প্রণয়ী পায়রা পর্ব-০৫

0
677

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ০৫ |

[কপি নিষেধ]

সপ্তাহ খানেক কেটে গেছে। এই সময় গুলোতে আরোরা ফায়ানকে সম্পূর্ণভাবে ইগনোর করেছে। ভুল করেও ফায়ানের সামনে দাঁড়ায় না। ফায়ানের ক্লাস থাকলে পেছনের একদম কর্ণারের বেঞ্চটায় গিয়ে বসে। ফায়ান ঘুরে-ফিরে তাকেই পড়া ধরে, তাকেই ফায়ানের লেকচার নিয়ে প্রশ্ন করে। আরোরার এমন অবস্থা সে না পারে ক্লাস গ্যাপ দিতে না পারে ফায়ানের সামনে থাকতে। আজ আরোরাকে ভীষণ বিষন্ন লাগছে। সে চুপ করে ফোন ঘাটছে। আজ ইংলিশ এসাইনমেন্টের রেজাল্ট দিবে। আরোরা তো জেদ ধরে দ্বিতীয় কোনো এসাইনমেন্ট করেনি। এর মানে কী ফায়ান তাকে ফেইল করিয়ে দিবে? ফেলের ভয়েই আরোরা তার মুখ ঘুচে রেখেছে। পাশ থেকে আরিশা তার কাঁধে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনামূলক বাণীতে বললো,

-‘টেনশন নিস না। কিছু হবে না, স্যার এতোটাও নির্দয় নয়। যদি এমন কিছু হয় ডিরেক্ট প্রিন্সিপালের নিকট নালিশ দিবো বুঝলি?’

-‘তুই যাবি প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ দিতে? ক্যারিডোর দিয়ে প্রিন্সিপাল গেলেও তোর হাঁটু কাঁপে আর তুই ইনডাইরেক্টলি তাকে কোনো টিচারের নামে নালিশ দিবি? হাউ ফানি!’ কটাক্ষ করে বললো রুহান।

-‘জাস্ট শাট আপ রুহান!’

-‘রুহান তো ভুল কিছু বলেনি। তোর হাঁটু আগে শক্ত কর অতঃপর আমায় বড়ো বড়ো লেকচার দিতে আসিস, ডাফার!’

আরিশা আর কিছু বলতে পারলো না। তাদের কথার মধ্যে বাম হাত ঢুকিয়ে লামিসা এবং তার গ্যাং এসে ওদের সামনে দাঁড়ালো। আরোরা কোণা চোখে একবার ওদের দিকে তাকিয়ে ফোন স্ক্রোল করতে মনোযোগী হয়। লামিসা আরোরার ধ্যান পাবার জন্যে স-শব্দে আরোরার সামনে বসলো। অতঃপর দাঁত বের করে কটাক্ষের স্বরে বলতে লাগলো,

-‘শুনলাম এই এসাইনমেন্টে ফেইল করলে সেমিস্টার ফাইনাল দেয়া যাবে না। আমি তো এখনই তোমার অদূরের ব্ল্যাক ফিউচার দেখতে পারছি। আহারে, আমাদের সহপাঠী জুনিয়র হয়ে যাবে! যাক সমস্যা না, যেতে আসতে সালাম দিবা তাতেই তোমার সকল বেয়াদবি মাফ করে দিবো! আমি আবার ওতো পাথর নই!’

লামিসা সহ তার পুরো গ্যাং অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। আরোরা নিশ্চুপ হয়ে সবটা শুনলো কিন্তু প্রতিউত্তরে জবাব দেয় না। আপাতত কিছু বলা টাইম ওয়েস্ট করা ব্যতীত কিছুই না। আরিশা কিছু বলার প্রস্তুতি নিতেই আরোরা শক্ত করে তার হাত চেপে ধরলো। যার ফলে আরিশা কিছু চেয়েও বলতে পারলো না। লামিসা হাসি থামিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বলে,

-‘এজন্যই বলে অতি বাড় বেড়ো না, ঝড়ে পরে যাবে! মিললো তো কথাটা? আমার সাথে লাগতে এসেছো না? এখন দেখো তোমার অবস্থা। সময় থাকতে নিজেকে শুধরে নেও, নয়তো পরবর্তী ব্যবস্থা আমি নিজেই নিবো! গট ইট?’

