প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-১১+১২+১৩

0
408

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-১১)
ইসরাত জাহান তানজিলা
_____________________
পাবেল উগ্র রোষ নিয়ে শ্রাবণীর সাথে চিৎকার করছে। মাঝে মাঝে বিশ্রী ভাষায় গালিও দিচ্ছে। এই উন্মাদ লোকটার উপর শ্রাবণীর মেজাজও তুমুল চড়ে গেল। ওর ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে পাবেলের গলায় ছুরি চালিয়ে চিৎকার বন্ধ করতে। অনেকক্ষণ ধরে পাবেলের এই উদ্ভট আচরণ সহ্য করছে। শ্রাবণী ধৈর্যচ্যুত হয়ে গেল এবার। ও চট করে খাট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
–‘আপনার চিৎকার চেঁচামেচি বন্ধ করুন দয়া করে এবার। নাটক আমি করছি নাকি নাটক আপনি করছেন? আপনিই আমায় অপহরণ করিয়েছেন। এসব কিছু সব আপনিই করিয়েছেন।’

শ্রাবণীর কথা শুনে রাগে যেন পাবেলের চোখ দুটো বের হয়ে যাবে। ও হঠাৎ শ্রাবণীর গলা টিপে ধরে বলল,
–‘সকাল থেকে তোমার বাপ আমার মাথা খারাপ করেছে। আর এখন তুমি করছো। গলা ধাক্কা দিয়ে তোমাকে এই বাসা থেকে বের করে দিবো। বলেছিনা আমি গাড়ি পাঠাইনি। তুমি নিজের ইচ্ছেতে কোথায়ও গিয়েছিলে। এখন উল্টো আমার সাথে গলা উঁচিয়ে কথা বলছো কোন সাহসে?’

পাবেল হিংস্র ভাবে শ্রাবণীর গলা টিপে ধরে আছে। শ্রাবণীর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। ও গলা থেকে পাবেলের হাত সরানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে। শ্রাবণীর দুর্বল চেষ্টা পাবেলের শক্তির কাছে তুচ্ছ। গলা থেকে পাবেলের বলিষ্ঠ হাত সরাতে ব্যর্থ হলো। শ্রাবণীর শ্বাস পুরোপুরি রুদ্ধ হয়ে আসছে। ওর চোখ বেয়ে নিঃশব্দে পানি গড়াচ্ছে। এক পর্যায়ে পাবেল ওর হাত সরিয়ে নিলো। শ্রাবণী ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে আর হাঁপাচ্ছে। একটু পর পাবেলও হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে বসলো শ্রাবণীর মুখোমুখি। পাবেলের চেহারার সেই ভয়ঙ্কর রাগটা হালকা হয়ে আসছে। সে শান্ত গলায় শ্রাবণীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
–‘যে কাজটা আমি করিনি সে কাজের দোষারোপ যদি আমার উপর দেওয়া হয় তাহলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। তোমায় অপহরণ করেছে, আটকে রেখেছে এসব তোমার সাজানো গল্প। সকালে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে কোথায় গিয়েছিলে তুমি? বিয়ের আগের কোনো‌ প্রেমিকের সাথে দেখা করতে নাকি কারো সাথে পালিয়ে যেতে? পালিয়ে যাওয়ার কথা বলে তোমাকে নেয়নি তোমার প্রেমিক? সেজন্য আবার বাসায় ফিরে এসেছো তাই তো? তুমি আমাকে বোকা বানাতে চাচ্ছো? আমার সাথে চালাকি করছো? আমার সাথে চালাকি করা এত সহজ নয়।’

শ্রাবণী এখনো হাঁপাচ্ছে গলায় হাত দিয়ে। পাবেলের আঙুলের ছাপ স্পষ্ট ভাবে বসে গেছে ওর গলায়। ফর্সা গলাটা লাল হয়ে গেছে। পাবেলের কথার প্রত্যুত্তর করার জোর পেল না। পাবেল বলল,
–‘আমার মুখে মুখে ভবিষ্যতে কখনো তর্ক করবে না। গলা টিপে মেরে ফেলবো।’

