পুষ্পের নিদ্র পর্ব-০৬

0
302

#পুষ্পের_নিদ্র
#আনআমতা_হাসান
পর্ব : ৬

ট্রিং ট্রিং করে রিং হয়ে কেটে গেল। আবার ফোন করলো পুষ্প। এবারও রিং হয়ে কেটে গেল। ওপাশের ব্যাক্তিটির ফোন রিসিভ করার যেন কোন ইচ্ছাই নেই। বিরক্তি নিয়ে আবার ফোন করতেই ফোন রিসিভ করে ওপাশ থেকে একটা মিষ্টি মেয়েলি কন্ঠ বলল
– সরি দোস্ত। আফিসে কাজে একটু বিজি আছি।

– বিজি মানে আজকে সকালে তোর আসার কথা ছিল। আর তুই এই বিকেল বেলা বলছিস আফিসের কাজে বিজি আছিস।

– সরি দোস্ত আজকে আসতে পারবো না। আমি কালকে সকাল সকাল চলে আসবো।

– তোর আর আসতে হবে না।

বলেই রেগে ফোনটা কেটে। খুব রাগ হচ্ছে তার। আসুক কালকে রিমঝিমের বাচ্চা কথা বলবে না সে।

সাহানা ড্রয়িং রুম থেকে পুষ্পকে ডেকে বলল
– এই পুষ্প দেখে যা কে এসেছে।

পুষ্প রুম থেকে বের হয়ে ড্রয়িংরুমে যেতেই প্রথমে রিমঝিমকে চোখে পরে। মুখে দুষ্ট হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে সে। রিমঝিমকে সম্পূর্ণ ইগনোর করে হাসিমুখে রিমঝিমের মাকে জড়িয়ে ধরে বলল
– কেমন আছো আন্টি? এই মেয়েটাকে তোও ভুলেই গেছ।

রেনু পুষ্পের গালে হাত রেখে বলল
– মেয়েকে কেউ ভুলতে পারে পাগলি। বয়স হয়ে গেছে তো ঢাকা থেকে রাজশাহী জার্নি করতে কষ্ট হয় রে মা তাই আসতে পারি না।

রিমঝিম মুখে নকল অসহায় ভাব ফুটিয়ে বলল
– আমার দিকেও একটু তাকাস।

পুষ্প রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করল
– এখন এখানে কি করছিস তুই? তোর না অনেক কাজ। আজকে আসতে পারবিনা। কালকে সকালে আসবি।

রিমঝিম পুষ্পকে জোড়িয়ে ধরে বলল
– সরি জানু ওই টাকলা বস ছুটিই দিতে চায় না। জানিস কত কষ্ট করে ছুটি নিয়ে এসেছি জানিস। পুরো সাতদিনের। শুক্র শনি মিলে নয় দিনের।

পুষ্প কপাল কুচকে বলল
– কেন করিস এই বদ লোকের জব।

রেনু অভিযোগ করে বলল
– মানুষ ঢাকাতে জব করতে চায়। আর ও ঢাকার এতো ভালো জব পেয়েও রাজশাহীতে গিয়ে জব নিল।

রিমঝিম মনে মনে বলে, ‘মা আমি তোমাকে কিভাবে বুঝাবো ওখানেই যে আমার সব।’

সাহানাও রিমঝিমের মার কথায় সায় দিয়ে বলল
– হ্যাঁ রিমঝিম তুমি ঢাকাতে চলে এসো। রেনুও বয়স হয়েছে। ওখানে একা একা আর কতো।

রিমঝিমের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে পুষ্প কথা ঘুরানোর জন্য বলল
– বাকি গল্প পরে হবে। জার্নি করে এসেছো আগে গিয়ে তোমরা ফ্রেশ রেস্ট নিবে। চল চল রুমে চল।