লাবিবা ওয়াহিদের প্রথম বই ‘আঁধারে আগন্তুক’ আসছে। চাইলে এখনই অর্ডার করতে পারেন।
এবার আরোরা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। অতঃপর লামিসার দিকে তাচ্ছিল্য দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে বললো,

-‘আমি ঝড়ে পরলেও কী না পরলেও কী, সেখানে তোমার কোনো হাত নেই। আর হাত থাকলেও সেই হাত মুঁচড়ে ভেঙ্গে দিতেও আমার বেশি সময় লাগতো না… এন্ড তুমিও, বেশি লাফিও না। পরে দেখা যাবে আমি নই তুমি নিজেই সেই ঝড়ে গোল গোল করে ঘুরছো!’

-‘চ্যালেঞ্জ করছো?’

-‘তা তো অবশ্যই না। তকদির কখন কারে ঘুরিয়ে দেয় সেটা তো উপরওয়ালাই ভালো বলতে পারবে। আর তুমি কী ভাবছো এসাইনমেন্টে ভালো করে স্যারের মন পেয়ে যাবে? এতো ইজিলি?’

-‘মানে?’

-‘নিশ্চয়ই বুঝেছো, তাই এক কথা রিপিট করে টাইম ওয়েস্ট করতে চাই না। তুমি কী মনে করো, স্যারের দৃষ্টি নিজের দিকে ফেরানোর জন্য কী কী করো আমরা কেউ দেখি না? আমরা অন্ধ? সে তো ঠিকই তোমার দিকে ফিরেও তাকায় না। লজ্জা করে না স্যারের সাথে লাইন মারার চেষ্টা করতে?’

-‘না করে না। এনি প্রব্লেম? নাকি তোমারও আমার মতো… যাইহোক তুমি কখনোই পারবে না, বিকজ তুমি আমার মতো বড়লোক বাবার মেয়ে নও প্লাস তোমার সেই যোগ্যতা নেই।’

-‘আমার তোমার মতো নোংরা মানসিকতা নেই! সো সামনে থেকে সরে যাও এন্ড এইসব ফালতু কথাবার্তা তোমার ওই ফালতু গ্যাংকেই শোনাও!’ কাঠ কাঠ গলায় বলে আরোরা। রাগে সে তড়তড় করে কাঁপছে। মৃদ্যু কম্পিত অধরজোড়া ফাঁক করে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস নিচ্ছে সে।
লামিসা হাসতে হাসতে নিজের সিটে গিয়ে বসলো। ইচ্ছে তো করছে এখনই ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে। দুই এক মিনিট এই ডাফারকে জুতো দ্বারা সাইজ করতে পারতো, মনে প্রশান্তি আসতো। কীরূপ লো মেন্টালিটির! কিসের সাথে কী মিলাচ্ছে? ফায়ান স্যার আর আরোরা? ছিঃ! কখনো কল্পনাও করতে পারে না সে। কিন্তু আরোরার মন চাইছে, এই অসভ্য মেয়েকে কোনো না কোনোভাবে শাস্তি দিতে।
আরোরার ভাবনার মাঝেই ফায়ান তার ব্লেজার ঠিক করতে করতে লম্বা লম্বা পা ফেলে ক্লাসে প্রবেশ করলো। আরোরার এতক্ষণে ধ্যান হলো। তার তো পিছে যাওয়ার কথা। এই লামিসার চক্করে পরে সে তো ভুলেই গেছে। নিজেই নিজের কপালে হালকা চাপড় মারলো। [লাবিবা ওয়াহিদের প্রথম বই ‘আঁধারে আগন্তুক’ এর প্রি-অর্ডার চলছে। চাইলে অর্ডার করতে পারেন।]
সকলকে বসতে বলে ফায়ান শেষের সেই কর্ণারে নজর দেয় আরোরাকে দেখার জন্যে। কিন্তু একি, সিট ফাঁকা। ফায়ান এবার পুরো ক্লাসের মধ্যে চোখ বুলিয়ে আরোরাকে পেলো। মুহূর্তেই দুজনের দৃষ্টি অদলবদল ঘটে। ফায়ানের বাদামী চোখ জোড়ার তীক্ষ্ম দৃষ্টিপাত আরোরা সহ্য করতে না পেরে চোখ নামিয়ে ফেললো। কেমন জড়তা কাজ করছে তার মাঝে।

