নন্দিতা পর্ব-০১

0
343

পর্ব-০১
#নন্দিতা
#kheya

” আপনি আমায় কেন ভালোবাসলেন না, রায়াজ ভাই।”

নন্দিতার এহেন কথায় বিন্দুমাত্র বিস্মিত হলো না রায়াজ।মেয়েটা বরাবরই এমন খাপছাড়া কথা বলে।
নন্দিতার দিকে একপলক তাকিয়েই আবার নিজের কাজে মন দিলো রায়াজ।মেয়েটার সাথে এখন অপ্রয়োজনীয় কথা বলার কোনো প্রয়োজন মনে করছেনা সে।

” কথা বলবেন না, রায়াজ ভাই!”
উত্তর দেয়না রাজায়।পুনরায় ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে মনোনিবেশ করে।এই মেয়েটাকে সে কীভাবে বোঝাবে যে তার পাগলামি কখনোই রায়াজের মনে জায়গা করে নিতে পারবেনা।কেবল তুচ্ছ একটা বিরক্তির কারণ হয়ে যাবে.।
আজ বড্ড মেঘ জমেছে, হয়ত এখনই বর্ষণ হবে।তবে কথায় আছে না, যত গর্জে তত বর্ষে না,নন্দিতার অবস্থাও এমন।খুব বেশি মন খারাপ হলে তার কান্না পায়না।নন্দিতা গুটিগুটি পায়ে রায়াজের রুম থেকে চলে গেলো।

নন্দিতা চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে কপট বিরক্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে রায়াজ।

ফোনটা বেজে উঠতেই সেকেন্ডের মাঝে তার নিউরন গুলো সজাগ হয়।স্ক্রিনে রিয়া নামটা স্পষ্ট। মুখে সন্তুষ্টির হাসি ফুটিয়ে ফোনটা তুলে রায়াজ।
ফোনে কথা শেষ করতেই নন্দিতার কথা মাথায় আসে রায়াজের।

” মেয়েটা বেশ অদ্ভুত । খুব আহামরি সুন্দর না।তবে চেহারায় বেশ মায়া।ফর্সা না।শ্যামলা।নাহ! শ্যামলাও না,, খানিকটা ফরসা আর শ্যামলার মাঝামাঝি। চেহারা মন্দ না।তবে এমন বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে প্রেমের কথাও রায়াজের মনে আসেনা।

—-

অশান্ত বিকেল,নাহ ঠিক অশান্ত না।একটু বেশিই শান্ত।যেমনটা ঝড় আসার পূর্বে হয়।
প্রকৃতি আজ যতটাই শান্ত, ততটাই অশান্ত নন্দিতার মন।আচ্ছা রায়াজ ভাই কেন তাকে ভালোবাসেনা,কখনোই কী বাসবেনা।
অসম্ভব রকমের কিছু চিন্তা শুধু আমাদের যন্ত্রণাই দিয়ে যায়।ব্যতিক্রম হলোনা এখানেও, অহস্য যন্ত্রণায় মাথা যেন ছিড়ে আসছে তার।
ভারি, অগাছালো পায়ে দু’পা দু’পা করে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো নন্দিতা

” নন্দিতা ”

পিছন ফিরে তাকালো সে।রায়াজের এমন শান্ত কন্ঠের ডাকটা বরাবরই মুগ্ধ করে তাকে।অশান্ত করে তার মনকে।মানুষটার দিকে তাকালে যেন পুরো বিশ্বব্রমান্ড ভুলে যায় সে।

” এক কাপ চা দিবি।মাথাটা বড্ড ধরেছে।”

” আদা দিয়ে দেই, রায়াজ ভা,,,,”

মুহুর্তের মাঝে থেমে যায় নন্দিতা ।লোকটার প্রতি বিশেষ যত্ন দেখাতে গিয়ে বরাবরই ভুল করে বসে সে।রায়াজ ভাই যে আদার গন্ধ সহ্য করতে পারেনা সে জানে।তবুও,,
পুনরায় কিছু না বলে গুটিগুটি পায়ে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।

