প্রণয়ী পায়রা পর্ব-১৭

0
873

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ১৭ |

[কপি নিষেধ]

-‘জ্বর নিয়ে ভার্সিটি এসেছো ভালো কথা, না খেয়ে সব ফেলে দিছো কেন? খাবারের মূল্য জানো? তোমার ওই খাবার এক ক্ষুধার্ত মানুষকে দিলে কতো সওয়াব হতো?’

আরোরা গোল গোল চোখে ফায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়ানের চোখ-মুখ রক্তিম লাল। অত্যন্ত ক্রোধের মধ্যেও সে থমথমে গলায় কথাগুলো বলেছে। এই ক্রোধমিশ্রিত শান্ত ভঙ্গি যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। আরোরার আতঙ্কে গা কাঁপিয়ে ভেতরটা ধক করে উঠলো। সে আটকে আটকে গলায় উল্টো প্রশ্ন করে উঠলো,

-‘আ আপনি জানলেন কী করে?’

আরোরার এই প্রশ্নটি আগুনে ঘি ঢালার মতো হলো যার প্রতিফলনে ফায়ান সজোরে দেয়ালে থাবা বসালো। আরোরা আতঙ্কে দেয়ালের সাথে পিঠ লাগিয়ে লেপ্টে রইলো। আরোরা চোখ মুখ খিচে রইলো, হয়তো এবার ধমকের স্বীকার হতে হবে। তাই আরোরা অন্তঃপুরে দোয়া-দরুদ পড়া আরম্ভ করলো। কিন্তু আরোরাকে চমকে দিয়ে ফায়ান কিছুই বললো না। শুধু ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। আরোরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক বুঝতে পেরে এক চোখ মেলে পর্যবেক্ষণ করলো৷ ফায়ানের মুখশ্রী ঠিক তার সামনে ঝুঁকে। আরোরা আতঙ্কে দুই চোখ খুলে বড় বড় করে ফেললো। ফায়ান মিনমিন করে বললো,

-‘সে থ্যাংকস টু আল্লাহ! আজ তুমি অসুস্থ না হলে আমি যে তোমায় কী করতাম আমি নিজেও জানি না। আই সয়্যার! তুমি তোমার জেদের জন্যে বড় রকম বিপদের সম্মুখীন হতে। খাবারের সাথে খুব রাগ তোমার না? এতোই রাগ তুমি তা ফেলে দেয়ার মতো দুঃসাহস করো?’

আরোরা জবাবে কিছু বলে না, নিশ্চুপ হয়ে থাকে। সে কেন রেগে আছে সেটার কৈফিয়ত কেন দিবে ফায়ানকে? ফায়ানের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। সে দূরে সরে দাঁড়ায়। কোমড়ে এক হাত এবং অপর হাত দিয়ে চুলে বিচরণ করতে করতে নিজেকে শান্ত করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালালো। কয়েকবার লম্বা ও সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস গ্রহণ এবং ত্যাগ করলো। কোনরকমে নিজের রাগকে সামাল দিয়ে বলে,

-‘কী চাও তুমি? কী হয়েছে, এমন জেদ কেন ধরেছো?’

-‘আপনার মাথা খেতে চাই, আপনায় এক দুইটা ঘুষি দিয়ে ক্ষান্ত হতে চাই!’

আরও কিছু বলার পূর্বে আরোরা নিজের মুখ নিজের হাত দিয়েই চেপে ধরলো। ভয়ে এবং লজ্জায় তার গাল ভারি হতে শুরু করেছে৷ চোখ দুটোও যেন কুটির থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। কী বলে ফেললো সে ফায়ানকে? ফায়ান আর যাইহোক আরোরার স্যার সে। আরোরার ইচ্ছে করছে নিজের ওড়নাটা গলায় দিয়ে একটা ফ্যানের সাথে ঝুলে যেতে। ছিঃ ছিঃ কিসব বলে ফেললো সে! ভাবতে ভাবতেই দৃষ্টিনত করে ফেললো আরোরা।

এদিকে ফায়ানও বোকা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো অনেকক্ষণ! এরকম একটা উত্তর সে কল্পনায়ও চিন্তা করেনি। আরোরার এমন অবাস্তব কথাগুলো তাকে বিস্মিত করলেও পরমুহূর্তে তা হাসিতে রূপান্তর করে। বাঁকা হাসলো সে। বেশ প্রিয়তমার ইচ্ছে সে পূরণ করুক। ফায়ান আরোরার দিকে যেতে অগ্রসর হতেই আরোরার মনে ভয় হতে লাগলো। ফায়ান বড়সড় কিছু একটা ঘটানোর পূর্বেই তাকে কিছু করতে হবে। পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে আরোরা আমতা আমতা করতে লাগলো। কিন্তু ফায়ান তার কোনো বচনই কর্ণগোচর করে না। ফায়ান তার বলিষ্ঠ হাত দিয়ে আরোরার ডান হাত চেপে ধরলো। অতঃপর তাকে নিয়ে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলো। সামনের লো বেঞ্চ থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে পুণরায় নিজের আসনে বসলো ফায়ান। অতঃপর প্যাকেটটি আরোরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

-‘এটা আগে ফিনিশ করো। অতঃপর তোমার ধার্য করা কার্য সম্পন্ন করো!’

