পুষ্পের নিদ্র পর্ব-০৩

0
401

#পুষ্পের_নিদ্র
#আনআমতা_হাসান
পর্ব : ৩

ভোর ৬:৩৩ এ ঘুম থেকে উঠে পুষ্প পাশে তাকিয়েই দেখে তার মা আর নিদ্রের মা সোফাতে বসে কথা বলছে।অপর পাশে তাকাতেই দেখে নিদ্র মাথায় বেন্ডিজ নিয়ে আধসোয়া হয়ে বসে ফোন টিপছে।

কালকে রাতের কথা মনে পড়তেই হুট করে রাগ উঠে যায় পুষ্পের। এক ঝটকায় নিজের বেড থেকে নেমে নিদ্রের বেডে গিয়ে নিদ্রের কলার চেপে দরে এক প্রকার চিৎকার করে বলল
– কি ভাবেন কি আপনি নিজেকে? মহারাজা? যখন যা ইচ্ছে করবে তাই করে বেড়াবেন? ইচ্ছে হয়েছে আমাকে জোড় করে বিয়ে করেছেন এখন আবার ইচ্ছে হয়েছে তাই নিজেকে শেষ করে দিতে চাইছেন। কি পেয়েছেনটা কি আপনি? কি ভেবেছেন কি আপনি? আপনি যা বলবেন তাই হবে? আর কখনো যদি এমন কোন কাজ করেন তাহলে আমিই আপনার হাত-পা ভেঙে আপনাকে বেডে সুয়িয়ে রাখবো। আর কে আপনাকে এসব আলতু-ফালতু কথা বলেছে? আন্টি কথায় কথায় তপুর সাথে আমার বিয়ের কথাটা যাস্ট মাকে বলেছে। এর বাইরে এ নিয়ে আর কোন কথা হয়নি। আমার স্বামী থাকতে আমি কেন আবার বিয়ে করতে যাব? আপনি কি আমাকে এতটাই খারাপ ভাবেন? আপনি নাকি আমাকে ভালোবাসেন তা আপনি কি কোনদিন আমাকে বুঝার চেস্টা করেছেন? আমি আপনাকে ভয় পাই শুধু এটাই দেখেছেন। আমি যে আপনাকে কতোটা ভালোবাসি তা না আপনি বুঝেছেন আর না কখনো বুঝতে চেয়েছেন।

কথাগুলো রাগে একদমে বলেই পুষ্প কেদে দিল। নিদ্র অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে পুষ্পের মুখের দিকে। হাতে থাকা ফোনটা হাত থেকে বেডে পরে গেছে সেই কখন। সে যেন আজ নিজের চোখ কানকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না। যেই মেয়ে তাকে বাঘের মতো ভয় পেত। সেই মেয়ে আজ তার শার্টের কলার চেপে দরে তাকে হুমকি দিচ্ছে। আর পুষ্পের শেষের কথাগুলো শুনে নিদ্র অবাক হয়ে যায়। পুষ্প তাকে ভালোবাসে? সত্যিই সে কখনো পুষ্পের চোখে তার জন্য ভালোবাসা দেখেনি। দেখবেই বা কি করে পুষ্পতো কোনদিন তার চোখের দিকে তাকিয়ে তার সাথে কথা বলেনি। সারাজীবন তার সামনে মাথা নিচু করে কাপাকাপা কন্ঠে কথা বলে গেছে। কিন্তু আজ সে পুষ্পের চোখ দুটো দেখতে পাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছে সেই চোখে তার জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা।

নিদ্র নিজের দুই হাত দিয়ে পুষ্পের দুই গালে দরে মুখটা উপরে তুলে দুই হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে পুষ্পের দুই চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
– সরি পুষ্প আর কখনো এমন করবো না। আই প্রমিজ আর কান্না করো না। প্লিজ কান্না থামাও।