শ্রাবণী নিশ্চুপ। শরীরটা একদম নিস্তেজ হয়ে গেছে ওর। নড়াচড়া করার শক্তি নেই। পাবেল হঠাৎ শ্রাবণীর হাত ধরে টেনে ফ্লোর থেকে তুলে খাটে বসালো। এর ভিতর শ্রাবণীর ফোনটা বেজে ওঠল। শ্রাবণী নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকাল। শ্রাবণীর চেহারায় এখন কোনো রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ নেই। চেহারাটা একদম শীতল আর অসহায় লাগছে। সেলিম হোসেন ফোন করেছেন। ফোন ধরে তাকে চিন্তামুক্ত করা দরকার। শ্রাবণী ফোন ধরলো। ওপাশ থেকে সেলিম হোসেন উতলা হয়ে বলল,
–‘কে? কে? শ্রাবণী?’
শ্রাবণী ক্ষীণ গলায় আস্তে করে বলল,
–‘হ্যাঁ বাবা।’
সেলিম হোসেন বড়সড় একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ফোনের এপাশের শ্রাবণী সেটা পরিষ্কার শুনতে পেল। সেলিম হোসেন এবার দ্বিগুন উতলা হয়ে প্রশ্ন করল,
–‘কই ছিলি তুই? কোথায় গিয়েছিলি? কি হয়েছিল? ফোন বন্ধ কেন ছিলো?’
এ মুহূর্তে শ্রাবণী এত কথা বলতে পারবে না,
–‘বাবা আমি পরে সব বলবো। আমার বিশ্রামের দরকার।’
–‘আগে বলে তুই ঠিক আছিস তো পুরোপুরি? শুধু একটা কথা, বল তোকে কি ওই ড্রাইভার তুলে নিয়ে গিয়েছিল?’
–‘হুম বাবা।’
–‘কেন নিয়ে গেছে? কোথায় নিয়ে গেছে? এখন তুই কোথায়?’
–‘বলছি তো পরে বলব। এখন আমি বাসায়।’
শ্রাবণী ফোন রেখে খাটের সাথে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় চোখ বুজে রইল। পাবেল একটু তফাতে বসে আছে। খাটের পাশের সোফাটায়। শ্রাবণী এখন শুধু ভাবছে ও বাসায় ফিরলো কিভাবে? এই রুমে, এই বিছানায়? পাবেল অপহরণ করালে ও আবার বাসায় নিয়ে আসবে কেন? এই প্রশ্ন দুইটা শ্রাবণীর মস্তিষ্ক অস্থির করে তুলছে। পাবেলের সাথে কথা বলতে শ্রাবণীর ঘৃণা লাগছে। উল্টো শ্রাবণীকে দোষারোপ করছে পাবেল। এমন মেজাজ দেখাচ্ছে যেন ও সত্যি এ ব্যাপারে কিছু জানে না। শ্রাবণীর না ছিলো কোনো প্রেমিক, না কোনো শত্রু। অন্তত এমন পর্যায়ের শত্রুতা নেই যে এভাবে তুলে নিয়ে যাবে। কিন্তু এখন শ্রাবণীর কাছে কে তুলে নিয়ে গেছে ওর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ওকে ওই দালানটা থেকে এই বিছানায় পৌঁছলো কিভাবে? তুলে নেওয়ার বিষয়টা অস্বীকার করলেও শ্রাবণী কিভাবে বাসায় ফিরেছে অন্তত এটা তো পাবেল দেখেছে। এটা শ্রাবণীর একান্তই জানা দরকার। এই মুহূর্তে জানা দরকার। নয়ত এই প্রবল অস্থিরতা কমবে না। পাবেল এখনো সোফায় বসে আছে উন্মনা হয়ে। তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে কোনো বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। শ্রাবণী যন্ত্রের মতন মনের অনিচ্ছা ঠেলে জিজ্ঞেস করল,
–‘অন্তত এটা বলুন আমি বাসায় ফিরেছি কিভাবে?’
পাবেল আবার চোখ লাল করে তাকিয়ে বলল,
–‘এত অভিনয় করার প্রয়োজন নেই তোমার। তুমি দরকার হলে এখন আবার গিয়ে তোমার প্রেমিকের সাথে দেখা করে আসো। হু কেয়ারস? শুধু শুধু এসব নিয়ে প্রশ্ন করে আমার মাথাটা খারাপ করো না আবার।’
পাবেলের রাগ দেখেও শ্রাবণী দমল না। বলল,
–‘আচ্ছা আমি অভিনয় করছি। আমার প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গিয়েছি। তবুও এটা বলুন যে আমি কিভাবে বাসায় পৌঁছেছি?’
পাবেল এবার দম ফেলে বিরক্ত গলায় বলল,
–‘সন্ধ্যার সময় আমি ছাদে গিয়েছিলাম। দুই ঘন্টার মত ছাদেই ছিলাম। বাড়ির মেইন গেট খোলা ছিলো। ছাদ থেকে রুমে এসে দেখি তুমি ঘুমাচ্ছো।’
পাবেলের কথা শ্রাবণীর বিশ্বাস হচ্ছে না। এটা কি করে হতে পারে? কিছুতেই এমনটা হতে পারে না। পাবেলকে এ নিয়ে দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না শ্রাবণীর।
_______________
জয়নাল সাহেব পাবেলকে ফোন করলেন। তার সন্দেহও পাবেলের উপর ছিলো। কিন্তু শ্রাবণীর এভাবে ফিরে আসার কথা শুনে পাবেলের উপর আর সন্দেহ রইল। গোলমাল যা সব শ্রাবণীর ভিতরেই- এমনটাই জয়নাল সাহেবের ধারণা। তিনি শ্রাবণীকে ভীষণ সহজ-সরল ভেবেছিলেন। তার ধারণা মিথ্যা হওয়ায় সে কিঞ্চিৎ দুঃখ পেল। তবুও পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন,
–‘পাবেল এসব কিছু তুই করিসনি তো?’
–‘সত্যি বলছি বাবা আমি কিচ্ছু জানি না। আমার তো মনে হচ্ছে সব গোলমাল শ্রাবণীর ভিতর।’
–‘শ্রাবণী কি করছে এখন?’
–‘শুয়ে আছে।’
–‘আচ্ছা তুই ওকে কিছু বলিস না। আমরা কালকেই ফিরবো বাড়িতে।’
–‘কেন? কয়েকদিন থাকবে নাকি তোমরা?’
–‘না। এত ঝৈ ঝামেলা হচ্ছে বাড়িতে থাকি কিভাবে?’
–‘কিসের ঝৈ ঝামেলা? কিডনাপ-টিডনাপ এসব ওর মিথ্যে কথা বাবা। সুন্দরী মেয়ে। বিয়ের আগে কতজনের সাথে সম্পর্ক ছিলো। কার সাথে কোথায় কি দেখা করতে গেছে। তোমরা এসব নিয়ে চিন্তা করো না। নিশ্চিন্তে বেড়াও।’
–‘কোনো কিছু সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে এভাবে বলা ঠিক না পাবেল।’

