প্রণয়ী পায়রা পর্ব-১৬

0
652

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ১৬ |

[কপি নিষেধ]

নিকষকৃষ্ণ রজনী। রজনীর গভীরতায় কোলাহলপূর্ণ শহর ঘুমন্ত শহরে পরিণত হয়েছে। নিশাচর পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ এবং তাদের ডাক অদূর থেকে ভেসে আসছে। গা ছমছমে আঁধারে কয়েকটা কুকুর এদিক সেদিক ছুটছে নয়তো সোডিয়াম আলোয় আলোকিত পথের ধারে গা এলিয়ে দিচ্ছে। এই নিবিঘ্ন রজনীতে ঘুম নেই আইমান এবং ফায়ানের। মুনীব ব্যবসার কাজে শহরের বাইরে গিয়েছে। অনন্যা ঘুমের ওষুধ খেয়ে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। আইমানই অবশ্য জোরপূর্বক ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পারিয়ে দিয়েছে। নয়তো অনন্যা মেয়ের সেবায় মেয়ের কাছ থেকে নড়ছিলো-ই না। আরোরা তীব্র জ্বরে আক্রান্ত। তার গায়ের উত্তাপ এতোই তীব্র যে তার পাশে কেউ বসলেও সেই তাপ অনুভব করতে পারবে। ফায়ান আরোরার মাথার কাছে বসে, এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এখানেই এসেছে সে। চোখ-নাক রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে, চুলগুলো এলোমেলো। গলায় টাইটা ঢিল করে রাখা, ইনটাও ঠিক নেই। আইমান ফায়ানের এই হাল লক্ষ্য করলেও কিছু বলতে পারছে না। একে তো মাঝরাতে ফায়ানকে তাদের বাসায় পাগলের মতো ছুটে আসতে দেখে অবাক হয়েছে তার উপর ফায়ানের মুখে আরোরার নাম শুনে সে আরও বেশি বিস্মিত। অনন্যা এখনো অবগত নয় ফায়ানের আসা সম্বন্ধে। আইমান আরোরার মাথায় জলপট্টি দিতে গেলেই ফায়ান তার হাত থেকে ছো মেরে সেটা কেড়ে নেয় এবং নিজে জলপট্টি দিতে শুরু করে৷ জ্বরের তীব্রতায় আরোরার হুঁশ নেই। অধর জোড়া মৃদু কম্পিত। আইমান ফায়ানকে শান্ত করতে থমথমে গলায় বলে,

-‘কুল! আমার বোন ঠিক হয়ে যাবে! বেশি প্রেশার নিও না। তুমি বাড়ি যাও, তোমার রেস্টের প্রয়োজন!’

ফায়ান অগ্নিময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আইমানের দিকে। অতঃপর কাঠ কাঠ গলায় বেসামাল হয়ে বলতে লাগে,

-‘আমার পিজ্যান সে, আমার প্রণয়ীনি সে! তার এতো তীব্র জ্বর আর আমি কী করে দূরে থাকবো? এন্সা মি আইমান!’

আইমান সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফায়ানের দিকে। সামান্য কথায় ফায়ান এমন তেঁতে উঠবে সে ভাবতে পারেনি। ফায়ান বারংবার আরোরার কপোল ছুঁয়ে যাচ্ছে। ভাব-ভঙ্গি এমন, জ্বরটা সে শুষে নিতে চায় ওই বলিষ্ঠ হাতের মাধ্যমে। আরোরার এই অসুস্থতায় ফায়ান যেন কৈ মাছের ছটফট করছে। আইমানের মাথায় দেয় আরেকটি প্রশ্ন। ফায়ান তাকে কী বললো? প্রণয়ীনি? এর মানে কী তার ভাবনা সঠিক? ভুল হলে তো ফায়ান এই মাঝরাতে ছুটে আসতো না। আইমান কিছুটা দুশ্চিন্তায় পরে যায়। অতঃপর সে দিয়াকে কল দিতে পকেটে হাত দেয়। পকেট চেক করে দেখে মুঠোফোনটা নেই। আইমানের মনে পরলো সে মুঠোফোনটা নিজের ঘরেই রেখে এসেছে। আইমান দেরী না করে রুম হতে বের হয়ে যায়।

