নিয়তি পর্ব-০১

0
630

-‘নিয়তি’
লেখনীতে -বর্ষা ইসলাম

।১।

-ভোরের সূর্য্য ডুবে গেলো। সন্ধ্যা নামলো। দিনের সোনালী সূর্যের বিদায় সম্ভাষনে জায়গা করে নিলো রাতের আবছা অন্ধকার। চারদিকে পিন পতন নীরবতা। বিশাল বড় দু তলার বাড়িটির ঝকমকে আলো আস্তে আস্তে নিভে গেলো। সারা দিনের সকল ক্লান্তির ভার বিছানায় ঢেলে দিয়ে ঘুমের রাজ্যে ডুব দিলো পৃথিবী।

-বারান্দায় কমলা রঙা ডিম লাইটের আলো। দুতলার পশ্চিম পাশের রুমটিতে নিভু নিভু আলো চোখে পড়ছে। শরীর ভর্তি গহনা আর শাড়ির ভারে হিমশিম খাচ্ছে সদ্য পরিনয়ী শেহরীন।রুমে এসি থাকা স্বত্বেও অনবরত ঘামছে সে। ঘর ভর্তি বেলী ফুলের তাজা সুভাষেও তার মন বিষিয়ে উঠছে। অসহ্য লাগছে।।

এভাবে আর কত ক্ষন বসে থাকা যায়? ঘড়িতে দেড়টার কাটা ছুঁই ছুঁই। এখনো তার আসার নাম গন্ধ নেই। বিরক্তি নিয়ে কি যেনো ভেবে বিছানা থেকে নেমে আসে শেহরীন।

-কয়েক কদম এগুতেই রুমে ঢোকে আবেশ। চোখে মুখে নিদারুন ক্লান্তির ছাপ। গতর গা ঘামে চুপচুপ। দরজাটা আটকে গা থেকে সেরোয়ানি খুলতেই চোখ পড়ে শেহরীনের দিকে।সেই চেনা মায়াবী মুখ। জানালার সামনে দাড়িয়ে পরনের এলোমেলো শাড়ি নিয়ে আনমনে বাইরে তাকিয়ে আছে। ঘর ভর্তি মোমের আলোর ছটায় ঝিলিক দিয়ে উঠছে তার ফর্সা নাকে জায়গা করে নেওয়া ছোট্ট নাক ফুল। আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে নির্লিপ্ত গলায় বলে,

-শাড়িটা চেঞ্জ করে নাও শেহের।

আবেশের কথায় ঘাড় ঘুড়িয়ে পিছু ফিরে শেহরীন। আবেশের এমন অবস্থা দেখে তাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো,ঘরে নতুন বউ রেখে কোথায় ছিলে এতোক্ষণ? কিন্তুু অভিমানি মন সায় দিলো না। কোনো কথা না বলে ঝট করে আবেশের হাত থেকে শাড়ি টা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। আবেশ আহত চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।

-‘শেহরীন যে রেগে আছে তা বুঝতে বাকী রইলো না তার। প্রথম আলাপে শেহরীন কে সে কথা দিয়েছিলো কখনও তাকে কষ্ট দিবে না। অথচ প্রথম রাতটাতেই সে কিছু দিতে পারলোনা শেহরীন কে। নিয়তি বোধহয় একেই বলে। কথাটা ভেবেই বুক চিঁড়া একটা দীর্ঘশ্বাস আছড়ে পরে আবেশের বুকে।

আবেশের ভাবনার মাঝেই ওয়াশরুম ছেড়ে রুমে আসে শেহরীন। একহাত মাথার নিচে দিয়ে অন্যহাত কপালের উপর আড়াআড়ি ভাবে ফেলে টান টান হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে আবেশ। খালি গায়ে চওড়া রোমশ বুকটা খুব সহজেই ধরা দিলে সেহরীনের চোখে। এতেক্ষনের জমানো রাগ টা এবার বরফের মতো গলে গলো। ধীর পায়ে এগিয়ে আবেশের মাথার কাছে বসে চুলে বিলি কেটে সন্তর্পণে শুধালো,

‘শরীর খারাপ তোমার? এমন মন মরা হয়ে আছো যে?