জয়নাল সাহেবের সাথে পাবেল নিচু গলায় কথা বললেও শ্রাবণী সব শুনেছে। ওর কান‌ খুব পরিষ্কার। শ্রাবণীর খুব দুঃখ হচ্ছে ওর নামে বলা মিথ্যে বদনাম গুলো শুনে। অসহায় বোধ হচ্ছে। ও না শোনার ভান করে রইল। কিডনাপাররা শ্রাবণীকে যখন গাড়ির ভিতর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করেছিল তখন একজনের নখের আঁচড়ে শ্রাবণীর হাতের মাংস উঠে গিয়েছিল। সেই দাগটা এখনো তাজা। শ্রাবণীর মুখ যখন চেপে ধরেছিল তখন ওর মুখের কাছেও খামচির দাগ পড়ে গেছে। সেখানে এখনো জ্বলছে। তবুও এরা সবাই বলছে, শ্রাবণী মিথ্যা বলছে, অভিনয় করছে। তীব্র ক্ষোভ হচ্ছে শ্রাবণীর মনে। চোখ থেকে নিভৃতে জল গড়াচ্ছে।
একটু পর পাবেল এসে শ্রাবণীর পাশে শুইলো। আস্তে করে হাত রাখলো ওর কোমড়ে। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছে। শ্রাবণীও দূরে সরে যাচ্ছে। দূরে সরতে সরতে খাটের একদম ও প্রান্তে চলে গেল। আরেকটু হলেই খাট থেকে ধুপ করে ফ্লোরে পড়ে যাবে। এই লোকটার কি লাজ লজ্জার বালাই নেই? কোন লাজে শ্রাবণীর শরীর হাতাচ্ছে? শ্রাবণী হঠাৎ পাবেলের হাত দুটো ধরে ওর শরীর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো‌। তারপর চট করে খাট ছেড়ে উঠে গেল।

