নন্দিতা পর্ব-২+৩

0
247

#নন্দিতা
০২+০৩
পর্ব-০২
#kheya

স্বচ্ছ শান্ত জলরাশির মতো বয়ে চলেছে সময়।থেমে নেই কারো জন্য।
সেদিনের পর কেটেছে সপ্তাখানেক। রায়াজের সাথে কথা হয়নি নন্দিতার।
নন্দিতাই বলেনি।সে মানবের ওপর আর একটু দুর্বল হওয়া মানে যে নিজের প্রাণনাশ করা, সেটা সে বুঝেছে।সে ভুল করছে।অন্যের কাছে নিজেকে এতটা তুচ্ছ প্রমাণ করা ঠিক নয়।তবুও কেন,,,
নাহ যে করেই হোক নিজেকে সংযত করতে হবে।

সকাল নয়টা!

নিজের রুমে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে আসে নন্দিতা।কী করবে না করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা।রায়াজ ছাড়া অন্য কিছু যেন তার মাথায় আসেই না।

অগোছালো এলোমেলো পায়ে ছাঁদে চলে গেলো।

ছাঁদটা বেশ বড় না হলেও সুন্দর।বেশির ভাগ জায়গা জুড়েই রয়েছে বাগান বিলাস।বাগান বিলাস আবার রায়াজের একটু বেশিই পছন্দ।নন্দিতা আনমনে বলে উঠলো
” ইশ আমি কেন বাগান বিলাস হলাম না।তাহলে হয়ত উনি আমায়,,,”

” কী করছো নন্দিত? ”

একপলক আবারও পেছনে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো নন্দিতা।রাসেল এসে নন্দিতার সামনে দাঁড়ালো।

” মন খারাপ ”

নন্দিতা রাসেলের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না।তার চোখ ছলছল করছে।যেমনটা তীব্র দাবদাহে শুকিয়ে যাওয়া নদী বর্ষার পানি পেলে উচ্ছাসিত হয়ে সূর্যের আলোয় চিকচিক করে।তেমনই রোদের আলোয় নন্দিতার চোখের পানিগুলো চিকচিক করছে

” রাসেল ভাই!উনি আমাকে কেন ভালোবাসলো না!আমি কী উনার সাথে বেশি পাগলামী করে ফেলেছি।”

অবাক হয়না রাসেল।সে জানে সবই।নন্দিতা কী বলবে জানা ছিল তার।মেয়েটার বয়স কম, আবেগ বেশি।তবে এত বেশি আবেগ যে, তাকে শেষ করে দিচ্ছে এটা সে বুঝেনা।

” সামনে মাসে রায়াজ ভাই আর রিয়া আপুর বিয়ে।”

থমকে যায় নন্দিতা। কথাগুলো তার মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই যেন নিউরনগুলো অচল হয়ে এলো।কী আশ্চর্য, তার কষ্ট হচ্ছেনা।খারাপ লাগছেনা।একটুও!

______

পৌষ মাসের সমাপ্তি হয়ে এসেছে প্রায়।রায়াজ রিয়ার বিয়ের কথাও মোটামুটিভাবে সব ঠিকঠাক।এতে অবশ্য কোন ঝামেলা করেনি নন্দিতা। এটা নিয়ে রায়াজ বেশি অবাক হলেও কোন কথা তোলেনা।

সকালের ব্রেকফাস্ট টেবিলে রায়াজ নন্দিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে

” কদিন পর তো রেজাল্ট। কোন কলেজে পড়বি না পড়বি ঠিক করেছিস।হ্যাঁ সবই রেজাল্টের ওপর জানি।তবে শখ বলে একটা ব্যাপার আছে তো। প্রাইভেট কলেজ হলে তো এডমিশন করিয়ে দেওয়া যাবে। ”

রায়াজের কথায় তার বাবা বলে উঠলেন

” হ্যাঁ রে মা তোর কোনো চয়েস থাকলে তো বলতে পারিস।”

