প্রণয়ী পায়রা পর্ব-১৮

0
654

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ১৮ |

[কপি নিষেধ]

-‘তুমি ঠিক বলেছিলে জেবা, ওদের মুখশ্রী মুখোশে আবৃত ছিলো। আমি তাদের মুখোশের আড়ালের ছোবলময়ী মুখশ্রী চিনতে পারিনি। ভুল ছিলাম, আমি!’

বলতে বলতেই রুহান নিজের মুখে দুই হাত দিয়ে ঢেকে ফেললো। জেবা পৈশাচিক হাসি দিলো। অতঃপর রুহানের পাশে বসে সান্ত্বনামূলক বাণী ছেড়ে বলে,

-‘আমি তোমায় আগেই বলেছিলাম রুহান। ওরা ভালো নয়, আরোরা আপু তো বিষাধর সাপ। ভালোই হয়েছে তুমি তাদের চিনতে পেরেছো!’

রুহান চোখ মেলে তাকায় এবং মুখ থেকে হাতটাও সরিয়ে নেয়! জেবা রুহানকে ক্ষেপানোর জন্যে তার সাথে আরও কিছুটা ঘেষে বসে এবং ম্লান হেসে বলে,

-‘ভয় পাবে না। ওদের থেকে প্রতিশোধ নেও। সকলকে দেখিয়ে দাও, তোমার মতো ভোলাভালা ছেলে পেয়ে ওরা তোমার সঙ্গে কেমন আচরণ করেছে। আমি সবসময়ই তোমার সাথে আছি৷ তুমি যে আমার…’

মাঝপথেই জেবা থেমে যায় এবং দৃষ্টি নত করে ফেলে। তার মুখশ্রীতে ভর করেছে লাজুকতা। রুহান জেবার লাজুক চেহারায় চোখ বুলিয়ে থমথমে গলায় বলে ওঠে,

-‘আমি কী?’

-‘যাও বলবো না। আমার লজ্জা করে! শুনো রাত হচ্ছে, আমি যাচ্ছি।’

-‘আসো তোমায় পৌঁছে দেই?’

-‘না, না। আমি যেতে পারবো!’

বলেই জেবা রুহানকে বিদায় দিয়ে চলে যায়। রুহানও তার বাসার দিকে রওনা হয়। জেবা আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে স্মিত হাসলো। অতঃপর হেসেই বলে,

-‘কী বোকা তুমি রুহান! শেষ পর্যন্ত আমার ফাঁদে পা দিয়েই দিলে। সো সুইট অফ ইউ!’

————

দুইদিন হয়ে গেলো, রুহান আর আরোরাদের সাথে মিশে না। বেশ দূরত্ব বজায় রাখে। আরোরা বিষয়টি লক্ষ্য করলেও আরিশার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। এ নিয়ে আরোরার ছটফটানির শেষ নেই। আরিশাও যেমন তার বেস্টফ্রেন্ড, রুহানও তাই। দুজনের দুজনকেই আরোরার জীবনে চাই। একজন কম হলেও তার একদম চলবে না। আরিশাকে এ প্রসঙ্গে কিছু বললেই আরিশা বিরক্তির সাথে জবাব দেয়,

-‘তার কাছে যদি দু’দিনের জেবা প্রিয় হয়ে তাহলে ওরে নিয়েই থাকতে দে! আমাদের কী?’
এই বিষয়টি আরোরা একদমই মানতে নারাজ। রুহান যার সাথে ইচ্ছা মিশুক, সর্বপ্রথম তো ওদের বন্ধু? কেন তাদের এড়িয়ে চলছে রুহান? এত এত প্রশ্ন সব আরোরার মস্তিষ্কেই গেঁথে রইলো। এই বিষণ্ণ মনে সে আরেকটা খারাপ সংবাদ শুনতে পায়। জানতে পারে ফায়ান খুব শীঘ্রই রিজাইন লেটার দিতে চলেছে।
যা শুনে আরোরার ভেতরটা ধক করে উঠলো। অদ্ভুতভাবে তার সবকিছু ফাঁকা লাগতে শুরু করে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার।
আর কিছু হোক না হোক, সে ফায়ানকে তো প্রতিদিন দেখতে পারবে না। এমনেই সে চরমভাবে তৃষ্ণার্ত। এমতাবস্থায় ফায়ান তাকে মরুভূমিতে একা রেখে গেলে সে পিপাসাতেই মরে যাবে। আরোরা নিশ্চুপ হয়েই বসে রইলো।

—-

ফায়ান নিজের কেবিনে প্রয়োজনীয় ফাইলগুলো একটা বক্সে নিয়ে নিচ্ছে। ফাইল চেক করার মুহূর্তেই কেউ একজন ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছে। এতে অসাবধানবশত তার হাত থেকেও ফাইলটা পরে যায়। ফায়ান হতবিহ্বল হয়ে মেঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরা ফাইলের কাগজগুলোতে নজর বুলাতে লাগে। হঠাৎ কর্ণগোচর হয় ফোঁপানোর শব্দ!