পাবেল বিহ্বল হয়ে গেল। শ্রাবণীর মত ভীতু ধাঁচের মেয়ে এভাবে ওর হাত ছুঁড়ে ফেলে দিবে এটা ও ভাবতেই পারেনি। কি আশ্চর্য! মেয়েটার সাহস বাড়ছে দিন দিন। শ্রাবণী রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় চলে গেল। বারান্দার দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো। মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস ছাড়লো। কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না ও। কি হয়েছিল ওর সাথে? চাপা এক ভয় শ্রাবণীর মনে বিরাজ করছে। ও চোখ বুজে সবকিছু মনে করার চেষ্টা করছে। কিচ্ছু মনে পড়ছে না। ওর চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছে। পাবেল নিজেকে এমন নির্দোষ দাবি করছে নিজেকে যে এ বিষয়ে তার সাথে কথাই বলা যাচ্ছে না। একদম তেতে ওঠে। শ্রাবণী ভেবেছিল ও বিছানা ছেড়ে আসার পর পাবেল চিৎকার চেঁচামেচি করবে। দরজা ধাক্কাধাক্কি করবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না। জানালার পর্দা সরিয়ে রুমের দিকে উঁকি দিয়ে শ্রাবণী দেখলো পাবেল ঘুমাচ্ছে। ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বাসায় শুধু ওরা দুজন। বাসাটা একদম নীরব। পাবেলের দাদা-দাদিও গেছে গ্রামের বাড়িতে। বারান্দায় কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা কদম ফুল গাছটা বাতাস ছাড়াই অস্বাভাবিক ভাবে নড়ছে হঠাৎ করে। শ্রাবণীর অচেতন মনে নানান শঙ্কা উঁকি দেয়। গা ছমছম করে ওঠে। ও তড়িৎবেগে বারান্দা থেকে রুমে চলে গেল। পাবেল গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। শ্রাবণী নিঃশব্দে খাটের এক কোণ ঘেঁষে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো।
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-১২)
ইসরাত জাহান তানজিলা
_____________________
দুই-তিন দিন কেটে গেল। অপহরণের ঘটনা নিয়ে কয়দিন অস্বাভাবিক ঘোরের ভিতর ছিলো শ্রাবণী। চাইলেও সে ঘোর থেকে বের‌ করতে পারেনি নিজের মন, নিজের মস্তিষ্ককে। কেউ ওভাবে তুলে নিলো আবার একদম বাসায় বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গেল! এর থেকে আশ্চর্যের কিছু শ্রাবণীর জীবনে আগে কখনো ঘটেছে বলে ওর স্মরণে আসে না। সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠে ছাদে চলে যায় শ্রাবণী। সকাল বেলার ছাদের পরিবেশটা মন ভালো করার মতন। সতেজ বাতাস গা ছুঁয়ে দেয়। টবে‌‌ লাগানো ফুল গাছের ফুল গুলো থেকে মৌ মৌ গন্ধ ছড়ায়। ফুল গাছের আশেপাশে প্রজাপতি আর ঘাসফড়িং নাচানাচি করে। টকটকে লাল চমৎকার দেখতে একটা প্রজাপতির দিকে শ্রাবণীর দৃষ্টি আটকে যায়। ও প্রজাপতিটাকে আঙুলের ডগায় বসানোর বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে কয়েক মিনিট ধরে। হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। পাবেল দাঁড়িয়ে আছে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠেছে‌‌ বোধ‌ হয়। মাথার চুল গুলো জবুথবু হয়ে আছে। ডান পায়ের ট্রাউজার হাঁটু পর্যন্ত তোলা। ঘুম জড়ানো গলায় শ্রাবণীকে বলল,
–‘চা কোথায় আমার? তুমি জানো না আমি ঘুম থেকে ওঠে সবার আগে চা খাই? চা না দিয়ে তুমি ছাদে বসে আছো।’
শ্রাবণী হেঁয়ালি করে বলল,
–‘কোথায় বসে আছি আমি? আমি তো দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রজাপতি ধরার চেষ্টা করছি।’
পাবেল বিরক্ত মুখে বলল,
–‘এই মেয়ে ফাজলামি করো তুমি আমার সাথে?’
–‘হ্যাঁ করছি ফাজলামি। আমি আপনার মত বুড়ো হরিণ না যে সব সময় সিরিয়াস মুডে থাকবো। আমার বয়স মাত্র ষোলো।’
–‘কি বললে তুমি আমায়? বুড়ো হরিণ?’
–‘তো কি আপনি কচি ছোকরা?
শ্রাবণীর এমন আচরণে পাবেল থ হয়ে গেল। মেয়েটার মাথা ঠিক আছে তো? এ মেয়ে তো পাবেলের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেই ভয় পেত। গত দুইদিন ধরে সব কথার বিপরীতে কি চটপটে উত্তর দিচ্ছে। পাবেল বড়ো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। বলল,
–‘বেশি কথা বলছো তুমি আজকাল। এত সাহস আসছে কোত্থেকে?’
–‘সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।’
–‘মানে? তুমি কি বলতে চাচ্ছো?’
–‘লেখাপড়ায় কি খারাপ ছিলেন আপনি? বাংলা প্রবাদও বুঝেন না।’
বিস্ময়ে পাবেলের চোখ দুটো যেন খুলে পড়বে। শ্রাবণীর মাথায় কি গণ্ডগোল হয়ে গেল? এই ষোলো বছরের এইটুকুন মেয়েটা ওর সাথে এভাবে কথা বলার সাহস পাচ্ছে কোথায়? পাবেল রাগ চেপে বলল,
–‘বকবক বন্ধ করে চা দিয়ে যাও।’
শ্রাবণী স্বাভাবিক ভাবে বলল,
–‘বানিয়ে খান। নয়ত কাজের মেয়ে রাখেন।’
–‘তুমি কি চাচ্ছো সকাল বেলা আমি চেঁচামেচি করি? কোন সাহসে তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছো?’
শ্রাবণী এক শব্দে হেসে উত্তর দিলো,
–‘দুঃসাহসে।’
পাবেল ছাদ থেকে নেমে গেল। ওর জরুরি কাজ আছে। শ্রাবণীর সাথে রাগারাগি করার সময় নেই। মেয়েটা দুইদিন ধরে ওর মেজাজের, রাগের একদমই গুরুত্বই দিচ্ছে না। কি আশ্চর্য! রাগে পাবেলের মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। ও ফ্রেশ হয়ে না খেয়েই রেডি হতে লাগলো। শ্রাবণী আজ নাস্তাও বানায়নি।‌‌ সকাল থেকে ছাদের বসে আছে। বিরক্ত ভঙ্গি নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধতে লাগলো পাবেল। হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দেখলো শ্রাবণী চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে ওর পিছনে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে মুখ বাঁকিয়ে হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। পাবেল আজ যতই শ্রাবণীকে দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। মেয়েটা বিচিত্র আচরণ করা শুরু করেছে হুট করে। শ্রাবণী কয়েক পা এগিয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে শব্দ করে চায়ের কাপটা রাখলো। ঠোঁটের হাসিটা আরো প্রশস্ত করে বলল,
–‘এই আপনার চা বুড়ো হরিণ। এই চায়ের একটা বিশেষত্ব আছে। এই চা খেলে মানুষের বয়স কমে, যৌবন ফিরে আসে। বুড়ো থেকে আপনি একদম কচি ছোকরা হয়ে যেতে পারবেন।’
পাবেল রেগে গিয়ে বলল,
–‘ঠিকঠাক ভদ্র ভাবে কথা বলো তুমি। কি সব বলছো এগুলো? নিয়ে যাও চা। তোমার চা তুমি খাও।’
শ্রাবণীর ঠোঁটের হাসি বিলীন হলো না। ও আগের ন্যায় হেসেই বলল,
–‘উঁহু। এই চা আমি খেতে পারবো না। আমার বয়স তাহলে আরো কমে যাবে। ষোলো থেকে দশ হয়ে যাবে। এখন তো আপনি আমার থেকে আঠারো বছরের বড়ো। তখন চব্বিশ বছরের বড়ো হয়ে যাবেন। আমার বাপ, চাচা, মামাদের বয়সী।’
পাবেল তীব্র রাগে চোখ দুটো বন্ধ করে বলল,
–‘তোমার এই অসংলগ্ন কথাবার্তা বন্ধ করবে? বের হয়ে যাও রুম থেকে।’
শ্রাবণী মাথা নত করে কুর্ণিশ করার ভঙ্গি করে বলল,
–‘পতি আজ্ঞা শিরধার্য। বের হয়ে যাচ্ছি আমি। আপনি বাসা থেকে বের হওয়ার আগে আমার সাথে দেখা করে যেয়েন। কপালে চুমু খেয়ে দিবো আপনার।’

