প্রণয়ী পায়রা পর্ব-০৬

0
709

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ০৬ |

নিস্তব্ধ রৌদ্রজ্বল মধ্যাহ্ন দুপুর। কাঠফাটা রোদের উত্তাপে তৃষ্ণায় গলা শুকোচ্ছে অনবরত। অধিক গরমে মানুষ ভুল করেও বাইরে পা মাড়াচ্ছে না। ভার্সিটি ছুটি হয়েছে এক ঘন্টা হলো। মূলত আরোরা ফায়ানের কেবিনে আসতেই ছুটির বেল বেজেছে। কোনো কারণে আজ খুব সংক্ষিপ্ত ক্লাস হয়েছে। আরোরা বারংবার ঘর্মাক্ত কপালে ওড়নার বিচরণ চালাচ্ছে নতুবা ঘড়ি দেখছে। ফায়ানের কেবিনের সিলিং ফ্যানটাই চলছে অনবরত। এসি অফ। সিলিং ফ্যানটাও ফায়ানের টেবিল বরাবর। এই দিকটায় বাতাসটা সঠিকভাবে আসছেও না। এভাবে ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয়? ফায়ান যদি জরুরি তলবই করে থাকে তাহলে দাঁড় করিয়ে রাখার মানে কী? আরোরা চেয়েও ফায়ানকে ডাকতে পারছে না। জড়তা কাজ করছে তার মধ্যে। এভাবে বারংবার ডাকতে চেয়েও ব্যর্থ হয়। ব্যর্থ হতে হতে একসময় সে নিজেকে সামলে ফেললো এবং মৃদু স্বরে বলে ওঠলো,

-‘স্যার! ডেকেছেন কেন বলবেন? এভাবে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন কেন?’ কন্ঠে খানিক বিরক্তিও অবশ্য ছিলো।

ফায়ান কিছু ফাইল দেখছিলো। আরোরার বলা বাক্য দুইটি কর্ণধারে প্রবেশ করতেই সে চোখ তুলে তাকালো এবং সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। অতঃপর থমথমে গলায় বলে ওঠলো,

-‘কেন, বিরক্ত লাগছে? আমি যখন ডেকেছিলাম তখন কেন আসোনি? টিচারদের সাথে এটিটিউড দেখানো দেখছি আজকাল ফ্যাশন হয়ে গেছে। এনিওয়ে, আমারও লেগেছিলো একইরকম বিরক্তি। তাই কিছুটা পানিশমেন্ট দিলাম। আরও পাচ্ছো অবশ্য..’

-‘মানেহ? আমায় কী তাহলে পানিশমেন্টের জন্য ডেকেছেন?’

-‘সেটা জানি না। ইউ আর লেইট সো, কী জন্য ডেকেছিলাম সেই চিন্তা বাদ। আন্ডারস্ট্যান্ড? নাও সিট..’

ফায়ান উঠে দাঁড়ায় এবং তার অপজিটের চেয়ারে বসতে ইশারা করলো। আরোরা রাগে গিজগিজ করতে করতে চেয়ারে গিয়ে বসলো। ফায়ান তার গোল ফ্রেমের চশমাটি ঠিক করে তার শেল্ফে চলে গেলো এবং একটা ফাইল ঘেটে কুয়েশ্চন পেপার বের করলো। সেটা নিয়ে আবারও আরোরার সামনে আসলো। কুয়েশ্চন পেপারগুলো চেক করতে করতে বললো,

-‘তোমার মা বলেছে তুমি ইংলিশে উইক আর আমি যেন তোমার উইক পয়েন্ট গুলোকে বুঝিয়ে দেই। সো এজ এ টিচার আমি তা করতে বাধ্য। সো নাও, এই ইংলিশ লেসন আর গ্রামাটিক্যাল পার্টের এসাইনমেন্টটা আমায় এই সময়গুলোর মাঝে বুঝাভে!’

বলেই কুয়েশ্চন পেপারটা আরোরার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের সিটে বসে। আরোরা বিমূঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ফায়ানের পানে। মানে এই দুপুর সময়টা তাকে বইয়ের মধ্যে ডুব দিতে হবে? আরোরা গোল গোল চোখে ফায়ানের দিকে তাকালো এবং অস্ফুট স্বরে বললো,

-‘এটা কেমন ক…’

-‘নো মোর টক। বই বের করো। লেসনে প্রব্লেম থাকলে আমায় জানাও আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। ফাস্ট! আগামী এসাইনমেন্টে এবারের মতো ছাড় পাবে না সো সো ডু হোয়াটেভার আই সে!’