মিস্টার রহমানের কথায় এবার নন্দিতা খাওয়া ছেড়ে তার দিকে তাকিয়ে বললো

” আমি বিয়ে করতে চাই, মামা।তোমরা আমার জন্য ছেলে দেখো।”

কথাগুলো একদমে বলেই অতি সন্তপর্ণে আবারও খাওয়া শুরু করল নন্দিতা।তবে সেদিন আর কারো গলা দিয়ে খাওয়া নামলোনা। মেয়েটা বলে কী!
,,,,,

বাসার সবাই একটা দাওয়ার এ গেছে।শরীর খরাপের বাহানা দিয়ে নন্দিতা যায়নি।সে ভেবেছিল হয়ত রায়াজও গিয়েছে।তবে তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে রায়াজ তার রুমে প্রবেশ করলো। রায়াজকে দেখেও কিছু বললো না সে।ভালোবাসার মানুষের কাছে নিজেকে এতটা তুচ্ছ করতে নেই যে।

” নন্দিতা ”

মৃদু দৃষ্টি পেলে সে রায়াজের দিকে। আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়।মনটা ভালো নেই তার।রায়াজের বিয়ের কথা মাথায় আসলেই কান্না পাচ্ছে তার ভীষণ রকম।

প্রতিবারের মতো এবারও রায়াজের শীতল কন্ঠের মোহনীয় এ ডাক যেন নন্দিতার কলিজায় শূলের মতো বিধলো।তবে প্রতিউত্তর করলোনা।পুনরায় রায়াজ বললো

” তুই ঠিক আসিস।উল্টাপাল্টা কথা কেন বলছিলি তখন,,,!”

রায়াজের কথা শেষ হওয়ারয় কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার।নিজকে সামলে নিতে শিখতে হবে। কিঞ্চিত বিরক্ত হয় রায়াজ।এই মেয়েটা এমন কেন।

রায়াজের দিকে তাকিয়ে যেন নিজের অশ্রু গুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে সে।

” আপনি আমায় কেন ভালোবাসলেন না রায়াজ ভাই।কী কমতি ছিল আমার ভালোবাসায়। আমি তো আপনাকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবেসেছিলাম।আমার মতো এত ভালো যে আর কেউ বাসতে পারবেনা।আমি যে শেষ হয়ে যাচ্ছি রায়াজ ভাই।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। আপনাকে অন্যকারো সাথে দেখার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়,,”মনে মনে কথাগুলো ভাবলো নন্দিতা। তবে মুখে কিছু প্রকাশ করল না।চপি থাকতে দেখে ভীষণ রেগে গেল রায়াজ।

নন্দিতা কেবল ছলছল চোখে তার দিকে চেয়ে রইল।আচমকা গালে অনুভূত চিনচিনে ব্যাথায় অনুভবে রায়াজের দিকে অশ্রুসিক্ত টলমল চাহনি দিলো নন্দিতা।শেষ পর্যন্ত রায়াজ তার গাঁয়ে হাত তুললো।বিনা কারণে মার খেয়ে চোখের জল আটকে রাখতে পারলোনা সে।তবে

এখনও ফুঁফিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।দেখেই বোঝা যাচ্ছে শ্বাস নিতে তার ভীষন কষ্ট হচ্ছে। এটা অবশ্য নন্দিতার চিরকালের ব্যাপার।একটু কাঁদলেই তার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।এই একটা কারণেই নন্দিতা কাঁদুক এটা রায়াজের পছন্দ না।গম্ভীর হলেও যে এতটা নিষ্ঠুর সে নয়।

নন্দিতাকে কাছে টেনে আলতো হাতে গাল স্পর্শ করে বললো

“আমার দিকে তাকা।আমার জন্য কেন এমন করসিস তুই।এসব আবেগ বাদ দিতে হবে পিচ্চি। আমার মতো এমন অনেক মানুষ জীবনে আসবে যাবে।তবে কারো জন্য নিজেকে শেষ করতে নেই।কারো জন্য না।নিজের জন্য বাঁচতে শিখো।দুনিয়াটাকে নিজের মতো উপভোগ করো।
আমার জন্য কেন মরবি তুই।আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করতে হবেনা।শুধু নরমাল হয়ে যা।আগের মতো।”

