প্রিয় শ্রাবণী পর্ব -১৪+১৫+১৬

0
398

প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-১৪+১৫+১৬
ইসরাত জাহান তানজিলা
_____________________
পাবেলের দুই আঙুলের ফাঁকে একটি জ্বলন্ত সিগারেট। ও আয়েশি ভঙ্গিতে সিগারেট ফুঁকছে আর মুখ উঁচু করে আকাশের দিকে ধোঁয়া ছাড়ছে। পাবেল ফুটপাত ধরে হাঁটছে। গাড়ির তীব্র হর্ন মাঝে মাঝে কান দুটা তব্দা লাগিয়ে দিচ্ছে। শ্রাবণী মেয়েটা এখনো কি রেস্তোরাঁয় বসে আছে? আজকাল বেশি মাথা খাচ্ছে। একটা শাস্তির দরকার ছিলো ওর। হাঁটুর বয়সী মেয়ে মুখে একদম খই ফোটে। চড় থাপ্পড়েও ভীতু হয়না এখন। কোনো হেলদোল নেই তার। চড় খেয়ে পাথরের মূর্তির মতন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে। যেন চোখের চাউনি দিয়েই নোংরা গালাগাল দেয় পাবেলকে, গিলে খেতে চায়। মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে পাবেল। পাবেলের হাতের সিগারেটটা শেষ। উচ্ছিষ্ট অংশটা রাস্তার মাঝে ছুঁড়ে ফেলে। আরেকটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু পকেটে একটাই সিগারেট ছিল। একটু সামনেই চায়ের দোকান। সিগারেট পাওয়া যাবে সেখানে। পাবেল সিগারেটের সাথে এক কাপ চা খাওয়ারও‌ মনস্থির করলো। এক কাপ না, পাবেল তিন কাপ চা খেলো। খাঁটি গরুর দুধের চা। স্বাদ ভালো। দশ টাকা করে। চা শেষ‌‌ করে এক প্যাকেট সিগারেট নিলো। সিগারেট ধরানোর গ্যাস লাইটাও জ্বলছে না। ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করছে শুধু। একটা গ্যাস লাইটও কিনে নিলো। তারপর সিগারেট ধরাতে ধরাতে জিজ্ঞেস করল,
–‘চাচা বিল কত হয়েছে?’
দোকানদার বয়স্ক লোক। তিনি কয়েকবার হিসেব করে তিনি বললেন,
–‘দুইশ বিশ‌ টাকা।’

বিল দিতে গিয়ে পাবেল দেখল ওর পকেটে মানিব্যাগ নেই। প্যান্টের পকেটে, শার্টের পকেটে কোথায়ও নেই। শার্টের পকেটে কখনো মানিব্যাগ রাখে না। তবুও খুঁজলো। মানিব্যাগ কোথায় গেল? দোকানদার ব্যস্ত গলায় বলল,
–‘কি হইলো বিল দেও। দোকান বন্ধ করুম। বাড়ি যামু।’
পাবেলের পরিষ্কার মনে আছে ও বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মানিব্যাগ পকেটে নিয়েছে। প্রায় নির্জন রাস্তা এটা। কোনো ভিড়ভাট্টা ছিলো না যে কেউ ভিড়ভাট্টার সুযোগে পকেট কাটবে। পাবেল বিব্রত হয়ে বলল,
–‘চাচা আমার মানিব্যাগ পাচ্ছি না।‌ পকেটেই ছিলো। কাল সকালে আপনার টাকাটা দিয়ে যাবো।’
বুড়ো রেগে গেলেন। পাবেলকে তিনি ভালো করেই চেনেন। বেকার ঘুরেফিরে, বাপের টাকা উড়ায় আর রাজনীতি করে। এলাকায় রাজনীতি করা এ ধরণের কয়েকটা ছেলেপেলে আছে। দোকানে এসে চা খেয়ে বাকির খাতায় টুকে রাখবে নয়ত মানিব্যাগ পাচ্ছে না বলে কেটে পড়বে। বুড়োও হলো উগ্র স্বভাবের। এসব ধূর্ততা তার কাছে চলবে না,
–‘কোনো কথা হুনতে চাইনা আমি। টেকা না দিয়া এক পাও যাইতে পারবা না। এইসব ধান্দাবাজি বাদ দেও বাবা। তুমি যত বিশাল নেতা হও‌ ওসব দাপট আমার কাছে দেখাইয়া লাভ নেই।’

