#পুষ্পের_নিদ্র
#আনআমতা_হাসান
পর্ব : ৭
ডাইনিং টেবিলের উপর সাজানো রয়েছে বাসমতী চালের ভাত, মুরগির রোস্ট, বেগুন ভাজি, পোড়া বেগুনের ভর্তা, বড় চিংড়ি ভাজা, ছোট চিংড়ি দিয়ে পাতাকফি ভাজি, মিস্টি লাউ ভাজি, ইলিশ মাছ ভাজি, ডিমের ভুনা, ঘি’য়ে ভাজা আলুর ভর্তা, সালাত, মিষ্টি আর পায়েস। খাবার টেবিলে রাখা এতো আইটেমের মধ্যে পল্লবের চোখ দুটো পোড়া বেগুন ভর্তা আর ঘি’য়ে ভাজা আলুর ভর্তা দিকে যেতেই তার প্রথম যেদিন এই দুটো ভর্তা খেয়েছিল সেই দিনটির কথা মনে পড়ে যায়।
দিনটি ছিল মে মাসের পনেরো তারিখ,
ভরদুপুর বেলা। হিংসুটে সূয্যিমামা নিজের সর্বত্র দিয়ে পৃথিবীতে নিজের উত্তাপ বর্ষন করছে। হিংসুটে সূয্যিমামা উত্তাপে ঘামগ্রন্থী থেকে নির্গত হচ্ছে ঘাম। মূখে আমাবস্যার আধার নিয়ে প্রসস্থ পিচ ডালা রাস্তার পাশের যাএী ছাওনির নিচে চিন্তিত মনে গালে হাত দিয়ে বসে আছে সপ্তদশী রিমঝিম। হঠাৎ একটা কন্ঠস্বরে পাশ থেকে বলল
– কি বেপার আজকে রিমিঝিমি বৃষ্টির পরিবর্তে আকাশ মেঘলা যে।
রিমঝিম পাশে তাকিয়ে দেখে মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পল্লব। রিমঝিম গাল থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল
– চিন্তায় আছি।
পল্লব রিমঝিমের পাশে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসে জিজ্ঞেস করল
– আচ্ছা। তা কি নিয়ে এতো চিন্তা এই অধমকে কি তা জানতে পারে?
– হায়ারম্যাথের একটা ম্যাথ কিছুতেই মাথায় ডুকছে না। ব্রেক টাইমে ম্যামের কাছে গিয়ে আবার বুঝে এসেছি। তারপরও হচ্ছে না। এদিকে কালকে ওই ম্যাথটার উপর এক্সাম।
– আমি কি একবার ট্রাই করতে পারি?
– হুম্ম।
রিমঝিম ব্যাগ খুলে ম্যাথ খাতাটা বের করে পল্লবকে দেয়। পল্লব কিছুসময় ম্যাথটা দেখে ভাবে সহজ কোন ভাবে রিমঝিমকে বুঝানো যায়। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে রিমঝিমকে পুরো ম্যাথটা খুব সুন্দর করে সহজ করে বুঝিয়ে দেয়। ম্যাথটা বুঝানো শেষ হলে রিমঝিম হাসি মুখে বলল
– এতোওওওওগুলো ধন্যবাদ হিমরাজ।
– ইটস মাই প্লেজার,,,,,,,,
গুরুমমমমম। পল্লবের কথার মাঝ পথেই ওর পেট থেকে আওয়াজ আসতে থাকে। শব্দ শুনে রিমঝিম গোল গোল চোখ করে তাকায় প্রথমেই শব্দের উৎস অর্থাৎ পল্লবের পেটের দিকে তারপর পল্লবের দিকে। রিমঝিমকে এভাবে তাকাতে দেখে মাথার পিছনে চুলকাতে-চুলকাতে কিছুটা লাজুক ভজ্ঞিতে পল্লব বলল
– আসলে পড়তে পড়তে কালকে রাতে খাওয়ার কথা ভুলে গিয়েছি। আর সকালেও এক্সামের জন্য সময় করে উঠতে পারিনি। তাই,,,,,,,,,।
– আমার কাছে ভাত আছে খাবে?
– তুমি খাওনি?
– না ম্যামের কাছে ম্যাথ বুঝতে বুঝতে আর খাওয়ার টাইম পাইনি।
– তা বললে হবে না। ঠিক টাইমে খাবার না খেয়ে অসুস্থ হয়ে যাবে।
– ওহ তাই। আর নিজে যে কালকে রাত থেকে না খাওয়া। তার বেলায়।
– তুমি ছোট তাই তোমার খাওয়া প্রয়োজন।
– তোমার তো বেশি খুদা লেগেছে। তাই তোমার খাওয়া প্রয়োজন।
– আমি আশেপাশের কোন হোটেল থেকে খেয়ে নিবো।
– না। এতোক্ষণ দরে না খাওয়া। তোমাকে এখন ওইসব আনহায়জেনিক খাবার এখন খেতে হবে না। তুমি এটা খাও।
পল্লব আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল আর আগেই রিমঝিম বলল
– আমি কিন্তু খুব রাগ করবো এখন তুমি না খেলে।
– আচ্ছা চল আমরা দুজনই ভাগ করে খাই। কিন্তু এখানে কিভাবে খাবো? চল মাঠের ওইখানে এই দুপুরে এখন মানুষ হবে না।
– আচ্ছা।
রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে মিনিট পাঁচেক পর মাঠে পৌছায় রিমঝিম আর পল্লব। পাঠের পাশে একটা পুরোনো আম গাছ আছে। সেই গাছের ছায়ার নিচে গিয়ে বসে দুজন। রিমঝিম ব্যাগ থেকে একটা মাঝারি সাইজের হটপট বের করে। হটপটে খুলতে নাম না জানা এক খাবারের সুশাদ্য খারাপ গন্ধ নাকে আসে পল্লবের। রিমঝিম হটপটের উপরের ছোট বাটিটায় অল্প কিছু ভাত আর ভর্তা দুটো থেকে অল্প অল্প ভর্তা নিজের জন্য রাখে। বাকিটা পল্লবকে দিয়ে দেয়। পল্লব খাবারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
– এগুলো কিসের ভর্তা?
