প্রিয়া তুমি পর্ব-০৯

0
99

#প্রিয়া_তুমি
#পর্বঃ৯
#লেখিকা_লক্ষী_দেব

তানিয়া রাফসানের জন্য অপেক্ষা করল। রাতে যখন খেয়ে যার যার রুমে চলে গেল তখন তানিয়া একা রাফসানের জন্য অপেক্ষা করল। আমেনা বেগম মাথা ব্যা’থার কারণে টিকতে না পেরে রুমে চলে গেল। রাত বাড়তে লাগলো। ঘড়ির কাঁটা ১২ টার ঘর পেরিয়ে গেল। তানিয়া সোফায় বসে ঝিমুচ্ছে। তানিয়া সোফার গায়ে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। মিনিট খানেকের মধ্যেই চোখ জোড়ায় ঘুম নেমে এলো।

তানিয়ার চোখ জোড়া যখন ঘুমে বন্ধ ঠিক তখনই কলিং বেল বেজে উঠল। তানিয়ার চোখ থেকে ঘুম উড়ে গেল। সোফা থেকে উঠে দরজা খুলে দিল। প্রায় দুইদিন পর রাফসানের মুখ দেখল তানিয়া। রাফসানের মুখটা এখনও গম্ভীর করা। রাফসান তানিয়ার ঘুমে লাল হয়ে যাওয়া চোখ দুটো দেখে তানিয়ার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল।

তানিয়া রাফসানের এড়িয়ে যাওয়া দেখল। তবে কোনো কথা বলল না। তানিয়া রাফসানের জন্য খাবার বেড়ে দিল। রাফসান নি’শ্চুপে খাবার খেয়ে চলে গেল। তানিয়া নিজেও খাবার খেয়ে রুমে গেল।

রাফসান বিছানায় শুয়ে আছে। বাম হাতটা কপালের উপর রেখে চোখের উপর লাইটের আলো আসা আটকালো। তানিয়া বিছানায় গিয়ে বসল। রাফসানকে প্রশ্ন করবে, কি করবে না ভেবে বি’ব্রত বোধ করল। শাড়ির আঁচলটা আঙুলের মাথায় প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল,
“আপনি সারাদিনে কোথায় থাকেন?

তানিয়া প্রশ্নটা করে উত্তরের আশায় রাফসানের দিকে তাকিয়ে রইল। রাফসান কটা’ক্ষ করে বলল,
“আমি কোথায় থাকি সেটা জেনে তুমি কি করবে? আজকাল কি আমাকে স্বামী ভাবতে শুরু করেছো নাকি?

তানিয়া রাফসানের কটা’ক্ষ করে বলা কথাটা হজম করে নিল। দুচোখ বন্ধ করতেই তিন বছর আগের ঘটনাটা মনে পড়ল। সেই সাথে রিতার বলা কথাটাও মতো পড়ল। তানিয়ার মধ্যে আসতে আসতে তৈরি হওয়া কোমলতার স্বভাবটা যেন মুহুর্তের মধ্যেই ভে’ঙেচুড়ে কঠিন হয়ে গেল। তানিয়া কঠোর স্বরে বলল,
“আমার সাথে আপনার কোনো শ’ত্রুটা ছিল বলে তো মনে পড়ছে না। তাহলে কেন সেদিন ইচ্ছে করে আমাকে অপমান করলেন?

রাফসান কপাল থেকে বাম হাতটা নামিয়ে ফেলল। তানিয়ার দিকে তাকিয়ে অবাক ক’ন্ঠে বলল,
“আমি ইচ্ছে করে তোমায় অপমান করেছি?

“ইচ্ছে করে করেন নি? তাহলে কিসের ভিত্তিতে সেদিন বলেছিলেন, আপনার বোনের চোখের পানি স’হ্য করতে না পেরে আপনি ভার্সিটিতে এসেছেন। আপনার তো নিজের বোন নেই। রিতা আপনাদের এইখানে পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু রিতা আমাকে বলল রিতা আমার কথা আপনাকে বলেনি।

রাফসান তানিয়ার কথাটা শুনলো। বিছানায় উঠে বসে তানিয়ার দিকে তাকাল। তারপর মুখটা মলিন করে বলল,
“সেদিন ভুলটা আমার ছিল। আমি ইচ্ছে করে ওই রকম করতে চাইনি। কিন্তু মাথা গরম থাকায় ভালোমতো যাচাই না করেই তোমার সাথে অমন আচরণ করে ফেলেছিলাম।

তানিয়া অবাক ক’ন্ঠে বলল,
“মানে? কি যাচাই করেননি?

