নীল কণ্ঠ পর্ব-০১

0
783

#নীল_কণ্ঠ💜
#সূচনা_পর্ব
#সাদিয়া

হরেক রকমের ফুলে সাজানো বাসর ঘরে বসে বসে চোখের পানি ফেলছে নীল। অপর পাশের সোফায় বসে গালে হাত দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী কণ্ঠ। বাসর ঘরে বসে নতুন বউ কাদঁলে তা মানা যায়। কিন্তু বাসর ঘরে বসে যদি কোনো বর কান্না করে তাহলে কি তা মানা যায়? এর চাইতে উদ্ভট ঘটনা পৃথিবীতে দুটো আছে বলে মনে হয় না।

নীলের কান্নায় কণ্ঠ প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না এত কান্নার কি আছে। বিয়েই তো হয়েছে অন্য কিছু তো আর না। কণ্ঠ কোনো কথা না বলে চরম বিরক্তির সহিত উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়। নীল একবার আড়চোখে কণ্ঠের যাওয়ার দিকে তাকালো। কণ্ঠকে দেখলেই নীলের কান্না উপচে পড়ছে। এই ছিলো তার কপালে? সে তো কোনো দিন কারো কোনো ক্ষতি করে নি। তাহলে এটা কেন হলো তার সাথে? কেন হলো এমন? এর থেকে তো ভালো ছিলো সে সারাজীবন চিরকুমার থেকে যেতো।
কিয়ৎক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে কণ্ঠ। কণ্ঠ একবার নীলের দিকে তাকালো। সে এখনও কান্নায় মগ্ন।
–এনাফ নীল। আর কতো কাঁদবি? এমন ভাব করছিস কেউ তোর রে’প করেছে।

–ছিঃ এগুলো কেমন ভাষা।
নাক সিটকে বললো নীল।
–তোর এই ফ্যাচফ্যানো দেখে এর চেয়ে ভালো কিছু আমার মুখে আসছে না বিশ্বাস কর। এমন উদ্ভট আচরণ কেন করছিস তুই?

–তুই আমার কষ্ট কি বুঝবি। তোর গলায় তো আর সাক্ষাৎ শাঁ’ক’চু’ন্নি বউ ঝোটেনি।

–কি বললি তুই?
চিবিয়ে চিবিয়ে কথাটা বললো কণ্ঠ। কণ্ঠর এমন রাগি কণ্ঠ শুনে নীলের খেয়াল হলো সে কি বলেছে। নীল জিহ্বায় কামড় দিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো কণ্ঠের দিকে। কণ্ঠ তার-ই দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নীল কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললো।
–বিশ্বাস কর নীল তুই যদি আমার স্বামী না হতিস এই মূহুর্তে তোর ঘাড় আমি মটকাতাম।

–এই জন্যই তো তোকে শাঁ’কচু’ন্নি বলি।
কথাটা আস্তে বলায় কণ্ঠ ঠিকভাবে তা শুনতে পায়নি।
–কি বিরবির করছিস? জোরে বল যা বলার।

–ন..না কিছু না। কিছু বলছি না আমি।
কণ্ঠ আর কোনো কথা বাড়ালো না। সে এমনিতেই প্রচুর ক্লান্ত। সারাদিনে অনেক ধকল গিয়েছে তার উপর দিয়ে। আজ সকালেও সে স্বাধীন একজন মানুষ ছিলো। মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেরিয়েছে সে। কিন্তু এখন? এখন সে একজনের স্ত্রী! একটা ভদ্র বাড়ির বউ সে। যদি জানতো নিজের বেস্টফ্রেন্ডের বিয়ের দাওয়াতে বরযাত্রী হিসেবে গিয়ে বিয়ের কনে হয়ে যেতে হবে তাও আবার নীলের মতো ব’ল’দ মার্কা একটা ছেলের তাহলে সে জীবনেও কি বিয়েতে যেতো? নাহ্! একদম যেতো না সে। কণ্ঠ খুব শখ করে সেজেগুজে নিজের বেস্টফ্রেন্ডের বিয়েতে গিয়েছিলো। আর সেই শখটাই তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো কণ্ঠ। কণ্ঠকে বিছানায় শুতে দেখে এক লাফে দাঁড়িয়ে গেলো নীল। কণ্ঠ নীলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–বা’নর হলি কবে থেকে তুই?

–মানে?

–লাফাচ্ছিস কেন এমন ভাবে? দেখছিস না আমি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি।

–ঘুমাবি ভালো কথা এখানে খাটের উপর কেন?

–আমার জানা মতে মানুষ খাটের উপরে-ই ঘুমায়। খাটের ত’লা’য় না।

নীল চোখমুখ কুচঁকালো। ঠিক এই কারণেই মেয়েটাকে তার পছন্দ নয়। এই মেয়ে কখনোই সোজা ভাবে কথা বলতে পরে না। সোজা ভাবে কথা বলা এই মেয়ের ধাতে নেই।
–তুই খাটে ঘুমাবি না।

–তো কি তোর ঘাড়ে ঘুমাবো?
নীল কণ্ঠের দিকে কেমন করে তাকালো।

–আচ্ছা বল আমি কেন খাটে ঘুমাতে পারবো না?

–কারণ এটা আমার খাট।

–ওহ্ আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আব্বুকে বলে দেবো কাল একটা খাট পাঠিয়ে দিতে। এখন অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। এখন সম্ভব না। জানিসই তো আব্বু অসুস্থ। আজকে ঘুমাতে দে।

–তুই খাটে ঘুমালে আমি কোথায় ঘুমাবো?