শেহরীনের হাতের ছোঁয়া পেয়ে এক লাফে বিছানা থেকে উঠে বসে আবেশ। আবেশের রিয়েকশন এ মনে হলো শেহরীন এক অযাচিত কাজ করে ফেলেছে। আবেশ কে ছোঁয়া তার জন্য নিষেধ। তাকে এটা মানায় না।

শেহরীন হতবাক হয়। অবাক হয়। আবেশের এমন আচরণ শেহরীনের বুক কাপিয়ে তুলে। দ্বিতীয় বারের মতো আরো একবার অবাক করে দিয়ে আবেশ বলে উঠে,

-‘অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড় শেহের। আমি আলো গুলো নিভিয়ে দিচ্ছি।

আবেশ আলো নিভাতে ব্যস্ত হয়ে পরে।শেহরীন এতোক্ষণে খেয়াল করলো পুরো রুমটা মোমের আলোয় আলোয় জ্বলজ্বল করছে। কি অসম্ভব সৌন্দর্যের অগ্নীকুন্ডলি। হলদে আলোয় আলোয় রুম টা যেনো স্বর্গীয় রুপ ধারন করেছে। শেহরীনের চোখ জুড়িয়ে গেলো। কিন্তু পরক্ষণেই মোমের শিখার মতো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে তার মন। মোমের আলোয় সে আহত চোখে দেখছে,তার এতোদিনে লালিত সপ্ন কি নিদারুন ভাবে আবেশ অন্ধকারে মিশিয়ে দিচ্ছে। মোমের মতো তার ভেতরটা ও জ্বলে যাচ্ছে,ব্যথায় গলে যাচ্ছে। কিন্তু আবেশ থামছে না।শেষ মোম টা নিভিয়ে দিয়ে চিরদিনের মতো অন্ধকারে ভরিয়ে দিলো ভালোবাসার সেই কাঙ্খিত, কামনার রাত টি।

-সকাল ৯ টা

জানালার কাচ ভেদ করে রুমে ঢুকেছে সুর্যের উপচে পড়া আলো। সেই আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শেহরীনের লতানো দেহে। কোমড় থেকে শাড়ি টা সরে গিয়ে ফুটে উঠেছে ফর্সা মেদহীন নারীসুলভ বাক। এমন অবস্থায় শরীরের কার্ভের ভাজে ডুবে যেতে যে কেউ দু বার ভাববেনা।

-‘আবেশ,এই আবেশ। ঘুম ভাঙলো? নাকি বউ কে সোহাগ করা হয়নি এখনো?

কর্কশ কারো কন্ঠস্বরের চিৎকারে ধরফরিয়ে বিছানায় উঠে বসে শেহরীন। রাতের অন্ধকারে রুমটা ভালো করে দেখা হয়নি। সকালের ঘুমন্ত অবচেতন মস্তিষ্কে ধরা দিতে সময় লাগলো কোথায় আছে সে? নিজের বেডরুম নাকি অন্যকোথাও? কয়েক সেকেন্ড পর সে রিয়ালাইজ করে এটা তো তার প্রিয় মানুষটির ঘর। কয়েক দিনের পরিচয় হলেও ভিডিও কলে বেশ কয়েককবার রুমটি দেখেছিলো সে। কিন্তুু আবেশ কোথায়? তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মুহুর্তে ই রাতের কথা মনে পরতেই আরো একবার মন খারাপ হয়ে গেলো শেহরীনের।

-আবেশ এতো সকালে কোথায় গেলো? আবার বাইরে থেকেও কেউ একজন আবেশ আবেশ বলে চিৎকার করছে। কি হচ্ছে এসব?

সকাল সকল মেজাজ টা বিগড়ে গেলো শেহরীনের। সাওয়ার নেওয়া প্রয়োজন। শাড়ি আর টাওয়াল টা নিয়ে এগিয়ে যায় ওয়াশরুমের দিকে।

-আপনাকে অনেক বার বলেছিলাম ভাবী, এসব ঝামেলা না মিটিয়ে ছেলেকে বিয়ে দিয়েন না। শুনলেন না। এখন কি কেলেংকারীটাই না সৃষ্টি হয় আল্লাহ মালুম।

-আহ চুপ করো তো সাফিনা। নতুন বউ বাড়িতে। গলা চেচিয়ে চিৎকার করে কথা বলছো। মেয়েটা শুনলে কি না কি ভাব্বে!কষ্ট পাবেনা? মুখটা কি টা কি একটু সংযত করা যায় না?