” আমি যে আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি রায়াজ ভাই।”

রায়াজ পুনরায় নন্দিতার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে

” সে নাহয় বুঝলাম।আমাকে যখন এত ভালোবাসিস। তখন একটু ভালো নাহয় নিজেকে বাসতে শিখে নে।”

ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে থাকে নন্দিতা।এবার তার রায়াজ তাকে সরাই না।কী জানি আজকে ভীষণ ইচ্ছে হলো মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে রাখতে।
তবে ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখলো রায়াজ।
—-

নন্দিতার রুম থেকে বেরিয়ে এলো রায়াজ।কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে।সারাজীবন ওকে নিজের বোনের মতোই ভেবেছে।
যদিও রায়াজের মনের কোণে কোথাও নন্দিতার জন্য বিন্দুমাত্র অনুভূতি থেকে থাকে তাও প্রকাশ্যে আনলে চলবেনা।
রায়াজের কপালের কোণে বিন্দু বিন্দ ঘামগুলো হাত দিয়ে মুছে এগিয়ে গেলো তার রুমে দিকে।আচ্ছা এই বাচ্চা মেয়েটাকে কীভাবে ভালোবাসতো সে।কম না হলেও পুরো একযুগ বয়সের ব্যবধান তাদের।
পরক্ষনেই মাথায় আসলো আচ্ছা ভালোবাসা কী বয়স দেখে।

দুহাতে মাথার চুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে ধরল রায়াজ।না না! সে এসব কী ভাবছে।নন্দিতার সাথে তারও পাগল হলে চলবেনা।

,,,,,,,,

রাত প্রায় সাড়ে নয়টা।ছাদে একা দাঁড়িয়ে আছে নন্দিতা। মনটা তার বড্ড খারাপ।এবার সে দৃঢ় সংকল্প করে নিয়েছে রায়াজের কাছে আর নিজেকে ছোট করবেনা। তবে অনুভূতিগুলো কেন এত অবাধ্য।তবুও নিজেকে সংযত করতেই হবে এবার।

প্রতি মুহুর্তে তার মনে পড়ছে আচ্ছা সে কী রায়াজের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে।
নন্দিতাকে ঘরে দেখতে না পেয়ে কোনো অজানা আশংকায় মনটা বিরক্তিতে ভরে উঠে রায়াজের।এত রাতে সে কোথায় যেতে পারে তা রায়াজ জানে।তাইতো সেও দেরি না করে ছাঁদে যায়।
নন্দিতাকে বেশ কয়েকবার ডাকতেই চমকে পিছনে ফিরে।
সবাই তোকে খুজছে।খেতে আয়।”

” রায়াজ ভাই।”

” বল”

“ওই যে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদটা দেখছেন না!
আপনাকে পেয়ে গেলে আমার জীবনটাও
ঠিক ওই চাঁদের মতো একইরকম পূর্ণতা পেতো।
” (সালমান হাবীব)তবে কী জানেন আমি আর আপনার বিরক্তির কারণ হবোনা।ভালবাসলেনই যে তাকে পেতে হবে তার মানে নেই।আজ থেকে আমি আমার মতো নিজেকে গুছিয়ে নিবো।”

রদয়াজ
” নিচে আয় জলদি।এভাবে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”

নন্দিতা কিছু না বলে নিচে যায়।

সবাই একসাথে খেতে বসেছে।রায়াজের বাবা মিস্টার রহমান বললেন

” রিয়ার বাবা মা সামনে মাসেই বিয়ে কাজটা সেরে ফেলতে চাচ্ছে।তোমরা সবাই রাজি থাকো তো সামনে বরিবার ওদের এ বাড়িতে ডেকে কথাবার্তা ঠিক করে ফেলি।”