পাবেল বুঝে ফেলল‌ বুড়ো কঠিন ধাঁচের লোক। এ ধরণের মানুষদের কাছে নিজের দাপট দেখিয়ে সুবিধা করতে পারবে না। ও নমনীয় ভাবে বলল,
–‘চাচা আমি আপনার সামান্য এই কয়টা মেরে খাবো না। কাল সকালেই দিয়ে দিবো। আপনি দয়া করে চেঁচামেচি করবেন না।’

বুড়ো গর্জন করে ওঠল,
–‘চেঁচামু না তো কি করমু? মানিব্যাগ বাইর করো। টেকা দেও।‌‌ সকাল দুপুর বুঝিনা। এহনি দিতে হইবে টেকা।’

এমন চরম নাকাল অবস্থার স্বীকার পাবেল বোধ আগে কখনো হয় নাই। ও পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর গ্যাস লাইটটা বের করে দোকানদারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–‘এগুলো রেখে দেন চাচা।’

–‘এগুলো রাইখা আমি কি করমু? প্যাকেট খুলে তুমি সিগারেট খাইছো একটা। গ্যাস লাইট দিয়ে সিগারেট ধরাইছো। এছাড়া আমার তিন কাপ চায়ের টাকা কেডা দিবে?’

এই বাগবিতণ্ডা অনেকক্ষণ চলল। শেষে পাবেল‌ বলল,
–‘চাচা আপনি আমার সাথে বাসায় চলেন। আপনাকে আমি গাড়ি করে নিয়ে যাবো। আবার আপনার টাকা দিয়ে গাড়ি করে পাঠাবো।’
পাবেল ভেবেছিল বুড়ো এত লম্বা ঝামেলা করতে চাইবে না। কিন্তু পাবেলকে অবাক করে দিয়ে তিনি যেতে রাজি হয়ে গেল।
_________________
শ্রাবণী একটা শপিংমলের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সরিষা দিয়ে আমড়া মাখানো খাচ্ছে। ঝালে ওর ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে। পেট জ্বলছে। তবুও খেতে চমৎকার লাগছে। হৃষ্টচিত্তে আমড়া মুখে পুরছে। হঠাৎ ফিক করে হেসে ওঠল শ্রাবণী। পাবেল‌ কি ভেবেছিল শ্রাবণী ওর মতলব ধরতে পারেনি? পাবেল যখন শ্রাবণীকে অপেক্ষা করার কথা বলে টেবিল ছেড়ে ওঠতে উদ্যত হয়েছিল তখনই শ্রাবণী আলগোছে পাবেলের প্যান্টের পিছনের পকেটটা থেকে টুপ করে মানিব্যাগটা নিয়ে গেছে। কারণ পাবেল অপেক্ষা করার কথা বলতেই শ্রাবণীর মনে হলো পাবেল ওকে রেখে বিল না দিয়ে চলে যাওয়ার ফন্দি এঁটেছে। পাবেল চলে যাওয়ার পরও শ্রাবণী আধা ঘন্টা অপেক্ষা করল। যদি পাবেল ফিরে আসে? শ্রাবণীর ধারণা যদি ভুল হয়? কিন্তু শ্রাবণীর ধারণা সঠিক হয়েছে। আধা ঘন্টা অপেক্ষা করার পর শ্রাবণী বিল দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। গুনে দেখলো মানিব্যাগে আঠারো হাজার টাকা আছে। এটাকা দিয়ে জমজমাট শপিং করা যাবে। একটু হাঁটতেই বড়ো একটা শপিংমল পেল। শপিংমলের সামনে দাঁড়িয়ে আয়েশ করে আমড়া মাখানো খেয়ে ভিতরে ঢুকলো। তিনটা শাড়ি আর কিছু কসমেটিকস কিনলো। শপিং শেষে বের হয়ে বাসার উদ্দেশ্যে ট্যাক্সি নিলো। শ্রাবণীর হাসি পাচ্ছে আবার দুঃখও হচ্ছে। মানুষ কত বড়ো ডাহা আহাম্মক হলে নিজের স্ত্রীকে এধরণের পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দেওয়ার কথা ভাবে! পাবেল ভালো করেই জানে শ্রাবণীর কাছে কোনো টাকা নেই। এ লোকের ভিতরে কি কোনো আবেগ, অনুভূতি নেই? নাকি বিয়ের আগেই তার প্রেমিকা প্রজাতি সমস্ত আবেগ, অনুভূতি নিংড়ে শুষে খেয়ে ফেলেছে? শ্রাবণীকে নিয়ে এতটা বিতৃষ্ণা তার মনে? ট্যাক্সি এসে বাসার সামনে দাঁড়িয়েছে। শ্রাবণী ভাড়া চুকিয়ে বাসায় ঢুকলো। বাসা অন্ধকার। তার মানে পাবেল এখনো ফিরেনি। শ্রাবণী আলো জ্বালায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমে যায়। শাড়ি তিনটে শপিং ব্যাগ থেকে বের করে আলমারিতে রাখে। কসমেটিকস গুলো ড্রেসিং টেবিলের সামনে সাজিয়ে রাখলো। রাত বারোটার কাছাকাছি। পাবেল‌ কি ফিরবে? নাকি আবার এক সপ্তাহের জন্য পালিয়েছে?