পুষ্প রাগী কন্ঠেই বলল
– কেন কান্না থামাবো? আমি কান্না করবো। অনেক অনেক কান্না করবো। আপনার কষ্ট হচ্ছে এখন আমার সামান্য চোখের পানি দেখে। আর আমার? তখন আপনার মাথা ফাটিয়ে অজ্ঞান হওয়ার কথা শুনে কেমন লেগেছে তা সম্পর্কে কি আপনার কোন ধারণা আছে? আপনার কিছু হলে আমার কি হতো তা কি আপনি একবারও ভেবেছেন? আপনি আসলে খুব বাজে মানুষ, খুব সার্থপর, খুব খুব খুব খারাপ মানুষ।

বলেই পুষ্প নিদ্রের বুকে মাথা রেখে কান্না করতে থাকে।

সামনের কেবিন থেকে জোরে কথা বলার শব্দ শুনে নার্স সেই কেবিনের দিকে যায়। দরজার কাছে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন লোককে উদ্দেশ্য করে বলল
– স্যার কোন সমস্যা হয়েছে কি?

নার্সের কথা শুনে নিদ্র, পুষ্প আর ওদের বাবা মা নার্সের দিকে তাকায়। নিদ্র আর পুষ্পের এতোক্ষণে খেয়াল হলো তারা কোথায় আছে আর কাদের সামনে আছে। খেয়াল হতেই পুষ্প তাড়াতাড়ি নিদ্রের থেকে সরে, বেড থেকে নেমে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে যায়। ছি,,,ই বাবা-মা, আংকেল-আন্টির সামনে ও এতোক্ষণ নিদ্রের বুকে মাথা রেখে কান্না করছিলো। এখন কথাটা ভাবতেই লজ্জায় তার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করছে।

আতাউর নার্সকে উত্তর দিল
– না সব ঠিক আছে।

-ওকে স্যার হসপিটাল তোও প্লিজ একটু আস্তে কথা বলবেন।

কথাটা বলেই নার্স চলে যায়।

জাহানারা এগিয়ে এসে নিদ্রকে জিজ্ঞেস করে
– তোরা বিয়ে করেছিস?

কথাটা শুনেই পুষ্প অবাক চোখে নিদ্রের মার দিকে তাকায়। এতোক্ষণ রাগে দুঃখে ও যে নিষিদ্ধ যায়গায় নিষিদ্ধ কথা বলে ফেলেছে। তা ও এখন ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে। পুষ্প নিদ্রের মার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিদ্রের দিকে তাকায়। নিদ্র কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। পুষ্পের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিদ্রের সাথে চোখাচোখি হলেই পুষ্প চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। জাহানারা নিদ্রকে আবার জিজ্ঞেস করল
– কিরে কথা বলছিস না কেন?

নিদ্র মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকে কিছু বলে না। এবার সাহানা পুষ্পকে জিজ্ঞেস করল
– পুষ্প ভাবি যা জিজ্ঞেস করছে তার উত্তর দে?

পুষ্প খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। যেহেতু নিদ্র তাকে প্রমিজ করেছে, যত কিছুই হয়ে যাক না কেন সে না বলা পর্যন্ত তাদের বিয়ের কথা নিদ্র কাউকে বলবে না। তাই সে নিজে কিছু না বলা পর্যন্ত নিদ্র এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিবে না। তাই মাথা নিচু করে আস্তে করে বলল
– হ্যাঁ। আমরা বিয়ে করেছি।

সবাই অবাক চোখে পুষ্পের দিকে তাকায়। সাহানা রেগে পুষ্পকে বলল
– কি? কাউকে কিছু না জানিয়ে এতো বড় একটা কাজ করে ফেললি। আমরা কি মরে গিয়েছি নাকি আমরা তোদের মেনে নিতাম না। তুই নিদ্রকে ভয় পাস দেখে আমরা তোদের বিয়েতে আপত্তি করেছিলাম। কিন্তু তুই কাউকে না জানিয়ে কেন এমন একটা কান্ড করলি বল?