শ্বাশুড়ি আয়না বেগম আর ফুপু শ্বাশুড়ি সাফিনার কথার মাঝেই সিড়ি বেয়ে ড্রয়িংরুমে আসে শেহরীন। এসেই ড্রয়িংরুমটা ভালো ভাবে এক নজরে দেখে নেয়। পুরো ড্রয়িংরুমের কোথাও আবেশ নেই। কলুষিত হৃদয়ে মনের এক পাশ হন্যে হয়ে আবেশ আবেশ বলেই হাতরাতে থাকে।

-আবেশ এলো না শেহরীন?

শ্বাশুড়ি আয়না বেগমের কথায় স্থির হয় শেহরীন। ছোট্ট করে নির্লিপ্ত গলায় বলে,

-সে তো ঘরে নেই মা।
-এতো সকাল সকাল কোথায় গেছে?
-জানিনা মা।
-তোমাকে বলে যায় নি?

শেহরীন মাথা নিচু করে থাকে। মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই সাফিনা ফুপু বলে উঠেন,

-ভাবী বুঝতে পারছে না আবেশ কো,,,,,,

‘-আহ! সাফিনা আবারো?

সাফিনা ফুপু কথা শেষ করার আগেই ধমকে উঠেন শ্বাশুড়ি আয়না বেগম। শেহরীনের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,

-তুমি খেতে বসো। আমি খাবার দিচ্ছি।

শ্বাশুড়ির কথায় মাথা নাড়িয়ে টেবিলে বসে পড়ে শেহরীন। বাম পাশে সাফিনা ফুপু, ডান পাশের চেয়ার টা খালি। হয়তো আবেশ বসে এই চেয়ার টাতে।তার পাশের চেয়ার দুটোতে আয়ুশ ও আইরিন। সবার সামনে আবেশের বাবা ইসহাক সাহেব। আয়না বেগম সবাই কে খাবার সার্ভ করে যাচ্ছেন।

-দুই লোকমা খাবার মুখে দিয়েই টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ে শেহরীন।মাথা টা ঝিম ঝিম করছে তার। গা গুলাচ্ছে। এক হাতে কপাল চেপে ধরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে।আয়না বেগম বুঝতে পেরে ডালের বাটিটা ফেলে এসে দৌড়ে এসে জাপটে ধরে শেহরীন কে। শেহরীন ততক্ষণে পুরো শরীরের ভার টুকু ছেড়ে দিয়েছে শ্বাশুড়ির উপর। টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে বসে পরেন আয়না বেগম।শেহরীনে তার কোলে লুটিয়ে পরে। হাতের আঙ্গুল দ্বারা মুখ নাড়াতেই গড়গড় করে চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ে সাদা রঙের ফেনাযুক্ত তরল পদার্থ।

-মাথায় কারো স্পর্শ পরতেই পিটপিট করে চোখ তুলে তাকায় শেহরীন। ঝাপসা চোখে আবেশকেই সামনে দেখতে পায়। পাঁচ আঙুল চুলে গুজে দিয়ে বিলি কেটে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,

-ঠিক আছো এখন?

শেহরীন মাথা নেড়ে জবাব দেয়। যার অর্থ হ্যা।

-‘কি নিয়ে এতো টেনশন করছো বলো তো শেহের? এমনিতেই বিয়ের কত শত ধকল গেছে তার মাঝে না খেয়ে খেয়ে শরীরের এই হাল করেছো। ডাইনিং এ আম্মা না থাকলে কি হতো ভেবেছো? মাথায় আঘাত পেলে কি হতো?

-আবেশের এতোসব কথা শেহরীনের উপর তেমন প্রভাব ফেললো না। দু হাত ভর করে আধ শোয়া হয়ে পিঠের নিচে বালিশ চাপা দিয়ে বসে শেহরীন। ক্লান্ত শরীরে আধো আধো বুলিতে জিজ্ঞেস করে,

-কোথায় ছিলে আবেশ?

শেহরীনের কথায় আবেশ নড়েচাড়ে উঠে। শেহরীনের চুল থেকে হাত টা সরিয়ে নেয়। কিন্তুু কোনো উত্তর দেয়না। শ্যামবর্ণ সুক্ষ চামড়ার ভাজে দুশ্চিন্তার রেখা স্পষ্ট হয়। দু-হাত মুঠো করে কপালে ঠেকিয়ে নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে নির্লিপ্ত ভাবে বসে থাকে।

শেহরীন আহত গলায় আবারো জিজ্ঞেস করে,

-তুমি কি আমাকে ইগনোর করছো?