🌺

সোফাতে বসে ফ্রেন্স ফাইড খাচ্ছে গল্প করছে দুই বান্ধবী পুষ্প আর রিমঝিম। আজ সারাদিন তারা ঘুড়ে বেড়িয়েছে। ঠিক যেমন অনার্সে পড়ার সময় দুই বান্ধবী মিলে রিকশায় করে ঝালমুড়ি খেতে খেতে পুরো শহর ঘুরতো। তাদের সব পছন্দের যায়গায় গিয়েছে। সন্ধ্যায় বাসায় এসেছে। ফ্রেশ হয়ে আবার ড্রয়িং রুমে বসে ফ্রেন্স ফাইড চিবাচ্ছে আর এতো দিনের জামানো কথা পেট থেকে বের করে একজন অন্যজনকে বলছে। অনার্স ফাস্ট ইয়ারে দুই বান্ধবীর পরিচয়। বেশিদিন না মাএ চারটা বছর তারা একসাথে ছিল। আর এই চার বছরেই তারা একজন অন্যজনের প্রানপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা নিজেদের জীবনের ছোট বড় সব কিছুই একজন অন্যজনকে শেয়ার করে। তাইতো তাদের গল্প শেষই হয় না। তাদের গল্পের মাঝেই কলিংবেল বেজে উঠে। পুষ্প উঠে দাঁড়ানোর আগেই রিমঝিম পুষ্পকে বলল
– তুই বস আমি খুলে দিয়ে আসি।

পুষ্প আর উঠে না। রিমঝিম গিয়ে দরজা খুলে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটিকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ ছলছল করে উঠে। হাত-পা কাপতে থাকে। কম্পনরত ঠোঁট দুটো হালকা নেড়ে বলল
– হিমরাজ।

তার সামনের দাঁড়িয়ে থাকা পল্লবও অবাক হয়ে তার দিকে স্থীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি যার থেকে দূরে থাকার জন্য সে এতো বছর নিজের পরিবার-পরিজন ছেড়ে দেশের বাহিরে ছিল। দেশে আসতে না আসতেই তার সাথেই দেখা হবে। স্থীর দৃষ্টিতে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে তাদের তৃষ্ণার্ত চোখ গুলোর তৃষ্ণা মেটাতে থাকে।

অনেকক্ষণ হয়ে গেছে রিমঝিম দরজা খুলতে গেছে কিন্তু এখনো আসছেনা। তাই পুষ্প উঠে দেখতে যায়। দরজার সামনে যেতেই পুষ্প দেখে তার ভাই দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। সাড়ে ছয় বছর পর নিজের ভাইকে দেখে পুষ্প একপ্রকার চিল্লিয়ে বলে উঠলো
– ভাইয়া। মা দেখ ভাইয়া এসেছে।

বলেই দৌড়ে গিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিল। পল্লবও ছলছল চোখে মিষ্টি হেসে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল
– আমার বনুটা কতো বড় হয়ে গেছে। এই বনু কান্না থামা। এতো কাদে না।

পুষ্প পল্লবের বুক থেকে মাথা তুলে অভিমানী কন্ঠে বলল
– এতো দিনে তোমার বনুর কাছে এসতে ইচ্ছা হলো। তুমি খুব খারাপ ভাইয়া। আমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছ।

– জানিতো ভাইয়া খুব খারাপ, সার্থপর। এই খাবাপ ভাইটাকে এবারের মতো ক্ষমা দে। এই দেখ কানে দরছি।

পল্লব কথাগুলো বলে বাম হাত দিয়ে বাম কানে ধরে।
পুষ্প আর পল্লবের কথা শুনে রিমঝিম দ্বিতীয়বারের মতো অবাক হয়ে যায়। সে জানতো পুষ্পের একটা বড় ভাই আছে। যে বিদেশে চলে যায় পিএইচডি করতে। কিন্তু পিএইচডি শেষ হলেও দেশে আসেনি। সবাই বলার পরও দেশে আসেনি। ওখানেই থেকে গেছে। পুষ্পের মুখে এতোটুকু শুধু শুনেছে সে। তাহলে এই পুষ্পের সেই ভাই। পুষ্প পল্লবকে সব সময় ভাইয়া বলেই সম্বোধন করতো। তাই পল্লবের নামটা জানা হয়নি তার। আর সেও পল্লবকে হিমরাজ বলে ডাকে। তাই পুষ্পও হিমরাজের আসল নামটা জানতো না। সাহানা আর রেনু রান্নাঘরে গল্প করতে করতে রান্না করছিল। পুষ্পের কথা স্পষ্ট না শুনতে পেলেও পুষ্পের চিল্লানি শুনে দুজনেই রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসে। দরজার সামনে এসে সাহানা ছেলেকে দেখেই কান্না করে দেয়। ছেলের কাছে গিয়ে ছেলে জড়িয়ে ধরে আবার কান্না করে দেয়। আবার ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে ছেলের মুখে হাত বুলিয়ে দেয়। আবার পরক্ষণেই দুই হাত দিয়ে ছেলের দুই গাল দরে কপালে চুমু খায়। সাড়ে ছয় বছর পর ছেলেকে পেয়ে তিনি যেন পাগল প্রায় হয়ে গেছে।

