নিয়তি পর্ব-০২

0
358

#নিয়তি’
লেখনীতে -বর্ষা ইসলাম

২.

উত্তপ্ত দুপুর। সূর্য্যের বেপোরোয়া তাপে তেঁতে উঠেছে রাস্তাঘাট। গায়ের পলো টি শার্ট ঘামে ভিজে জুবুথুবু। ঘর্মাক্ত শরীরে রুমে ঢুকে আবেশ। নিজের শরীরের ভারটুকু ছেড়ে ধপ করে বসে পরে সোফায়।

-সবেমাত্রই সাওয়ার নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়েছে শেহরীন। পরনে হালকা গোলাপী রংয়ের সুতি শাড়ি। কোমড় ছড়ানো চুলের টপটপ পানিতে ভিজে উঠেছে শাড়ির অর্ধেক অংশ। পিঠময় আধভেজা এলোমেলো চুল গুলো সামনে একপাশে টেনে টাওয়াল দিয়ে পেচিয়ে নিতেই আবেশের চোখে পড়ে শেহরীনের ফর্সা পিঠের অস্বাভাবিক লালচে দাগে।অনেকটা জায়গা জুরেই দাগটা দৃশ্যমান।

-‘আবেশ নড়েচড়ে বসে। দাগ টা ভালো করে দেখার জন্য দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ করে। কপাল থেকে হাত টা নামিয়ে উৎসুক চোখে তাকায় শেহরীনের দিকে। খুব রয়ে সয়ে প্রশ্ন করে,

-পিঠে এমন কিসের দাগ শেহের?

শেহরীন কোনো হেলদোল করলোনা। সে একহাতে আনমনে চুলের পানি মুছতে ব্যস্ত। আবেশের দিকে একবার তাকালো না পর্যন্ত।আবেশ বুঝতে পারে। কিছু একটা আন্দাজ করে আবারো শান্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ে দেয় শেহরীনের দিকে,

-তোমার শরীর কি এখনো খারাপ লাগছে শেহের?কথা কেনো বলছো না?পড়ে টড়ে গেছিলা কোথাও? এমন ক্ষত হলো কি করে?

একসাথে এতো গুলা প্রশ্ন শুনে শেহরীন এবার স্থির হয়। ভেজা টাওয়াল টা বারান্দায় মেলে দিয়ে তটস্থ হয়ে বসে আবেশের পাশে।বিরস গলায় বলতে থাকে,

-‘বিয়ের দিন বাড়ি ভর্তি মেহমান ছিলো। ভোরে উঠে সমস্ত কাজ শেষ করে শরীর টা খুবই ক্লান্ত লাগছিলো। তবুও আস্তে আস্তে ৯ টার দিকে রান্না ঘরে যায়।গিয়ে দেখি মামি চুলায় রান্না বসিয়ে দিয়েছে।আমাকে দেখা মাত্রই মামি বলে উঠে,থালাবাসন গুলা ধুয়ে আনতেই যদি দিন শেষ কইরা ফেলেন বাকি কাজ গুলা কখন শেষ করবেন মহারানী। দুপুরের পরেই বরযাত্রী চইলা আইবো তখন তো ধেই ধেই করে বরের সাথে চইলা যাবি।এদিকে বাড়িসুদ্ধ এতো গুলা মানুষ না খেয়ে আছে সেদিকে কারো খেয়াল আছে।-‘

মামির কথায় কোনো পাল্টা জবাব না করে রান্না ঘর থেকে ডালের বাটিটা নিয়ে বসার ঘরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই। উঠে দাড়াতেই চোখে অন্ধকার নেমে আসে। কোনো মতে শরীরের টাল সামলাতে পারলেও বাটি ভর্তি সমস্ত ডাল মামির শরীরে পড়ে যায়।মামি আগুনের মতো তেঁতে উঠে।

-‘হাতের গরম খুন্তি টা নিয়ে তেড়ে আসে আমার দিকে। মামির মতে আমি ইচ্ছে করেই এমন কাজ করেছি। কোনো কিছু বলার আগেই খুন্তি টা পিঠে চেপে ধরে বাজখাই গলায় বলতে থাকে,

-কাজ করতে কইছি বইলা এতো দেমাগ দেহাইতে হইবো। শইল্য এতো দেমাগ তোর? গরম ডাইল আমার শইল্যে ঢাইলা দিলি। খুন্তির ছেঁকা খাইয়া শইল্যের দেমাগ ছোডা এহন।

-‘আমি পোড়া যন্ত্রণায় ছটফট করছি।তবুও মামি আমাকে ছাড়েনি। পেছন থেকে আমার মামাতো বোন মিহি এসে মামিকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়েই সরিয়ে দেয়। মামি দুরে ছিটকে পড়ে যায়।আমি তখনো কাঁচুমাচু হয়ে মাটিতে পড়ে আছি।আর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি।

-‘মিহি মামির দিকে রাগী চোখে তাকায়। কঠোর গলায় বলতে থাকে,

-‘আর কত মা?মেয়েটা তো একটু পরে চলেই যাবে।বিয়ের দিন টা মেয়েটাকে অন্তত ছাড় দেও।ছোটোবেলা থেকে তো অনেক করলে?আর কত মা?তুমি কি মানুষ?