আরোরা আর কথা বাড়ায় না। ফায়ানকে একশো এক বকা দিয়ে ব্যাগ থেকে মোটা বইটা বের করলো। অতঃপর ফায়ানের বলা লেসন বের করলো। কিন্তু সমস্যা হলো এই লেসনটা আরোরার বেশ ক্রিটিক্যাল লাগছে। আরোরা কোণা চোখে ফায়ানের দিকে তাকালো। ল্যাপটপে কিছু একটা টাইপ করতে ব্যস্ত। আরোরা না চাইতেও ফায়ানকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। সাদা শার্ট কনুই অবধি ফোল্ড করা, ব্লেজারটা চেয়ারের এক হাতলে রাখা। ঘর্মাক্ত কপালে কিছু চুল লেপ্টে আছে। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। অধর জোড়ার কিঞ্চিৎ পাশেই বাম হাতটা বুলাচ্ছে। চোখ তার ল্যাপটপেই নিবদ্ধ। আরোরা স্বীকার করতে বাধ্য ফায়ান আসলেই একজন ইংরেজ। আরোরার মনে পরে যায় সেই কিশোর বেলার ঘটনা। সেদিন সে ভাইয়ার সঙ্গে স্কুল থেকে ফিরছিলো তখনই কিছু ফরেইনারকে চারপাশে ঘুরাঘুরি করতে দেখেছিলো। সেদিন আরোরার ছোট মাথায় এক উদ্ভট প্রশ্ন এসেছিলো। সেই প্রশ্ন নিজের মধ্যে রাখতে না পেরে আইমানকে করেছিলো,

-‘আচ্ছা ভাইয়া ওরা কী সাদা হওয়ার জন্যে বেশি বেশি দুধ আর লাচ্ছি খায়? এতো সাদা তো আমি ভাল্লুক ছাড়া কখনোই দেখিনি। আচ্ছা ওরা কী ওই সাদা ভাল্লুকদের অধিবাসী?’

সেদিন আইমান সারা রাস্তায় হেসেছিলো। আরোরা ডিসকভারি চ্যানেল দেখতো বেশি তাই সে সাদা মানুষগুলোকে সাদা ভাল্লুকের অধিবাসী হিসেবে ভেবেছিলো। সেই কথা ভাবলে আরোরার এখন লজ্জা পায়। কীরূপ উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা ছিলো তার। আইমান তো কোনোরূপ খুঁত পেলে সেদিনের প্রশ্নগুলো নিয়ে খোঁচা মারতে ছাড়ে না। আরোরার তখন ইচ্ছে করে দেয়ালে বারি দিয়ে নিজের কপাল ফুটাতে। কেন সে আইমানকেই এসব বলতে গেলো?

-‘কী কেয়ারলেস? এসব ভূত দেখার মতো তাকিয়ে আছো কেন?’

আরোরার ধ্যান ভাঙে এবং দ্রুত মাথা নুইয়ে ফেলে। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে তার। ফায়ান তার দৃষ্টি দেখে ফেললো, কী সাংঘাতিক। এখন কী ফায়ান তার সম্পর্কে খারাপ ধারণা করবে? সে কী ভাববে অন্যান্য মেয়েদের মতো সেও তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। কী লজ্জা! আরোরার ভাবনায় এক বালতি পানি ঢেলে ফায়ান টু-শব্দও করলো না। সে আবারও ল্যাপটপে মনোযোগী হয়ে যায়। আরোরা পুণরায় কোণা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ফায়ানের দিকে। মনের মাঝে স্বস্তি ফেললো এই ভেবে মাঝেমধ্যে কিছু কিছু ভাব লজ্জা থেকে নিস্তার দেয়! এখন মনে হচ্ছে এই এটিটিউডটা সঠিক সময়েই ফায়ানের ঘাড়ে চেপেছে।

আরোরাকে থম মেরে বসে থাকতে দেখে ফায়ান ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরোরার দিকে নিবদ্ধ করলো। আরোরা সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে ফেলে যার ফলে দ্বিতীয়বারের মতো লজ্জার হাত থেকে বেঁচে যায়।

-‘কী হলো? বসে আছো কেন? বসে থাকার জন্য লেসন দিয়েছি বুঝি?’

-‘আমি এই লেসনটা ঠিক বুঝতে পারছি না!’

ফায়ান আরোরার মুখশ্রীতে সূক্ষ্মাগ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উঠে দাঁড়ালো। আরোরা গোল গোল চোখে ফায়ানের দৃষ্টি বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলো। ফায়ান ল্যাপটপ অফ করে সেটা নিয়ে আরোরার ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। আরোরার পেছন থেকে কিছুটা ঝুকে সে বইটি সরিয়ে দিলো। আরোরা নিথর পাথরের ন্যায় সেভাবেই বসে রইলো। জড়তা, অস্বস্তি, বিস্ময়ে তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ফায়ান কোণা চোখে আরোরার বিস্মিত মুখশ্রী লক্ষ্য করে ল্যাপটপটি সঠিক স্থানে রাখলো। অতঃপর ল্যাপটপ পুণরায় অন করে সেই লেসনের পিডিএফ অন করে এবং আরোরার দিকে ঝুঁকেই তাকে বোঝাতে শুরু করলো। আরোরার হার্টবিট মুহূর্তেই ঢিপঢিপ করে বাড়তেই থাকলো! আরোরা অনবরত ঘামছে৷ কী বলবে না করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। ফায়ান তার খুব নিকটে, খুব। ফায়ানের উষ্ণ নিঃশ্বাস তার কপাল ছুঁয়ে যাচ্ছে অনবরত। ফায়ান আরেক পলক তাকালো আরোরার পানে। অতঃপর সে সরে দাঁড়ায় এবং সিলিং ফ্যান অফ করে এসি অন করে দেয়। আরোরা এতক্ষণে যেন স্বস্তি পেলো। ফায়ান আরোরার পাশের চেয়ার টেনে বসে পরলো অতঃপর পুণরায় বুঝাতে শুরু করলো। চল্লিশ মিনিটের মতো বুঝিয়ে আরোরাকে কিছু লিখতে দিয়ে ফায়ান উঠে দাঁড়ায় এবং জানালার দিকে চলে গেলো। জানালার পর্দা সরিয়ে থাই গ্লাস ভেদ করে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু লোককে চেক করলো সে। হ্যাঁ, ইয়ামিন’রা এখনো আছে। ফায়ান ঠোঁট বাঁকা করে হাসলো। ইয়ামিন তার লোকদের উপর মেজাজ দেখাতে ব্যস্ত। অনেকক্ষণ ধরেই সে ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়ান বাঁকা হেসে পকেট থেকে নিজের ফোন বের করলো এবং অনলকে মেসেজ করলো,

