প্রণয়ী পায়রা পর্ব-২০

0
630

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ২০ |

[কপি নিষেধ]

ফায়ানের আনন্দ আজ আকাশচুম্বী। আরোরাকে বাসায় দিয়ে সে কোনরকমে বাসায় গিয়ে গোসল সেরে গায়ে পাঞ্জাবি জড়িয়ে দ্রুত মসজিদের দিকে হাঁটা দেয়। তাদের এলাকার মসজিদের ইমাম তাকে বেশ ভালো করেই চেনে। ফায়ান বিনা দ্বিধায় ইমামকে অনুরোধ করে যেন তাকে নফল নামাজ পড়তে শিখিয়ে দেয়। ফায়ান তার ছোটমার থেকে শুনেছে,

-‘যখনই তুমি আল্লাহ’র পক্ষ থেকে কোনো সুসংবাদ অথবা তোমার দোয়া কবুল হতে দেখবে সেক্ষেত্রে নফল নামাজ পড়ে তার শুকুরিয়া জ্ঞাপন করতে হয়। নামাজ ব্যতীতও ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে শুকরান গুজার করতে পারবে। এতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন।’

ছোটমা বেশ ধার্মিক মানুষ। তার এসব সম্পর্কে বেশ জ্ঞান আছে। তবে ফায়ান সাধারণভাবে নামাজ সম্পর্কে অবগত হলেও নফল নামাজের দোয়া এবং পড়ার নিয়মাবলি জানে না। ইমাম সন্তুষ্টি মনেই ফায়ানকে সবটা শিখিয়ে দেয়। ফায়ান সব রপ্ত করে দেরী না করে ওযু-খানার উদ্দেশ্যে ছুটে যায়!

-‘কী ব্যাপার আমার পুত্র, আজ তুমি এতো খুশি যে আমার থেকে নফল নামাজ শিখলে? কোনো সুসংবাদ?’

ফায়ান বাঁকা হাসলো৷ তসবিহ পাঠ করতে করতে স্মিত হেসে বললো,

-‘আল্লাহ আমার সবচেয়ে বড় দোয়া কবুল করে নিয়েছেন হুজুর! যাকে আমি প্রাণপনে চেয়ে এসেছি, তার সঙ্গে আমার পবিত্র বাঁধন জুড়েছে। তার দরবারে না এসে কী করে পারি বলুন তো? আমি যেটাকে কঠিনভাবে নিয়েছিলাম উনি তা সহজভাবে করে দিয়েছে। শুকরান আলহামদুলিল্লাহ!’

হুজুর হাসে। অতঃপর ফায়ানের প্বার্শে বসে প্রশ্ন করে,

-‘তা কোন অমূল্য রত্ন চেয়েছিলে শুনি, যার জন্যে আমার ফায়ান পুত্র নিজ থেকে মসজিদে ছুটে এসেছে?’

-‘আমার ভালোবাসা অর্থাৎ আমার বউকে!’

————————————–

এশারের ওয়াক্ত। আযানের ধ্বনি চারপাশে নিবিড়ভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। হিম বাতাসে নিমজ্জিত পরিবেশ। আরোরা বিছানায় গা এলিয়ে জানালা ভেদ করে বাহিরের বিশাল অম্বরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার দৃষ্টি আনমনা। আযানের ধ্বনিতেই তার ধ্যান ভাঙ্গে মূলত। আরোরার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়। হাতের ব্যান্ডেজটার দিকে দৃষ্টি বুলায় সে। অতঃপর বিয়ে এবং ফায়ানের ভাবনা আবারও মস্তিষ্কে হানা দিতেই আরোরা তপ্তশ্বাস ফেলে। আবারও আযানের ধ্বনি কানে আসে। আরোরা উঠে বসে এবং বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ায়। অতঃপর ওয়াশরুমের দিকে যেতে অগ্রসর হয়।

ওযু সেরে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ায় আরোরা। নামাজ সেরে মোনাজাতে আসতেই কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে রইলো। অতঃপর আল্লাহর কাছে বলতে লাগলো,

