প্রণয়ী পায়রা পর্ব-০২

0
875

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ০২ |

জনমানবহীন লাইব্রেরিতে নিঃশব্দে প্রবেশ করলো আরোরা। বিশাল লাইব্রেরিতে দৃষ্টি বুলাতে বুলাতে সোহরাব ফায়ানকে খুঁজতে লাগলো সে। উনি হচ্ছেন একজন ইংলিশ লেকচারার! জয়েন করেছে তিন মাস হলো। ফায়ান আমেরিকা তার ফুল ফ্যামিলির সাথে থাকতো বলে শোনা যায়। তার চেয়েও বড় কথা ফায়ান সংসদ সদস্য ইকবালের ভাইপো। তাও ফায়ানের মাঝে তাকে নিয়ে আহামরি কিছু লক্ষ্য করা যায় না। সে ভিষণ শান্ত প্রকৃতির। তার ভেতরকার রাগ হয়তো আরোরা সেদিনই প্রথম দেখেছে। সেদিনের পর থেকে আরোরা ফায়ানকে বড্ড ভয় পায়। ফায়ানকে দেখলেই দূরে দুরে থাকে। যদি কখনো ভুলবশতও ফায়ানের মুখোমুখি হয় আরোরা তাকে সালাম দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে আসে। ফায়ান এমনিতে শান্ত প্রকৃতির হলেও তার মাঝে আমেরিকান কালচার ভালোই লক্ষ্য করা যায়। চেহারাও হয়েছে তাদের মতোই। এমনও শোনা যায় ফায়ানের নানা নাকি আমেরিকান ছিলেন। সেই হিসেবে তার মায়ের গায়ের রং শুভ্র হলেও চেহারা পেয়েছে বাঙালি। সেই হিসেবে হয়তো ফায়ানও একইরকম। তবে তাকে কোনো আক্কেলে বোঝা যায় না সে বাঙালি। আরোরা তো তাকে নিকনেম দিয়েছে ‘এংগ্রি ইংরেজ!’ মিনিট খানেক হাঁটাহাঁটি করে আরোরা দেখলো মাঝামাঝি এক শেল্ফের সামনে বসে ফায়ান ইংলিশের কিছু নোবেল ঘাটাঘাটিতে ব্যস্ত। আঁখিতে তার গোল ফ্রেমের চশমা৷ আরোরা কিছুক্ষণ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ফায়ানের দিকে। লাইব্রেরিতে পিনপতন নীরবতা। এখন লাঞ্চ ব্রেক থাকায় সকলেই বাহিরে। লাইব্রেরিতে সে আর ফায়ান ব্যতীত কেউ নেই। লাইব্রেরিয়ানকেও দেখা যাচ্ছে না। আরোরার মস্তিষ্ক তাকে জানান দিলো এ-ই সুযোগ! যা বলার এখনই বলে কেটে পরতে হবে। আরোরা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো কয়েকবার। অতঃপর পা বাড়িয়ে এগিয়ে গেলো এবং ফায়ানের অপজিটে এসে দাঁড়ালো। ফায়ান কারো উপস্থিতি টের পেতেই মাথা উঁচু করে আরোরার দিকে তাকালো। চশমার কাচ ভেদ করে তার বাদামী তীক্ষ্ম দৃষ্টিপাত আরোরার বুঝতে অসুবিধা হলো না। মুহূর্তেই যেন সেই অক্ষির গভীরে হারিয়ে যেতে শুরু করলো সে। তার গভীরে হারানোর পূর্বেই ফায়ান তার দৃষ্টি আবারও বইয়ে নিবদ্ধ করলো। কোনোরূপ প্রশ্ন করলো না৷ ভাব এমন সামনের মানুষটির প্রতি তার কোনোরূপ আগ্রহ নেই। আরোরা বাস্তবে ফিরে শূন্য দৃষ্টিতে ফায়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো। গলা দিয়ে যেন কথা বের হচ্ছে না। কন্ঠনালিতে যেন ঘোর মরিচিকা ধরেছে। বহুক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়েও তার কণ্ঠধ্বনি তাকে কোনোরূপ সাড়া দিলো না। হতাশায় আরোরার মুখশ্রীতে আঁধার নেমে এলো।
ফায়ান বইয়ের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে,

-‘ক্লাস নেই? এভাবে বটগাছের মতো দাঁড়িয়ে কোন মহা কাজ করছো? কিছু বললে বলো নয়তো এখান থেকে বিদায় হও! তোমার জন্য আমার ডিস্টার্ব হচ্ছে!’