সকলেই সম্মতি দিলো।রায়াজের মুখে একটা তৃপ্তির হাসি। অবশেষে তার ভালোবাসার মানুষটা তার হবে। নন্দিতা কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে বলল

” আমার ব্যাপারে কী ভাবলে মামা।”

” তোর ব্যাপারে আবার কী ভাববে।”

নন্দিতার মায়ের কথা কেড়ে নিয়ে মিসেস রহমান বললেন

” মেয়ে দেখি বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে।আর তর সইছে না বুঝি মা।আমাদের বাড়ি আর ভালো লাগছেনা বুঝি।তোমাকে এত সহজে ছাড়ি কেমনে। এত লক্ষী একটা মেয়ে হাতছাড়া করলে তো আমাদেরই লস।”তিনি পুনরায় নন্দিতার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো

” আপা, আমি আর আপনার ভাই ঠিক করেছি আমার ভাইয়ের ছেলে রাসেলের সাথে বিয়ে দিবো নন্দিতার।ছেলেটা তো মন্দ না।আপনি দেখেছেন।বাবার ব্যবসায় বেশ নাম করেছে।বাড়ির মেয়ে বাড়িতে থাকলে মন্দ হয়না।”

” তোমরা যা বোঝো কর।তোমরা তো আর আমার মেয়ের খারাপ চাইবে না।”

মুচকি হেসে সবাই খাওয়ায় মন দিলো।তবে নন্দিতার গলা দিয়ে খাবার নামলোনা।সে তো চেয়েছিল বিয়ে করে রায়াজের থেকে অনেক দূরে চলে যাবে। রাসেল মন্দ নয় তবে তাকে নন্দিতার ভালো ও লাগেনা।
প্রস্তাবটা রায়াজের ও মন মতো হলো না।রাসেল কেমন ছেলে সে জানে।নন্দিতাকে তো জেনেশুনে একটা সাইকোর হাতে তুলে দিবেনা।
গম্ভীর গলায় মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো

” ওর সাথে সাথে কী তোমরাও পাগল হচ্ছো।বয়স কতো ওর।মাত্র ষোলো এখনই কিসের বিয়ে।আর ফুফু তুমিও, তোমার মেয়ে কী এতই বোঝা হয়ে গেছে যে এত কম বয়সেই বিয়ে দিয়ে তাড়াতে চাইছো।
আর নন্দিতা তুই।মাথা থেকে এসব বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মন দে।”

নন্দিতা কিছু বলতে নিয়েও আর বলেনা।ঠিকই তো বলেছে রায়াজ।নাহ,আর পাগলামী না।অনেক হয়েছে নিজের আত্মসম্মানের বিসর্জন। এবার থেকে আর নিজেকে ছোট করলে চলবেনা।

চলবে

#নন্দিতা
পর্ব-০৩
#kheya

আজ বরিবার।

রিয়ার বাবা মা এসে রায়াজ আর রিয়াী বিয়ের দিনটা ঠিক করে গেছে।মনটা আজ বড্ড বেশী খারাপ নন্দিতার।
রিয়া মেয়েটা খারাপ না।বড় বোনের মতোই লাগে তার রিয়াকে।রিয়াও তাকে ভীষন স্নেহ করে।তবে রায়াজের সাথে রিয়ার বিয়েটা কিছুতেই মানতে পারছেনা সে।নিজের ভালোবাসার মানুষটার সাথে কাউকে সহ্য করা কী এতই সহজ!