শ্রাবণীর মোবাইলটা এখনো ফ্লোরে পড়ে আছে। ওটা আর তোলা হয়নি। শ্রাবণী মোবাইলটা তুলে হাতে নেয়। ও ভেবেছিল শুধু ব্যাক কভার ভেঙেছে। এখন দেখছে মোবাইলই অন হয়না। শ্রাবণীর মন খারাপ হয়ে গেল। যাইফের সাথে কথা বলবে কিভাবে? যাইফের সাথে কথা বললে ওর সব কষ্ট হালকা লাগে। ভরসা পায়, সাহস পায়। শ্রাবণী মোবাইলটা চার্জে বসিয়ে রাখলো। তাও অন হচ্ছে না। ব্যাটারি বার বার খুলে সেট করছে। বিফল চেষ্টা। একেবারে নষ্ট হয়েছে যন্ত্রটা। অতি রাগে ক্ষুব্ধ হয়ে শ্রাবণী মোবাইলটা তীব্র বেগে ছুড়ে মারে। মোবাইলটা ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। মানিব্যাগে এখনো দশ হাজার টাকা আছে। চাইলে সে টাকা দিয়েও মোবাইল কেনা যায়। কিন্তু মোবাইলর কেনার টাকা কোথায় পেয়েছে এই প্রশ্নের উত্তরে কি বলবে? তাই এটাকা দিয়ে মোবাইল কেনা যাবে না। আর মানিব্যাগ পাবেলকে কিছুতেই ফেরত দিবে না। মানিব্যাগের টাকা গুলো হলো পাবেলের ডাহা আহাম্মকির জরিমানা।

ডোরবেল বাজছে। দীর্ঘ সময় ধরে বেজে চলেছে। পাবেল ছাড়া আর কে আসবে? নেমকহারাম লোক! শ্রাবণী ইচ্ছে করেই দরজা খুললো না।‌ দরজার সামনে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকুক। পাবেল অনেকক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্ত হয়ে এখন পদাঘাতে দরজা ভাঙতে চাইছে। শ্রাবণী দরজা খুললো এবার। দরজা খুলে শ্রাবণী পাবেলের দিকে না তাকিয়ে রুমে চলে আসলো। পাবেলের সাথে সেই দোকানদার দাঁড়ানো। ও দ্রুত পায়ে রুমে ছুটে এসে ড্রয়ার থেকে টাকা বের করল। দোকানদারকে টাকা দিয়ে বিদায় করল। মনে মনে বুড়োটাকে কুৎসিত কয়েকটা গালি দিলো। শালা বুড়ো! কাল রাতেই তোর দোকানের মালামাল সব উধাও হয়ে যাবে। নেতা ভয় পাও না? ছোটলোকের জাত! এই বিষয় নিয়ে রাস্তাঘাটে ঝামেলা করলে পাবেলেরই মান যেত।