আরোরা এবার যেন সাড়া পেলো। ভেতর থেকে এক লম্বা নিঃশ্বাস আসলো। এ নিঃশ্বাস ফায়ানের বিপক্ষে বলার তীব্র ঝংকারের সংকেত। আরোরা পুণরায় নিঃশ্বাস ফেলে অপ্রসন্ন হয়ে বলতে লাগলো,

-‘আমি সেদিন ভুল করেছি মানি! তাই বলে আজ আমি কিছু করিনি৷ ওই লোকগুলো নিজেরাই এসেছে ঝামেলা বাজাতে। একটা মানুষ নিজ থেকে বিপদ ডেকে আনে না। তাই আপনার উক্তি মোটেই যুক্তি-যুক্ত নয়! কোনো কিছু চোখে দেখার আগে যাচাই করে নিতে হয়!’

এক দমে সবটা বলেই আরোরা ক্ষান্ত হলো। কথাগুলো বলে তার শান্তি লাগছে, প্রচু শান্তি। সে অন্তঃপুরে নিজেকে ‘ওয়েল ডান’ করলো এবং নিজের সাহসের জন্যে নিজেকে বাহবা দিলো। আরোরা এবার ফায়ানের দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করতেই দেখলো ফায়ান শান্ত ভঙ্গিতেই আরোরার দিকে তাকিয়ে। ফায়ানের কোনোরূপ পতিক্রিয়া না দেখে আরোরা বিস্মিত হলো। গোল গোল চোখে সে ফায়ানের চশমা ভেদ করে গভীর আঁখিপল্লবের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। কিছু বোঝার প্রচেষ্টা চালানোর পূর্বেই ফায়ান উঠে দাঁড়ায়! আরোরা ক্ষণেই নড়েচড়ে দাঁড়ালো। মুহুর্তেই খেয়াল করলো ফায়ান তার দিকে এগিয়ে আসছে। মনের মাঝে দোলা দেয় হাজারো আতঙ্ক। আরোরা শুকনো ঢোক গিলে পেছাতে শুরু করলো। স্থানটি কিছুটা ছোট হওয়ায় তিন কদমেই সে শেল্ফের সাথে লেপ্টে গেলো। ফায়ান এগোচ্ছেই। একসময় সে আরোরার কাছে এসে তার মুখের উপর কিছুটা ঝুঁকে গেলো। আরোরা সঙ্গে সঙ্গে চোখ-মুখ খিঁচে নিজের পরিহিত কুর্তির খানিক অংশ খামচে ধরলো। হঠাৎ তার ডান হাতে এক বইয়ের হালকা স্পর্শ পেলো। আরোরা চোখ মেলে হাতের দিকে তাকায়। ফায়ান কিছুটা দূরে অবস্থান করছে আর একটা হাতে থাকা বইটির পাতা উল্টাচ্ছে। আরোরার চোখে-মুখে সীমাহীন বিস্ময়ের ছাপ! সে সেখানেই মুর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রয়। অধর জোড়ার মাঝে মৃদু ফাঁক!
ফায়ানের কণ্ঠধ্বনি কর্ণধারে পৌঁছাতেই আরোরা বাস্তবে ফিরলো।

-‘আর কিছু বলার না থাকলে ক্লাসে যাও! এখানে থম মেরে দাঁড়ানোর মানে হয় না। জাস্ট লিভ!’

