প্রণয়ী পায়রা পর্ব-০১

0
1299

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| সূচনা পর্ব |

আরোরা কে পাত্রপক্ষ দেখতে আসলে, আরোরা পাত্রকে বারণ করায় সেই পাত্রের বন্ধুগণ আরোরার ভার্সিটি এসে আরোরাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার একপ্রকার হুমকি দেয়। আরোরা তাদের দিকে অগ্নিময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। রাগে রীতিমতো তড়তড় করে কাঁপছে আরোরা। বন্ধুগণের মধ্যে প্রথমজন তটস্থ গলায় বলে উঠলো,

-‘ইয়ামিনকে তুমি অপছন্দ করলেও ইয়ামিন তোমায় পছন্দ করেছে। তাই কোনোরূপ দ্বিরুক্তি না করে রাজি হয়ে যাও। এতে তোমারই মঙ্গল। ইয়ামিন বলেছে তোমার কোনরকম বানোয়াট কাহীনি বা এক্সপ্লেইন না শুনতে। রাজি হও নয়তো আমরা আমাদের আঙুল বাঁকাতে বাধ্য হবো!’

ছেলেটা এরূপ কথায় আরোরার পিলে চমকে উঠলো। আরোরা তীর্যক দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে কাঠ কাঠ গলায় বলে ওঠে,

-‘মামা বাড়ির আবদার পেয়েছেন? আমি কারো খরিদ করা সম্পদ নই, আমার নিজস্ব স্বাধীনতা আছে। এখানে আপনার বন্ধুর কোনো অধিকার নেই আমার স্বাধীনতায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ানোর।’

-‘ইয়ামিন পারে না এমন কিছু নেই!’

-‘মহা ঝামেলা তো আপনারা। আপনারা যাবেন? এসব হুমকির কোনো মানে হয় না, এখানে পড়তে এসেছি, নাটক দেখতে নয়। জাস্ট লিভ! নয়তো টিচারদের ডাকতে আমি বাধ্য হবো!’

আরোরার উক্তিতে ছেলেগুলো অট্টহাসি দিয়ে ওঠে, যেন আরোরা জোক্স শুনিয়েছে তাদের। ছেলেটি বিদ্রুপের সুরে বলে,

-‘কী করবে তোমার ওই স্যার’রা?’

-‘অনেক কিছু। ওয়ান্স মোর, আপনাদের বি নেগেটিভ মার্কা হুমকিতে এই আরোরা ভয় পায় না। সো, স্টে ফ্রম এওয়েএ!’

ছেলেগুলোর মেজাজ যেন তুঙ্গে উঠলো। রাগে গিজগিজ করতে করতে একজন যেই আরোরার হাত স্পর্শ করবে তৎক্ষনাৎ কেউ ছেলেটির হাত মোঁচড়ে আরোরার সামনে এসে দাঁড়ালো। আগন্তুকটির পারফিউমের ঘ্রাণটি আরোরার পূর্ব পরিচিত! আরোরা আবেশে চোখ বুজে ফেললো। অতঃপর কী মনে করে সামনে তাকালো এবং ঘটনা বোঝার প্রচেষ্টা চালালো। আগন্তুকটি ছেলেটির হাত আরেকটু মোঁচড়ে বলে উঠলো,

-‘এটা ভার্সিটি ডিয়ার! বাহিরের মানুষ হয়ে এখানে মাতলামি করা চলবে না। ভার্সিটির ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করার অধিকার কেউ তোমায়, আমায় দেয়নি! তাও সুন্দরভাবে বলছি এই মুহূর্তে এখান থেকে বের হ নয়তো সিকিউরিটি দিয়ে…’

কাঠ কাঠ গলায় বলে ফায়ান। আরোরা এতটাই ধ্যানে আছে যে তার অধর জোড়ার মাঝে কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে যায়। ফায়ান লোকটির হাত ছেড়ে আরোরার দিকে ফিরলো। ফায়ানের সরু দৃষ্টি আরোরার চোখে পরতেই তার হৃদস্পন্দন দ্রুত গতিতে স্পন্দিত হতে শুরু করলো। ভেতরটায় কেমন ঢিপ ঢিপ শব্দ হচ্ছে। ফায়ানের বলা উক্তি আরোরার মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হতেই আরোরার ধ্যান ভাঙলো।

-‘তুমি ঠিক আছো?’

আরোরা ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি ফায়ানের দিকে নিক্ষেপ করেই হ্যাবলার মতো মাথা নাড়ায়। ছেলেটা তার হাত কচলাতে কচলাতে আবারও চিৎকার দিয়ে ওঠে,

-‘কে তুমি মিয়া? তুমি জানো আমরা কার লোক? তোমার…’

ছেলেটার কথায় ফোড়ন কেটে ফায়ান তার দিকে ফিরে বলে উঠলো,

-‘সেই পরিচয় আমি দিতে ইচ্ছুক নই। তোমাদের এখানে থাকার সময় দেয়া হয়নি! সিকিউরিটি! এই ভেঁজাল মানুষদের বের করুন। খামাখা ডিসিপ্লিন নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না!’