আইমান যেতেই ফায়ান আরোরার ললাট হতে জলপট্টিটা সরিয়ে নিজের ললাট ঠেকালো। আরোরার উষ্ণতা সে বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করছে। ফায়ান আবেশে চোখ বুজে আটকে আটকে বলা শুরু করলো,

-‘কোথায় ভেবেছিলাম বিডিতে এসে তোমায় সারপ্রাইজ দিবো, তোমার অভিমান ভাঙ্গাবো সেখানে তুমি নিজেই আমায় এই সারপ্রাইজ দিলে? এতোই শক্ত তোমার অভিমানের পাহাড় যে আমার এই নরম বুলি তোমার কানে যাচ্ছে না, আমার সাথে কথা বলছো না। এ যে অনেক বড় অবিচার প্রণয়ী! এর বিচার আমি কোন আদালতে পাবো বলো তো? তোমার ওই মসৃণ হৃদয়ে? ওটাও যে আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। একবার কথা বলো লক্ষীটি! দেখো না একবার চোখ মেলে তাকিয়ে, তোমার ওই রাগমিশ্রিত, লাজুক, হাসিমাখা মুখশ্রী দেখার জন্যে যে আমি ফায়ান বড্ড তৃষ্ণার্ত!’

মুখশ্রীতে উষ্ণ নিঃশ্বাস অনুভূত হতেই আরোরা নড়েচড়ে উঠে এবং জ্বরের ঘোরে মৃদু স্বরে বলে উঠলো,

-‘ইংরে..জ আ আপনি একদম ভালো না। আপনি শুধু আমায় কষ্ট দেন। আপনি খুব বাজে, এখন কী আপনি বিদেশীনিদের সাথে ঘুরছেন? আমি নিজ চক্ষে তা কী করে দেখবো ইংরেজ? এতো কষ্ট কেন দেন আপনি? পাষাণ আপনি, আপনার ওই কাঠের তৈরি হৃদয়টাও পাষাণ!’

এমন নানান উদ্ভট কথাবার্তা বলতে বলতে আরোরা ঘুমিয়ে যায়। ফায়ান আপনমনে হেসে সোজা হয়ে বসে এবং আরোরার গায়ের কম্বলটি টেনে দেয়। তখনই তড়িঘড়ি করে রুমে প্রবেশ করে আইমান। বিনা-বাক্যে ফায়ানের অপরপাশে গিয়ে বসলো সে। অতঃপর কিছু সময় নীরবতায় কাটলো। নিস্তব্ধতা প্রগাঢ় হওয়ার পূর্বেই আইমান বলে উঠলো,

-‘আই থিংক এবার তোমার বাড়ি যাওয়া উচিত। আমি আছি, তোমায় আপডেট জানাবো!’

ফায়ানের নির্বিকার দৃষ্টি আরোরার পানে স্থির। কিছুক্ষণ ওভাবে থেকে ফায়ান উঠে দাঁড়ায় এবং বলে,

-‘খেয়াল রেখো!’
বলেই আরেক পলক আরোরার দিকে তাকিয়ে ধপধপ পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

———————————–

আরোরা নিশ্চুপ হয়ে তার মায়ের হাতে স্যুপ খাচ্ছে। আইমান অফিসে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। আরোরার চোখে-মুখে তীব্র রাগ স্পষ্ট। বুয়া একবার আরোরার রুমে তো আরেকবার রান্নাঘরের দিকে দৌড় দিচ্ছে। আরোরা মনে মনে বিরাট রাগ পুষেছে ফায়ানের প্রতি। সে কেমন আছে, একবারও ফায়ান খবর নেয়নি বাহ! নিশ্চয়ই শুনেছে দিয়ার থেকে, তাও কীভাবে এতোটা নিরব থাকতে পারে? ফোনেও কয়েকবার চেক করেছে, কিন্তু ফায়ান ভুল করেও একটা কল দেয়নি। আরোরার অধরে হঠাৎ তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটলো। মনে পরে গেলো আমেরিকায় যাওয়ার আগমুহূর্ত গুলো! আরোরা ওষুধ খেয়েই উঠে দাঁড়ায়। জ্বরটা পুরোপুরি কাটেনি তার। কিন্তু জেদের বসে সে উঠে দাঁড়ায় এবং কাবার্ডের দিকে যেতে অগ্রসর হয়। অনন্যা আরোরাকে লক্ষ্য করে গোল গোল চোখ করে অস্ফুট স্বরে বলে,

-‘একি আরু, কী করছিস?’