নিজের রুমে এসে চুপচাপ শুয়ে ছিলো নন্দিতা। অসময়ে মেয়েকে শুয়ে থাকতে দেখে নন্দিতার মা নন্দিতার রুমে আসে। মেয়ের মন খারাপের কারণ তার অজানা নয়।শত হলেও সে মা।

মেয়ের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে

” মন খারাপ করিস না মা।মানুষ সবসময় যা চাই তা সে পায়না।আর ভালোবাসা মানেই যে মানুষটাকে পেতে হবে এমন নয়।ভালোবাসার মানুষকে ভালো থাকতে দিয়ে, দূর থেকে তার ভালোথাকা দেখাটাও এক প্রকার ভালোবাসা। জোর করে কাউকে নিজের করলেই ভালোবাসা হয়না বুঝলি পাগলী। ভালোবাসতে জানলে তাকে দূর থেকেও ভালোবাসা যায়।”

” আচ্ছা মা, আমরা সবসময় ভুল মানুষকে ভালোবাসি তাইনা! ”

মেয়ের প্রশ্নের উত্তরটা ঠিক জানা নেই তার।তাই চুপ রইলেন।পুনরায় মেয়ের মাথায় বিলি কাটতে কাটতে বললেন

” আমিও তোর বাবাকে ভালোবেসেই বিয়ে করে ছিলাম জানিস।মাত্র সাতটা বছর একসাথে থাকার সুযোগ হলো।তোর বাবা যাওয়ার পর কত লোকে কত কথা শুনিয়েছে।আজ মানুষটা নেই। তাই বলে কী তাকে ভালোবাসা বাদ দিয়ে দিয়েছি নাকি।”

একটু ভাবে নন্দিতা।বাবার চেহারাটা ঠিক তার মনে নেই।ছবিতে দেখেছে।তবে বাবার সাথে কাটানো কোনো মুহুর্ত তার স্মৃতির কোটরে নেই।থাকলেও হয়ত মনে পড়বেনা।তার তখন মাত্র দেড় বছর যখন বাবা মারা যায়।
মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে

” রায়াজ ভাই তো আমার হবেনা।তাই বলে কী তাকে ভালোবাসা ছেড়ে দিবো নাকি আমি।”

__________

টিভির সামনে বসে কাঁদছে নন্দিতা। অফিস থেকে ফিরেই এমন দৃশ্য দেখে হকচকিয়ে যায় রায়াজ ও তার বাবা।মিস্টার রহমান নন্দিতার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করে
” কী হয়েছে মা”

আচমকা কারো স্পষ্ট পাওয়ায় চমকে উঠে নন্দিতা।তিন কুল পড়ে বুকে ফু দিয়ে বলে

” আসলে মামা আমি সিনেমা দেখছিলাম।ওখানে স্যাড সিন দেখে আমিও কেঁদে দিয়েছি।”

হেসে উঠে রহমান সাহেব।এই মেয়েটা এখনো বাচ্চায় রয়ে গেলো বড় আর হলোনা।

” সবকিছুতে এত কান্নাকাটির কী আছে।এত আবেগ দিয়ে যে জীবন চলেনা এটা সবার বুঝতে হবে।”

রায়াজের কড়াগলায় বলা কথাগুলো চুপচাপ হজম করে নন্দিতা। তর্কে জড়ানোর দরকার মনে পড়েনা।কারণ সে জানে আপাতত এই লোকটার দিকে তাকালেই তার কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম আর অতলস্পর্শ গভীর নিষ্পাপ চাহনিতে আরও একবার বিলীন হয়ে যাবে সে।

———

ছাঁদে চুপচাপ বসে সাথে নন্দিতা। তার বেশির ভাগ সময় এখানেই কাটে।বিকেলের সময়টা রায়াজও ছাঁদে কাটায়।নিজের বাবার ব্যবসা হওয়ার রোজ তার ধরাবাধা কাজের রুটিন থাকেনা।

কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনে খোলা আকাশের নিচে মৃদু মন্দ বাতাস উপভোগ করাটা রায়াজের ভীষণ প্রিয় একটা শখ।তবে ছাঁদে থাকা কালীন রায়াজকে মোটেও বিরক্ত করেনা নন্দিতা।তবে আজ টার খানিকটা ব্যতিক্রম হলো। ছাঁদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন নন্দিতা।
রায়াজের অগোচোর হলোনা ব্যাপারটা।আজ তার মনটা ভীষণ ফুরফুরে।আজ নন্দিতার সাথে কঠোর হতে ইচ্ছে হচ্ছেনা তার।মেয়েটা যেমন তেমনই কোমল পদ্মের ন্যায় দুটো মিষ্টি কথা বলায় ক্ষতি কী।

” এই যে চিন্তামণি।সারাদিন এত কী ভাবেন!”