কয়েকজন সিকিউরিটি তৎক্ষনাৎ আসলো। হাত মোঁচড়ানোর ছেলেটি অগ্নিময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আরোরার দিকে। আরোরা সেটা লক্ষ্য করে ফায়ানের পিছে লুকালো। অতঃপর ওরা কোনোরূপ ঝামেলা না করেই বেরিয়ে গেলো। তখন আশেপাশের সকলের দৃষ্টি ওদের দিকেই। ওরা চলে যেতেই ফায়ান আবারও আরোরার দিকে ফিরলো এবং তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্ষীণ গলায় বলে ওঠে,

-‘আর যেন না দেখি তোমার কারণে কোনোরকম ঝামেলা হয়েছে! তোমাকে সিকিউরিটি দেয়ার জন্য আসিনি আমি স্টুপিড!’

আরোরা বিভ্রান্তিতে পরে মাথা নিচু করে ফেলে। ফায়ানের উক্তিগুলোতে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ ছিলো। বুঝলো আগেরদিন তার ভুল ছিলো, আজ তো সে কোনো ভুল করেনি। লোকগুলো কে তো আর নিমন্ত্রণ করে আনেনি। আরোরা ফায়ানের বিপক্ষে কিছু বলার প্রস্তুতি নিলো। যেই মুখ খুলবে ফায়ান তার পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আরোরা আশ্চর্যান্বিত হয়ে পিছে ফিরলো। আরোরা যেন মুহূর্তের জন্য বাক্যহারা হয়ে গেলো। এমন অদ্ভুত কেন উনি? এই ভালো আবার মুহূর্তেই আগুন চড়ে তার মাথায়। আরোরা বিড়বিড় করে বললো,

-‘হ্যান্ডসাম স্যারদের এতো রাগ মানায় না। পুরোই বি পজেটিভ থুক্কু নেগেটিভ মার্কা রাগ!’

আরোরা তার ব্যাগের জন্য ক্লাসের দিকে যাওয়া ধরলেই কোথা থেকে আরোরার কাজিন আরিশা ছুটে তার দিকেই আসতে লাগলো। আরিশার হাতে আরোরার ব্যাগ। আরিশার পিছে পিছে রুহানও আসছে। আরোরা ওদের দেখে কোনোরূপ রিয়েকশন না করে সে উল্টোপথে হাঁটা দিয়ে মাঠের বর্হিভাগের বাগানে চলে গেলো। একটি কৃষ্ণচূড়া গাছে অবস্তনের সবুজ ঘাসে আবৃত স্থানে বসে পরে। আরোরার দৃষ্টি ভবঘুরে। তার মাথায় রাজ্যের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। ইয়ামিনটা দিনদিন তার জীবনে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হচ্ছে। বিপদ সংকেত যেন খুব শীঘ্রই ৮ পেরিয়ে ৯,১০ এর চাইতেও বেশি পর্যায়ে যেতে পারে। তার অক্ষিকাচে ভেসে উঠলো দু’দিন আগের অতীতের চিত্র।

আরোরা ভার্সিটি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো তখনই তার মা অনন্যা হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করে এবং আরোরাকে হঠাৎ জানায়,

-‘আজ ভার্সিটি যাওয়া লাগবে না। পাত্রপক্ষ আসবে, তোর বাবা তাদের ইনভাইট করেছেন। সেই হিসেবে তোকেও নাকি দেখবেন। যদি পছন্দ হয় আজই তোর এঙ্গেজমেন্ট হয়ে যাবে!’

আরোরা আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মায়ের মুখশ্রীতে। অন্তঃপুরে সে বিবাহের জন্যে একদমই প্রস্তুত নয়। মুহূর্তেই আরোরা খানিকটা বেসামাল হয়ে পরলো। তবে তার ভেতরের খুঁচখুঁচানি বহিঃপ্রকাশ করলো না। সে বরাবরই পরিবারের বাধ্য মেয়ে। বড়দের মুখের উপর কখনোই কথা বলেনি। তাই কোনো রকমে অধর জোড়ায় কৃত্রিম হাসি ফুটালো। অনন্যা মেয়ের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বেরিয়ে গেলো মেয়ের জন্য নিজের একটি শাড়ি চয়েস করতে। এদিকে আরোরা অন্তরালে নানান দ্বিধা – দ্বন্দ্বে ভুগছে। কী হবে, কী হবে? যদি সত্যি সত্যি-ই পাত্র তাকে পছন্দ করে ফেলে তাহলে সে একটা অপ্রস্তুত সম্পর্কের মাঝে আটকে পরবে, সম্পূর্ণ নতুন, অচেনা একজন মানুষের সঙ্গে। সেই নতুন মানুষটার অবশ্যই তার উপর অধিকারবোধ থাকবে। সেই অধিকারবোধ হয়তো পরিবারের চেয়েও বেশি। আরোরা আপাতত স্বাধীন থাকতে চায়। আলাদা করে কারো জোর খাটানো, আদেশ-নিষেধ.. এটা কিছুতেই সে মানতে পারছে না। কানে ঝুমকা লাগিয়ে সে বিধ্বস্ত দৃষ্টিতে জানালার সোনালী পর্দার দিকে তাকালো। দমকা হাওয়ায় পর্দাগুলো অসমান্তরাল ভাবে উড়ছে। আপাতত আরোরার দৃষ্টি সেখানেই নিবদ্ধ।

