তখন অপরাজিতা পর্ব-০১

0
87

তখন অপরাজিতা -১
শানজানা আলম

আজ শনিবার। হিসেব মতো অয়নির আজ বাবার সাথে দেখা করার কথা। কিন্তু আজ অয়নির যেতে ইচ্ছে করছে না একদম।ইদানিং মাঝে মাঝেই এমন হয়। যখন যা করার কথা তখন সেটা করতে ইচ্ছে করে না।অকারণে মন খারাপ হয়। মনে হয় দরজা বন্ধ করে চিৎকার করে কাঁদে।
অয়নির ভালো নাম অপরাজিতা।নামটা মা রেখেছেন।
অয়নি ঘুম থেকে উঠে বিছানায় হেলান দিয়ে বসল। ঘড়িতে আটটা বাজে। মা এতক্ষণে অফিসে চলে গিয়েছেন।আপুমণি অয়নির সাথেই ঘুমান। কিন্তু তিনি অনেক ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। ফজরের নামাজ পরে কোরআন তিলাওয়াত করেন।তারপর কিছু সময় ছাদে হাঁটেন।নাজমা ব্রেকফাস্ট দিয়ে দেয় টেবিলে সোয়া সাতটার মধ্যে। সে ব্রেকফাস্টও একটা বিরক্তিকর জিনিস, রুটি আর ভাজি, সাথে ডিম পোচ। ডিম পোচের মত এমন ল্যাতল্যাতে জিনিস অয়নির খেতে খুব বাজে লাগে, তাও জোর করে খেতে হবে।

মা বের হয়ে যান পোণে আটটায়, অফিসের গাড়ি তাকে পিক করতে আসে। অয়নির স্কুল ডে শিফটে, বারোটা থেকে শুরু হয়।আজ অবশ্য ছুটি।

অয়নির বাবা ঢাকায়ই থাকেন তবে তিনি আলাদা থাকেন।
কোর্টের নির্দেশমতো প্রতি শনিবারে অয়নির সাথে দেখা করেন।তবে ইদানীং বাবা ভীষণ ব্যস্ত। দুয়েক ঘন্টার জন্য আসেন, এসেই তাড়াহুড়ো শুরু করেন। অয়নি বাবাকে বলেছে, আসতে হবে না প্রতি সপ্তাহে।

অয়নির বাবা মা আলাদাভাবে ভীষণ ব্যস্ত।তাই তাদের একসাথে থাকা হয়ে ওঠেনি।অয়নি যখন ক্লাশ ফাইভে পড়ে, তখন একদিন মা বললেন, এখন থেকে মা আর অয়নি আপুমনির সাথে থাকবেন। অবশ্য তখনো যে বাবা রোজ বাসায় আসতেন, তেমন নয়। অয়নি শুনেছে আড়ালে, বাবার অফিসে একটা আন্টি ছিল, রিতু আন্টি, বাবা তার সাথেই থাকেন।অয়নি ক্লাশ টেনে পড়ে এখন। পাঁচ বছর আগে যা বুঝতে পারত না, এখন সেটা ভালো করেই বোঝে।বাবা রিতু আন্টিকে বিয়ে করেছেন।

আজ বিকেলে হাসিব ভাইয়া পড়াতে আসতে চেয়েছেন। তিনি সাধারণত বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার পড়াতে আসেন।গতকাল তার একটা রিইউনিয়ন ছিল। তাই আসতে পারেননি।

হাসিব ভাইয়ার কাছে পড়তে অয়নির খুব ভাল লাগে।
ভাইয়া দারুণ হ্যান্ডসাম। তবে ভাইয়া খুব একটা কথা বলেন না পড়াতে এসে। দেড়ঘন্টা থাকেন, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি পড়ান সপ্তাহে দুদিন। হাসিব ভাইয়া ‘প্রয়াস’ কোচিং এর টিচার।গতবার অয়নির ফিজিক্স কেমিস্ট্রিতে মার্ক একটু কম আসায় মা হাসিব ভাইয়াকে অনুরোধ করে বাসায় নিয়ে এসেছেন পড়াতে। নয়তো উনি বাসায় এসে প্রাইভেট টিউশনি করেন না। ভারী গম্ভীর মানুষ।

