েছে। এবার আপনারা আসেন। একবারও ভাবল না যে, বাসায় এসে ছেলেকে বোঝাতে হবে। এখন যদি না করে দেয় বেচারাদের মনটাই নষ্ট হয়ে যাবে। এমনিতেই মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ তারা।’
এবার ফারাশও বলে,
‘হ্যাঁ। দেখে তো মনে হয়েছে একেবারেই নিরীহ মানুষ।’
‘সেটাই তো বলছি ছোটো ভাইয়া। একবার আসতে বলে আবার না করে দিলে কতটা কষ্ট পাবে ভাবো তো।’
‘মেয়েটাও কষ্ট পাবে। মেয়েটাকে দেখতে খুব মায়াবী। বাদ দে, আমাদের কী আর? বাবা মা’কে ছোটো হতে হবে সবার কাছে৷ এই বয়সে এসে কথা শুনতে হবে। তাও ভাইয়ার জন্য। চল উপরে চল।’
কথাগুলো বলে সাজি আর ফারাশ নিজেদের মতো চলে যায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে তারা দু’জন একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসে। মূলত তাদের উদ্দেশ্য ছিল কথাগুলো ফারহানের কানে দেওয়া। আর তারা সেটা পেরেছে।
ফারহান সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ফারাশ আর সাজির কথাগুলো নিয়ে ভাবছে সে। না করে দিলে কি সত্যিই তারা কষ্ট পাবে? আর ওই মেয়েটা, সেও কি কষ্ট পাবে।

পরদিন বিকেলবেলা।
ফারাশ আর সাজি দু’জন ছাদে বসে চা খাচ্ছে। ভাইবোন হলেও তারা বন্ধুর মতো মেশে। প্রতিদিন না হলেও দুইদিন পর-পর তারা দুই ভাইবোন ছাদে চায়ের কাপ নিয়ে বসে পড়ে। আজও বসে-বসে গল্প করছে দু’জন।
ফারহান হুট করেই ছাদে আসে। ফারাশ আর সাজির নজর ভাইয়ের দিকে যেতেই সাজি বলে ওঠে,
‘ভাইয়া, আসো। চা খাবে?’
ফারহান তখন তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। তার চোখ-মুখের অবস্থা দেখে ফারাশ বলে,
‘কিছু বলবা?’
ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে মুখ খোলে ফারহান।
‘বাবা আর মা’কে বলে দিস, তারা যেন উনাদের বারণ না করে। আসতে যখন বলেছে আসুক।’
ফারাশ আর সাজি আবারও একে অপরের দিকে তাকায়। মুচকি হেসে বলে,
‘তার মানে, তুমি রাজি?’
‘এখানে রাজির কথা কেন আসে? উনাদের আসতে বলা হয়েছে উনারা আসবে।’
‘উনারা তো আর এমনি-এমনি আসবে না। তোমাকে দেখতে আসবে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে আসবে।’
‘আসুক তবে।’
‘যাকে আমরা দেখতে গিয়েছিলাম সে কিন্তু মাশা-আল্লাহ অনেক সুন্দর। একবার ছবি দেখবে নাকি?’
‘এত কথা বলিস কেন? যা বললাম সেটা গিয়ে বাবাকে বলে দে।’
ফারহান সেখান থেকে বের হয়ে গেলে ফারাশ আর সাজি শব্দ করে হেসে দেয়৷ তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। এখন ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হলে হয়।

চলবে………………………….

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৯
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