-‘আমি জানি না মাবুদ, আপনি আমায় কোন দিকে নিয়েছেন, কার সাথে পবিত্র বন্ধন তৈরি করেছেন। আমি জানি না মানুষটা সৎ কি না, তবে আজ তার আসল রূপ দেখে আমি কিছুই ভাবতে পারছি না মাবুদ, মস্তিষ্কে আমার প্রশান্তি আসছে না। সারাটাদিন নানান খারাপ কিছুর সম্মুখীন হতে হয়েছে, এই খারাপ মুহূর্তে বিয়ে নামক শব্দ সহ আরেকজন মানুষ আমার সাথে জুড়ে যাবে কে জানতো? আমি শান্তি চাই প্রভু, আপনি আমায় বুঝ দিন! পরিস্থিতি সামলানোর ধৈর্য দিন। আমি যেন পূর্বের ন্যায় স্যারের সাথে মিশতে পারি। যতোই হোক…’

বলতেই কিছুক্ষণ থেমে যায় আরোরা। অতঃপর আটকে গলায় বললো,

-‘যতোই হোক, উনি এখন আমার স্বামী৷ তাকে এবং আমার পরিবারকে সুস্থ এবং ভালো রাখুন, আমিন!’

বলেই আরোরা তার মোনাজাত শেষ করলো। বুকের উপর যেন বিরাট পাথর এসে বসেছিলো। নামাজের পরপর যেন বেশ হালকা লাগলো তার। জায়নামাজ নিয়ে উঠতেই আইমান রুমে প্রবেশ করলো। একপলক হিজাবে আবৃত আরোরাকে দেখে হাতের জায়নামাজের দিকে তাকায়।

-‘নামাজ পড়লি?’

-‘হুম ভাইয়া, কিছু বলবি?’

-‘না, এই জিজ্ঞেস করতে এলাম ঠিক আছিস কি না!’

-‘আলহামদুলিল্লাহ! শুয়ে থাকতে থাকতে ঠিক হয়ে গেছি!’ কাবার্ডে জায়নামাজ তুলতে তুলতে বললো। আইমান আর কিছু বললো না। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বলে,

-‘কিছু জিজ্ঞেস করার ছিলো।’

-‘আমি জানি তুমি কী জানতে চাও।’

-‘জানিস যেহেতু তাহলে চুপ করে আছিস কেন? আমাদেরও জানা। কী ঘটেছিলো? কে তোকে তুলে নিয়ে গেছিলো?’

-‘ইয়ামিন, ভাইয়া!’ তপ্তশ্বাস ফেলে জবাব দেয় আরোরা। এক মুহূর্তের জন্যে আইমানের ভেতরটা ধক করে উঠলো। পরমুহূর্তে রেগে কিছু বলতে নিতেই আরোরা তাকে থামিয়ে বললো,

-‘বিয়ে করতে চেয়েছিলো আমায়। আর ঠিক ওই মুহূর্তেই স্যার এসে হাজির হয়!’

বলেই চুপ করে যায় আরোরা। সে পারবে না সত্যিটা খুলে বলতে। আইমান জিজ্ঞেস করলো,

-‘তারপর?’

-‘ওইতো, পুলিশে দেয়ার আগেই ইয়ামিন পালালো। অতঃপর স্যার পুলিশদের লাগিয়ে আমায় এখানে ছেড়ে গেলো।’ পুরো মিথ্যাটা আগে থেকেই আরোরা ভেবে রেখেছিলো। সে চায়নি আইমান ফায়ান সম্পর্কে খারাপ ধারণা নিক। আর যতক্ষণ না সে ফায়ান সম্পর্কে পুরোটা জানতে পারছে ততক্ষণে তার শান্তি হবে না। ইয়ামিন সেই মুহূর্তে খুব রেগে গেলো। রেগে কিছু বলতে নিবে তখনই অনন্যা এসে হাজির হয়। আরোরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আইমান যেভাবে তাকে চেপে ধরেছে তাতে তার মুখ ফসকে কথা বের হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিলো। অনন্যা নিজ হাতে আরোরাকে খাইয়ে দিয়ে আরোরাকে শুইয়ে দেয় এবং বলে,

-‘এখন ঘুমা মা! শান্তি লাগবে। কম ঝড় তো যায়নি!’