অয়নির ইদানীং কী যে হয়েছে, হাসিব ভাইয়ার মোটা ফ্রেমের চশমাটাও ভীষণ ভালো লাগছে। অন্য সব পড়া বাদ দিয়ে হলেও ফিজিক্স কেমিস্ট্রি রেগুলার পড়ছে, যদিও ভাইয়া “গুড” এর বেশি কিছু বলছেন না!
অয়নি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।
রোদ ঝলমল করছে, পাশের বাসার ছাদে কাজের মেয়েটা জামা কাপড় নেড়ে দিয়েছে।একটা সবুজ রঙের ওড়না পতপত করে উড়ছে পতাকার মত।অয়নির নামতে ইচ্ছে করছে না বিছানা থেকে।আপুমণি এসে কয়েকবার ডেকেছেন। ব্রেকফাস্ট করে তৈরি হতে হবে। নয়টায় কোচিং, সেখানেই বাবা আসবেন। তারপর তাড়াতাড়ি করে বাসায় ফিরতে হবে।
প্রতিদিন কোচিং থেকে বের হয়ে বন্ধুদের সাথে স্কুলে চলে যায় অয়নি।
আপুমণি আবারো ডাকছেন। অয়নি বিছানা থেকে নেমে ঝটপট হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে নিলো। ডাইনিংয়ে গিয়ে ওর মনটা ভালো হয়ে গেল।আজ আপুমণি খিচুড়ি রেধেছেন ছোলার ডাল দিয়ে।এটা ভীষণ ভালো হয় খেতে। তবে রোজ রোজ এটা রান্না হয় না বাসায়।
নানাভাই মারা যাওয়ার পরে আপুমনিও একটু নরম হয়ে গেছেন। এই পৃথিবীতে আপুমণিই অয়নিকে একটু বোঝেন।অয়নি খেতে বসল।
আপুমনি জলপাই এর আচার দিয়ে দিলেন প্লেটের পাশে।
-মা কী বের হয়ে গেছে?- আপুমনিকে জিজ্ঞেস করল অয়নি।
-মা বের হয় পোণে আটটায়, এখন বাজে পোণে নয়টা, বলে আপুমনি হাসলেন।তবে হাসলেও তিনি মনে মনে কষ্ট পেলেন।বাচ্চাটা মা কে পায় না একদম। সেপারেশন এর পর মনি কাজ নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে গেছে। তিনি মাঝে মাঝে ভাবেন, তিনি না থাকলে অয়নের
কী হবে!
অয়নি ব্রেকফাস্ট শেষ করে উঠল।এখনি বের হতে হবে, নয়তো কোচিং এ দেরী হয়ে যাবে। ভাগ্যিস স্কুল কোচিং দুটোই বাসার কাছেই। তাই অয়নি একাই যেতে পারে। আপুমনিকে আর বের হতে হয় না।