পাবেল এবার একটু হোঁচট খেল শ্রাবণীর কথায়। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকায় শ্রাবণীর মুখের দিকে। লজ্জায় সিঁদুরে হয়ে ওঠছে ওর চেহারা। লাজরঞ্জিত মুখে হাসছে। কিছুক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে রইল পাবেল। গলার টাইটা অর্ধ বাঁধা। শ্রাবণীর কথায় কোনো প্রত্যুত্তর না করে ফের ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকালো। শ্রাবণী রুম থেকে চলে গেছে গুনগুন করতে করতে। পাবেল মনে মনে হাসছে শ্রাবণীর হালচাল দেখে। ও টাই বেঁধে গায়ে কড়া পারফিউম দিলো। তারপর রুম থেকে বের হয়ে রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জুতা পড়ছে নিচের দিকে ঝুঁকে।‌ এর ভিতর হঠাৎ শ্রাবণী কোত্থেকে ছুটে আসলো। পাবেল জুতা পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো মাত্র। পাবেলের সামনে দাঁড়ানো শ্রাবণী হঠাৎ চট করে চুমু খেয়ে নিলো পাবেলের কপালে। চুমু খেয়েই মুখ বিকৃত করে পাবেলের দিকে তাকিয়ে বলল,
–‘বিশ্রী স্বাদ আপনার কপালে। একটুও ভালো লাগলো না চুমু খেয়ে। আবেগ, অনুভূতি কিছুই হলো না। যেন রাস্তায় মাথা উঁচু করে সারি সারি ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা কারেন্টের খাম্বায় চুমু খেয়েছি আমি।’
যে শ্রাবণী সব সময় পাবেলের ছোঁয়া থেকে পালিয়ে বেড়ায় সে হঠাৎ করে এভাবে পাবেলের কপালে চুমু খেল! পাবেল মনে মনে অবাক হলো খুব। কিন্তু প্রকাশ‌‌ করলো না। রাগি ভঙ্গিতে বলল,
–‘বিশ্রী স্বাদ তো চুমু খেলে কেন?’
–‘আমার বাপ তো আমার গলায় কারেন্টের খাম্বা ঝুলিয়ে দিয়েছে। বিশ্রী স্বাদ‌ হলেই বা কি করার!’
–‘তোমায় এক হাতে তুলে জানালা দিয়ে রাস্তায় ছুঁড়ে মারবো। এ ধরণের বকবক তুমি ফের আমার সাথে করবে না।’
এই বলে পাবেল ব্যস্ত চোখে হাতের কব্জিতে আবদ্ধ গড়িটার দিকে তাকালো। দেরি হয়ে গেছে খুব। ও লম্বা লম্বা পা ফেলে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।
______________
পাবেল বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর শ্রাবণী হো হো করে হেসে উঠল। পাবেলের বিব্রত মুখটা আজ দেখার মতন ছিলো। পাবেলের‌‌ সাথে এমন আচরণ করতে শ্রাবণী মনে মনে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলো। তবুও মুখের অভিব্যক্তি স্বাভাবিক রেখেছে খুব চেষ্টায়। শ্রাবণী ভীত হয়ে ছিল; এই বুঝি পাবেল কষিয়ে ওর গালে চড় মারবে। সুন্দরী বউয়ের এমন আহ্লাদের বিপরীতে কজন পুরুষই বা চড় মারতে পারে? শ্রাবণীর ধারণা কোনো পুরুষই পারবে না।
শ্রাবণী রুমে আসলো। রুমটা পুরো অগোছালো। পাবেল আলমারির সব কাপড় নামিয়ে রেখেছে। কাপড় গুলো বিচ্ছিন্ন ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গোসল শেষে ভেজা চুপচুপে তোয়ালেটাও বিছানার উপর ফেলে রেখেছে। বিছানায় চাদরটা খাটের মাঝখানে দলা পাকিয়ে আছে। সোফার কুশন গুলো ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আশ্চর্য এই লোকটা রুমটা এমন হাল বানিয়ে রেখেছে কেন? শ্রাবণী চা বানিয়ে দেয়নি সেই ক্ষোভে? ড্রেসিং টেবিলের কাছে রাখা চায়ের কাপটাও এখনো সেখানে পড়ে আছে। পাবেল খায়নি চা। চা ঠাণ্ডা হয়ে শরবত হয়ে গেছে। শ্রাবণী বিরক্ত মুখে প্রথমে বিছানা গুছিয়ে তারপর আলমারিটা গুছিতে লাগলো। এই আলমারিতে সব পাবেলের জামাকাপড়। আলমারি গোছাতে গিয়ে শ্রাবণী হঠাৎ একটা প্যাকেট পেলো। প্যাকেটের মুখ খোলাই ছিলো। প্যাকেটের ভিতর কি আছে তা দেখার জন্য মুহুর্তেই কৌতুহলী হয়ে ওঠল ও। প্যাকেটের ভিতর একটা খয়েরি রঙের ফিনফিনে পাতলা শাড়ি দেখতে পেল। খুব দামি শাড়ি। পাবেলের আলমারিতে শাড়ি কেন? শ্রাবণী খুব বেশি অবাক হলো না। পাবেলের দুই চারটি প্রেমিকা আছে জানলেও খুব বেশি অবাক হবে না। পাবেল বড়লোক বাবার অতি আদরের বিলাসী ছেলে। দুই চারটা প্রেম থাকবে না এ কী করে হয়? হয়ত পাবেল তার কোনো প্রেমিকা কিংবা মেয়ের ফ্রেন্ডের জন্য কিনেছে। মেয়ে ফ্রেন্ডের থেকে প্রেমিকা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে কানের ঝুমকোও কিনেছে। সাথে চমৎকার একটা চিঠির খামও পেল। অন্যের চিঠি পড়া কি উচিত হবে? নিজের মনকে করা এমন অবন্তর‌‌ প্রশ্নের বিপরীতে শ্রাবণী নিজেই একা একা হাসলো। অন্যের চিঠি কোথায়? এটা তো ওর স্বামীর চিঠি। বিয়ের পর তো স্বামীই সব, সবচে আপনজন। শ্রাবণী চিঠিটা খোললো। চিঠিতে লেখা,
খয়েরি শাড়িতে তোকে বরাবরই সুন্দর লাগে। এ কথাটা কি তোর হাজবেন্ড তোকে কখনো বলেছে? না বললে বুঝে নিস সে তোর প্রতি একটুও মনোযোগী না।’