নিদ্র অপরাধী কণ্ঠে বলল
– আন্টি ওর কোন দোষ নেই। আমি ওকে জোর করে বিয়ে করেছিলাম। ও আমাকে ছোট থেকেই অনেক ভয় পায়। তাই আমার সব সময় ওকে নিয়ে ভয় হতো। যদি ও ভয়ে আমাকে বিয়ে করতে না চায়। তাই ওর ১৮তম জন্মদিনের দিন আমি ওকে জোর করে ভয় দেখিয়ে বাদ্য করি বিয়ে করতে।

আতাউর নিদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল
– কখনো করো কথা ভাবলি না নিজের যা ইচ্ছা তাই করে গেলি।

নিদ্র মাথা নিচু করে অপরাধী কণ্ঠে বলল
– সরি।

নিদ্রের বাবা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আতিকুরের দিকে তাকিয়ে বলল
– আতিক আমার ছেলেটা রাগী, জেদি, নিজের ইচ্ছায় চলে, কারো কোন কথা শুনে না। কিন্তু ও মানুষ হিসেবে অনেক ভালো আর পুষ্পকে অনেক ভালোও বাসে।সারাজীবন মাথায় করে রাখবে ও তোর মেয়েকে। ওদের তুই মেনে নে ভাই।

আতিকুর স্বাভাবিক ভাবেই বলল
– আমি জানি ভাই নিদ্র ভালো ছেলে। আমরা তো শুধু পুষ্প নিদ্রকে ভয় পায় দেখে রাজি হচ্ছিলাম না। কিন্তু যদি ওদের বিয়ের কথা জানতাম তাহলে ঠিকই আমি মেয়েকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তোমাদের কাছে পাঠিয়ে দিতাম।

আতাউর মুখে কিছুটা বিরক্তভাব ফুটিয়ে বলল
– সেই বুদ্ধি থাকলে তো ভালোই ছিল। মাথাটা তো গাধার।

আতাউরের কথা শুনে পুষ্প নিদ্রের মাথার যায়গায় একটা গাধার মাথা থাকলে নিদ্রকে দেখতে ঠিক কেমন লাগবে তা কল্পনা করতে শুরু করে দেয়। এতো বড় একটা মানুষের বডিতে সাদা দাত বের করে হাসা একটি গাধার মাথা কল্পনা করতেই হাসি পায় তার। হাসি থামাতে না পেরে মাথা নিচু করে ঠোঁট চেপে হেসে দিলো সে। হাসির মাঝেই আড়চোখে নিদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখে নিদ্র ওর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। যেন এখনই কাচা চিবিয়ে খাবে। সাথে সাথেই ওর হাসি উড়ে চলে গিয়ে ভয়ে হাত-পা কাপাকাপি শুরু হয়ে গেল। রাগে তখন নিদ্রের কলার দরে কথা বললেও এখন রাগ কমার সাথে সাথে তার সাহসটাও যে দৌড়ে পালিয়েছে। তাই আগের মতো আবার ভয়ে মাথা নিচু করে রইলো।

সে তো পুষ্পকে প্রমিজ করেছিল দেখেই তাদের বাবা-মা বা অন্য কাউকে কথাটা বলেনি। কিন্তু পুষ্প সেটা যেনে বুঝেও তার বাবাকে সত্যটা না বলে উল্টো ঠোঁট টিপে হাসছে। কথাটা ভেবেই নিদ্র প্রথমে রেগে গেলেও পুষ্পের বর্তমান অবস্থা দেখে মনে মনে হেসে ভাবতে থাকে এই পাগলি মেয়েটা যাকে সবথেকে বেশি ভয় পায় তাকেই সবথেকে বেশি ভালোও বাসে। কি অদ্ভুত মেয়ে। আর এই পাগলা মেয়েটাকেই যে ও পাগলের মতো ভালোবাসে।

জাহানারার চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক। এতো বছর পর তার ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে। তার ছেলে যে পুষ্পকে ভালোবাসে বা বিয়ে করেছে সে সম্পর্কে সেও জানতো না। পুষ্পের সহজ-সরল, শান্ত স্বভাবের জন্য তাকে ছেলের বউ করতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই তো আত্নীয় স্বজন পারা প্রতিবেশিদের আনা প্রস্তাবগুলো সে না করে দিয়েছে। সে খুশি মুখে বলল
– সে যাই হোক। এখন তো ডেট ফিক্সড করতে হবে।

আতাউর জাহানারার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করল
– কিসের ডেট?