🌺

ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে। সন্ধ্যা হলেই বাহিরে কুয়াশার চাদরে সব ডেকে যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টেনে কুয়াশাদের মধ্যে সেই ধোঁয়া ছেড়ে দিচ্ছে পল্লব। চোখে ভাসছে রিমঝিমের মুখ। তার অবুঝ নাবালিকা বউটা আজ পরিণত নারী। সেই নাবালিকার মায়াবী মুখটি দেখেই নিজেকে সামলানো তার জন্য কষ্টকর হয়ে যেত। এখন এই সুন্দরী রমনী তার সামনে সারাদিন ঘুরঘুর করলে কিভাবে সামলাবে সে নিজেকে। দরজা খোলার শব্দে পিছনে ফিরে সে। এতো রাতে নক ছাড়া তার রুমে কে এসেছে তা দেখার জন্য রুমে ঢুকেই স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সে। সে কখনো ভাবতেই পারেনি রিমঝিম এতো রাতে তার রুমে আসবে। রিমঝিম গুটিগুটি পায়ে এসে পল্লবের সামনে দাঁড়ায়। তার দৃষ্টি স্থীর পল্লবের মুখের দিকে। চোখ দিয়ে ঝড়তে লাগলো নোনা জল। পল্লবের দিকে তাকিয়ে অপরাধীর কন্ঠে বলল
– সরি হিমরাজ। প্লিজ আমাকে এভাবের মতো ক্ষমা করে দেও। কথা দিচ্ছি আর কখনো তোমাকে অবিশ্বাস করবোনা।

পল্লবের খুব কষ্ট হচ্ছিল। খুব ইচ্ছে করছিল রিমঝিমের চোখের জল মুছে তাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিতে। কিন্তু না যে মানুষটা তাকে নূন্যতম বিশ্বাশ করে না। তার প্রতি সে আর দুর্বল হবে না। মুখ ঘুড়িয়ে বিরক্ত নিয়ে বলল
– এতোরাতে একটা ছেলের রুমে আসতে লজ্জা করে না আপনার মিস রিমঝিম।

রিমঝিম অবাক হয়ে বলল
– একটা ছেলে মানে! তুমি আমার স্বা ,,,,,,,,,

রিমঝিম কথাটা শেষ করার আগেই পল্লব তার দিকে তাকিয়ে রাগী কন্ঠে বলল
– সেই সম্পর্ক অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে মিস রিমঝিম। এখন আমার কাছে আপনি শুধুই আমার বোনের বান্ধবী। এর বেশি কিছু না। আর আমার বোনের বান্ধবীকে মাঝরাতে কেউ আমার রুমে দেখে উল্টো পাল্টা কিছু ভাবুক তা আমি চাই না। সো প্লিজ লিভ।

রিমঝিম আসহায় কন্ঠে বলল
– হিমরাজ ,,,,,

রিমঝিমের মিষ্টি কন্ঠে বারবার হিমরাজ ডাকটা শুনলে সে দুর্বল হয়ে যায়। নিজের দুর্বলতা যাতে প্রকাশ না পায় তাই আরো রাগ দেখায়। রাগে দাতে দাত চেপে বলল
– স্টপ কলিং মি হিমরাজ। আই আম নট ইউর হিমরাজ। আই এম পল্লব। পল্লব চৌধুরী। নাও প্লিজ গো।

রিমঝিম কান্না জড়িত কন্ঠে বলল
– হিমরাজ প্লিজ ,,,,,,

রিমঝিমকে আর কিছু বলতে না দিয়ে পল্লব রিমঝিমের হাত দরে টেনে তাকে রুমের বাহিরে বের করে দরজা লাগিয়ে দেয়। রিমঝিম দরজা ধাক্কাও দিতে পারছে না। যদি অন্য কেউ শব্দ পেয়ে দেখতে চলে আসে। রিমঝিম চোখের পানি মুছতে মুছতে রুমের দিকে পা বাড়ানোর আগেই একটা ছাড়া মূর্তি সেখান থেকে চলে যায়।

🌺

চলবে………..