রায়াজের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে নন্দিতা বলে

” জানেন রায়াজ ভাই, আমার সকল অসংলগ্ন চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রবিন্দুর বৃত্ত জুড়ে বয়ে চলেছে আপনার দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে দেওয়া বিধস্থ ভালবাসার গভীর ক্ষত আর অবিরাম ধারায় বয়ে চলা রক্তাক্ত বিষের স্রোত।”

সবকিছুই মাথার ওপর দিয়ে যায় রায়াজের।বাচ্চা মেয়েটা এত কঠিন কঠিন কথা কোথায় পায় কে জানে।ভালোবাসার মানুষকে না পেলে বুঝি এমনই কঠোর আর সুদৃঢ় চিন্তার অধিকারী হওয়া লাগে।
_____

শীতের শেষ প্রায়।বসন্তের শুরু।নির্জন নিরালয়ে ফাকা রাস্তায় রিয়ার হাত ধরে হাটছে রায়াজ।বাইরে যতটাই কঠিন। প্রেয়সীর কাছে ততটাই কোমল সে।

” নন্দিতা তোমাকে ভালোবাসে তাইনা, রায়াজ।”

রিয়া বরাবরই ভীষণ শান্ত মেয়ে।তবে আজকে তার কন্ঠটা আরও শীতল শান্ত মোহনীয় লাগলো রায়াজের।প্রেয়সীর বুকের চিনচিনে ব্যাথ্যা অনুভবে তার ওষ্ঠ্য কেঁপে উঠলো।

” তোমাকে এসব কে বলেছে? ”

” আমি কী তোমাকে হারিয়ে ফেলবো। ”

” পাগল হয়েছো রিয়া।কী সব বলছো।নন্দিতা ছোট।আবেগে ভাসছে এখন।একটু বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

” ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা তো আমার চেয়ে বেশি তুমি জানোনা তাইনা।
তোমাকে পাওয়ার এক আকাশ সমান অনিশ্চয়তা, বিচ্ছেদের সুর জেনেও কী ভীষণ রকমের ভালোবাসে মেয়েটা তোমায়।”

চুপচাপ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রায়াজ।কেন জানি নন্দিতা মেয়েটাকে একটুও ভালোবাসতে ইচ্ছা হয়না তার।

,,,,,

নন্দিতা দিনদিন কেমন জানি নির্জীব হয়ে যাচ্ছে।কারো সাথে কথা বলতেও আর ভালোলাগেনা তার।চুপচাপ একা থাকলে যেন সে আরও একটু সময় পেয়ে যায় রায়াজকে ভালোবাসার।
তবে এখন আর ভালোবাসতেও ইচ্ছে হয়না।আর কত ভালোবাসবে।একটা মানুষের পক্ষে অন্য একটা মানুষকে ঠিক যতটা ভালবাসা সম্ভব।তার চেয়েও অনেক বেশি ভালো সে রায়াজকে বেসে ফেলেছে।
কদিন পরেই রেজাল্ট। একটু ভয় থাকলেও এ নিয়ে ভাবার সময় পায়না নন্দিতা।
গুটি গুটি পায়ে মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে যায়।
মা ঘুমোচ্ছে দেখে রান্নাঘরে গিয়ে নিজের জন্য একটা চা বানিয়ে নেয়।নাহ! এখন আর ছাদে যেতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। রুমেই বসলো। টেবিলে কাপটা রেখে একটা ডাইরি খুললো।
মনে সবগুলো কথাই সে এখানে লিখে রাখে।