মেয়েটার হাজবেন্ড আছে। আবার মেয়েটাকে পাবেল তুই করে সম্বোধন করছে। তাহলে মেয়েটা কে হতে পারে পাবেলের? শ্রাবণী ব্যাগের ভিতর শুকনো কিছু গোলাপের পাপড়ি আর একটা চকচকে আংটি ও পেল। হীরার আংটি বোধ হয়। খুব সুন্দর আংটিটার ডিজাইন। কি করবে এখন এই প্যাকেটটা? আলমারিতে রেখে দিবে নাকি লুকিয়ে রাখবে? শ্রাবণীর মাথায় কু বুদ্ধি চাপলো। ও প্যাকেটটা লুকিয়ে ফেলল। চিঠিটা পড়ে ও দ্বিধায় পড়ে গেল মেয়েটা সম্পর্কে পাবেলের কে হয় এই নিয়ে। চিঠি পড়ে যদি পরিষ্কার বুঝতে পারতো মেয়েটা পাবেলের প্রেমিকা। তাহলে শাড়িটা কেটে কুচি কুচি করে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিতো।
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-১৩)
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
পাবেল সেই সকালে বের হয়েছে বাসা থেকে। এখনো বাসায় ফিরেনি। জয়নাল সাহেব গ্রামে যাওয়ায় এখন ব্যবসার সামান্য দায়িত্ব পাবেলের কাঁধে পড়েছে। শ্রাবণী সারাদিন বাসায় একদম একাকী ছিলো। বাসায় আর একটি প্রাণীও নেই। দুইটা কথা বলার কেউ নেই, আলাপচারিতা করার মতন কেউ নেই। এত বড়ো বাসা পুরোপুরি নিসাড়া। শ্রাবণীর গা ছমছম করে ওঠে। ও জানালার পর্দা সরিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। এরাস্তা দিয়ে তেমন গাড়ি যাওয়া-আসা করেনা। ওপাশের মেইন সড়ক ধরে গাড়ির চলাচল। নিরিবিলি রাস্তাটা। নিরিবিলি হওয়ায় রোজই বিকাল বেলায় জোড়ায় জোড়ায় কপোত-কপোতী এখান দিয়ে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যায় কিংবা রাস্তার পাশের বেঞ্চ গুলোতে বসে থাকে। কেউ কেউ আবার দিনে দুপুরে নির্জন রাস্তায় চুমুও খায়। এদের বোধ হয় লাজলজ্জার ঘাটতি পড়েছে। আজও এক জোড়া কপোত-কপোতীর হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটা গাঢ় খয়েরি একটা শাড়ি পরা, ছেলেটা খয়েরি পাঞ্জাবি গায়ে। মেয়েটার হাতে আধখাওয়া একটা আইসক্রিম। ছেলেটা মাঝে মাঝে সেই আইসক্রিমটায় কামড় দিচ্ছে। দুইজনের হাস্যোজ্জ্বল মুখ। মেয়েটা আদুরে ভঙ্গিতে হাসছে। ছেলেটা মুগ্ধ হয়ে সেই হাসি দেখছে। শ্রাবণী অনিমেষ দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে ছিলো। এক সময় ছেলে-মেয়ে দুটো ওর দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেল। শ্রাবণী এতক্ষণ মেয়েটার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে মনের ভিতর এক তীক্ষ্ণ অনুভূতির সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ছেলেটার জায়গায় শ্রাবণীর কল্পনায় পাবেল আসলো না। এসেছিল শ্রাবণীর কাঙ্ক্ষিত প্রেমিক মানুষটি। যে ওর জীবনে আসার সুযোগই পায়নি।

রাত নয়টার পর পাবেল বাসায় ফিরে। বাসায় এসেই গোসল দিতে যায়। শ্রাবণী তোয়ালে হাতে বাথরুমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। এসব যাইফের বু্দ্ধির। এই নিরামিষের সাথে এত রং ঢং করতে শ্রাবণীর মোটেও ভালো লাগছে না। কিন্তু এসব না করলে প্রেমের ফাঁদে আটকাবে কীভাবে? পাবেল শুধু কোমরে একটা তোয়ালে পেঁচিয়ে উদাম গায়ে বাথরুম থেকে বের হলো। শ্রাবণী এই অর্ধ নগ্ন লোকটার দিকে তাকাতেই লজ্জা পাচ্ছে, তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছিয়ে দিবে কীভাবে? পাবেল বাথরুম থেকে বের হয়ে শ্রাবণীকে তোয়ালে হাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
–‘বকবক থেমেছে? মাথা ঠিক হয়েছে তোমার? তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে আছো কেন এখানে?’
–‘বকবক থামেনি। বকবক শুরু করার জন্যই তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে আছি।’