-‘আপনি জানেন কতো নিষ্ঠুর! আপনার ওই নিষ্ঠুর হৃদয়ে কী আমার জন্য সামান্যতম মায়া জম্মায় না? আমি কী এতোটাই অসফল, আপনার ওই মনকুঠুরিতে জায়গা করে নিতে? এতোই কুৎসিত আমি, যার জন্যে শুধু কষ্ট দেন? আর কতো আঘাত করবেন, কতো আমার থেকে অদূরে চলে যাবেন বলুন তো?’

ফায়ান নিরুত্তর। সেভাবেই থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে সে। হয়তো আরোরার বচনগুলোর সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত। যখন সে প্রতিটি অক্ষর বুঝতে পারে তখন আবেশে প্রণয়িনীর কোমড় জড়িয়ে ধরে। আরোরার চোখের জলে তার শার্ট কিছুটা ভিঁজে গেছে। এ যেন স্বর্গীয় সুখ। আরোরা যখন দেখলো ফায়ান কথা বলছে না তখন সে নিজেকে ছাড়িয়ে দূরে সরে যেতে চাইলো, কিন্তু ফায়ানের জন্যে ব্যর্থ। ফায়ান তার বাঁধন আরও শক্ত করে আরোরার কানের সামনে মুখ নিয়ে বলে,

-‘শুদ্ধ ভাষায় একটা বাক্য বলি?’

আরোরা উত্তরে কিছু বললো না, ওভাবেই নিশ্চুপ হয়ে রইলো। ফায়ান নিশব্দে হেসে ফিসফিস করে বলে,

-‘আপনি আমার অভ্যন্তরের প্রণয়ী পায়রা!’

————————————–

-‘বস! এ কী শুনছি? আপনাকে নাকি এমপি দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে?’

ইয়ামিন ফোঁস ফোঁস করে রাগে ফুঁসছে। চোখ দিয়ে যেন আগুনের লাভা বের হচ্ছে তার। রুম ভীষণ এলোমেলো। কিচ্ছু জায়গামতো নেই। সব ভেঙ্গে চুড়মার করেছে কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই। ইয়ামিন তার লোকের কোনো জবাব দিলো না। মুহূর্তেই পুরো রুমে ছড়িয়ে গেলো কঠিন নিস্তব্ধতা। ছেলেটি তার মনিবকে রাগাম্বিত দেখে ভয়ে আর মুখ খোলার সাহস পেলো না। নিস্তব্ধতা প্রগাঢ় হওয়ার পূর্বেই ইয়ামিন শব্দ করে নরম বিছানায় শুয়ে পরে এবং থমথমে গলায় বলে,

-‘এই রুম দ্রুত পরিষ্কার হওয়া চাই! নতুন সদস্য আসবে, এরকম নোংরা থাকলে চলে নাকি?’

ছেলেটা কিছুটা ভড়কে উঠলো ইয়ামিনের কথায়। নিজের কৌতুহল সামলাতে না পেরে আমতা আমতা করে বলে উঠলো,

-‘মা..মানে?’

ইয়ামিন হেসে উঠে বসে। অতঃপর সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

-‘পরশু ডিল, আগামীকাল তোদের ভাবী আসছে। লেট’স পার্টি এন্ড রেডি ফর টুমরো!’

——

সকাল থেকেই আরোরা নিখোঁজ। আরিশার মতে সে ভার্সিটিতে যায়নি। আরিশার এই উক্তিতে অনন্যা পরপর দু’বার জ্ঞান হারিয়েছে। চোখে ভেসে উঠছে তার সেই অতীতের ঘটনা। অনন্যা কেঁদে কেটে পুরোই অস্থির৷ মেয়ে/বোনের নিখোঁজ হওয়া শুনে মুনীব, আইমান উভয়েই ছুটে আসে বাড়িতে। দুপুর তিনটা। আরোরার ফোন বারংবার সুইচড অফ বলছে। অনন্যা মুখে আঁচল গুঁজে কাঁদছে। আরিশা তার পাশে বসে অনন্যাকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আরিশার চোখেও জল৷ আরিশাও যে সমানতালে চিন্তিত। মুনীব দূরে দাঁড়িয়ে কোনো এক অফিসারের সঙ্গে চিৎকার-চেঁচামেঁচি করছে। মেয়ের নিখোঁজ হওয়ায় মুনীবও নিজেকে সামলাতে পারছে না। আইমান কী করবে বুঝলো না, দুই-তিন ঘন্টার মতো সময় নিয়ে বাহিরে খুঁজে এসেছে বোনকে। আইমান ডায়াল লিষ্ট চেক করতে নিতেই ফায়ানের কথা কথা পরে যায় তার। দ্রুত সে কল দেয় ফায়ানের নম্বরে। ফায়ানের নম্বরটা আউট অফ নেটওয়ার্ক বলছে। কয়েকবার চেষ্টা করলো, কোনো ফল পেলো না। আইমানের ক্রোধে ফোনটা আছাড় মারতে ইচ্ছে হলো।

-‘আচ্ছা রুহান, তোমার কী মনে হয় না আরোরার প্রতি প্রতিশোধ পরায়ণ হতে?’