পুরো ক্লাসেই আরোরা ফায়ানের তীক্ষ্ম দৃষ্টির মুখোমুখি হয় যার ফলে অস্বস্তিতে আরোরা এদিক সেদিক তাকিয়ে ছটফট করেছে। মাঝে-মধ্যে পুণরায় দুজনের দৃষ্টির আদান-প্রদান হলে ফায়ান যেন তার নেত্রপল্লব দ্বারাই আরোরাকে দু’চারটা ধমক দিয়ে দেয়। এটা অবশ্য আরোরার ধারণা। এদিকে লামিসা কিছুক্ষণ পর পর হালকা করে লিপস্টিক দিচ্ছে, চুল ঠিক করছে, ইভেন পারফিউমও দিচ্ছে যাতে করে ফায়ান তার প্রতি এট্রাক্টেড হয়। কিন্তু ফায়ান ভুল করেও লামিসার দিকে তাকায় না যা বারংবার লামিসাকে হতাশ করেছে।

ফায়ানের লেকচার শেষে একে একে সকলের রেজাল্ট জানিয়ে দেয়। অবাক করা ব্যাপার হলো আরোরা ক্লাসের টপ হয়েছে এসাইনমেন্টে আর লামিসা হয়েছে সেকেন্ড লাস্ট! আরোরাসহ পুরো ক্লাস সেখানেই থম মেরে ছিলো। আরোরার কর্ণাধারে বারংবার ফায়ানের বলা উক্তিটিই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। পরিশেষে আরোরা ভীষণ খুশি হলো। হোক ফায়ান তাকে আটকিয়েছে তাও ফায়ান যে তার এসাইনমেন্ট নিজের কাছেই রেখেছিলো। আরোরা ভাবতে পারেনি ফায়ান তার এসাইনমেন্টও বাকিদের সাথে দেখবে। আরোরার ঠোঁটে তৃপ্তিময় হাসি দেখে ফায়ান দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্যদিকে ধ্যান দেয়। লামিসা নিজের রাগকে সংবরণ করতে না পেরে উঠে দাঁড়ায় এবং রাগমিশ্রিত স্বরে লামিসা ফায়ানের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো,

-‘হোয়াট ইজ দিস স্যার? কেউ এসাইনমেন্ট জমা না দিয়ে ফাস্ট হয়ে যায় আর আমি এসাইনমেন্ট জমা দিয়েও সেকেন্ড লাস্ট? ইজ ইট রাইট?’

-‘আমি কারো চেহারা কাটিং দেখে নাম্বার দেইনি মিস! আর এসাইনমেন্ট না দিলে অবশ্যই সে এবসেন্ট থাকতো! আর আপনি, আপনি শোকর করুন আপনায় সেকেন্ড লাস্ট দিয়েছি! বড় গলায় চেঁচানোর আগে আমি নিশ্চয়ই বলেছিলাম কেউ কারো এসাইনমেন্ট কপি করতে পারবে না? সো? থ্যাংকস টু গড এন্ড শাট ইওর মাউথ!’