এই বলে শ্রাবণী পাবেলের মাথা মুছিয়ে দিতে উদ্যত হলো। পাবেল সরে দাঁড়ালো। ভ্রু কুঁচকে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল,
–‘কি করছো তুমি এটা?’
–‘আপনার মাথা মুছিয়ে দিবো।’
–‘আমার মাথা মুছিয়ে দিতে হবে কেন? আর আমি কি মাথা না মুছে বাথরুম থেকে বের হয়েছি? আমার শুকনো মাথা তুমি কি মুছবে?’
শ্রাবণী বিব্রত হয়ে গেল। তাই তো; মানুষ কি মাথা না মুছে বাথরুম থেকে বের হয়? পাবেল যদি পঁচিশ বছরের নরম কোমর মনের রোমান্টিক হাজবেন্ড হত তাহলে হয়ত বউয়ের হাতে শুকনো মাথাও সাত বার মুছতে কোনো আপত্তি প্রকাশ করতো না। কিন্তু চৌত্রিশ বছরের বুড়ো এই আহ্লাদের মর্ম বুঝবে কি করে? পাবেল বলল,
–‘আজ আমার অনেক খাটাখাটুনি গেছে। আগড়ম-বাগড়ম কথাবার্তা বলে মেজাজ বিগড়াবে না। আর তোমার হঠাৎ হলোটা কি? কে দিচ্ছে তোমায় এসব বুদ্ধি?’
শ্রাবণীর মনে কু ডাক ছিলো। চমকে ওঠে বলল,
–‘কোন বুদ্ধি? কিসের বুদ্ধি?’

পাবেল উত্তর না দিয়ে শ্রাবণীকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে আলমারি থেকে কাপড় বের করছে। শ্রাবণীর আঁতকে ওঠল। যে আলমারি থেকে শ্রাবণী শাড়ি লুকিয়েছে সেই আলমারিই খুলেছে পাবেল। ওই প্যাকেটা তালাস করবে এখন নিশ্চিত। শ্রাবণী নিজের কপাল চাপড়াতে লাগলো মনে মনে। কেন লুকাতে গেল? আজকাল মাথায় এত কু বুদ্ধি আসছে কেন? একটু পর শ্রাবণী একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। পাবেল প্যাকেটটার খোঁজ করেনি। নিজের কাপড় বের করে আলমারি আটকে রেখেছে। পাবেল শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে শ্রাবণীকে জিজ্ঞেস করল,
–‘আলমারি গুছিয়েছে কে?’

শ্রাবণী ভীত গলায় উত্তর দিলো,
–‘বাসায় আমি ছাড়া আর কে আছে?’
–‘আমার আলমারি আর কখনো গোছাবে না তুমি।’

শ্রাবণী হঠাৎ করে ভীতু হয়ে গেল। ওর দুর্দান্ত সাহস উবে গেল। দ্রুত যাইফের সাথে কথা বলে সাহস লোড করতে হবে। শ্রাবণী ফোন নিয়ে অন্য রুমে গিয়ে যাইফের কাছে ফোন দিয়ে অস্থির গলায় বলল,
–‘আরে যাইফ ভাই কি সাহস দিয়েছেন? একটু পর পর চলে যাচ্ছে।’
যাইফ হাসতে হাসতে বলে,
–‘কোনো ভয় নেই শ্রাবণী। পাবেল একটা বললে তুই তিনটা বলবি। তোর দুর্বলতাই পাবেলের শক্তি। তুই একদম দুর্বল হয়ে থাকবি না। মাথা উঁচু করে বজ্রকণ্ঠে কথা বলবি। তোকে প্রমান করতে হবে তুই স্ট্রং মাইন্ডের মেয়ে।’

এর ভিতর পাবেল শ্রাবণী শ্রাবণী বলে বিরক্ত মেজাজে তিনবার ডাকলো। শ্রাবণী ব্যস্ত গলায় বলল,
–‘উনি ডাকছে। রাখছি ভাইয়া। সাহস পেয়েছি।’

যাইফ কঠিন আদেশের স্বরে বলল,
–‘নো.. ফোন রাখা যাবে না। তুই ফোনে কথা বলতে বলতেই পাবেলের কাছে যা।’

–‘তারপর?’
–‘তারপর বিরক্ত মেজাজে বলবি, কি হয়েছে দেখছেন না আমি ফোনে কথা বলছি। আমায় ডাকছেন কেন? এত চেঁচামেচি ভদ্রলোক করে না।’

শ্রাবণী ফোনে কথা বলতে বলতে পাবেলের কাছে গেল। বিরক্ত হওয়ার ভান করে বলল,
–‘কি হয়েছে দেখছেন না আমি ফোনে কথা বলছি। আমায় ডাকছেন কেন? এত চেঁচামেচি ভদ্রলোক করে না।’

পাবেল অতি আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল শ্রাবণীর মুখের দিকে। কষিয়ে চড় মারবে মেয়েটার গালে? পাবেল হঠাৎ শ্রাবণীর কানের কাছ থেকে ফোনটা ছোঁ মেরে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো।‌‌ ফোনের ব্যাক কভার ভেঙে চৌচির হয়ে গেল। শ্রাবণী ভীষণ দুঃখী মুখে পাবেলের দিকে তাকিয়ে বলল,
–‘কি করলেন এটা আপনি? আমার ফোনটা ভেঙে দিলেন? বিয়ের পর সামান্য একটা ফোন কিনে দেননি, উল্টো আমার ফোন ভেঙে ফেললেন।’

পাবেল বিক্ষুব্ধ হয়ে বলল,
–‘কার সাথে কথা বলছিলে তুমি? কিসের এত ফোনে কথা বলা তোমার? আমি ডেকেছি‌ সেটা তোমার কানে যায় না? তুমি কি চাও নিত্য তোমার গায়ে হাত তুলি?’

