পুষ্পের নিদ্র পর্ব-০৫

0
305

#পুষ্পের_নিদ্র
#আনআমতা_হাসান
পর্ব : ৫

রেস্টুরেন্টে খুব অস্বস্তি নিয়ে তপুর সামনে বসে আছে পুষ্প। আগে কখনো তপুর সামনে এমন অস্বস্তি লাগনি তার। ইনফেক্ট তাদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। যা পুষ্পের চোখে ছিল ভাই-বোনের সম্পর্ক। কাজিন ভাই বলতে দাদুর বাড়ির দিক থেকে ছিল নিদ্র আর নানুর বাড়ির দিক থেকে তপু। ছোট থেকে নিদ্র ছিল রাগী, জেদি আর একরোখা ছেলে। তাই পুষ্প ছোট থেকে নিদ্রের থেকে দূরে দূরে থাকতো। কিন্তু তপু ছিল নিদ্রের ঠিক উল্টো। হাসিখুশি প্রান উজ্জ্বল ছেলে। দেখা হলেই কথার জালে পুষ্পকে হাসিয়ে মারতো সে। কিন্তু আজ তপু নিশ্চুপ, গম্ভীর। তার চাহনিও আজকে অন্য রকম লাগছে পুষ্পর কাছে।

– কি খাবে?

তপুর প্রশ্নে ভাবনার সুতো কাটলো পুষ্পের। হালকা হেসে উত্তর দিল
– কিছু খাব না ভাইয়া।

তপুও হালকা হেসে বলল
– রেস্টুরেন্টে এসে কিছু না খেলে কেমন হয় বল।

একটু ভেবে হেসে পুষ্প বলল
– তাহলে এক কাপ কফি।

তপু ওয়েটারকে ডেকে দুইকাপ কফি অর্ডার করলো। পুষ্পের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
– কিছুদিন পর নিদ্রের সাথে নাকি তোমার বিয়ে?

পুষ্প অসস্থি আর লজ্জা নিয়ে ছোট করে উত্তর দিল
– হ্যাঁ ভাইয়া।

– দেখ পুষ্প আমি থাকতে তোমার নিদ্রকে ভয় পাওয়ার কোন কিছু নেই। নিদ্র তোমার কিছু করতে পারবে না। তুমি বিয়েটা করোনা।

অবাক চোখে চেয়ে উত্তর দিল পুষ্প
– কিন্তু আমাদের তো বিয়ে হয়ে গেছে!

– দেখ পুষ্প এই জোরের বিয়ে নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। দুদিনের মধ্যেই আমি তোমাদের ডিভোর্সের সমস্ত পেপার রেডি করে ফেলবো। ওর মতো রাগী, জেদি, মাস্তান ছেলের সাথে তোমাকে ,,,,,,,

পুষ্প রাগী কন্ঠে বলল
– প্লিজ। প্লিজ ভাইয়া চুপ করুন। প্রথমত, প্রথমবার নিদ্র আমাকে ভয় দেখিয়ে বিয়ে করলেও এবাবের বিয়েটা আমি সেচ্ছায় করছি। কারণ আমি নিদ্রকে ভালোবাসি। আর দ্বিতীয়ত, আমি কাকে ভালোবাসি আর কাকে ভয় করি তা আমার থেকে নিশ্চয়ই অন্য কেউ বেশি জানেন না? তাই না? আর আপনাকে আমি বড় ভাইয়ের চোখে দেখি। বড় ভাইয়ের মতো সম্মান করি। কিন্তু আপনি যদি আর কোনদিন আমার স্বামীকে নিয়ে কোন আজেবাজে কথা বলেন তাহলে সেই সম্মানটা আপনি হারাবেন।