অয়নি কোচিং থেকে বের হয়েছে মিনিট বিশেক আগে। অয়নির বাবা আশফাক সাহেব ফোন করেছেন, কাছাকাছি আছেন কিন্তু জ্যাম অনেক। অয়নি ধানমন্ডি ৭/এ তে কেএফসি এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কেএফসি এর ভিতরে যেতে ইচ্ছে করছে না। বাইরে আজ রোদ বেশ চড়া।
অয়নির মুখ কালো হয়ে গেছে, ঘেমে একাকার অবস্থা। আশফাক সাহেব এসে নামলেন ওর সামনে। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে বললেন, চলো কেএফসি তে যাই?
অয়নি রাজি হলো না।গত কয়েকমাস ধরে ওর বাবার ব্যবহার মনে হচ্ছে অপরিচিত কেউ। ভালো লাগে না একদম।
অয়নি বলল, আমার টিউশনি আছে, আজ তো না এলেও পারতে!
অয়নির বাবা আশফাক সাহেব ব্যস্ত ইদানিং। একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন তিনি। অয়নির প্রতি তিনি সব দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু অয়নির মা রাজী হননি।শুধু একদিন দেখা করতে দিতে রাজী হয়েছেন। তার মনে হয়, মেয়েটাকে নিশ্চয়ই আজে বাজে কথা বলা হয় তার সম্পর্কে। নয়তো মেয়েটা কখনো কিছু নিতে চায় না, কোথাও খেতে যেতে চায় না! জাস্ট দেখা করেই চলে যেতে চায়। তার ইদানিং প্রতি সপ্তাহে দেখা করার বিষয়টা ভালো লাগছে না।
রিতুও বলেছে, এটা তার জন্য অপমানজনক।অয়নি এসে থাকুক তার সাথে, অন্তত মাসে কয়েকদিন।
একথা তিনি গত কয়েকমাস ধরে বলে উঠতে পারেন নি অয়নির মা কে। মণিকা অসম্ভব ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলে, আরে ঘরের বউ এত ভাব নিলে চলে নাকি!তাকে যদি প্রয়োজন অপ্রয়োজনে দুয়েকটা ঝাড়ি না দেয়া যায়, তার সামনে যদি কর্মচারীর মতো মিউমিউ করে থাকতে হয়!
ধুর, এসব ভালো লাগত না। তার আর রিতুর একটা তিন বছরের ছেলে আছে।ছেলেটার বুদ্ধিশুদ্ধি মনে হয় কম, কোন কথা বললে, অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। তার স্পষ্ট মনে আছে, এই বয়সে অয়নি টুকটুক করে ছড়া বলত, গান ছেড়ে দিলে তালে তালে নাচত, ফিকফিক করে হাসত।
আহা, মেয়েটা আমার! পর করে দিলো মেয়েটাকে।হঠাৎ আশফাক সাহেবের মনটা খারাপ হলো।
তিনি বললেন, চলনা মা, কোথাও বসি একটু। তুই তো আমার বাসায় যাবি না।
অয়নি কথা না বলে লেকের দিকে হাঁটতে লাগল। আশফাক সাহেব বললেন, আমড়া মাখা খাবি?
অয়নি বলল, নাহ। আমি কিছু খাবো না। আশফাক সাহেব লেকের পাড়ে বসলেন।অয়নি কথা বলছিল না।
আশফাক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি রেগে আছিস আমার উপরে?
অয়নি বলল, না তো, কেন?
আশফাক সাহেব বললেন, গত তিন মাসে তুই একবারো বাবা বলে ডাকিস নি আমাকে!
অয়নি কথা বলল না।আশফাক সাহেব বললেন, তোর সাথে আমি থাকতে পারিনি৷ এটা আমার একার দোষ না, তোর মায়েরও সমান দায়।
অয়নি বলল, এ বিষয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না।
আশফাক সাহেব বললেন, আমার সাথে থাকবি?
