প্রণয়ী পায়রা পর্ব-১৯

0
627

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ১৯ |

[কপি নিষেধ]

আরোরার উপর জোর-জবরদস্তি করা হয়। যখন ইয়ামিন দেখলো আরোরা কিছুতেই রাজি না তখন সে হুংকার ছাড়লো কাজীর উদ্দেশ্যে। কাজী কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে ইয়ামিনের হুংকারে।

-‘রেজিস্ট্রি ব্যাপার বের করো। সাইন না করলেও আঙুলের ছাপ দিয়ে দিবে। ফাস্ট!’

কাজী অনেকটা আতঙ্কিত হয়ে রেজিস্ট্রি পেপার গুছাতে লাগলো৷ আরোরার বাঁধন খুলে দেয়া হলেও পায়ে বাঁধন ছিলো৷ আরোরা তাড়াহুড়োয় বাঁধনটা খুলতে পারছিলো না। শেষে উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সে একপ্রকার লেসড়িয়ে লেসড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ইয়ামিনের থেকে পালাতে পারলো না। তার সকল কার্যই বিফলে যায়। ইয়ামিন যেই আরোরাকে আরেক চড় মারতে যাবে তখনই অদূর থেকে লোহার খন্ড ছিটকে গেলো যেটা ডিরেক্ট ইয়ামিনের মাথায় গিয়ে লাগে। ইয়ামিন টাল সামলাতে না পেরে বালিতে লুটিয়ে পরে। আরোরা তা দেখে ঝাপসা দৃষ্টিতে চারপাশে চোখ বুলালো। ইয়ামিনের লোকদের কালো পোশাকধারী গার্ডরা মেরে যাচ্ছে। অতঃপর আরোরা সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখতে পেলো। আরোরার নেত্রের অশ্রু ঝরঝর করে পরতে লাগলো। এটা দুঃখের না, সুখের। তার প্রেম পুরুষটি তাকে বাঁচাতে এসেছে। মুহূর্তেই বুলেটের বিকট শব্দ চারপাশে প্রতিধ্বনিত হয়। আরোরা আতঙ্কে দুই কান চেপে ধরে। চোখ মেলে দেখে ফায়ানের হাতে গান আর সেটা দিয়েই সে শুট করছে। আরোরা স্তব্ধ হয়ে যায়। ফায়ান তার প্রণয়িনীকে মেঝেতে এলোমেলো ভাবে বসে থাকতে দেখে দ্রুত ছুটে আসে। ফায়ান এসেই একহাতে আরোরাকে বুকে আগলে নেয় এবং অপর হাত দিয়ে আরোরার পায়ের বাঁধন খুলে দিতে লাগে। বাঁধন খোলা শেষ হতেই ফায়ান আরোরার মুখশ্রীতে তাকায়৷ আরোরাও বুক থেকে মাথা সরিয়ে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে ফায়ানের দিকে তাকায়। ফায়ান আবেগে আরোরার ললাটে অধর ছোঁয়ায়। আবেশে আরোরার চোখ বুজে রইলো। অতঃপর ললাটে ললাট লাগিয়ে ফায়ান ক্ষিপ্ত গলায় বলে উঠে,

-‘সরি আমার লক্ষিটি! আজ আমার ভুলের জন্যে তোমার এই হাল। আমি যদি ইম্পর্টেন্ট মিটিং এ না থাকতাম তাহলে ইয়ামিন আমারই গার্ডদের মেরে তোমায় কিডন্যাপ করতে পারতো না। তোমার সাথে করা প্রতিটি অন্যায়ের শাস্তি অপরাধীরা পাবে। আমার আদালতে এবং আমার নিয়মে ভয়ংকর মৃত্যু ভোগ করবে ইয়ামিন!’

আরোরা ভয়ে কেঁপে উঠলো এবং কিছুটা দূরে সরে এলো। হঠাৎ আরোরা ফায়ানের পেছনে তাকিয়ে এক চিৎকার দিলো। ফায়ান পিছে তাকানোর পূর্বেই অনল ফায়ানকে রক্ষা করলো৷ ইয়ামিন তার লোহার খন্ডাংশ নিয়ে দূরে ছিটকে পরলো। অনল ফায়ানের দিকে ফিরে হাতের সাহায্যে ফায়ানকে উঠতে সাহায্য করে। ফায়ান কয়েকজন গার্ডকে আদেশ করলো আরোরাকে প্রটেক্ট করতে। ফায়ানের বলার সঙ্গে সঙ্গেই ছয়জন আরোরাকে ঘিরে ধরলো। আরোরা ওভাবেই নির্বিকার হয়ে বসে রইলো এবং ফায়ানের হিংস্রতা নিশ্চুপ হয়ে দেখতে লাগলো।

ইয়ামিনের ভাড়া করা সব গুন্ডাদের কিছুক্ষণের মধ্যেই মেরে ফেলা হয়। ফায়ান এখন ইয়ামিনকে অনবরত মারছে। এক হাতে তার আগুনে পোড়ানো জলন্ত ছুঁরি আর আরেক হাতে পিস্তল। ইয়ামিন লেসড়িয়ে লেসড়িয়ে পেছনের দিকে যেতে লাগলো এবং শেষ একটা ফন্দি আটলো। শেষবারের জন্যে হলেও সে ফায়ানকে হারতে দেখতে চায়। ইয়ামিন তার রক্তমাখা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে,