-‘এই অলক্ষী মাইয়া চইলা গেলেই বাঁছি আমি।আপত বিদায় হয়া যাক।

কথা টা বলেই মামি রাগে গিজগিক করতে করতে রান্না ঘরে চলে গেলেন।আমি তখনো ঠাঁই মাটিতে বসে আছি।মিহি এসে আমার পাশে বসলো।পোড়া যায়গায় হাত বোলাতেই ব্যথায় আমার শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠে।আমি বিষে ডুকরে উঠলাম।নিজেকে আর দমাতে না পেরে মিহিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদতে কাঁদতে থাকলাম।কতক্ষণ ওইভাবে ছিলাম আমার জানা নেই।

-‘একদমে কথা গুলো শেষ করে শেহরীন থামলো।আবেশ এতোক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে শেহরীনের কথা গুলো শুনছিলো।নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।আজ বিয়ের ৪ দিন হয়ে গেলেও শেহরীনের এমন একটা ভয়াবহ ক্ষত তার চোখে পড়েনি। আর পড়বেই বা কি করে!!!!!

কথাটা ভেবেই একটা ফাঁকা দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে মুক্ত বাতাসে।শেহরীন কে কিছু বলার আগেই শেহরীন আবারো বলতে থাকে,

-‘জানেন যেদিন আপনার সাথে আমার বিয়ের কথা পাকা হয় সেদিন আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমার বুঝি দুঃখের দিন শেষ হলো।আমি বুঝি একটা নিজের ঘর পেলাম,একটা বর পেলাম।বিয়ে হয়ে যেদিন রাতে এ বাড়িতে পা রাখলাম ঠিক তখনো আমার মনে হয়নি এই রাত টাও আমার জন্য সুখের হবেনা।দিন গুলো সুখের হবেনা।আমি জানি না এ আমার কপালের লিখন নাকি অসুখের বাঁধন!!!

মামির দেওয়া এই ক্ষতটা তো বাইরে থেকে স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে বিধায় আপনি জানতে চাইলেন এমনটা কি করে হলো।হয়তো একটু হলেও আমার ব্যথাটা অনুভব ও করে ফেলেছেন।

-‘এই বাহ্যিক ক্ষতটার মতো যদি আমার ভেতরের ক্ষতটা দেখতে পারতেন তাহলে হয়তো এভাবে দুরে রাখতেন না আমাকে।একবার হলেও আমাকে ছুঁয়ে দেখতেন।বুকে মিশে বুকের ধুকপুকানি শুনতে পেতেন।নিউরনে দুরে রাখার চিন্তাই আসতোনা।ঐ যে ক্ষত দেখার মতো আৎকে উঠতেন বলে।আমার কষ্ট হবে বলে!!!!

-‘শেহরীনের কথায় আবেশ চুপসে যায়।নিস্তব্ধতা গ্রাস করে।শেহরীনের দিকে চোখ রাখতে হিমশিম খাচ্ছে।নির্লিপ্ত মনে ভাবতে থাকে,

-‘আসলেই তো এখানে শেহরীনের কোনো দোষ নেই।শেহরীন কে সব টা জানালে তো আর সে বিয়ের জন্য জোর করতো না।কিন্তুু তারও তো দোষ নেই সেখানে।সে নিজেও নিয়তির শেকলে বাঁধা।

আচ্ছা, শেহরীন কে সব টা জানালে সে কি মেনে নিবে?সবটা জানার পরও কি অধিকার চাইবে নাকি দুরে সরে যাবে?আর যদি স্ত্রীর অধিকার চেয়েও বসে সেটাও কি দেওয়া সম্ভব? এখন তার কি করা উচিত? একটা সম্পর্ক তো এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে পারেনা।হয় বিচ্ছেদ নয় মিলন।একটা শেষ পরিনতি তো অবশ্যই জরুরী।

-‘ভাবনার মারপ্যাঁচে পড়ে আবেশের মাথায় সহস্র প্রশ্ন ঘুরতে থাকে।চিপ বেয়ে ফোঁটা ফোটা ঘাম গড়িয়ে পরে মেঝেতে।শেহরীন তখনও অবুঝের মতো তার দিকেই তাকিয়ে আছে।কি নিষ্পাপ চাহনি।মায়াবী মুখ।