আবেশ হতবাক হয়। ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায় শেহরীনের দিকে।বিরস মুখে বলে,

-শেহের তোমার শরীরের কন্ডিশন একদমই ভালো নেই। বিশ্রাম প্রয়োজন তোমার। তুমি ঘুমাতে চেষ্টা করো। আমি আসছি।

কথা গুলো বলতে দেরি কিন্তুু আবেশ প্রস্থান করতে দেরি করলো না। হনহন করে লম্বা লম্বা পা ফেলে চোখের পলকেই মিলিয়ে গেলো শেহরীনের দৃষ্টি থেকে।

-শেহরীনের আহত হয়। বুক ভেঙে কান্না আসে। আবেশের এমন আচরনের কারন সে ধরতে পারেনা। গতকাল ই তাদের বিয়ে হয়েছে। সপ্তাহ দুয়েক আগে ঘরোয়া ভাবে রেজিষ্ট্রি হয় আবেশের সাথে। বিয়ের আগের দিনও আবেশের সাথে তার ভালোই কথা হয়েছে। কিন্তুু বিয়ের দিন কি এমন হলো যে আবেশ তাকে এড়িয়ে চলছে? তবে আবেশের মনে অন্য কেউ আছে? সে কি বিয়েটা করতে চায়নি?

-‘নাহ এমনটা হতে পারেনা। এমন কিছু হলে আবেশ তাকে জানাতো। বিয়ের আগে কানাঘোষায় জানা গেছে এ বিয়েতে আবেশের মত ছিলো না। কিন্তুু বিয়ের আগে বেশ কয়েক বার আবেশের সাথে কথা হয়েছে, দেখা হয়েছে শেহরীনের। কই এমন কিছু তো মনে হয়নি। বরং আবেশ সব কিছুতেই নরমাল ছিলো। তবে হঠাৎ কি এমন হলো যে আবেশ তাকে ইগনোর করা শুরু করে দিলো?

নাহ! আর কিছু ভাবতে পারে না শেহরীন। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। প্রেশার বেড়ে ঘাড়ের রগে রগে লাগাতার টান পরছে।ডান হাতে ঘাড় চেপে ধরে অসহায় মুখে নিরলসভাবে বসে থাকে কিছুক্ষণ।

-এই ভর দুপুরে কোথায় যাচ্ছিস?

ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই মায়ের প্রশ্নের মুখোমুখি হয় আবেশ।কিছু বলার আগেই মা আয়না বেগম আবারো বলে উঠেন,

-শেহরীন কেমন আছে এখন।

-হু ভালো।

-‘এই অসুস্থ মেয়েটাকে ঘরে রেখে টই টই করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস? বাপ মা মরা মেয়েটাকে আর কত কষ্ট দিবি আবেশ? তোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তো বিয়েটা হয় নি। এবার সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে,,,,,,,

-‘থাক না আম্মা!!

মায়ের কথা পুরোটা না শেষ করতেই মাঝপথে থামিয়ে দেয় আবেশ। মুহুর্তেই রাগী গলায় বলে উঠে,

ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেমন হয়নি, তেমনি নিজ মতেও বিয়েটা হয়নি আম্মা। আর কষ্টের কথা বলছো? কষ্ট কি আমাকেও তোমরা কম দিচ্ছ আম্মা? প্রতিটা মুহূর্তে পুড়ে খাক করে দিচ্ছো। আর কি চাই তোমাদের? এবার না হয় আমাকে আমার উপরেই ছেড়ে দাও। নিজের ভালো টা আমাকেই বুঝতে দাও।

কথা গুলো শেষ করে হনহন করে বাইরে চলে যায় আবেশ।আয়না বেগমের মুখটা নিমিষেই অন্ধকারে ছাপিয়ে উঠে। বুক চিড়া একটা দীর্ঘ শ্বাস জলপ্রপাতের মতো বুকে আছড়ে পরে।যার লুকায়িত অর্থ দ্বাড় করায়,,,

-ভালো করতে গিয়ে নিজ হাতে মেয়েটার জীবন নষ্ট করে ফেললাম না তো!

-ছোট্ট একটি প্রান। কত ছোট্ট একটা হৃদপিণ্ড। ছোট্ট শরীরটি কত সুন্দর ভাবে নীলাভ পালকে আবৃত। চোখা ঠোঁট দুটোয় লাল টকটকে আবির মাখা। খাঁচার ভেতর এ পাশ থেকে অপাশ মনের সুখে নাচানাচি করছে। নাম তার ডাকপাখি।

-‘আচ্ছা পাখিরা তো মুক্ত থাকতে ভালোবাস। তারা আজন্ম ছুটে বেড়ায়। কিন্তুু ডাকপাখি তোর কষ্ট হচ্ছে না এভাবে খাঁচায় বন্দী থাকতে?