-‘আমি জানি তুইও আরোরাকে ভোগ করতে চাস! আই প্রমিস, আমার ভোগ করা শেষ হলে তোকে আমি ওরে দিয়ে দিবো। তোরও সাধ মিটলো আর আমারও! আর যদি এতোই ভালোবাসিস, বিয়ে করে দেখা! এতদিন কই ছিলি? বিয়ের কথা উঠলেই মামা লেজ গুটিয়ে পালাও তাই না?’

ইয়ামিন ভেবেছিলো ফায়ান দমে যাবে। এসব মাফিয়াদের তো এ-ই কাজ৷ তাদের মন বলতে কিছু আছে নাকি? কিন্তু ভাগ্যিস, ফায়ানের একটা সুন্দর হৃদয় আছে! ফায়ান হিংস্রভাবে তাকালো ইয়ামিনের দিকে। অতঃপর অধর বাঁকিয়েই বলে,

-‘লেজ গুটিয়ে পালাবো আমি তাই না? ফাইন! তোর শেষ ইচ্ছা এবং হার দেখে নে। এখন এবং এই মুহূর্তে তোকে সাক্ষী রেখে আরোরাকে আমি বিয়ে করবো। তারপর তুই মরবি! তোর মৃত্যু এই ফায়ানের হাতেই লেখা!’

বলেই ফায়ান কিছু গার্ডকে ইশারা দিলো। তারা ইয়ামিনকে ভালোভাবে পাকড়াও করলো। অনলকে ইশারা দিতেই অনল পানির বোতল এনে কাজীর জ্ঞান ফেরালো। এতো রক্তপাত দেখে বেচারা তখনোই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো। আরোরা সেখানেই থমকে রইলো। ফায়ান তাকে বিয়ে করার কথা বলেছে? আরোরা নিস্তেজ প্রাণী হয়ে গেলো, একদম পুতুল।

অনল কাজীকে সব বুঝিয়ে দিলো। ফায়ান আরোরাকে নিয়ে কাজীর সামনে বসেছে। আরোরা তখনো আনমনা। এই কিছু সময়ের ব্যবধানে তার উপর দিয়ে কী ঝড়টাই না গেলো। ফায়ানের এই হিংস্র রূপ, ইয়ামিন সহ চারপাশের সবার করুণ চিত্র, এ যেন দুস্বপ্ন থেকেও অধিক ভয়ংকর। আরোরাকে আনমনা দেখে ফায়ান তার বলিষ্ঠ হাতের মুঠোয় নিলো আরোরার নরম মসৃণ হাত। আরোরা বাস্তবে ফিরে এবং আতঙ্কিত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ফায়ানের দিকে তাকায়। ফায়ান আরোরাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,

-‘ভয় পেও না। আমি আছি, তোমারই প্বার্শে। কবুল বললে বলে দিও প্লিজ?’

ফায়ান যে এখনো হিংস্র রূপে আছে সে সম্পর্কে আরোরা অবগত। আরোরার সামনে সে সবসময়ই নিষ্পাপ, মলিন ব্যবহার করে। আর মাঝেমধ্যে ওই যা একটু রেগে ধমক দেয় আর কী! আরোরা নিরুত্তর, শুধু শূণ্য নজরে তার প্বার্শে বসা যুবটিকে দেখতে লাগলো৷ হঠাৎ আরোরাকে কবুল বলতে বলা হলো। আরোরা কিছুটা সময় নিয়ে বলে, ‘কবুল!’

ফায়ানের পর্ব আসলে সে চিৎকার করে ইয়ামিনের দিকে তাকিয়েই বলে,

-‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল, কবুল, কবুল!’

ফায়ানের বচন পুরো পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরিতে প্রতিধ্বনিত হয়। বিয়ে সম্পন্ন হতেই কাজী মোনাজাত ধরলো। ইয়ামিন মোনাজাত না ধরলে এক গার্ড তাকে চড়-থাপ্পড় মেরে জোর-জবরদস্তি মোনাজাত ধরালো। মোনাজাত শেষ হতেই ফায়ান কিছুক্ষণ তার বিবাহিতা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর এক তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিয়ে ফায়ান উঠে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গেই ইয়ামিনকে গার্ডরা ছেড়ে দেয়। ইয়ামিনের মধ্যে পাহাড়সম ভয় ঘিরে ধরে। সে আকুতি-মিনুতি করতে করতে পিছে যাচ্ছে। কাজী এই সুযোগে কোনরকমে পালিয়েছে। ফায়ান কয়েকজন গার্ডের উদ্দেশ্যে বললো,

-‘আরোরাকে আমার গাড়িতে নিয়ে যাও ফাস্ট!’