-‘শেহরীনের মুখ চেয়ে আবেশের এক পাশ অস্বস্তিতে কাঁদা হয়ে গেলেও অন্যপাশ হুংকার ছেড়ে বলছে,-‘এ মায়াদেবীর জন্ম বিসর্জনের জন্য নয়।সে বিসর্জিত নয়।স্বীকৃতি তার বিধিগত অধিকার।-‘

-‘সবে মাত্র মাগরিবের আযান পড়েছে।সন্ধা মিলিয়েছে মিনিট কয়েক আগে।রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে খাবারের সুঘ্রাণ।নামায টা শেষ করে তসবীহ হাতে রান্নাঘরে ঢুকেন আয়না বেগম।

-‘শাড়ির আচল টা কোমড়ে গুঁজে চুলায় গরুর মাংস কসাতে ব্যস্ত শেহরীন।জ্যোষ্ঠের ভ্যাপসা গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার।বাম হাতের তালুতে কপালের ঘাম মুছতেই চোখে পড়ে শ্বাশুড়ি আয়না বেগমের স্নিগ্ধ মুখ।অযুর পানির রেশ এখনো মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।হাতে তসবীহ।মাথায় খিমার।বেশ নির্মল আর স্বচ্ছ দেখাচ্ছে তাকে।

-‘শ্বাশুড়ির মুখ থেকে চোখ টা সরিয়ে নিয়ে মাংসের কড়াই টা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেয়।পাশে পাতিলে থাকা চাল গুলো বেসিনে কচলাতে কচলাতে শান্ত গলায় বলে,

-‘আচ্ছা মা আপনি কখনো আমার মাকে দেখেছেন?মামার কাছে শুনেছি আমার মা নাকি আমার মতোই ছিলো দেখতে?আসলেই কি মা?

-‘শেহরীনের কথায় ডান হাতে তসবীহ টা কে চুমু খেয়ে ডাইনিং এর উপর রেখে খুব রয়ে সয়ে উত্তর দেয়,

-‘তোমার মামা ঠিকই বলেছেন শেহরীন।রুপে গুনে তুমি ঠিক তোমার মায়ের মতোই হয়েছো।

-‘মাইয়া মানুষের এমন রুপ আর গুন দিয়েই কি হইবো ভাবি?যদি সোয়ামিই কাছে না টানে!!

আয়না বেগমের কথার মাঝে ফোড়ন কাটে সাফিনা ফুপু।কথার ভাজে ফুটে উঠে উপহাসের নিদারুন প্রতিচ্ছবি।

আয়না বেগম ধমকে উঠেন।

-‘এসব কি ধরনের কথাবার্তা সাফিনা।কোথায় কি বলা উচিৎ তা এতোদিনেও শিখে উঠতে পারলেনা!!!

আমারে ধমকাইয়া কি হইবো ভাবি?আফনের গুনবতী পুত্র বধুরেই জিগান তো,

-‘আবেশ তারে ছুঁইয়া দেখছে নাকি!!

সাফিনা ফুপুর কথায় আয়না বেগম একরাশ প্রশ্ন নিয়ে শেহরীনের দিকে তাকায়।শেহরীন লজ্জা পায়।ভীষন লজ্জা।ইচ্ছে হচ্ছে মাটি দুভাগ হয়ে তাকে তার মাঝে তাকে যেনো জায়গা করে দেয়।আহত মনে আহত চোখে নুইয়ে পড়ে নিচের দিকে।

কিছু বলে উঠার আগেই সাফিনা ফুপু আবারো বলে উঠেন,

-‘আমরা মাইয়া মানুষ।আমরা মুখ দেখলেই কয়া দিতে পারি কেডা স্বামী সোহাগী আর কেডা স্বামী অভাগী।সময় থাকতে সোয়ামিরে বাইন্ধা রাহো।নয়তো তোমার অবস্থাও তোমার মায়ের মতোই হইবো।তোমার লাইগা মন পুড়ে তাই কই।মাইয়া মাইনসের সোয়ামি ছাড়া গতি নাইরে মা!!

কথা গুলো শেষ করে আঁচলে মুখ ঢেকে দৌড়ে রান্নাঘর থেকে চলে যান ফুপু সাফিনা বেগম।শেহরীন নিচু মাথা উচু করে অশ্রুশীতল চোখে তাকায় শ্বাশুড়ি আয়না বেগমের দিকে।আহত গলায় জিজ্ঞেস করে,

-‘আমার মায়ের কি হয়েছিলো মা?

চলবে,,,,,