,,,,,,

দুকাপ চা বানিয়ে নিলো।একটা নিজের জন্য আর একটা রায়াজের জন্য। রায়াজ অবশ্য চায়ে চিনি খায় না।ভীষন স্বাস্থ সচেতন মানুষ,বলেই হয়ত এতো সুদর্শন তিনি।যদিও সৌন্দর্য তো সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি।তবুও নন্দিতার মনে বিশাল আক্ষেপ, এই সুদর্শন সৃষ্টিকে কেবল তার জন্য বরাদ্দ কেন রাখা হলো না।

রায়াজের রুমে চা দিয়েই নিজের কাপটা নিয়ে বেলকনিতে বসলো সে।সাথে হূমায়ন আহমেদের ” নবনী” বইটা।বইটা বেশ কয়েকবার পড়েছে সে।তবুও আবার পড়তে মন্দ লাগেনা তার।

স্বচ্ছ সুন্দর দীঘল আকাশের পানে চেয়ে মনে মনে বলে উঠলো

” বই আমার একদম পছন্দ না, জানেন রায়াজ ভাই।তবুও আপনার মনের মতো হয়ে উঠার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা আমার।”

রায়াজ বই ভীষণ পছন্দ করে।লোকটা বেশ গম্ভীর স্বভাবের হলেও কখনো খারাপ ব্যবহার করেনি নন্দিতার সাথে।নন্দিতা মেয়েটা মন্দ না।নিতান্তই গোলগাল সুন্দর চেহারার এক ষোড়শী তরুণী।তবে রায়াজকে চাওয়ার মাঝে তার ভুলটা কী?বয়স!

——–

পৌষমাসের আজকে বারো তারিখ।
বাংলা মাসের হিসাব রাখতে বেশ ভাল্লাগে নন্দিতার। আজকে রায়াজের জন্মদিন।
দিনটা খুব স্পেশাল হলেও বিশেষ কোনো কারণে এই দিনটা পালন করা হয়না।তবে কেন করা হয়না জানা নেই নন্দিতার।
ঘুম থেকে উঠে গুটিগুটি পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায় সে।

” আমি কিছু করে দেবো মামি।”

নন্দিতার কথায় রায়াজের মা পেছন ফিরে কেবল মুচকি হেসে বলল

” লাগবেনা মা, সব হয়ে গেছে। তুমি টেবিলে বসো আমি খাবার দিচ্ছি। ”

মিসেস রহমানের এমন মিষ্টি ব্যবহার নন্দিতার ভীষণ প্রিয়।রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মায়ের সাথে ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেলো নন্দিতা।

” তুই আবার রানন্নাঘরে গিয়েছিলি।”

মায়ের কড়া গলায় কথাটা শুনে নন্দিতা কিছু না বলেই চলে গেলো। সে জানে মা এখন কী বলবে।নন্দিতার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মামার বাড়িতেই আছে তারা।মামা মামি যথেষ্ট স্নেহ করলেও তার মা কখনো চায়না মেয়ে তাদের কাছে বিশেষ বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াক।

আরো দু’কদম সামনে এগোতেই আবারও ধাক্কা খায় নন্দিতা।তবে এবার বেশ জোড়েই খায়।শূন্যে ভাসতে লাগে সে।ভাবে হয়ত তার কল্পনার মতো রায়াজ তাকে ধরে নিবে।কিন্তু না।
নন্দিতা পড়ে যায়। বেশ জোরেই!

শব্দ মেয়ে রান্নাঘর থেকে নন্দিতার মামি ও মা ছুটে আসে।প্রশ্ন করে ” কী হয়েছে”

পাউরুটিতে জ্যাম লাগাতে লাগাতে রায়াজ বলে
” দিনের বেলা জেগে জেগে আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখলে যা হয় তাই হয়েছে ”

বলেই নিজের মতো খাওয়া শুরু করে।মামি গিয়ে নন্দিতা কে টেনে তোলে।ভীষণ রাগ হয় নন্দিতার। শুভ্র গালগুলোই লাল রংয়ের মিষ্টি আভাস স্পষ্ট।
কপট রাগ দেখিয়ে মামির দিকে তাকিয়ে বলে