আরোরা উত্তরে একটা শুকনো হাসি উপহার দিলো৷ অতঃপর অনন্যা আইমানকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আরোরা ডান কাত হয়ে শুলো। অতঃপর চিন্তিত মনেই বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতড়ে হাতে নিলো। আজ ফোনটা সে বাড়িতেই ফেলে গেছিলো। আইমান তখন না বুঝতে পারলেও যখন আরোরার ঘরে আসে তখন টেবিলের উপর ফোনটা পায়। ফোন হাতে নিয়ে দেখে সুইচড অফ। আইমান অন করতে গিয়েই লক্ষ্য করলো চার্জ শেষ। সে বুদ্ধি করে চার্জ দিয়ে রাখায় আরোরার এখন ফোন চালাতে সমস্যা হচ্ছে না। সে অনেকক্ষণ ডায়াল লিস্টে ফায়ানের নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে রইলো। আপনমনেই বলে উঠলো,

-‘কী করছেন উনি? আমায় কী স্মরণে রেখেছেন আপনি?’

————————————–

অনন্যা এবং মুনীব বিস্মিত হয়ে বিপরীত সোফায় বসা ফায়ানের বলা বচনগুলো শুনলো। আরোরা বেশ দূরেই আছে এবং সে অনবরত ঘেমেই চলেছে। আইমান পিলারের সঙ্গে হেলান দিয়ে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। ইকবাল নিস্তব্ধতা প্রগাঢ় হওয়ার পূর্বেই মুনীব এবং অনন্যার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

-‘দেখুন আমাদের হাতে এখন কিছুই নেই! পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করেছিলো বিয়ের জন্য। এখন সেসব বিষয়ে বলতে আসিনি৷ আমি চাইছি আমার ভাইপো এবং আমার মেয়ের বিয়ে একসাথেই সম্পূর্ণ হোক। এখন আমাদের প্রস্তাবে আপনাদের মতামত কী? আমি চাইছি না বিয়েটা গোপনই থাকুক৷ যতই হোক একমাত্র ভাইপো, আমার ভাই ভাবীও এই সিদ্ধান্তে সম্মতি জানিয়েছে।’

মুনীব কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে ভাবলো। অতঃপর ম্লান হাসার চেষ্টা চালিয়ে বলে,

-‘মেয়ে যদি রাজি থাকে আর ফায়ান বাবা যদি চায়, আমরা আটকানোর কে? যেই পরিস্থিতি-ই হোক, শরিয়তের নিয়মেই তো বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছে।’

আইমানকে বিধ্বস্ত দেখালো বেশ। দিয়া আইমানের অবস্থা দেখে বুঝলো আইমান কী ভাবছে। ওদের কথার মাঝে বেঁগড়া হওয়ার পূর্বেই দিয়া লাজুক স্বরে মুনীবের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

-‘আঙ্কেল আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে আমি আইমানের সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চাই!’

-‘নিশ্চয়ই মা! তোমার বাগদত্তা এখন সে, পারমিশন নেয়ার কী আছে?’

দিয়া লাজুক হেসে উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর আইমানকে একপ্রকার জোর করেই সেখান থেকে ছাদে নিয়ে যায়! মুনীব ঘাড় বাঁকিয়ে আরোরার দিকে তাকালো। আরোরা মাথায় স্পর্শ পেতেই তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে তাকালো। মুনীব তার সামনে দাঁড়িয়ে।

-‘মা, গতকাল যা হয়েছে তা হয়েছেই। এখন তুই কী নতুন করে সব শুরু করবি? তুই কী চাস আমরা এগোই? তোকে জোর করবো না আমি!’

আরোরা নির্বাক দৃষ্টিতে একবার বাবার দিকে তো আরেকবার ফায়ানের দিকে তাকালো। ফায়ান এক বুক আশা নিয়ে আরোরার পানেই তাকিয়ে। মুহূর্তেই ফায়ানের সাথে কাটানো সকল ভালো মুহূর্তগুলো তার মস্তিষ্কে নাড়া দিলো। স্মৃতিচারণ করতে করতে আপনমনেই আরোরা বলে উঠলো,

-‘আমার কোনো আপত্তি নেই বাবা।’

~চলবে।

গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম। রিচেক দেয়ার সময় হয়ে উঠেনি।