বেশ ভয়ংকর শোনালো ফায়ানের কন্ঠস্বর। গার্ড এবং অনল স্বয়ং আরোরাকে নিয়ে বাহিরে চলে গেলো। বালিতে পরে থাকা ছুঁরি পুণরায় গরম করে এনে দেয় গার্ড। সেটা ফায়ানের হাতে তুলে দেয় সে। আরেকজন গার্ড ফায়ানের অপর হাতে গান ধরিয়ে দেয়। ছুঁরিটা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে যার ফলে ছুঁরিটাও বেশ ভয়ংকর লাগছে। ইয়ামিন প্রথমবারের মতো ভয়ে কেঁদে দেয়। ইয়ামিনের আকুতি ফায়ানের কর্ণগোচর হলো না। সে এক ছুটে ইয়ামিনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে এবং ছুঁরিটা দিয়ে তার ডান হাতে কোপ দেয়। ইয়ামিন চোখে আর্তনাদ করে উঠলো এবং অনবরত করতেই থাকলো। ফায়ান হিংস্রের মতো বামহাতেও কোপ দিলো। ইয়ামিনের আর্তনাদ শুনে ফায়ান পৈচাশিক হাসি দিলো। অতঃপর বললো,

-‘কেমন লাগছে? ধারালো ছুঁরির সাথে আগুনের তাপ, নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে? এখনো তো কিছুই করলাম না ম্যান! তুই কী ভেবেছিস? তোকে সহজ মৃত্যু দিবো? একদম না। সাপের লেজে পা দিয়েছিস তুই! এই সাপ তোকে একটা ছোবল নয়, খুবলে খাবে তোকে। কাতড়াতে কাতড়াতে মরবি তুই। বলেছিলাম না, আমার জানের দিকে চোখ তুলেও তাকাবি না? দেখ, কঠোর যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে মরবি। বুঝবি এই ফায়ান কী ভয়ংকর জিনিস! আমি ফায়ার, আগুন! তোকে ঝলসে দিবো আমি, সহ্য করতে পারবি তো?’

বলেই পেটে গভীরভাবে ক্ষত করলো। ইয়ামিন চেঁচালো। ইয়ামিনের হাতের দুই তালুতেও ছুঁরি দিয়ে পোছ দেয় ফায়ান। অতঃপর হাতের দিকে তাকিয়ে আফসোসের সুরে বলে,

-‘আজ যদি আমার জানের গায়ে হাত না তুলতি, তোর এই হাত বেঁচে যেত। কিন্তু আফসোস, তুই তো কুকুরের লেজ যা কখনো সোজা হয় না!’

বলেই দু পায়ে গুলি করলো। কাছ থেকে গুলি করায় গুলি দুটি বেরিয়ে গেছে। এবার ফায়ান ছুঁরি ঘুরাতে ঘুরাতে ইয়ামিনের মাথার কাছে এসে বসলো।

-‘এতদিন তোকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছিলাম জানিস? যাতে করে তোর মার কোল খালি না হয়। মায়েদের যথেষ্ট সম্মান করি আমি। আর তুই সেই মায়ের জাতিকেই ভোগের বস্তু বানিয়েছিস?’

বলেই সজোরে এক চোখে ছুঁরি বসিয়ে দেয়। এবার ইয়ামিন পূর্বের চেয়ে অধিক জোরে আর্তনাদ করে উঠলো। এতো যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ইয়ামিন সেখানেই মৃত্যুবরণ করলো। ফায়ান তার মনের মতো ঝাল মিটিয়ে উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর তআর গার্ডদের উদ্দেশ্যে বলে,

-‘সকল প্রুভ মুছে আবারও পুড়িয়ে দাও এই ফ্যাক্টরি। পুড়ে ছাই হোক সকল কালো সত্ত্বা! ইয়ামিনের দেহসহ সকলের দেহের হাড্ডি ব্যতীত কিছু যেন না দেখি!’

-‘আপনি নিশ্চিন্তে যান স্যার। এগুলো আমাদের বা হাতের কাজ!’

ফায়ান উত্তর দিলো না। ললাটের পাশের নিজের ছোট ক্ষতটির রক্ত মুছতে মুছতে সে বেরিয়ে গেলো।

———————————–

আইমান দরজা খুলতেই আরোরাকে কিছুটা আহত অবস্থায় ফায়ানের কোলে আবিষ্কার করলো। ফায়ান নির্বিকার হয়ে আইমানের পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে পরলো বিনা-বাক্যে। আইমানকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ পর্যন্ত দিলো না। ওদের এরূপ অবস্থায় দেখে উপস্থিত সকলে চমকে উঠলেও আরোরার করুণ অবস্থা দেখে মুহূর্তেই উত্তেজিত হয়ে উঠলো। কেউ কোনো প্রশ্ন করার পূর্বেই ফায়ান সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

-‘আগে আরোরাকে রেস্ট করতে দিন। চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন, প্রশ্ন করার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে না!’

বলেই ধপধপ পা ফেলে ফায়ান আরোরার রুমের দিকে যেতে অগ্রসর হয়!

~চলবে।
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, রিচেক দেয়া হয়নি। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।