মুরব্বি টাইপ কিছু মানুষের মাঝে বসে থাকতে অদ্ভুত লাগছে ফারহানের। এমন পরিস্থিতিতে কখনও পড়েনি সে। বন্দনাকে নিয়ে নিজে নিজেই সব করেছিল বলেই হয়তো এইসব অদ্ভুত আর নতুন লাগছে তার কাছে।
খাইরুল সাহেব ফারহানকে খুঁতিয়ে-খুঁতিয়ে দেখছে। যিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি বলেছিলেন ছেলের বয়স নাকি কিছুটা বেশি। কিন্তু তার চোখে তেমন কিছুই ধরা পড়ছে না। তবে ভাগনি অয়নন্দিতার চেয়ে যে বয়সে বড়ো তা বোঝা যায়। সেটা সমস্যা না, পুরুষের বয়স থাকা ভালো। তিনি ফারহানের সঙ্গে কথা বলছেন। ফারহানও বেশ ঠিকঠাক ভাবেই কথা বলছে। মনে থাকা রাগ অভিমান এক পাশে রেখেই কথা বলছে। কারণ তার কাছে খাইরুল সাহেব লোকটাকে ভালো লাগছে। দেখেই বোঝা যায়, একটু বেশিই সহজ সরল। অন্যদিকে, হাসান বেশ ফ্রী হয়েই কথা বলছে ফারহানের সঙ্গে। কথা বলার এক পর্যায়ে হাসান বলে,
‘অয়নন্দিতা আমার ফুফাতো বোন হলেও আমাদের কাছে সে আমাদের ঘরের মেয়ে। কখনও ভেদাভেদ করিনি যে অয়নি আমার নিজের বোন নয়৷’
অয়নন্দিতা নামটা শুনেই ফারহান চমকে যায়। ভাবছে, এ কোন অয়নন্দিতা! সে যেই অয়নন্দিতাকে চেনে সে নয়তো। তার ভাবনার মাঝেই খাইরুল সাহেব বললেন,
‘মা-বাবা হারা সন্তানের যে কত কষ্ট তা আমি আমার ভাগনিকে দেখলে বুঝি। তাই তো তার জন্য আমি সব সময় ভালো চিন্তা করি। যাতে ভাগনি কখনও বলতে না পারে আমার বাবা-মা নেই বলে মামা আমার সঙ্গে এমন করেছে। আমার এই ভাগনিটা ভীষণ চাপা স্বভাবের। বিশেষ করে ওর বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকে আরও চুপচাপ হয়ে গেছে। ওকে কেটে ফেলে দিলেও টু-শব্দ বের করবে না মুখ থেকে। তার মন থেকে চাওয়া-পাওয়া মনে হয় চিরতরে হারিয়ে গেছে। নিজের জন্য না আছে কোনো চাহিদা না আছে কোনো আবদার। আমার বোনটা চলে তো গেছে যাওয়ার সময় মেয়ের সব হাসি আনন্দ নিয়ে গেছে।’
রমজান শেখ এবং রওশন বেগম আফসোস করছেন। ফারাশ আর সাজিরও খারাপ লাগছে। এই জগতে অনেকেই আছে যাদের কষ্টের শেষ নেই তাদের মধ্যে অয়নন্দিতা একজন। এটাই সবার মনে হচ্ছে।
এদিকে ফারহানের মাথায় ঘুরছে ব্যাপারটা। শরীফকে ফোন দিতে হবে।
‘এক্সকিউজ মি, আমি কি পাঁচ মিনিটের জন্য একটু উঠতে পারি?’
ফারহানের প্রশ্নে খাইরুল সাহেব এবং হাসান সহ সবাই মত দেন। সবার অনুমতি নিয়েই ফারহান সেখান থেকে উঠে যায়। একটু দূরে এসে শরীফকে ফোন দেয় ফারহান।
কয়েকবার ফোন বাজার পর রিসিভ হয়।
‘হ্যালো ফারহান, কী অবস্থা?’
‘অবস্থা পরে। আগে একটা প্রশ্নের উত্তর দে তো।’
‘কী প্রশ্ন?’
‘তোর ওই স্টুডেন্টটা, অয়নন্দিতা। ওর কি মা-বাবা মৃত?’
‘হ্যাঁ। প্রথমে বাবা মারা গেছে আর তার চল্লিশ দিনের মাথায় মা। অনেল বড়ো ধাক্কা খেয়েছিল মেয়েটা। সেই থেকে যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে আর কখনও মেলে ধরতে দেখিনি।’
ফারহান আর কিছু বলেনি। ফোনের লাইনটা কেটে দেয়। বাম হাত দিয়ে নিজেত মুখটা স্পর্শ করে সে। চোখ জোড়া মুছে নেয়। এরপর হালকা একটা নিঃশ্বাস ফেলে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