আরোরা লজ্জায় মাথা নত করে ফেললো। খাবারের সুঘ্রাণ সে আগেই পেয়েছিলো। প্যাকেট খুলে বিরিয়ানি দেখে তার ভাবনা বাস্তবে রূপান্তর হয়। বিরিয়ানির তৃপ্তিময় এবং নিজস্ব সুঘ্রাণে আরোরার মৃত খুদা পুণরায় জম্ম নেয়। আরোরার খাওয়া শেষ হতেই ফায়ান পানির বোতল এগিয়ে দেয়। আরোরা সেটা নিয়ে বোতলে চুমুক লাগায় এবং ঢকঢক করে অর্ধেক পানি খেয়ে নিলো। পানি খেয়ে হাত ধুতেই সে সুখের ঢেঁকুর তুললো। ফায়ান এতক্ষণ টেবিলে কনুই ভর দিয়ে কপোলে হাত দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে আরোরাকে দেখে যাচ্ছিলো। আরোরা এদিক সেদিক টিস্যু খুঁজতেই ফায়ান পকেট টিস্যুর প্যাকেট এগিয়ে দেয়। তৃপ্তিতে আরোরার অধরে ফিচেল হাসি ফুটে উঠলো তবে খুবই গোপনে। সে লাজুক ভঙ্গিতে টিস্যুটি নিয়ে নিজের প্রয়োজন মতো টিস্যু বের করে প্যাকেটটি কোলের উপরে রাখলো। ফায়ান ততক্ষণে ভার্সিটির এক বুয়াকে ডেকে পাঠালো বিরিয়ানির প্যাকেট ফেলার জন্য। বুয়া কিছুক্ষণের মধ্যে এসে সেটা নিয়েও যায়।

——————————

-‘এবার বলো, আমার নিকট তোমার আর্জি কী?’

আরোরা যেন মাটিতে থুবড়ে পড়ে। ভ্যাবাচ্যাকা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ফায়ানের দিকে। আরোরা আমতা আমতা করে বলে,

-‘মানে?’

-‘খাওয়ার পূর্বে তো বলেছিলে আমার মাথা খাবে, ঘুষি দিবে। তা দেও, নিজের অপূর্ণ ইচ্ছা পূর্ণ করো!’

আরোরার মুখশ্রী আঁধারে ঢেকে যায়। ফায়ান এখনো তার সেসব কথা মনে রেখেছে? আরোরা নিরুত্তর দেখে ফায়ান তার গাল বাড়িয়ে দিলো।

-‘কী হলো দাও, আমিও তোমার ওই মসৃণ হাতের নরম গুষি খেতে প্রস্তুত!’

আরোরার কী হলো সে জানে না। তবে অনুভূত হলো তার অভিমানের পাহাড় ফায়ানের এতো এতো কেয়ার এবং পাগলামোতে ভিষণভাবে চাপা পরেছে। আরোরা নিশব্দে হাসি দিয়ে নিবিড়ভাবে ফায়ানকে দেখতে লাগলো। আরোরার দু’চোখে তৃষ্ণা, ফায়ানকে দীর্ঘদিন পরে পাওয়ার তৃষ্ণা। সে ঘাড় কিছুটা বাকিয়ে ফায়ানকে দেখতে লাগলো। প্রণয়ীর কোনো অভিব্যক্তি না দেখে ফায়ান সোজা হয়ে আরোরার দিকে তাকালো। তার প্রণয়ীনি তার দিকেই তাকিয়ে। ফায়ান হাসলো এবং সেও একই ভাবে তাকিয়ে রয়। দীর্ঘক্ষণ দুজন দুজন কথোপকথন হয়। মুখে মুখে নয়, চোখে চোখে। আঠারো দিনের দেখার তৃষ্ণা মেটাচ্ছে দুজন প্রেমিক – প্রেমিকাই!