রাফসান দুচোখ বন্ধ করে সেদিনের কথা মনে করল। রিতা রাফসানদের বাসায় এসেছিল এখানে থেকে পড়ালেখা করবে বলে। ভার্সিটিতে চান্স ও পেয়ে ছিল। তবে সেখানে একদিনও টিকতে পারেনি। নতুন ভার্সিটি নতুন পরিবেশে অনেক উত্তেজনা, আনন্দ, খানিকটা ভয় নিয়ে গিয়েছিল রিতা। রাফসানই তাকে নিয়ে গিয়েছিল। তবে ভার্সিটির গেইট পর্যন্তই গিয়েছিল।

রিতার ভয় ছিল রেগিং নিয়ে। ভার্সিটিতে গেলে সিনিয়রদের কাছে রেগিংয়ের স্বীকার হতে হয় শুনেছিল রিতা। সেইটা নিয়েই মনের মাঝে কি’ঞ্চিত ভয়ের আভাস দেখা দিয়েছিল। তবে সেই কি’ঞ্চিত ভয়ের আভাসটা বিরাট হয়েছিল যখন একটা মেয়ে ‘এই মেয়ে’ বলে ডেকে উঠেছিল।

রিতার বুকটা ধক করে উঠেছিল। এই বুঝি রেগিংয়ের স্বীকার হতে হবে সেই ভয়ে ত’টস্থ হয়ে গেল। রিতা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকাল। তিনটা মেয়ে আর দুইটা ছেলেকে একসাথে গোল হয়ে বসে থাকতে দেখল। মাঝখানে বসা মেয়ের ডান হাতটা তার ডানপাশে বসে থাকা ছেলেটার কাঁধের উপর।

মেয়েটা বাম হাতের তর্জনী আঙ্গুলটা তাক করে রিতাকে কাছে ডাকল। রিতা দুরুদুরু বুকে এগিয়ে গেল। তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে খেয়াল করল মেয়েটার ঠোঁটটা কালো। মেয়েটার গাঁয়ের রঙের সাথে যা একদম বেমানান। রিতা নিজ মনে প্রশ্ন করল,
“আপুটা কি সিগারেট খায়?

রিতা নিজ মনে প্রশ্ন করার সাথে সাথেই তী’ক্ষ্ণ গলায় স্বরে কেঁপে উঠলো। মেয়েটার ডানপাশে বসে থাকা ছেলেটা ধ’মকে বলে উঠল,
“এই মেয়ে তুমি কোন ইয়ারের? নতুন মনে হচ্ছে।

রিতা মাথা উপর নিচ করে ‘হ্যাঁ’ বুঝালো। তখন মাঝখানে বসে থাকা মেয়েটা বলে উঠল,
“মাথা নাড়াচ্ছো কেন? তুমি কি বোবা? মুখ ফোটে কথা বলতে পারো না?

রিতা আবারো মাথা নাড়ালো। তখন দেখলো মাঝখানের মেয়েটা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। রিতা সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল সে আবারো একই ভুল করেছে। তড়িগড়ি করে বলল,
“জি, জি। আমি কথা বলতে পারি। আমি অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। আজকে প্রথম ক্লাস করতে এসেছি।

মাঝখানে বসে থাকা মেয়েটা এবার সোজা হয়ে বসল। তার ডান পাশে বসে থাকা ছেলেটার কাঁধ থেকে ডান হাতটা নামিয়ে নিল। বাম হাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে কপালের বাম দিকে পড়ে থাকা চুলগুলো আঙ্গুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল,
“গুড। তোমাকে দিয়ে সেই বিনোদন হবে। আমাকে চিনো তো। আমি তানিয়া। এবার ফাইনাল ইয়ারে বাংলা বিভাগের ছাত্রী। তো তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।

রিতা মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। মুখে বলল,
“কি কাজ আপু?

মেয়েটা চুপ করে রইল। হয়তো বা মনে মনে ভাবলো কি কাজ দেওয়া যায়। মিনিট দুয়েক পর বলে উঠল,
“গেইটের দিকে তাকিয়ে থাকো। যেই ছেলেটা প্রথমে আসবে তাকে একটা কিস করতে হবে। যদি একসাথে দুজন আসে তাহলে দুজনকে একটা একটা করে দুইটা কিস করতে হবে।

রিতা আঁতকে উঠলো। বুকের ভেতরের ধুকপুকানি বাড়তে লাগলো। এমন অপ্রত্যা’শিত কথায় শরীরটা কি’ঞ্চিত কাঁপতে লাগলো। রিতা শুকনো ঢোক গিলে বলল,
“আপু অন্য কোনো…..!

মেয়েটা হাতের ইশারায় রিতাকে থামিয়ে দিল। কড়া গলায় বলল,
“কোনো বাড়তি কথা শুনতে চাই না। হয় আমার কথামতো কাজ করবে নয়তো!