পাবেল রুমে এসে বিরক্ত মুখে শার্ট খুলছে। শ্রাবণীকে বিপদে ফেলে যে পৈশাচিক আনন্দের সৃষ্টি হয়েছিল পাবেলের মনে, বুড়ো দোকানদারের‌ খপ্পরে পরে তা বাষ্পাকারে উড়ে গেল। শ্রাবণী খাটে আধশোয়া হয়ে বসে রইল। পাবেল শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল,
–‘আমার মানিব্যাগ দেখছো?’

শ্রাবণী চোখ লাল করে পাবেলের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ,
–‘কাপুরুষ, নির্লজ্জ। কোন মতলবে আমায় রেস্টুরেন্ট ফেলে পালিয়েছেন? আপনি এতটা জঘন্য!’

একটু থেমে শ্রাবণী বলল,
–‘কীসের মানিব্যাগ আপনার? লজ্জা করে না সাথে কথা বলতে? আপনার তো নূন্যতম বিবেক নেই।’

পাবেল কিছু বলল না। কাজটা যে খুব খারাপ হয়ে গেছে সেটা নিজে বুড়ো দোকানদারের‌ খপ্পরে পড়ে বুঝেছে। জীবনে এরচে কত বড়ো পাপ করেছে। এই সামান্য বিষয় নিয়ে অপরাধ বোধ করার কি আছে? পাবেল বলল,
–‘আমার জন্য একটু ঠাণ্ডা শরবত নিয়ে আসো। আমার মেজাজটা খুব খারাপ।’

শ্রাবণী অবাক হলো। এই লোকের ভিতর কি অন্যায় বোধ বলতে কিছু নেই? কত বড়ো একটা অন্যায় করেছে বিবেকহীন মানুষের মতন। শ্রাবণী বলল,
–‘আপনার কি বিবেক বলতে কিছু নেই? অন্যায় অপরাধ বোধ বলতে কিছু নেই?’

পাবেল চিৎকার করে বলল,
–‘বকবক বন্ধ করো। আমার ভিতর কোনো বোধ নেই। যা বলছি তাই করো। মেজাজ বিগড়ে গেছে আমার। মানিব্যাগটা কোথায় গেল পকেট থেকে? চা, সিগারেট খেয়ে টাকা বিল দিতে পারিনি।’

শ্রাবণী চমকে গেল। কি বলল পাবেল? মানিব্যাগের জন্য বিল দিতে পারেনি চা, সিগারেট খেয়ে? সেজন্যই মেজাজ তেতে আছে? আনন্দে শ্রাবণীর মন পুলকিত হয়ে ওঠে। ওর চিত্তবিক্ষেপ, জেদ সব মিইয়ে গেল। প্রচণ্ড হাসি পেল। পাবেলের সামনে বসে হাসা সমীচীন নয়। ও ছুটে বাথরুমে গিয়ে পাঁচ মিনিট হাসলো। তারপর পাবেলের জন্য বরফ দিয়ে ঠাণ্ডা শরবত বানিয়ে নিয়ে এলো। শরবত মুখে দিয়ে পাবেল মুখ বিকৃত করে ফেলল। ওয়াক করে মুখ থেকে ফেলে দিলো। আবার চিৎকার করে বলল,
–‘কি করলে এটা তুমি? চিনি না দিয়ে লবন দিলে কেন?’