এই বলে পুষ্প পাশের চেয়ারে রাখা ব্যাগটা হাতে নিয়ে রেস্টুরেন্টে থেকে বের হয়ে গেল। তপু অবাক চোখে তাকিয়ে আছে পুষ্পের যাওয়ার দিকে। যেই পুষ্প কখনো তার চোখে চোখ রেখে কথা বলেনি। সেই পুষ্প আজ তার সাথে ঝগরা করে গেল! তাও আবার নিদ্রের জন্য! যার থেকে সে সব সময় পালিয়ে বেরিয়েছে। টেবিলে ওয়েটার কফি রাখার হালকা শব্দ হলে তপু ভাবনার সুতো ছিরে বাস্তবে ফিরে এলো। ধ্যান ভেঙে সামনে তাকাতেই অবাকের চরমে পৌছায় সে। কারণ তার সামনে নিদ্র বসে পুষ্পের জন্য ওডার করা কফি খাচ্ছে। কিন্তু নিদ্র এখানে কখন আর কিভাবে এলো? ভাবতে ভাবতেই নিদ্রকে জিজ্ঞেস করল
– আপনি এখানে?

নিদ্র কফি খেতে খেতে ভাবলেশহীন ভাবে বলল
– একজন ক্লাইড এর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। এসে দেখি আমার একমাত্র খালাতো শালা আমার বউকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছে। হাউ সেড।

তপু ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে। ছোটবেলা থেকে নিদ্রের সাথে একই স্কুলে পড়েছে সে। যদিও নিদ্র ছিল তার সিনিয়ার। কিন্তু স্কুল এক হওয়ার কারনে আর একই এলাকার হওয়ার কারনে সে নিদ্রের রাগ আর নৃশংসতা সম্পর্কে খুব ভালো করে জানে। এমনকি যে নৃশংসতাগুলো সম্পর্কে অন্যান্য মানুষ জানে না তার চাচাতো ভাই চন্দন নিদ্রের বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়ায় সেগুলো সম্পর্কেও সে জানে। তাও সাহস করে সে পুষ্পকে বিয়ের কথা বলেছে। কারন সে ভেবেছিল পুষ্প নিদ্রকে ভালোবাসেনা। ভয় পায় বলে তার নিদ্রকে কিছু বলে না। আর তপু জানতো নিদ্র কখনো পুষ্পকে জোর করবে না। শত কষ্ট হলেও হাসিমুখে তা মেনে নিবে। তাই তার পুষ্পকে পাওয়ার একটা আশা ছিল। কিন্তু পুষ্পও নিদ্রকে এতোটা ভালোবাসে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।

নিদ্র কফিটা শেষ করে ওয়েটারকে ডেকে বিলটা দিয়ে বসা থেকে উঠে তপুর সামনে ঝুকে দাতে দাত চেপে বলল
– শুধু তুমি পুষ্পের কাজিন বলে আজকে কিছু বললাম না। কিন্তু দ্বিতীয়বার আমিও ভুলে যাব যে তুমি পুষ্পের কাজিন হও।

কথাটা বলেই নিদ্র চলে যায়।

এদিকে,

রাগে গটগট করে রেস্টুরেন্টের থেকে বের হয় পুষ্প। এমনিতে সে চুপচাপ শান্ত-সৃষ্ট মেয়ে হলেও কেউ তার পছন্দের মানুষের সম্পর্কে খুব বেশি উল্টো-পাল্টা কথা বললে প্রচন্ড রেগে যায় সে। একটা রিকশা ঠিক করে যেই মাএ না রিকশাতে উঠবে ঠিক তখনি পিছন থেকে নিদ্রের কন্ঠে নিজের নাম শুনতে পায় সে। পিছনে তাকিয়ে দেখে তার পিছনে নিদ্র দাঁড়িয়ে আছে। রাগ ভুলে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে নিদ্র এখন এখানে কেন? এটা তোও অফিস টাইম। নিদ্রের তো এখন অফিসে থাকার কথা ছিল। নিদ্র কি তাকে তনুর সাথে কথা বলতে দেখেছে? একটা শুকনো ডোক গিলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। নিদ্র তার কাছে এসে বলল
– তুমি এখানেই দাঁড়াও আমি পার্কিংলট থেকে কারটা নিয়ে আসছি।