-‘ওরা চলে গেলে আমায় তৎক্ষনাৎ ইনফর্ম করবে! আর হ্যাঁ ওদের উপর নজর রাখবে, গট ইট?’

মেসেজ সেন্ড করার পরমুহূর্তেই রিপ্লাই আসলো ‘ওকে স্যার’!! ফায়ান ঠোঁট বাঁকা করে আরোরার সামনে গিয়ে বসলো এবং ফোনে নিউজ পড়তে শুরু করে দেয়।

অবশেষে বিকাল হতেই আরোরা ফায়ানের পড়ালেখাময় টর্চার হতে রক্ষা পেলো। পড়ার মাঝে অবশ্য ফায়ান ওকে লাঞ্চও করিয়েছে। আরোরা খেতে চায়নি তাও ফায়ান আরোরাকে ধমক দিয়ে ক্যান্টিনে নিয়ে যায়। আরোরাকে খাইয়ে আবারও ফায়ান আরোরাকে নিয়ে কেবিনে ফিরে আসে। তবে ফায়ান তাকে এক দুঃসংবাদও জানায়, তা হলো এই টর্চার তাকে রোজ গ্রহণ করতে হবে! আরোরা পারে না নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে। এই ইংরেজ গুলোকে জম্ম দিলো কে বুঝে না? ইংরেজ সব ইংরেজ দেশেই থাকুক তা না বাঙালির মাঝে ছেড়ে দিছে। এরা তো বাঙালির জাত শত্রু।

——————————–

আরোরা ভুল করেও আইমানের সাথে কথা বলছে না কারণ, ওই ইংরেজকে টর্চারের জন্যে তার রক্তের ভাই-ই উৎসাহ দিয়ে এসেছে৷ যখনই আরোরা এই ঘটনার আসল রহস্য উম্মোচন করলো তৎক্ষনাৎ আইমানের মাথায় বই দিয়ে এক ঘা দিয়ে নিজের মুখে কুলূপ এঁটেছে। মানে আজকাল আপন ভাইও ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়েছে। আরোরার তো ইচ্ছে করছে আইমানের মাথা ফুটো করে দিতে। এদিক দিয়ে অনন্যাও বেশ খুশি। এতদিনে যেন কাজের কাজ হলো। এমনেই আরোরা কোনরকম কোচিং করে না, সব ঘরেই পড়ে। এখন ফায়ান হেল্প করায় তার পড়ায় আরও কিছুটা উন্নতি হবে। আপাতত অনন্যার এটাই ধারণা। আইমানকে তো কিছুক্ষণ পরপরই জিজ্ঞেস করছে,
‘স্যার ভালো তো?’
‘আরুর ইংরেজীর সমস্যা মিটবে তো?’
‘কী লক্ষী ছেলে দেখ, তুই একবার বলতেই কতবড় সমস্যার সমাধান করে দিলো।’
‘যাক আমার আরুর একটা পথ হলো!’

রাত ন’টার বেশি বাজে। আরোরা টেবিলে বসে মাথায় হাত দিয়ে বই দাগাচ্ছে। আইমান তখনই আরোরার রুমে প্রবেশ করলো। কারো উপস্থিতি টের পেলেও আরোরা ফিরেও তাকালো না। আইমান বিছানায় বসে আরোরার রাগ দেখছে। অতঃপর তপ্তশ্বাস ফেলে বললো,

-‘এখনো রেগে আছিস? দেখ, তোর ভালোর জন্যই আমি স্যারকে বলেছি। যাইহোক, এসেছিলাম গুড নিউজ দিতে কই এক্সাইটমেন্ট দেখিয়ে জিজ্ঞেস করবি তা না করে এখনো রাগ দেখিয়ে চলেছিস। ওকে ফাইন! দিবো না কোনো নিউজ!’

আরোরা চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে আইমানের দিকে তাকালো। সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

-‘কিসের গুড নিউজ?’

~চলবে।

বিঃদ্রঃ রিচেক দেয়া হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।