ফায়ানের কথায় অনেকেই মুখ চেপে হাসতে লাগলো কারণ, ফায়ান তার ক্লাসে কোলাহল পছন্দ করে না। তাই ফায়ানের ধমকের ভয়ে কেউ উচ্চস্বরে হাসার সাহস পায় না। লামিসা সকলের দিকে নজর বুলিয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বসে পরলো। আরোরা নিজেও নিঃশব্দে হেসে একটা ছোট চিরকুট লিখে সেটা মুড়িয়ে লামিসার দিকে পাস করে।[লাবিবা ওয়াহিদের প্রথম বই ‘আঁধারে আগন্তুক’ বইয়ের প্রি-অর্ডার চলছে। চাইলে অর্ডার করে ফেলতে পারেন!]লামিসা মোড়ানো কাগজটা খুলে এক বাক্যের লাইনটা পড়লো।

-“শয়তানের বিচার আল্লাহ’য় করে,” উক্তিটা বাশি হলেও সত্য এবং প্রমাণিত।’

লামিসা অগ্নিময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আরোরার পানে। কিন্তু আরোরা এমন ভাব ধরে বসে আছে সে এই দৃষ্টি দেখেনি ইভেন দেখতে চায়ও না!
লামিসা দাঁতে দাঁত চেপে চিরকুটটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে তার পাশে বসে পিউর হাত ছুঁড়ে মারলো।
আজ আরোরা মন দিয়ে ক্লাস করলো। আজ তার মধ্যে অধিক সুখ নাড়া দিয়েছে। সে এতোই খুশি যে ফায়ানের উপর রাগটা নিমিষেই গলে গেলো। মেয়েদের মন নরম, এ কথাটি প্রকৃতপক্ষে আরোরার মধ্যে ফুটে ওঠছে। সে প্রতিশোধ পরায়ণ নয়, একদমই নয়!
ক্লাস শেষ হবার পূর্বে ফায়ান একান্তভাবে আরোরাকে তার কেবিনে যেতে বলেছে। আকস্মিক ঘটনায় ক্লাসের বাকিসব স্টুডেন্ট স্তব্ধ হয়ে যায়। আরিশা গোল গোল চোখে আরোরার পা থেকে মাথা অবধি দেখলো। আরোরা সকলের এরূপ দৃষ্টির মানে বুঝলো না। এমনেই স্যার কেন ডেকেছে সেই চিন্তায় আরোরা বাঁচে না তার উপর এদিক দিয়ে সবাই তাকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছে। এই দৃষ্টি আরোরার বোধগম্য হলো না। ফায়ান চলে যাওয়ার পরপরই লামিসা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছুটে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলো। আরোরা বের হলো না। তার কেমন অস্বস্তি লাগছে ফায়ানের কেবিনে যেতে। তাই পরপর আরও তিনটা ক্লাস করলো সে। চতুর্থ ক্লাস চলাকালীন পিওন এসে আরোরাকে ফায়ানের কথা জানালো।
ক্লাসের টিচার আরোরার উদ্দেশ্যে বিনয়ী কন্ঠে বললো,

-‘স্যার যেহেতু ডাকছে তুমি যেতে পারো।’

আরোরা ক্যাবলাকান্তের মতো মাথা নাড়ায় এবং ব্যাগ নিয়ে সে বেরিয়ে যায়। সারা পথে তার গলা বারংবার শুকিয়ে আসছিলো ভয়ে৷ ফায়ান তাকে কী বলার জন্যে এতো জরুরি তলব করলো? তার কেন এতো পরিমাণে অস্বস্তি লাগছে? এতো এতো প্রশ্নের একটা উত্তরও আরোরার জানা নেই। আরোরা তপ্তশ্বাস ফেলে ফায়ানের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজা খুলে শুধু মাথা ঢুকিয়ে কম্পিত গলায় বলে ওঠে,

-‘মে আই কামইন স্যার?’

ফায়ান তার টেবিলের ড্রয়ার ঘাটতে ঘাটতে বলে ওঠে,
-‘কাম ইন!’

~চলবে।