জেবার এরূপ বচনে রুহান তেঁতে উঠলেও তার এক মেসেজের কথা মনে পরলো। রুহান অধর জোড়া প্রসারিত করে জেবাকে কাছে টেনে বলে,

-‘অবশ্যই। আমি চাই, আরোরা ধ্বংস হোক! ওদের মতো মেয়ের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু…’

রুহানের উক্তিগুলো জেবার মনে তৃপ্তি আনতে লাগে। কিন্তু রুহান থেমে যাওয়ায় জেবা বিরক্ত হয়, চরম বিরক্ত! জেবা রুহানের ফ্যাকাসে মুখটার দিকে দৃষ্টি নিবব্ধ করে বলে,

-‘কিন্তু কী?’

-‘কীভাবে প্রতিশোধ নিবো? ও যে ধরাছোঁয়ার বাইরে!’
মুখটা বেজার করেই বলে রুহান। জেবা এতে অট্টহাসি দেয়। হাসতে হাসতেই বলে,

-‘ব্যাপার না রুহান। আজ ভাইয়া আরোরাকে বিয়ে করছে। ও তো শুধু ভাইয়ার রাতের পার্টনার। সারাদিন তো আমি-ই ওকে তিলে তিলে মারবো। তুমি চিন্তা করিও না তোমাকেও আমার দলে সামিল করবো!’

ভয়েসটা রুহান অধিক সতর্কতার সঙ্গে কাউকে পাঠিয়ে দিলো। তার মুখশ্রীতে সুপ্ত চিন্তার ভাব ফুটে উঠলেও নিমিষেই সে অধরে হাসির রেখা টানলো। জেবার গাল টেনে আহ্লাদী স্বরে বলে,

-‘এ তো সুখবর! চলো আমি আর তুমি মিলে ওদের বিয়েটা উপভোগ করি?’

-‘একি বলছো? ভাইয়া সেখানে যেতে নিষেধ করেছে তো!’

-‘এই ‘সেখানে’ টা আবার কোথায়?’

সঙ্গে সঙ্গে আড়ালে টেপ রেকর্ডার চালু করলো রুহান। জেবা মিষ্টি হেসে বলে,

-‘ভাইয়ার পুড়ে যাওয়া ফ্যাক্টরিতে। আজই কিডন্যাপ করেছে ভাই ওকে!’

————————

পোড়া, বিদঘুটে গন্ধে আরোরার বমি আসার উপক্রম। মুখে কাপড় বাঁধা সত্ত্বেও নাকে এই বাজে গন্ধটা এসে ঠেকছে। আরোরার সামনেই ইয়ামিন কাজীর সাথে কথা বলছে। কাজীকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কাজীকে হুমকি-ধামকি দিয়ে এখানে আনা হয়েছে। আরোরা তার পেছনের হাতের বাঁধন খোলার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালায় কিন্তু এতোই শক্ত বাঁধন আরোরার হাতের অংশে রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। আরোরার চোখ এবং ঠোঁট বড্ড জ্বালা করছে। সারাদিন ধরে কান্না করেছে, চোখ আর কতোটা ভালো থাকতে পারে? ইয়ামিন বেশ কয়েকবার তার গালে চড় মেরেছে যার ফলে তার ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়েছে। সেই ঠোঁটের জ্বালার মাঝেই আবার মুখে কাপড় বেঁধেছে। আরোরার চোখ আবারও ঝাপসা হয়ে এসেছে। মনে পরে যাচ্ছে ফায়ানের সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত। আচ্ছা সে কী এই নরকে সারাজীবনের মতো ফেঁসে যাবে? পারবে না ফায়ানের কাছে ফিরে যেতে? সত্যি-ই কী ইয়ামিন নামক কালো ছায়া তাকে নিঃশ্ব করে দিবে? আরোরা শূন্য দৃষ্টি উপরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। উপরওয়ালা ব্যতীত তার সামনে আর কোনো পথ নেই। ইয়ামিন কাজীর সঙ্গে কথা বলে আরোরার বরাবর হাঁটু গেড়ে বসে। অতঃপর ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,

-‘বি রেডি ফর মিসেস ইয়ামিন হাওলাদার! আমিও দেখবো আজ আমার হওয়া থেকে তোমায় কে বাঁচায়!’

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।