অয়নি আকাশ থেকে পড়ল, না না, আমি মা কে ছেড়ে থাকতে পারব না! বলেই মনে হলো, গত তিনদিন ধরে মায়ের সাথে দেখাই হচ্ছে না।গতকালও মায়ের মিটিং ছিল।
একটু থেমে অয়নি বলল, তোমার প্রতি সপ্তাহে আসতে হবে না, এত ঝামেলা করে আসো, কষ্ট হয়! মাসে একবার এসো।
আশফাক সাহেব মনে মনে ভাবলেন, মেয়েটার মনটা বিষিয়ে দিয়েছে।
যাক, কী আর করা যাবে!
তিনি বললেন, হুম, আমিও সেটা ভাবছিলাম, তোর যখন মন চাবে, আমাকে ফোন দিবি, আমি চলে আসব।
অয়নি হেসে মনে মনে ভাবল, তাহলে আর দেখাই হবে না, তোমরা দুজনই নিজেদের কথা ভেবেছ,আমাকে নিয়ে কেউ ভাবোনি!
আশফাক সাহেব উঠলেন। জোর করে অয়নিকে দু হাজার টাকা গুজে দিলেন।
অয়নি খুব অস্বস্তিতে পড়ল, মা জানলে খুব রাগ করবে।
প্রথম দিকে বাবাকে বলেছে, মা রেগে যায়।বাবা বলেছেন, মা কে জানানোর প্রয়োজন নেই।
এই টাকা অয়নি খরচ করে না।পিংক টেডির পেটে ঢুকিয়ে রাখে। অনেক টাকা জমেছে ওখানে।ইচ্ছে করলেই খরচ করা যায়, কিন্তু অয়নির ইচ্ছে ই করে না। অয়নিকে রিক্সা ঠিক করে দিলেন আশফাক সাহেব। তারপর ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন, রিক্সা চোখের আড়াল হওয়ার পরেও অনেকক্ষণ।
অয়নিতা অপরাজিতা খান৷ ক্লাশ টেন। সেকশন সানফ্লাওয়ার। গ্রুপ সায়েন্স। দোহারা গড়নের মেয়েটির শ্যামলা মুখে যত রাজ্যের মায়া। ওর বাবা মায়ের সেপারেশন হয়ে গেছে পাঁচ বছর আগে। তবে সেপারেশনের জন্য ওর তেমন কোন সমস্যা হয়নি। বরং ভালোই হয়েছে।আগে ওর সামনে প্রতিদিন ঝগড়া হতো। আলাদা হয়ে যাবার পরে নানীর কাছে চলে আসায় অন্তত ওর পাশে একজন মানুষ পাওয়া গিয়েছে।
অয়নির মা মণিকা খান। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। পড়াশোনা শেষ করে বেশ ভালো একটা চাকরি পেয়ে যান। পরিবারের পছন্দের বিয়ে হলেও তার স্বামী চাকরিতে তার উত্তরোত্তর উন্নতি মানতে পারতেন না!
সব সময় তার কথা মতো চলতে হবে, বাইরে সময় দেিয়া যাবে না। প্রতিদিন ঝগড়া ঝামেলার পাশাপাশি তার অ্যাফেয়ার শুরু হলো কলিগের সাথে।
মণিকা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করলেন না।মেয়েকে নিয়ে চলে এলেন সংসার ছেড়ে। চাকরির জন্য যখন সংসারই করা হলো না তবে চাকরিটাই ভালো ভাবে করি, এই ভাবনা পেয়ে বসলো তাকে। দিন দিন আরো উন্নতি করে বর্তমানে জাতিসংঘের একটি সংস্থার বাংলাদেশস্থ অফিসে উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করছেন।তবে আস্তে আস্তে মেয়ের কাছ থেকে সরে গিয়েছেন অনেকটা দূরে। ফর্মাল কিছু কথা ছাড়া অয়নিতার সাথে তার তেমন কথা হয় না।
অয়নিতার বাবা টিপিক্যাল বাঙালি পুরুষ, বউয়ের উপর হম্বিতম্বি করবেন। রাতে ফিরতে দেরী হলে চেঁচামেচি, অশান্তি চরমে উঠেছিল! তখন কলিগ রিতুর সাথে তার বোঝাপড়া ভালো হয়ে যায়। এটা জানাজানি হওয়ার পরে মণিকা চলে যান। সেপারেশন হয়ে যায় তাদের। মাঝখান থেকে অয়নি হয়ে গেল একদম একা।

চলবে।