শেষের ‘নয়তো’ কথাটা টেনে বলে মেয়েটা বিশ্রি ভাবে হেসে উঠল। তার সাথে তাল মেলালো তার পাশে বসে থাকা ছেলেমেয়ে গুলো। রিতার হুট করেই কান্না পেল। ভার্সিটিতে আসলে এমন বি’শ্রী ঘটনা হবে জানলে কখনোই আসতো না। রিতার নীরবতা দেখে তানিয়া নামের মেয়েটার পাশের মেয়েটা ধ’মকে বলে উঠল,
“এই মেয়ে, তোমাকে কি বলল শুনতে পাওনি? তাড়াতাড়ি গেইটের কাছে যাও।

রিতার চোখে পানি চিকচিক করে উঠল। এই মুহূর্তে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়াকে জীবনের সবচেয়ে বড় অন্যায়’তম কাজ হিসেবে মনে করল। এখানে কি আদৌ মানুষ পড়তে আসে? শিক্ষালাভ করতে আসে? নাকি রেগিংয়ের নামে সিনিয়র ছাত্র-ছাত্রীরা জুনিয়রদের রেগিং নামক কুশি’ক্ষা দেয়।

রিতা দাঁড়াল না। এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতে লাগলো। পাঁচ জোড়া চোখ উৎসুক হয়ে রিতার কান্ড দেখতে লাগলো। তবে তাদের আশায় পানি ঢেলে গেইটের কাছে গিয়ে রিতা দৌড়ে বের হয়ে গেল। যা দেখে পাঁচ জনের মুখে হাসি ফুটলো। পাঁচ জনই দম ফাটা হাসিতে ফেটে পড়ল।

রিতা ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে রাফসানকে দেখতে পেল। চোখ থেকে পানি পড়তে লাগল। রাফসান একটা ছেলের সাথে কথা বলছে। হয়তো পরিচিত কেউ হবে। রিতা রাফসানের কাছে গিয়ে ভেজা ক’ন্ঠে বলল,
“ভাইয়া আমি এখানে পড়বো না।

রিতার চোখে পানি, মুখে এমন অদ্ভুত কথা শুনে রাফসান হতবাক হয়ে গেল। এইতো কিছুক্ষণ আগে মেয়েটা খুশি মনে ভার্সিটিতে গেল। এইটুকু সময়ে এমন কি হলো যে চোখ থেকে পানি পড়ছে। রাফসান অবাক ক’ন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে রিতা? তুই কান্না করছিস কেন? এখানে পড়বি না এটাই বা বলছিস কেন?

রিতা মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল,
“আমি পড়বো না ভাইয়া। এখানে পড়বো না। এখানে রেগিংয়ের নামে অসৎ কাজ’কর্ম করা হয়।

“রেগিং তো সিনিয়ররা জুনিয়রদের দেয়। এখানে ভার্সিটিতে না পড়ার কি সম্পর্ক?

রিতা রাফসানকে তানিয়া নামের মেয়েটির দেওয়া কাজটার কথা বলল। বলতে বলতে চোখ দুটো আবারো চিকচিক করে উঠল। সবগুলো কথা শুনে রাফসানের মুখটা রা’গে, ক্ষো’ভে গম্ভীর হয়ে গেল। হাত দুটো মুষ্টি’বদ্ধ করল। রিতার হাতটা ধরে বলল,
“চল আমার সাথে। কোন মেয়েটা বলেছে দেখাবি আমাকে।

রিতা নড়লো না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
“আমি যাব না। এখানে পড়বো না আমি।

“না গেলে মেয়েটাকে চিনিয়ে দিবি কীভাবে?

“মেয়েটা বলেছিল মেয়েটার নাম তানিয়া। ফাইনাল ইয়ারে বাংলা বিভাগের ছাত্রী। ভার্সিটিতে গেলেই দেখতে পাবে। মেয়েটাকে বোধহয় অনেকেই চিনে। কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখো।

রাফসান রিতার হাতটা ছেড়ে দিল। গটগট করে বি’ক্ষিপ্ত মেজাজে চোখের পলকে ভার্সিটির ভেতরে চলে গেল। ভার্সিটির ভেতরে এতো এতো মেয়ের মাঝে তানিয়া নামের মেয়েটি কে বুঝতে পারল না। রিতার কথামতো কাউকে জিজ্ঞেস করবে ভাবলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা মেয়েকে চোখে পড়ল। মেয়েটার কাছে জানতে পারল সে ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। মেয়েটাকে বলল,
“ফাইনাল ইয়ারের বাংলা বিভাগের ছাত্রী তানিয়াকে চিনেন?

মেয়েটা রাফসানের পিছনে আঙুল তাক করে বলল,
“ওই যে গোলাপি থ্রি পিস পড়া মেয়েটা। ওইটাই তানিয়া।

রাফসান পেছন ফিরে তাকাল। গোলাপি থ্রি পিস পড়া মেয়েটার ফর্সা গোলগাল মুখশ্রী দেখে থমকে গেল, মু’গ্ধ হলো। এই মেয়েটা এমন জ’ঘন্য রেগিং দিয়েছে? এই মেয়েটা? রিতার কান্না’রত মুখটা মনে পড়তেই রাফসানের মু’গ্ধতা কেটে গেল। গোলাপি থ্রি পিস পড়া মেয়েটার সামনে গিয়ে ঠাস ঠাস করে দুইটা থা’প্পড় মেরে বলে উঠল,
“কি ভাবেন কি নিজেকে? নিজে চরিত্র’হীন বলে দুনিয়ার সকল মেয়েকে চরিত্র’হীন ভাববেন? সকলে আপনার মতো চরিত্র’হীন না। সবাইকে নিজের মতো একই পাল্লিতে মাপবেন না।

#চলবে