শেষোক্ত বাক্যটি রুক্ষ স্বরে বললো ফায়ান। আরোরা খানিকটা বেসামাল হয়ে মাথা নাড়ায়। অতঃপর একপ্রকার ছুটে বেরিয়ে এলো। লাইব্রেরি থেকে বের হতেই আরোরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এতক্ষণ যেন বাঘের খাঁচায় ছিলো সে। বারংবার তার বোকামির কথা মনে পরছে। কেমন বোকা সে! স্যারকে দেখে ওভাবে.. ছিঃ! কিসব ভুলভাল চিন্তা-ভাবনা! স্যার তো জাস্ট বই নিতে গেছিলো আর সে কী ভেবে নিলো? আরোরা নিজেকে কয়েক দফা বকে ক্লাসে চলে গেলো। ক্লাসে গিয়ে রুহান এবং আরিশার সাথেই বসলো। রাগটা সেই আতঙ্কের সাথে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। পুরো ক্লাসে আরোরার মাথায় লাইব্রেরির ঘটনাই চক্রের ন্যায় ঘুরঘুর করলো যার ফলস্বরূপ কোনো ক্লাসেই তার মন বসেনি। আরোরা নিজের প্রতি-ই বিরক্ত হয়ে গিয়েছে। বিরক্ত হয়েছে তার আজব ভাবনার ওপর। চরম বিরক্ত সে, চরম! ক্লাস শেষ করে তার বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে আরোরা বাড়ির পথে রওনা হলো।

———————————

-‘আহাম্মক! এতো ছোট একটা কাজ দিলাম আর তোরা সেটাই করতে পারলি না? তোদের বন্ধু বানিয়ে পাঠিয়েছি তাও পারিসনি? মাস শেষে বেতন গুলা আমি তাহলে কী হুদাই নদীতে ফেলছি? দূর হ তোরা!’ কর্কশ ধ্বনিতে হুংকার দিয়ে ওঠে ইয়ামিন।

-‘বস! আমাদের কাজ এগোচ্ছিলোই কিন্তু ভাবী মানতে চাইছিলো না!’

-‘তো ফোন দিতে পারলি না? আমি নিজে গিয়েই তুলে আনতাম!’

-‘আমরা তো চেয়েছিলাম নিজেরাই জোর করে নিয়ে আসবো কিন্তু…’

-‘কিন্তু কী?’

-‘একটা ছেলে আমাদের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। ওই হালার কারণে আরেকটুর জন্যে ভাবী হাত থেকে ফসকে যায়।’

-‘আমি তোদের বানোয়াট কাহীনিতে কান দিচ্ছি না। গেট আউট ফ্রম হেয়ার!’ ক্ষিপ্ত হয়ে বললো ইয়ামিন। তার লোকগুলো তাদের বসের রাগ দেখে কথা বাড়ায় না। দ্রুত রুম প্রস্থান করে। ইয়ামিন আরামদায়ক চেয়ারে হেলান দিয়ে ছোট কাচের গ্লাসের ওয়াইন নাড়তে নাড়তে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলো,

-‘প্রথম দেখাতেই তুমি আমার জেদে পরিণত হয়েছো আরোরা বিনতে মুনীব! আমি ভালোবাসার নয় জেদের অত্যন্ত কদর করি। তাই তোমায় আমি যেকোনো মূল্যে নিজের করেই ছাড়বো! আমার আর তোমার মাঝে যেই আসবে তাকে সেই মুহূর্তেই ওপারে পাঠিয়ে দিবো! বিকজ তুমি আমার সম্পদ!’

———-

নিস্তব্ধ চাঁদনী রাত। অর্ধ চন্দ্রের আশেপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে তুলো রাশির দম। শীতল হাওয়ায় নিমজ্জিত পরিবেশ। সারাদিনের উষ্ণ তাপটা রজনীর সঙ্গে নির্বিঘ্নে মিলিয়ে যাচ্ছে। এই সুন্দর মুহূর্তে আরোরা মুঠোফোন হাতে নিয়ে বেলকনির দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে। বারংবার আইমানের দেয়া লাস্ট মেসেজটা দেখছে সে। আইমান অফিসের কাজে অন্য শহরে গিয়েছে। আইমানকে ছাড়া সব কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। আইমান থাকলে ঝগড়াঝাঁটি অনবরত চলতো-ই। সারাদিনে রাত এবং সকালের ব্রেকফাস্টের সময়েই তো আইমানকে পায়! কিন্তু আজ? আজ রাতসহ কাল সকালের খাবার টেবিলেও আইমান থাকবে না। ফিরতে ফিরতে আগামীকাল বিকাল। আরোরার ইচ্ছে করছে ফোনের ভেতর গিয়ে আইমানকে ইচ্ছেমতো থাপ্পড় দিয়ে আসতে। বদ! অফিসের কাজ কী এতোই জরুরি? মুহূর্তেই আরোরার মনটা ছোট হয়ে গেলো। মনে পরে গেলো সেদিন রাতের কথা।

-‘মা! এই বিয়েতে কী আরোরার মত ছিলো?’