-‘চেঞ্জ হবো!’

-‘কিন্তু কেন?’

-‘ভার্সিটি যাবো আম্মু!’

—–

আরিশার হাত নিজের গায়ে লাগাতে দিচ্ছে না আরোরা। জেদের বসেই সে ভার্সিটি এসেছে। রুহান ওদের সঙ্গে থাকলেও আরিশা তার সাথে একটা কথাও বলছে না। আরোরা যা-ও দু-একবার হু হা করছে। আরোরা রিকশা করেই এসেছে ভার্সিটিতে আর তার মা আরিশাকে তার খেয়াল রাখার আদেশ দিয়েছে। তাই আরিশাও একবারের জন্যেও আরোরার থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়নি, একপ্রকার চিপকে আছে আরোরার সঙ্গে যা আরোরাকে ভিষণ রকম বিরক্ত করছে। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে শুধু প্রশ্নই করেছে,

-‘আরু, বাড়ি যাবি? খারাপ লাগছে? কিছু খাবি? প্লিজ কিছু বল, এই বুড়োর ক্লাস করতে ভালো লাগে না!’

আরোরা এখন তীব্র যন্ত্রণায় ভুগছে। লাঞ্চ টাইমে সকলে খাবার খেলেও আরোরা খাওয়ার নাম করে সব ফেলে দিয়েছে। তার সবকিছুই কেমন বিষাক্ত লাগছে। এখন তার ভিষণ আফসোস হচ্ছে, কেন আরামের বিছানা ছেড়ে এই ভার্সিটিতে আসলো তাও ওই ইংরেজের জন্যে? রুহান তখনো জানে না আরোরা অসুস্থ। দুই বান্ধুবির আচরণে সে বেশ ব্যথিত। মনের মধ্যে খারাপ লাগাও কাজ করছে তার। এভাবে ওরা মুখ ফিরিয়ে নিলো?

অবশেষে লাঞ্চের পরপরই আরিশা তার মহান কাজটা সারতে চলে যায়। মহান কাজটি হলো মেকআপ ঠিক করা। আরোরাকে নিতে চেয়েছিলো তবে আরোরা রাজি হয়নি। রুহানও গিয়েছে জেবার সঙ্গে দেখা করতে। আরোরা আর একা একা কী করবে, করিডোরে একাই হাঁটাহাঁটি করছে। দখিনা হাওয়া তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই হিম বাতাসে কিছু তো একটা আছে যা হৃদয়কে মুহুর্তেই স্বচ্ছ করে দিতে সক্ষম।
রুহান যেই জেবার সাথে দেখা করে চলে আসার জন্য পেছনে ঘুরবে তখনই সে ফায়ানের মুখোমুখি হয়। রুহান বিস্মিত হলো এবং সে শুকনো ঢোঁক গিললো। ফায়ান পকেটে দু’হাত গুজে রুহানের দিকে তাকালো। অতঃপর চোখ ছোট ছোট করে মেয়েটির যাওয়া দেখলো। আপনমনেই ফায়ান বলে ওঠে,

-‘মেয়েটি কে ছিলো?’

রুহান আমতা আমতা করে উত্তর দেয়, ‘জ্বী, জেবা!’

তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ফায়ান, সেই মেয়েটির উদ্দেশ্যে। অতঃপর গলায় গাম্ভীর্য এনে বলে,

-‘হুম, আরোরা কোথায়?’

-‘লাস্ট ফর্থ ফ্লোরের করিডোরে দেখেছিলাম।’

-‘যাওয়ার আগে তুমি আমার সাথে দেখা করে যাবে!’

বলেই ফায়ান একই ভাবে পকেটে দু’হাত গুজে উল্টোপথে হাঁটা দেয়। আর রুহান, সে তো ওখানেই থম মেরে দাঁড়িয়ে রয়!

——-

আরোরা যেই একটি ফাঁকা ক্লাসরুম অতিক্রম করবে ঠিক তৎক্ষণাৎ হাতে হেচকা টান খায়! আরোরা ভিষণ ভয় পেলো শীতল স্পর্শ পেয়ে।

~চলবে।

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, রিচেক করা হয়নি। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।