শ্রাবণী অত্যন্ত দুঃখিত হওয়ার ভান করে বলল,
–‘আমি একদম বুঝতে পারিনি। লবন আর চিনির বয়াম এক জায়গায় ছিলো।’

কাজটা যে শ্রাবণী ইচ্ছাকৃত ভাবেই করেছে সেটা পাবেলকে বুঝতে দিলো না। পাবেল শরবতের গ্লাস রেখে চলে গেল বেসিনের দিকে। মুখটা লবনে বিশ্রী রকমের লবনাক্ত হয়ে গেছে।
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-১৫)
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
শ্রাবণী শুয়ে পড়েছে।‌ ও ভেবেছে পাবেল খাটে আসবে। শ্রাবণীর মাথা ব্যথা করছে। লাইটের আলোতে বিরক্ত লাগছে। পাবেল খাটের একটু তফাতে সোফায় বসে আছে। শ্রাবণী চোখ মেলে পাবেলের দিকে তাকিয়ে অনিচ্ছাকৃত ভাবে বলল,
–‘লাইট বন্ধ করুন। মাথা যন্ত্রণা করছে।’

পাবেল লাইট বন্ধ করলো না।‌ রুমের ভিতর কিছুক্ষণ ধরে বেহুদা পায়চারি করছে। শ্রাবণী বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকালো সেদিকে। পাবেল হাঁটাহাঁটি বন্ধ করে শ্রাবণীর কাছে বসে বলল,
–‘মাথা বেশি ব্যথা করছে? আমার কাছে ব্যথার বাম আছে।‌ কপালে মালিশ করলে শিরশিরে ঠাণ্ডা অনুভূত হবে। ব্যথাও কমে যাবে।’

শ্রাবণী চমকিত হলো পাবেলের আচরণে। এই লোক গিরগিটির চেয়েও দ্রুত রং‌ বদলায়। যে মানুষটি রেস্টুরেন্টে শ্রাবণীকে অমন পরিস্থিতিতে রেখে চলে এসেছে সে এখন শ্রাবণীর মাথা ব্যথা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেছে। পাবেল ব্যথার বাম নিয়ে আসলো। শ্রাবণী চিৎকার করে প্রায় লাফিয়ে ওঠে বসে বলল,
–‘না, না ওটা নিয়ে আপনি আমার কাছে আসবেন না একদম। ওটা কোনো ব্যথার বাম-টাম না। ওটার ভিতর নিশ্চয়ই এসিড রয়েছে। আমি আপনাকে একদম বিশ্বাস করিনা।’

পাবেল হেসে বলল,
–‘কি সব উদ্ভট কথাবার্তা বলছো তুমি। এই যে দেখো আমি কপালে দিচ্ছি।’
পাবেলকে খুব কম হাসতে দেখেছে শ্রাবণী। পাবেল এক প্রকার জোর করে শ্রাবণীর মাথা নিজের কোলের উপর নিয়ে কপাল মালিশ করে দিচ্ছে। শ্রাবণীর বড়ো অস্বস্তি হচ্ছে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। এমনটা আগে কখনো হয়নি। পাবেল প্রতিরাতে অন্ধকার হাতড়ে শ্রাবণীকে যখন ওর খুব কাছাকাছি নিয়ে যায় তখনও না। শ্রাবণী ভেবে কুল পাচ্ছে না; পাবেলের মনে নতুন করে কি মতলব জাগলো আবার? শ্রাবণীর মাথা ব্যথা কমে আসছে। আরাম বোধ হচ্ছে। পাবেল মৃদু স্বরে ডাকলো,
–‘শ্রাবণী।’
–‘বলেন।’
পাবেল শ্রাবণীর চুলের ভিতরে ডান হাত ডুবিয়ে বিলি কাটতে কাটতে প্রশ্ন করে,
–‘সত্যি বলো আমার মানিব্যাগটা পেয়েছো তুমি?’
শ্রাবণী বড়ো হতাশ হলো। তাহলে এই মানিব্যাগের কথা জিজ্ঞেস করতে এত আহ্লাল?
–‘কি বলছেন? আমি আপনার মানিব্যাগ পাবো কোথায়?’
–‘তো তুমি রেস্টুরেন্ট বিল দিয়েছো কীভাবে?’
–‘আমার ব্যাগে টাকা ছিলো। এবার বাসা থেকে আসার সময় আব্বা দিয়েছেন।’