পরেরদিন আরোরা ভার্সিটি আসেনি। ফায়ান নিজেই মানা করেছে যেন আরোরা আজ না আসে। আরোরাও আর না করেনি, সে এখনো দুর্বলতা অনুভব করে। সাথে জ্বর তো আছেই। গতকাল রুহানের সঙ্গে দেখা করার কথা হলেও বিকাল পর্যন্ত ফায়ান আরোরার সঙ্গেই কাটিয়েছে। তাই ফায়ান আজ রুহানের সাথে সময় নিয়ে দেখা করে এবং তার কিছু অব্যক্ত বচন প্রকাশ করে। রুহান ফায়ানের সাথে সাক্ষাৎ শেষ করেই ভার্সিটি থেকে চলে যায়। ফায়ান তার চাচ্চুর সাথে কথা বলতে বলতে ভার্সিটি থেকে বের হচ্ছিলো তখনই ইয়ামিন এবং তার দলবল ফায়ানের সামনে এসে দাঁড়ায়। ফায়ান ওদের দেখে বাঁকা হাসি দেয় এবং কল কেটে মুঠোফোনটি পকেটে পুরলো! ইয়ামিনসহ তার দলবলের দিকে ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নেয় এবং বলে,

-‘কী ব্যাপার, তোমরা আমার দর্শনে? মারের ডোজ কী কম হয়ে গেছিলো নাকি সেদিন?’

ইয়ামিন খপ করে ফায়ানের কলার চেপে ধরে এবং রাগাম্বিত স্বরে বলতে লাগলো,

-‘তুই মন্ত্রীর ভাইপো দেখে তোরে কিছু করতে পারিনি। আর তুই কি না সুযোগ পেয়ে ডানা মেলে উড়ছিস? তুই জানিস তোর ওই ডানা ভাঙতে আমার দু’মিনিটও সময় লাগবে না! তুই আমার আরোরার দিকে নজর দিশ, এতো সাহস?’

শেষোক্ত বাক্যে ফায়ানের হাসির বেগ বেড়ে যায়। সে হাসতে হাসতে বলে,

-‘নাইস জোক। আরোরা কার সেটা তো সময় বলবে। এখন তুই যেই সাপের লেজে পা দিয়েছিস তার ছোবল সামলা! তারপর নাহয় আমার সাথে লাগিস!’

ইয়ামিন হাত তুলতে নিলে ফায়ান তা মুচড়ে দেয়। কলার থেকে ইয়ামিনের হাত সরিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে দেয়! ইয়ামিন হাত বাম হাতে তীব্র ব্যথা অনুভব করছে। এমন ভাবে মুচড়ে দিয়েছে ইয়ামিন চেঁচায়নি এটাই বড় কথা। ফায়ান নিজের কলার ঝাড়ার ভঙ্গি করে বলে,

-‘আমার গায়ে হাত তুলে লাভ নেই। তুই আমার ব্যাপারে কিছু না জানলেও আমি তোর সমন্ধে অনেক কিছু জানি। সো কেয়ারফুল। নয়তো তোর পাঁচদিন পরের কালো টাকার ডিলটায় আমি-ই সর্বপ্রথম বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো!’

ইয়ামিন ক্ষিপ্ত নজর নিক্ষেপ করে ফায়ানের দিকে। ফায়ান বিনা-বাক্যে রাস্তার অপরপাশে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। সে উঠে বসতেই গার্ড তার ডোর লাগিয়ে ফ্রন্ট সিটে বসে পরে। ইয়ামিন চোয়াল শক্ত করে সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। ফায়ান চলে গেলো। ইয়ামিনের এক চ্যালা তাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

-‘এখন কী করবেন বস? এই লোক তো সব জানে!’

-‘নাহ! অনেক সহ্য করেছি। আর নয়! ডিলের পূর্বেই আরোরাকে আমার করতে হবে। সে হোক মতামতে অথবা জোর-জবরদস্তিতে! আমি ইয়ামিন কখনো হারতে শিখিনি!’

—————

-‘আরোরা, ফায়ান কী কোনো ভাবে তোকে পছন্দ করে?’

আরোরা চমকে উঠলো আইমানের বচনে। তার ভাই এমন প্রশ্ন কেন তুললো আরোরার অজানা। তবে আইমান কী কিছু টের পেয়েছে এরূপ বিষয়ে? আরোরা আইমানের মুখশ্রীতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আইমানের সন্দিহান দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ। আরোরা আমতা আমতা করে বললো,

-‘এসব কী বলছো ভাইয়া? এসব কিছুই না। উনি তো আমার স্যার!’

বলেই আরোরা পুণরায় আইমানের দিকে তাকালো। আইমানের মুখশ্রী দেখে মনে হলো না সে এই উত্তরে সন্তুষ্ট হয়েছে। তার দৃষ্টিতে পূর্বের ন্যায়ই সন্দেহে ভরপুর। জড়তায় আরোরা কয়েকবার শুকনো ঢোক গিললো।

~চলবে।