জাহানারা কপাল কুচকে বলল
– কিসের ডেট মানে? আমার বউমাকে আমার বাসায় কবে নিয়ে যাবো তার ডেট ফিক্সড করতে হবেনা। আমি তো চাচ্ছি আজকেই আমাদের সাথে আমাদের বাড়ি নিয়ে যেতে। কিন্তু একটা মাএ ছেলে আমার বিয়ের অনুষ্ঠান না করলে কি হয়। আর আমি কিন্তু সব অনুষ্ঠান করবো। মানে এংগেজমেন্ট থেকে শুরু করে বিয়ে পর্যন্ত।

আতাউর বলল
– তাহলে সামনের মাসে এংগেস্টম্যান করি। আর তার পরের মাসে বিয়ে।

জাহানারা জোড় খাটিয়ে বলল
– না আমি এই মাসেই আমার বউমাকে আমার বাসায় নিয়ে যেতে চাই।

আতাউর স্বাভাবিক ভাবেই বলল
– তাহলে তুমিই ডেট বলো

জাহানারা ভেবে বলল
– আজকে শুক্রবার, সামনের শুক্রবার হলে।

আতিকুর কিছুটা চিন্তিত কন্ঠে বলল
– কিন্তু ভাবি এই পাঁচ-ছয় দিনে এতোকিছু করা সম্ভব হবে না।

সাহানা স্বামীর কথায় তাল মিলিয়ে বলল
– হ্যাঁ ভাবি। আমাদের তো একটা মাএ মেয়ে। সবাইকে বলতে হবে।

জাহানারা ভেবে বলল
– তাও ঠিক। কিন্তু আমি আমার বউমাকে একটু তাড়াতাড়ি ঘরে তুলতে চাই।

নিদ্র কিছুটা আমতা-আমতা করে বলল
– মা আমি বলিকি আর ষোল দিন পরই তোও পুষ্পের জন্মদিন।

নিদ্রের মা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল
– তোও। জন্মদিনের সাথে বিয়ের কি সম্পর্ক।

নিদ্র মাথা নিচু করে মাথার পিছনের অংশে ডান হাত দিয়ে চুলকাতে চুলকাতে কিছুটা লাজুক ভাবে বলল
– না মানে ওর জন্মদিনের দিনই তো আমাদের বিয়ে হয় তো ওই দিনই যদি,,,,,,

পুষ্প স্থির দৃষ্টিতে করে তাকিয়ে আছে নিদ্রের দিকে। নিদ্রকে সে এই প্রথমবার লজ্জা পেতে দেখছে। কি সুন্দর লাগছে তার এই রাগী বরটাকে। একেবারে কিউট বাচ্চা। ইচ্ছে করছে গিলে খেয়ে ফেলতে। কিন্তু এই কিউট বাচ্চাটা যদি জানতে পারে যে তার সে তাকে খেতে চেয়েছে তাহলে উল্টো তাকে চিবিয়ে খাবে। কথাটা মনে পড়তেই একটা শুকনো ডোক গিলে চোখ নামিয়ে আবার মাথা নিচু করে ফেলল সে।

– হ্যাঁ এটাই ভালো হবে। আর আট দিন পর এংগেজমেন্ট আর ষোল দিন পর বিয়ে।

আতাউরের প্রস্তাবে জাহানারাসহ সবাই রাজি হয়।

🌺

চলবে………..