পুষ্প কোন কথা না বলে শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। নিদ্র চলে যায় গাড়ি আনতে। পুষ্প বুঝতে পারছে না নিদ্র তাকে তপুর সাথে দেখেও তার সাথে রাগ দেখায়নি কেন? তাহলে কি নিদ্র তাকে তপুর সাথে রেস্টুরেন্টের ভিতরে দেখেনি। একটা সস্থির নিঃশ্বাস ফেললো সে। পাশে দাঁড়ানো বয়স্ক রিকশা চালকটি পুষ্পকে ডেকে বলল
– যাইবেন না মামা।

পুষ্প ব্যাগ থেকে ১০ টাকার চারটা নোট বের করে রিকশা চালককের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল
– মামা যাব না, এটা রাখুন।

রিকশা চালকটা কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
– আমনে তোও যাইবেন না। তাইলে টেহা দিতেছেন কেন?

পুষ্প হেসে উত্তর দিল
– আমাকে না নিলে তোও এতোক্ষণে তুমি অন্য পেসেঞ্জার নিয়ে চলে যেতে। আমার জন্য দাড়িয়ে থেকে তোমার লস হয়েছে না তাই।

রিকশা চালক খুশি মুখে পুষ্পের হাত থেকে টাকা নিতে নিতে বলল
– আমনের মনডা অনেক ভালা মামা। আল্লাহ আমনের মঈল করুক।

তখনি নিদ্র রিকশাটার সামনে তার গাড়ি সাইড করে। পুষ্প তাড়াতাড়ি গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে।

ব্যস্ত শহরে এমনিতেই রাস্তায় জ্যাম থাকে। তার উপর যদি হয় বৃষ্টি তাহলে তো কথাই নেই। থেমে থেমে গাড়ি চলছে। কিন্তু ভারি বর্ষনটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। দশ কি পনেরো মিনিট পরেই বৃষ্টিটা কমে আসে। এখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। পুষ্প চুপচাপ সোজা হয়ে ভাবছে নিদ্র যদি এখন তাকে জিজ্ঞেস করে সে কোথায় কি করতে গিয়েছিল? তারপর সে যদি বলে যে সে তপুর সাথে দেখা করতে গিয়েছে। তখন নিশ্চয়ই নিদ্র জিজ্ঞেস করবে তপুর সাথে কি কথা হয়েছে বা তপু কেন তাকে দেখা করতে বলেছে? তখন সে কি বলবে? ভয়ে হাত-পা অবস হয়ে আসছে তার। নিদ্র সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতেই বলল
– তোমার মনে আছে আমাদের বিয়ের দিন যখন তোমাকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছিলাম। সেইদিনও এমন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল।

নিদ্রের কথা শুনে পুষ্পের মনে পরে যায় সেদিন তাদের বিয়ের পর যখন নিদ্র তাকে গাড়ি করে তাকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছিল তখনও বাহিয়ে এমন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। এর সাথে আরো একটা বিষয় তার মনে পরে তা হলো সেদিন রাকিব রেস্টুরেন্টে তাকে প্রপোজ করেছিল বলেই নিদ্র তাকে ভয় দেখিয়ে বিয়ে করেছিল। আজ তো সে নিজে ইচ্ছায় নিদ্রকে না বলে তপুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। আজ কি হবে তার? ভাবতেই ভয়ে বুকটা কেপে উঠে তার। এখন খুব আপসোস হচ্ছে তার। কেন যে তপুর কথা মেনে তার সাথে একা দেখা করতে গেল সে। আচ্ছা এটা আবার তপুর কোন প্ল্যান নয় তো। যেভাবে তাদের বিয়ে কথা উঠার আগেই সে সবাইকে বলিয়ে বেড়িয়েছে যে তাদের বিয়ে ঠিক। সেই একইভাবে তাকে একা আসতে বলে পরে নিদ্রকে ফোন করে এসে দেখে যেতে বলেছে যে তারা দুজন রেস্টুরেন্টে প্রেম করছে। হায় আল্লাহ তাহলে তো সর্বনাশ হবে। নিদ্র আবার বলল
– আমার মনে হয় তোমার সাথে আমার সুখের দিনের সাক্ষী এই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হতে চায়। তাই যখনই তোমার সাথে আমার ভালো কিছু হয়। তখনি গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হয়। আজ আমি সত্যিই অনেক খুশি। আমার জীবনে আর চাওয়ার কিছু নেই।