রিমঝিম মিষ্টি হেসে আগুল দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে উত্তর দিল
– এটা ঘি’য়ে ভাজা আলুর ভর্তা। আর এটা পোড়া বেগুনের ভর্তা। আসলে আম্মু কালকে একটু ব্যস্ত ছিল। তাই আমি রান্না করেছি। আর আমি ভাত, ভর্তা, ডিম ভাজি আর ডাল ছাড়া কিছু রান্না করতে পারিনা। তাই এগুলোই সকালে রান্না করেছি। তুমি কখনো এগুলো খাওনি?
এমনেই পেটে খুদাত ইদুর দৌড়াচ্ছে। তার উপর খাবেরের এতো সুগান্ধে পল্লব আর দেরি করতে পারে না। আলু ভর্তা দিয়ে ভাত মেখে এক লোকমা খাওয়া মুখে পুরে দেয়। আলুর ভর্তাও যে এতো টেস্টি হয় তা আজও জানলো। দ্বিতীয় লোকমা মুখে দিতে দিতে বলল
– আমি আলুর ভর্তা খেয়েছি বাট এতো টেস্টি আলুর ভর্তা কখনো খাইনি।
– বেগুনের ভর্তাটা খাও। সবাই বলে আমার হাতের বেগুন ভর্তা নাকি অনেক টেস্টি।
পল্লব বেগুন ভর্তা দিয়ে ভাত মেখে মুখে দেয়। পর পর দুই লোকমা ভাত খেয়ে বলল
– আহ ঠিক যেন অমৃত।
——————
তারপর থেকেই মাঝে মাঝে রিমঝিমকে ভাত, পোড়া বেগুনের ভর্তা আর ঘি’য়ে ভাজা আলুর ভর্তা তার জন্য রান্না করে নিয়ে আসতে বলত। কতো সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো। সেই আমগাছে নিচে বসে একসাথে খাওয়া। একজন অন্যজনকে খাইয়ে দেওয়া। পল্লবের ধ্যান ভাংগে তার মার কথায়। সাহানা বেগম পল্লবকে বলল
– তোকে বেগুনের ভর্তা দেই। রিমঝিম মার হাতের বেগুনের ভর্তা অনেক ভালো। খেয়ে দেখ।
পুষ্প ও মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে বলল
– হ্যাঁ ভাইয়া রিমঝিমের হাতে জাদু আছে। খেয়ে দেখ একবার। আহা বারবার খেতে ইচ্ছা করবে।
কথাটা শুনেই পল্লব আড় চোখে রিমঝিমের দিকে তাকায়। লজ্জায় মাথা নত করে চুপচাপ খাচ্ছে। খাওয়ার খুব ইচ্ছা থাকলেও কুটিল মস্তিষ্কের প্ররোচনায় ভর্তা নেয় না। উল্টো মাকে বলল
– এসব ভর্তা-টর্তা খাবো না মা। ছোট চিংড়ি দিয়ে পাতাকফি ভাজি দেও।
সাহানা বেগম প্লেটে মাংস দিলে পল্লব খাওয়া শুরু করে। এতোবছর বাহিরে থাকায় ঘরের রান্না এসব খাবারগুলো খুব মিস করেছে পল্লব। রান্নাটাও খুব ভালো হয়েছে। পল্লব কোন কথা না বলে তৃপ্তিসহ খাচ্ছে। জাহানারা বেগম জিজ্ঞেস করল
– রান্না কেমন হয়েছে?
পল্লব খেতে খেতেই উত্তর দিল
– হুম্ম, যাস্ট অসাধারণ।
সাহানা বেগম খুশি হয়ে বলল
– রিমঝিম মায়ের হাতের রান্নার মাসাল্লা অনেক ভালো। জানিস তো মেয়েটা সেই ভোর থেকে এই সব কিছু রান্না করেছে।
পল্লবের খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ও ভেবেছিল রিমঝিম শুধু ভর্তা দুটো বানিয়েছে। ও এখনো অন্য কোন রান্না করতে পারেনা। তাই ভর্তা না নিয়ে মাংস নিয়েছে। পল্লব চোখ তুলে রিমঝিমের দিকে তাকায়। রিমঝিম তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নেয়। আর কোন কথা না বলে চুপচাপ অল্প খেয়ে উঠে যায়। না খেয়েই উঠে যেত কিন্তু এতে তার মা কষ্ট পেলে। এতোদিন পর সে বাড়িতে এসেছে বলে তার মা তাকে নিজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেড়ে খাওয়াচ্ছে। রিমঝিম বেপারটা বুঝতে পারে। তার চোখ থেকে একফোঁটা জল পরে। ও লুকিয়ে তা মুছে ফেলে। ভেবেছে কেউ দেখেনি। কিন্তু একজোড়া চোখ যে তাদের সব খুটিনাটি এতক্ষণ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিল তা তারা কেউ জানে না।
🌺
চলবে………..