-মেহরুবার কথায় কোনো হেলদোল করলো না ডাকপাখি। সে তখনও খাঁচার ভেতরেই ছোটাছুটি করতে ব্যস্ত। মেহরুবা আর বিরক্ত করলো না ডাকপাখি কে। কোল থেকে খাঁচা টা নামিয়ে মেঝেতে রাখলো। যে ভাবে থাকতে চায় তাকে সেভাবেই ছেড়ে দেওয়া উচিত। হউক সেটা ক্ষনস্থায়ী কিংবা চিরস্থায়ী।

-‘মনের ছটফটানি আর শরীরের যন্ত্রণায় উঠে দাড়ায় মেহরুবা।নয় মাসের ভরা পেট নিয়ে রাত দিন তার ছটফটিয়েই কাটে।ছোট্র একটি প্রান তার ভেতরেও একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে। তাকে নিয়ে মেহরুবার রাজ্যের চিন্তা। টলটলে ফিগার টা মুটিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালির আস্তর পড়েছে। তলপেটে মেদ জমেছে। তবুও তার আক্ষেপ নেই,হা হুতাশ নেই।নিজের সবটুকু দিয়ে চাইছে তার ভালোবাসার অংশবিশেষ, তার অনাগত সন্তান ভালো থাকুক। সুস্থ্য ভাবে পৃথিবীর আলো দেখুক। মায়েরা তো এমনি হয়। তার উপর প্রথম মা হওয়ার মতো অনুভুতিময় সুখ পৃথিবীতে আর দুটো হয় আছে বুঝি?

ফাকা একটা বাড়িতে খুব একা লাগে মেহরুবার। এই তো মাস নয়েক আগে জানালায় দাড়িয়ে আকাশ দেখছিলো মেহরুবা।বাইরে প্রচন্ড বাতাস। ঝড় বইছে। মনে তার অজানা সুখ। সেদিন ই সে জানতে পারে পৃথিবীর মহামূল্যবান একটি শব্দ’সে মা হবে’। ব্যস তার খুশী আর কে দেখে! ঝড়ের সাথে দমকা হাওয়ায় জানালা দিয়ে ছিটকে পড়ে এই ময়না পাখি টি। সেদিন থেকেই একাকিত্বের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে এই কথা কলি ময়না কে। নাম দিয়েছে ডাক পাখি।

-‘ময়না বুঝতে পারে কিনা জানে না,তবুও মেহরুবা একা একাই সব কথা বলে তার ডাকপাখিকে। ইদানীং খুব ভয় ঢুকেছে মনের মধ্যে। থেকে থেকে বুকটা ধরফর করে উঠে। হাতে পায়ে বেসামাল পানি নিয়ে ফোলা ফোলা হাতে পায়ে চলা ফেরা করা টা খুবই মুশকিল,বিপদজনক। এতো বড় একটা ফ্ল্যাটে একা থাকতে কতক্ষণ আর ভালো লাগে!!

-‘দু হাত কোমড়ে ভর করে থমথমে পায়ে স্লো মোশনে পায়চারি করতে থাকে মেহরুবা। ব্যকুল মন আচমকাই ভাবতে থাকে, -‘তার সেই মানুষটাকে এখন খুব দরকার। তার হাতে ভর করে পথ চলা ভীষন জরুরি। তার কাধে মাথা রেখে ঘুমের দেশে তলিয়ে যাওয়াটাও এখন খুব বেশী জরুরী।

-‘একটু স্থির হয়ে চেয়ারে বসে মেহরুবা। দু হাতের আদলে তলপেট চেপে ধরে আদুরে গলায় বলতে থাকে,

-‘বাবাই কখন আসবে বলতো সোনা? তোর একা লাগছে না খুব? বাবাই এলে আজ খুব করে বকে দিবি। বলবি মাম্মাম কে ছেড়ে যেনো আর কোথাও না যাওয়া হয়। হুম!

-‘আদুরে অনুভুতির সুতোয় টান লাগলো। কলিং বেজ বাজলো।মেহরুবা চেয়ার থেকে উঠে দাড়ায়। মেঝেতে পরে থাকা খাঁচায় বন্দী ডাকপাখির দিকে চেয়ে মুচকি হাসি দিতেই ডাক পাখি সুমিষ্ট সুরে ডেকে উঠলো,

-‘আবেশ! আবেশ!

চলবে,,,,