মেহমান চলে গেছে। সামনের মাসের দশ তারিখ বিয়ের তারিখ ফাইনাল করে গেছেন তারা। সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে ফারহান। ফারাশ আর সাজিও পাশে বসে আছে। তারা অয়নন্দিতার কথা বলছে। সাজি বলে,
‘ভাইয়া, একবার আমাদের ভাবীকে দেখে নাও।’
ফারহান কাজ রেখে একবার সাজির দিকে তাকায়। ভাইয়ের তাকানো দেখে সাজি মাথা নিচু করে নেয়।
‘দেখার কী আছে?’
ফারাশ তখন বলে,
‘সি ইজ সো বিউটিফুল। একবার দেখতে পারো। চোখ সরবে না।’
‘এতটাও সুন্দর না যতটা বলছিস।’
‘তুমি কী করে বুঝলে?’
‘ঠোঁটের ডান পাশের তিল, এক জোড়া হরিণী চোখ ছাড়া তেমন কিছুই নেই।’
সাজি আর ফারাশ হা হয়ে তাকিয়ে থাকে ফারহানের দিকে৷ আর ফারহান, সে নিজেই বোকা হয়ে গেছে এই কথাটা বলে। ফারাশের মুখ পুরো হা হয়ে যায়। কারণ, ফারহান যা বলেছে তার সবটাই অয়নন্দিতার মধ্যে বিদ্যমান৷ তবে প্রশ্ন হচ্ছে অন্য জায়গায়৷ ফারহান কী করে জানল এত কিছু?
সাজি প্রশ্ন করে,
‘তুমি জানো কীভাবে?’
ফারহান কিছু বলতে পারেনি। আমতা-আমতা না করে কাজ আছে বলে সোজা উপরে চলে যায়। সাজি নিজে থেকেই বলে ওঠে,
‘বুঝলা ছোটো ভাইয়া, ডাল ম্যায় কুছ কালা জারুর হ্যায়।’
ফারাশ টিপ্পনী কেটে বলে,
‘নেহি৷ মুঝে লাগতা হ্যায়, ডাল ম্যায় জারুর কুছ সাফেদ হ্যায়।’
‘মুঝে ভি লাগতা হ্যায়।’

কলেজের গেইট থেকে বের হতেই একটা গাড়ি এসে অয়নন্দিতাকে ঘিরে ধরে। তার সাথে এর আগে কখনও এমন হয়নি। এইভাবে পথ আটকে ধরা তাও আবার কলেজের সামনে। কারো চোখে পড়লে সমস্যা হতেই পারে৷ গাড়ির গ্লাস খুলে দিতেই অয়নন্দিতা ফারহানকে দেখতে পায়। ফারহান তখন ড্রাইভিং সীটে বসে আছে। অয়নন্দিতা ফারহানকে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয়। মনে-মনে বলতে থাকে, এই লোক এখানে কী করে? অয়নন্দিতার মনে থাকা প্রশ্নের উত্তর ফারহান অনায়াসে দিয়ে দেয়,
‘এখানে কাজেই এসেছি। অকারণে আসিনি। গাড়িতে উঠুন।’
অয়নন্দিতা ফারহানের হাব-ভাব দেখে একটু ভয়েও পাচ্ছে। সে চাইলেই এখন কারো সঙ্গে কোথাও যেতে পারবে না। কারণ তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। কিছুদিন পর সে অন্য কারো বউ হবে। এখন এভাবে কারো সঙ্গে উঠা-বসা করা উচিত না৷ অয়নন্দিতাকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফারহান আবারও বলে,
‘এইযে, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? গাড়িতে বসুন।’
‘আমার একটু কাজ আছে। তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে।’
‘এই মুহুর্তে আমার সাথে কথা বলা সব থেকে জরুরী। গাড়িতে আসুন।’
‘দেখুন, আমার কথা বলার ইচ্ছা নেই। আমার তাড়া আছে।’
‘আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না যে, আমি গাড়ি থেকে নেমে আপনাকে জোর করি।’
‘মানে,,,?’
‘মানি কিছুই না। চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসুন।’
গাড়ি থেকে নেমে যদি তার হাত ধরে টানে তাহলে তো মান সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে। এইসব ভেবে অয়নন্দিতা গাড়িতে বসে যায়। আর ফারহান ফুল স্পিডে গাড়ি স্টার্ট করে।

চলবে…………………………