আরোরার ভাবনার মাঝেই কলিংবেলের আবছা শব্দ তার কর্ণধারে প্রবেশ করলো। আরোরা তপ্তশ্বাস ফেলে মাথায় ঘোমটা টানলো। মিনিটখানেকের মাঝেই অনন্যা মেয়ের ঘরে প্রবেশ করলো। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলে,

-‘আরোরা? তৈরি হয়েছিস? এখন আয়, তোর বাবা তোকে নিয়ে যেতে বলেছে।’

আরোরা নিষ্প্রভ চাহনি নিক্ষেপ করে অধরে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে কণ্ঠধ্বনি নিচু করে বলে,

-‘চলো!’

সেদিন প্রথমবারের মতো বৈঠকঘরে আরোরা ইয়ামিনের মুখোমুখি হয়েছিলো। ইয়ামিন প্রথম দেখাতেই তার সকল বিরক্তি ভালো লাগায় পরিণত হলো। পুরোটা সময় অবলীলায় তাকিয়ে ছিলো আরোরার শুভ্র মুখশ্রীতে। বড়দের কথার মাঝে আরোরা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলো এই অচেনা মানুষটির দৃষ্টি। আরোরা তার শাড়ির আঁচল খামচে বারংবার অবিন্যস্ত দৃষ্টি বুলাচ্ছিলো চারদিকে। তার অস্বস্তির সীমাও যেন পেরিয়ে গেছে। ফ্যানের কৃত্রিম হাওয়াতেও সে অনবরত ঘামছিলো। নিজের ঘর্মাক্ত কপালে বারংবার আঁচলের বিচরণ চালিয়েছে সে।

যখনই কথাবার্তা পাকা হবে তখনই আরোরার বড় ভাই আইমান প্রবেশ করে বৈঠকঘরে। আইমান ইয়ামিনের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে সকলের দিকে চোখ বুলালো। অতঃপর পাত্রপক্ষ মানে ইয়ামিনদের উদ্দেশ্যে জানায়,

-‘আমরা আমাদের মূল্যবান সিদ্ধান্ত কাল জানাবো!’

আইমানের থমথমে গলার সিদ্ধান্তে মুনীব অর্থাৎ আরোরার বাবা এবং মা খানিকটা তটস্থ হলেন। তাও ছেলের মতামতের অমতে না গিয়ে সম্মতি জানালেন। আরোরা ভেতরে ভেতরে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো এবং তার প্রিয় ভাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দিলো। আরেকটু হলে তার দেহ থেকে রূহ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হতো। ভাগ্যক্রমে আইমান এসেছিলো, নয়তো পরবর্তী সময়ের জন্যে সে ভাবশূন্য হয়ে যাচ্ছিলো।
ইয়ামিনরা হালকা খাওয়া-দাওয়া করে বিদায় নিলেন।

———

-‘কীরেহ আরু? কোথায় হারালি? আমাদের ফেলে এভাবে এখানে আসার মানে কী?’ হাঁপানো কন্ঠে বলে ওঠে আরিশা।
আরিশার কথায় আরোরা বাস্তবে ফিরে এবং উপস্থিত ঘটনা সামলে উঠতে পারে না।
আরোরা নিজেকে সামলে ওদের অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় এবং বলে,

-‘যারা ফ্রেন্ডের বিপদে অনুপস্থিত থাকে তাদের সাথে কথা বলার মতো সামান্যতম ইচ্ছেও আমার নেই!’

রুহান আরিশার মাথায় গাট্টা মেরে বিধ্বস্ত গলায় বলে,

-‘সব এই মেয়ের দোষ! কতক্ষণ ধরে ওয়াশরুম বসে ছিলো ভাইরে ভাই! আমার তো কোমড় ধরে গেছে এর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে! মনে তো হচ্ছে ওয়াশরুমের সাথে রিলেশনশিপে গেছিলো।’

-‘তুই চুপ কর! আমি তো মেকআপে বিজি ছিলাম! তুই কেন সবসময় আমার আর মেকআপের মধ্যে কাবাবের হাড্ডি হবি? এর জ্বালাতনে আমি মেকআপও ঠিকমতো করতে পারি না!’

আরোরা ওদের অভিযোগে কর্ণধারে না নিয়ে লাইব্রেরী যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়। কারণ, এই সময়ে ফায়ান লাইব্রেরিতে বইয়ের মাঝে ডুবে থাকে।

~চলবে, ইনশাল্লাহ।