এবার যেন কণ্ঠর রাগ হলো। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে কণ্ঠ উত্তর দিলো,
–মানুষ যেহেতু খাটে ঘুমায় সেহেতু তোরও খাটেই ঘুমানোর কথা।

–অসম্ভব! আমি জীবনও তোর সাথে এক খাটে ঘুমাতে পারবো না।

একপ্রকার চেচিয়ে কথাটা বললো নীল। একে তো এই আনএক্সেপ্টেড বিয়ে তার উপর নীলের ফালতু বকরবকর মিলিয়ে কণ্ঠের মেজাজ এখন জ’ল’ন্ত আগ্নে’য়গি’রি।
–কেন রে আমার সাথে এক খাটে ঘুমালে কি সমস্যা তোর? আমার গায়ে কি কোনো ছোঁয়াছে রোগ আছে যে তা তোর মোমের শরীরে এ্যাটা’ক করবে? নাকি আমি কোনো বখাটে যে তোর মতো অবলা পুরুষকে একা পেয়ে তোর সুযোগ নেবো? তোর সতিত্ব হ’রণ করবো?

কণ্ঠের এমন কথায় নীলের যেন কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। নীল কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে মিনমিন করে বললো,
–আচ্ছা ঠিক আছে ঘুমা তুই।

–গুড বয়। আর শোন ঘুমের সময় আমি সাউন্ড একদম পছন্দ করি না। যদি তোর ভ্যাঁ ভ্যাঁ এর একটা শব্দও আমি পাই তাহলে তোর এমন অবস্থা করবো সারাজীবনে আর মুখ দিয়ে শব্দ করার মতো কোনো অবস্থায় থাকবি না।

নীল এমনিতেই কণ্ঠকে কিছুটা ভয় পায়। আর এখন কণ্ঠের এমন হুম’কি শুনে নীল ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করে রইলো। ক্লান্ত থাকায় অল্প সময়ের মধ্যেই কণ্ঠ ঘুমিয়ে যায়। নীল কণ্ঠের দিকে মুখ গোমড়া করে তাকিয়ে আছে। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার এখন ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।
–বাবা এটা আমার সাথে কিভাবে করতে পারলো? কনে পালিয়ে গিয়েছে বলে কি তিনি এমন একটা ধানিলঙ্কা টাইপ মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দেবে? আর ওই মেয়েকেও বলি বিয়ে যখন করবিই না তখন রাজি কেন হয়েছিলি? ধা’ন্দা’বা’জ মেয়ে মানুষ কোথাকার। কিন্তু ওই মেয়ের কথা বার্তায় তো কোনোদিন মনে হয়নি যে ওই মেয়ের অন্য জায়গায় চক্কর আছে। ফোনে কতো মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতো আহা। মনে হতো সে রসগোল্লার চাইতেও কয়েকগুন বেশি মিষ্টি। কিন্তু বিয়ের দিন কি করলো? পালিয়ে গেলো। শিউর অন্য জায়গায় চক্কর আছে। যদি না থাকে তাহলে পালালো কেন? আমাকে কি পছন্দ নয় তার? আরে কিভাবে আমাকে অপছন্দ করবে সে? আমি কি দেখতে খারাপ নাকি? তাহলে? আরে তাহলে যাই হোক না কেন ওই মেয়েকে যদি পাই একবার আচ্চা করে বকে দিবো। বেয়া’দব মেয়ে মানুষ। ওর চক্করে আমার জীবনে এই শাঁ’কচু’ন্নি পারমানেন্টলি জুরে গেছে। এখন আমার কি হবে? এই মেয়ে তো আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দেবে না। কোন কুক্ষণে যে এই মেয়ে আমার কপালে এসে জুটে ছিলো।
হাবিজাবি ভাবনার মাঝে নীল ডুব দিলো অতীতে যেদিন কণ্ঠের সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিলো। ওই দিনকে নীল নিজের জীবনের অভিশপ্ত দিন হিসেবে মনে রেখেছে।

নীল তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। বাবার ট্রান্সফারের কারণে তারা সে বছর সিলেট থেকে ঢাকায় শিফট হয়েছিলো।
সেদিন ছিলো স্কুলে নীলের প্রথম দিন। নীল বরাবর-ই শান্ত স্বভাবের ছেলে। স্কুলে নতুন হওয়ায় সেদিন তাকে স্কুলের সিনিয়র স্টুডেন্টরা আটকে ছিলো। নীলকে কোনো বড় কোনো আপুকে প্রেম নিবেদন করার টাস্ক দেওয়া হয়েছিল। নীল রাজি হলো না। যার দরুন তাকে বলা হলো মাঠে সবার সামনে কানে ধরে উঠ বস করতে। নীল এতেও রাজি হলো না। আর ওইদিকে বদ’মা’শ সিনিয়রগুলোও তাকে ছাড় দোবারা নয়। অবশেষে নীল পরাজিত হলো ওদের কাছে। চোখে এক সমুদ্র অশ্রু নিয়ে সে কানে ধরে উঠ বস করার প্রস্তুতি নিলো। যখনি সে বসতে যাবে তখন পেছন থেকে একটা মেয়ের ভরাট কণ্ঠ ভেসে আসলো।
–কি হচ্ছে এখানে?

নীল তাকিয়ে দেখলো নীল রঙের স্কুল ড্রেস পরিহিত দুই বিনুনি করা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির হাতে ছোট খাটো চিকন একটা লাঠি। মেয়েটাকে দেখে বদ’মা’শ সিনিয়রগুলোও কেমন ঘাবড়ে গেলো।

#চলবে…ইনশাআল্লাহ