পাবেল চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
–‘মানিব্যাগটা পেলে দিয়ে দেও। মানিব্যাগের ভিতর আমার জীবনের সবচে মূল্যবান এক টুকরো অনুভূতি আছে। প্লিজ শ্রাবণী।’

শ্রাবণী এবার মুখ উঁচিয়ে তাকালো পাবেলের দিকে। গাঢ় বেদনার ছায়া তার মুখে। চোখ জোড়ায় থৈ থৈ করা বিষণ্ণতা। কিছুতেই দিবে না মানিব্যাগ। পাবেলের সবচে মূল্যবান এক টুকরো অনুভূতি দেখার জন্য শ্রাবণীর মন ব্যগ্র হয়ে ওঠল। শ্রাবণী বলল,
–‘বিশ্বাস করুন আমি দেখিনি।’

পাবেল আর কিছু না বলে সিগারেট ধরিয়ে বারান্দার দিকে চলে গেল। জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নির্বিঘ্নে ঝরঝর করে আসা বাতাসের সাথে সিগারেটের উটকো গন্ধটাও ভেসে আসছে শ্রাবণীর নাকে। শ্রাবণী জানালা আটকে দিলো। ওর নিদারূণ কৌতুলী মন এক্ষুণি মানিব্যাগটা তন্ন তন্ন করে খুজে দেখতে চাইলো। এখন মানিব্যাগ বের করলে পাবেল দেখে ফেলতে পারে। এই ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না শ্রাবণী। সকালে দেখবে। পাবেল দীর্ঘ সময় ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণী ঘুমিয়ে পড়লো।

রাত দুইটার দিকে আচমকা শ্রাবণীর ঘুম ভেঙে যায় কাঁচের গ্লাস ভাঙার শব্দ। শ্রাবণী ভয় পেয়ে ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসে। রুমের বাতি এখনো জ্বালছে। রুমের ঠিক মাঝ বরাবর বসা পাবেল। পাশে মদের বোতল। মদের নেশায় টলমল শরীর। মদের গ্লাসটা হাত থেকে টুপ করে ফ্লোরে পড়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে। শ্রাবণী পরম আশ্চর্যে চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে রইল। কিছুটা ঘাবড়েও গেল। পাবেল নেশা করে সেটা বিয়ের আগে থেকেই জানে ও। মাঝে মাঝে শ্রাবণীর সামনে বসে সিগারেট খায়। কিন্তু মদ খেতে দেখেনি আর কখনো। বাসায় বসে জয়নাল সাহেবের জন্য মদ খেতে পারেনা। বাইরে থেকে খেয়ে আসে। পাবেল রাতে বাসায় ফিরলেই শ্রাবণী ওর শরীর থেকে উৎকট বিশ্রী গন্ধ পায়। জয়নাল সাহেব বাসায় না থাকায় সেই সুযোগে আজ বাসায় বসে খাচ্ছে। খুব বেশিই খেয়ে ফেলেছে বোধ হয়। ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলেছে। ঢলে পড়ে যাওয়া যাওয়া অবস্থা। পাবেলকে ধরবে গিয়ে? শ্রাবণী ভেবে পেল না। মাতাল মানুষ। কি রকম আচরণ করে বসে সেই ভেবে ভীতু হয়ে গেল শ্রাবণী। বমি করা শুরু করেছে পাবেল। শ্রাবণী এবার খাট থেকে নেমে গিয়ে পাবেলকে ধরলো। বিশ্রী গন্ধ আসছে। শ্রাবণী নাকে কাপড় চেপে রাখলো। হঠাৎ পাবেল ইচ্ছে করে গলগল করে শ্রাবণীর গায়ে বমি করে দিলো। শ্রাবণী হতবিহ্বল হয়ে গেল। পাবেল শব্দ করে হাসতে হাসতে জড়িয়ে আসা গলায় বলল,
–‘আমি ইচ্ছে করে তোমার গায়ে বমি করিনি। আমি একদম বুঝতে পারিনি।’
শ্রাবণীর নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসছে। গা গুলিয়ে আসছে। ও শরীর পরিষ্কার করার জন্য ওয়াশরুমে যেতে উদ্যত হলেই পাবেল ওর হাত চেপে ধরে আবারো হাসতে হাসতে বলল,
–‘তুমি ইচ্ছে করে আমায় লবন দিয়ে শরবত বানিয়ে দিয়েছো। আমি আবার তোমার গায়ে বমি করবো।’