পুষ্প বোকার মতো নিদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে বুঝতে পারছে না নিদ্র সেদিনের মতো তার সাথে রাগ না করে এগুলো কি বলছে। গাড়িটা জেমে আটকে আছে নিদ্র পুষ্পের বোকা বোকা করে রাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
– কিছু বুঝছো না তো।

পুষ্প না সূচক মাথা নাড়ে। জ্যাম ছেড়ে দেয়। নিদ্র সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বলল
– আচ্ছা আমি বুঝিয়ে বলছি। আজকে ক্লাইন্ডের সাথে রেস্টুরেন্টে একটা মিটিং ছিল। মিটিং শেষে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় তোমাকে দেখতে পাই তপুর সাথে বসে আছো। বিশ্বাস করো আমার তখন মনে হচ্ছিল তপুকে গুলি করে মেরে ফেলি আর তোমাকে মাথায় তুলে একটা আছাড় মারি।

ভয়ে পুষ্পের গলা শুকিয়ে যায়। নিদ্র তার অবস্থা বুঝতে পেরে এক বোতল পানি পুষ্পের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল
– পানি খাও।

পুষ্প বোতলের ঢাকনা খুলে পানি খায়। তার মতো এক গ্লাস পানি খেয়ে উঠতে না পারা মেয়ে আজ এক বোতল পানি ঢকঢক করে দুই মিনিটে শেষ করে দেয়। পুষ্পের পানি খাওয়া শেষ হলে নিদ্র আবার বলল
– সেই উদ্দেশ্যেই আমি তোমাদের কাছে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো পুরো বেপারটা না জেনে রিয়েক্ট করা ঠিক হবে না। তাই লুকিয়ে তোমাদের পিছনের টেবিলে গিয়ে বসে তোমাদের সব কথা শুনি। ভাগ্যিস তোমাদের কিছু না বলে তোমাদের কথা শুনেছিলাম। না হলে তো জানাই হতো না আমার এই চুপচাপ, শান্ত-সৃষ্ট, ভীত বউটা আমার জন্য অন্যের সাথে ঝগরাও করতে পারে!

পুষ্পর ভয় কেটে এবার তাকে ঘিরে ধরেছে একরাশ লজ্জা। লজ্জায় মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সে। গাড়ি গিয়ে থামে পুষ্পদের বাড়ির গেটের সামনে। নিদ্র দুষ্ট হেসে বলল
– বাসায় যাও বউ।

লজ্জায় পুষ্প কথা বলতে পারছে না। গাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য গাড়ির দরজায় হাত দিতেই নিদ্র শান্ত কন্ঠে ডেকে উঠলো
– পুষ্প।

পুষ্প নিদ্রের দিকে তাকালেই নিদ্র বলল
– খুব ভালোবাসি তোমায়।

পুষ্প গাড়ির দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে আস্তে করে বলল
– আমিও।

তারপর তাড়াতাড়ি গাড়ির দরজা লাগিয়ে দিল গেটের ভিতরে এক দৌড়। নিদ্র ভাবেনি পুষ্প তাকে কোন উত্তর দিবে তাই সে পুষ্পের উত্তর শুনে অবাক হয়। কিন্তু পুষ্পের এই দৌড়ে পালানো দেখে হেসে দিল সে।

🌺

চলবে………..