কথাটা বলে সাথে সাথে পাবেল চড় মেরে বসলো শ্রাবণীর গালে। শ্রাবণী হতভম্ব হয়ে গেল। উল্টো তিনটে চড় মারার মত বিশ্রী কাজটা করতে পারলো না। শ্রাবণী রাগে চেঁচিয়ে বলল,
–‘কি ভাবেন আপনি নিজেকে? অকারণে আমার গায়ে হাত তুলবেন আমি সেটা সহ্য করবো? পুরুষ মানুষ বলে যা ইচ্ছা তাই করবেন? কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রীর গায়ে অকারণে একটা চড় দেয়।‌‌ স্ত্রীরও উচিত উল্টো তিনটে চড় দেওয়া।’

কথাটা বলে শ্রাবণী আরেকটা চড় খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো। কিন্তু পাবেল চড় মারলো না। বলল,
–‘অকারণে চড় মারিনি তোমায়। অতিরিক্ত কথার জন্য মেরেছি। তুমি কি এখন উল্টো আমায় তিনটে চড় দিতে চাও?’

শ্রাবণী পাবেলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
–‘উল্টো তিনটে চড় মারার মত বিশ্রী কাজটা আমি করতে পারলাম না।’

এইটুকু বলে শ্রাবণী চুপ হয়ে রইল। পাবেলও নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাবেলের উত্তল সমুদ্রের মত ভয়ঙ্কর চেহারাটা বদলে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে। হঠাৎ এভাবে পাবেলের রাগ উবে যাওয়ার কারণটা শ্রাবণী বুঝতে পারলো না। পাবেল বলল,
–‘ক্ষুধা পেয়েছে। খাবো‌ চলো।’

শ্রাবণী থমথমে মুখে বলল,
–‘রান্না করেনি।’
–‘কেন‌ রান্না করো‌নি? এখন কি না খেয়ে থাকবো?’
–‘মাছ মাংস শাকসবজি কিছু নেই। কি রান্না করবো? আব্বা-আম্মা গ্রামে যাওয়ার পর আপনি তো বাজারই করেননি।’
–‘বাজার নেই সেটা তুমি বলেছো? আমি কিভাবে জানবো বাসায় বাজার নেই?’

শ্রাবণী কোনো কথা বলল না। পাবেল বলল,
–‘আচ্ছা চলো বাইরে থেকে খেয়ে আসি।’

শ্রাবণী ভীষণ চমকে তাকালো পাবেলের দিকে তাকালো। মতলব কি এই লোকের? পাবেল আবার বলল,
–‘কি হয়েছে? যাবে না?’
–‘যাবো।’

শ্রাবণীর মাথায় এখন কিছু কাজ করছে না। ও শুধু এখন পাবেলের এরূপ ভালো আচরণের কারণ খোঁজার চেষ্টা করছে। বাইরে খেতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে পাবেল কি ওকে গাড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিবে? শ্রাবণীর অবচেতন মনে এমন অনেক উদ্ভট চিন্তা আসছে। উদ্ভট চিন্তা গুলো যদি সত‌্যি হয়ে যায়? ওরা বাসা থেকে বের হয়ে বাসার গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো‌।‌ পাবেল বলল,
–‘ড্রাইভার আজ ছুটিটে। আর আমিও হাতে ব্যথা পেয়েছি। গাড়ি ড্রাইভ করতে পারবো না। রেস্টুরেন্ট একটু দূরে। এখানে অপেক্ষা করি। দেখি কোনো গাড়ি পাওয়া যায় কি-না।’

গাড়ির কথা শুনে চমকে ওঠল শ্রাবণী। বলল,
–‘না, না গাড়ির দরকার নেই। হেঁটে যাবো। হেঁটে যেতেই ভালো লাগবে।’

পাবেল‌ আপত্তি না করে বলল,
–‘আচ্ছা চলো।’

হেঁটে যেতে প্রায় পনেরো মিনিট লাগলো। ওরা একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। পাবেল বলল,
–‘এটা আমার পরিচিত রেস্টুরেন্ট। প্রায়ই খেতে আসি। এখানকার খাবার ভালো।’

পাবেল এত খেতে পারে শ্রাবণী এই প্রথম দেখলো। বাসায় এত বেশি খায় না। আজ বোধ হয় খুব ক্ষুধার্ত। শ্রাবণী এক প্লেট বিরিয়ানি নিয়ে সেটাই শেষ করতে পারলো না। খাওয়া শেষে পাবেল‌ বলল,
–‘শ্রাবণী তুমি একটু অপেক্ষা করো এখানে। আমি আসছি।’

এই বলে পাবেল রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেল। যাওয়ার সময় ক্যাশ কাউন্টারের ভদ্রলোকটাকে শ্রাবণীকে দেখিয়ে বলল,
–‘আজকে বিল ওই ম্যাডাম দিবে।’

পাবেল ভালো করেই জানে শ্রাবণীর কাছে টাকা নেই। ও হাসতে হাসতে হাঁটতে লাগলো।
(চলবে)