আইমানের উক্তিতে অনন্যা এবং মুনীব উভয়ই চুপসে গেলো। মুনীব অধর জোড়া প্রসারিত করে ভরাট গলায় বলে,

-‘ছেলে তো ভালো আইমান। পরিবারও বেশ ভালো!’

আইমান প্রত্যুত্তরে উত্তর দেয় না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আরোরার দিকে ফিরলো। আরোরা অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে আইমানের দিকে তাকিয়ে আছে। আইমান নরম স্বরে বললো,

-‘তুই কী বিয়েতে রাজি ছিলি?’

আরোরা মিইয়ে গিয়ে পদতলের নিকট দৃষ্টি স্থির করলো। আইমান আবারও প্রশ্ন ছুঁড়লো,

-‘আরোরা! আমি তোকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি!’

আরোরা বাবা-মায়ের দিকে একপলক তাকিয়ে সন্তপর্ণে আঁটসাঁট হয়ে বলে, ‘না!’
আইমান এবার বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

-‘তোমরা ওর বিয়ের জন্য উতলা হচ্ছো কেন বলো তো? আর বিয়ে যে দিবা ছেলেটার সম্পর্কে সামান্যতম খবর নিয়েছো? আমাকেও তো একবারও বলো নাই আরোরাকে কোনো পাত্র দেখতে আসবে! আচ্ছা মানলাম সময়ের অভাবে বলতে পারো নাই, তাই বলে ছেলেটার সম্পর্কে ভালো মতো খবর না নিয়েই বিয়ে পাঁকাপাঁকি পর্যন্ত চলে গেলা? আমি যদি সময়মতো না আসতাম তাহলে কী হতো ভাবতে পারছো?’

সবটি বাবা-মা মনোযোগ দিয়ে শুনলেও শেষোক্ত উক্তির মানে তারা বুঝলো না। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করে। মুনীব পুনরায় আইমানের দিকে তাকিয়ে বলে,

-‘মানে?’

-‘মানে ইয়ামিন একটা গুন্ডা! সব ধরণের খারাপ কাজের সঙ্গে লিপ্ত সে!’

——–

ফোনে টাইপ করতে করতে বাড়িতে প্রবেশ করলো ফায়ান। লিভিংরুমে খেয়াল হতেই দেখলো চাচী গালে হাত দিয়ে সদর দরজার দিকেই স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। ফায়ান একবার পিছে ফিরে তার ছোট মার দিকে এগোলো। এগোতে এগোতে বললো,

-‘চাচ্চুর জন্য বসে আছো?’

-‘হ্যাঁ! বিকালের দিকে কিছুটা অসুস্থ হয়ে গেছিলো। সন্ধ্যায় কোন পার্টির মিটিং এর ফোন এলো আর উনি তখনই দৌড়! এই এক পলিটিক্স এর পেছনে ছুটতে ছুটতে জীবন শেষ করে ফেললো! কী করি বলো তো তোর চাচাকে নিয়ে?’

-‘চাচ্চু পলিটিক্স পছন্দ করে দেখেই তো এতো পরিশ্রম করে। তুমি চিন্তা করিও না। চাচ্চুর আগে পিছে গার্ডরা তো আছেই।’

ছোট মা যেন কথাগুলো কর্ণাধারে নিলো না। পূর্বের ন্যায়-ই সে মুখটা বিবর্ণ করে রাখলো। ভরাট গলায় বলে ওঠে,

-‘ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নেও! আমি খাবার পাঠাচ্ছি, আর হ্যাঁ তোমার চাচ্চু রাতে থাকতে বলেছে। কী নাকি জরুরি কাজ আছে!’

ফায়ান মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। তার বুঝতে বাকি নেই চাচা তাকে কেন ডেকেছে। তাকে আবারও… ভাবতেই একটি তপ্তশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে ফায়ান।

~চলবে।