” আচ্ছা মামি মা, তোমাদের অবস্থা তো কোনকালেই এত খারাপ ছিল না যে জন্মের পর ছেলের মুখে একটু মধু দেওয়ার ক্ষমতা হয়নি।”

রায়াজ খানিকটা বিব্রত হলেও কিছু বলেনা।সে জানে এই মেয়েকে কিছু বলাও বৃথা।

———-
আজকে বিকেল থেকে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। অসময়ের এই বৃষ্টি যেন খারাপ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সবে মাত্র গোসল শেষ করে এসেছে রায়াজ।চুল দিয়ে এখনও টপটপ করে পানি পড়ছে। আজকে অবশ্য একটু দেরিই হয়ে গেছে গোসল করতে।বিকেল চারটা তখন বাজে।

টাওয়েল টা বিছানায় রাখতেই কারো ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ পায়।

এটা যে নন্দিতা সে জানে।চরম বিরক্তি নিয়ে নন্দিতার রুমের দিকে এগিয়ে গেলো রায়াজ।

নন্দিতা বিছানায় গুটিশুটি হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে।ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে।
চোখমুখ একদম লাল হয়ে আছে মেয়েটার।

কোন কারণ বশত যে মেয়েটা ভীষণ যন্ত্রণা ভেগ করছে তা তার চোখমুখ দেখেই বুঝলো রায়াজ।
তার প্রচন্ড বিরক্তিও খারাপ লাগায় পাল্টে গেলো মুহুর্তে। নন্দিতা মেয়েটা ভীষণ চঞ্চল।এত চঞ্চলতা রায়াজের ভালো লাগেনা। তবে তাকে এভাবে কাঁদতে দেখে কেন জানি বারবার বুকটা কেঁপে উঠে রায়াজের।আনমনে বলে,,

“এই মেয়ের চোখের দিকে যে একবার তাকাবে তার আর কখনো এ চোখের দিকে তাকানোর সাহস হবেনা।
কী গভীর সে চাহনি। শান্ত নিরলস বয়ে চলা সাগরের ন্যায় স্নিগ্ধ স্বচ্ছ দৃষ্টি।চোখের মাঝে দিয়ে যেন তার বুকফাটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে চাইছে।”

” রায়াজ ভাই,,,”

নন্দিতার ডাকে হুস ফিরে রায়াজের।রায়ায় তার দিকে তাকাতেই ডুকরে কেঁদে উঠে নন্দিতা।ভীষণ অস্থির আর এলোমেলো লাগছে রায়াজের নন্দিতাকে আজ।

” আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে রায়াজ ভাই।আমি শ্বাস নিতে পারছিনা রায়াজ ভাই।আমার প্রতিটি হৃদকম্পন যেন থমকে আসছে।আমার সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে রায়াজ ভাই।আপনি কেন আমাকে ভালবাসেন না।কেন বাসলেন না ভালো।আপনি অন্য কারো হবেন আমি এটা মানতে পারবোনা রায়াজ ভাই,,,,আমি মরে যাবো,,,”

নন্দিতা ভীষণ আর্তনাদ করছে, তার এ আর্তনাদ বাড়ির আর কারো কানে না পৌঁছালেও রায়াজের বুকে বিধলো। মেয়েটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার কী ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

মেয়েটাকে একবার আলতো করে বুকে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে হলো রায়াজের।তবে ইচ্ছাটা দমিয়ে রেখে দুহাতে নন্দিতাকে ঝাকিয়ে বললো

” শান্ত হ নন্দিতা। কারে জন্য না।শুধু মাত্র নিজের জন্য বাঁচতে শিখতে হবে তোকে,,,”

কথাগুলো নন্দিতার কান অবদি পৌঁছালেও তার নিউরনগুলো তা তার মনে পৌঁছাতে দিলোনা।

মেয়েটা ভীষণ ভাবে কাঁদছে।ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে। চোখমুখের অবস্থা ভীষণ করুন।মুহুর্তেই জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়লো রায়াজের বুকে।

চলবে