রায়াজকে কীভাবে ভালোবেসেছে জানা নেই তার।কীভাবে তার ওপর এত দুর্বল হয়ে গেলো সে সেটাও তার বোধগম্য হয়নি। এতদিনেও।

অবলীলয় ডাইরের একটা পেজ ছিড়ে ফেললো সে।
এটাতেই ছিল রায়াজকে নিয়ে তার প্রথম লেখা।

” আপনাকে আমার ভাল্লাগে জানেন রায়াজ ভাই।আপনি গম্ভীর।তবে আপনার চোখগুলো শান্ত স্বচ্ছ গভীর জলরাশির অবচেতন ঢেউয়ের মতোই উত্তল অস্থির চঞ্চল। আমার চোখের ঘন কালো গভীরতার মায়ায় আমি বারবার নিজেকে হারাতে চাই..”

এতটুকুই পরেই চুপ হলো নন্দিতা।আরও কটা লাইন ছিল।তবে পড়তে ইচ্ছে হলোনা।
নিমিষেই টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেললো কাগজটা।

নতুন একটা পাতায় বড় করে লিখলো
” আপনাকে আমি ভীষণ ঘৃণা করি রায়াজ ভাই।”

একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো নন্দিতার বুক চিরে।আর কতকাল রায়াজকে এভাবে ভালেবাসতে পারবে সে জানা নেই।হয়ত বা কোনো ঘৃণার সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে সব,,,,নয়ত বা,,আবার অতীতের পিছুটানে ফিরতে হবে তাকে।

“”””””‘

বদ্ধরুমে অন্ধকারে মাঝে সিগারেট হাতে বসে আছে রাসেল।চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো জিনিস পত্র।ভাঙা ভাঙা কাচের টুকরোয় পুরো ঘর ভরে আছে। দুর হতে চাঁদের আলোয় আবছা অবয়বের ন্যায় পরিস্ফুট হয়ে আছে রাসেল।

নিজেকে তার বদ্ধ উন্মাদ মনে হচ্ছে।দুহাতে সজোরে মাথার চুলগুলো টেনে ধরলো। রায়াজ কীভাবে পারলো তার সাথে এটা করতে।

—–

রায়াজ রিয়ার বিয়ের কথা হওয়ার পর থেকেই রায়াজকে প্রায় সময়ই বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখে নন্দিতা।ব্যাপারটা তার ভালোলাগে। ভালোবাসার মানুষকে ভালো থাকতে দেখার মাঝেও আনন্দ।

রায়াজ তখন ড্রয়িংরুমে বসে টকটাক কাজ করছিল। রায়াজের দিকে তাকিয়ে বিনা সংকোচে নন্দিতা বলে উঠে

” টিভির রিমোর্টটা দেন তো রায়াজ ভাই।”

ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই রিমোর্টটা নন্দিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো

” তুই আবার টিভি দেখিস কবে থেকে।কী দেখবি।”

” ডোরেমন দেখবো ”

” তুই আবার কার্টুুন দেখিস।অবশ্য এটা তোর কার্টুন দেখারই বয়স।অথচ তুই এসব না করে ভালোবাসি বাসি বলে ছুটে বেড়াস,,”

রায়াজের কথায় নিমিষেই ঘন কালো আধারে ঢেকে গেলো নন্দিতার মুখটা।সে তে আর এসব মনে আনতে চাইনা।তাই বলেই তো এসব করছে সে।তবে রায়াজ কেন তাকে আবার মনে করিয়ে দিলো।পুনরায় লালাভ ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি টেনে বলল

” আমাকে একটা আইসক্রিম কিনে দিবেন রায়াজ ভাই। মা থেকে দেয়না।আপনি আশা করি ছোট বোনের এই আবদার টা ফেলবেন না।”

বিষম খায় রায়াজ।সে কী ঠিক শুনলো।ছোট বোন মানে! নন্দিতা বলল এ কথা।ওর কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি।আশ্চর্য ।

চলবে…?