শ্রাবণী নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার তীব্র চেষ্টা করছে। অতিরিক্ত নেশার ফলে পাবেলের শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে। শ্রাবণী অতি সহজে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে পারলো। পাবেল মাতাল গলায় বিদঘুটে কথাবার্তা বলে যাচ্ছে। গায়ে বমি করে দেওয়ার মত এমন একটা কুৎসিত কাজ করে ফেলবে শ্রাবণী ভাবতে পারেনি। ও ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার নিলো। বমির গন্ধে ওর নিজেরই এখন বমি আসছে। পুরো রুম গন্ধে ছেয়ে গেছে। এগুলো সব শ্রাবণীর পরিষ্কার করতে হবে! ওর আবার নাড়িভুঁড়ি আবার উল্টে আসছে। পাবেল মদোন্মত্ত হয়ে ফ্লোরেই চিৎ হয়ে শুয়ে রইল। শ্রাবণী ওয়াশরুম থেকে বের হলো। পাবেল কাহিল গলায় ডাকলো,
–‘শ্রাবণী, শ্রাবণী।’
শ্রাবণী পাবেলের কাছে যেতেই ভয় পাচ্ছে। ও দূরে দাঁড়িয়ে জবাব দিলো,
–‘বলুন।’
–‘কাছে আসো। তোমার গায়ে বমি করবো না আর। আমায় খাটে শুইয়ে দেও।’
শ্রাবণী পাবেলকে খাটে শুইয়ে দিলো। পাবেল চোখ বুজে আছে। ওর গায়ের গন্ধটা যেন আরো তীব্র হচ্ছে। শ্রাবণী পাবেলের গায়ের শার্টটা খুলে দিলো। তারপর ওয়াশরুম থেকে পানি এনে ফ্রেশ করিয়ে দিলো।‌ পাবেল অচেতন হয়ে পড়ে আছে। ওর হুঁশ নেই। একটু পর নিভু নিভু চোখে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে ভাঙা ভাঙা স্বরে বলল,
–‘শ্রাবণী তুমি কি কখনো কারো প্রেমে পড়েছো?’
এই লোকের মাথা গেছে। শ্রাবণী হতাশ হয়ে তাকালো। পাবেল আবার বলল,
–‘কি হলো শ্রাবণী বলছো না কেন?’
–‘না পড়িনি।’
–‘কি দারুন দেখতে তুমি। তোমায় অপ্সরী লাগে। তোমার ঠোঁট গুলো বেশি সুন্দর। তুমি কি এই সুন্দর ঠোঁটে আমায় চুমু খাবে?’
শ্রাবণী যন্ত্রের মত বসে রইল। কোনো কথা বলল না। পাবেল অনুনয় করে বলল,
–‘আমায় একটু জড়িয়ে ধরো শ্রাবণী।’

শ্রাবণী জড়িয়ে ধরলো না। আগের ন্যায়ই বসে রইল। পাবেলের কথা অস্পষ্ট। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বার বার। শ্রাবণী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
–‘ঘুমান‌ আপনি।’
পাবেল চোখ বুজলো। ঠোঁট নেড়ে অস্পষ্ট ভাবে কি যেন বলল। শ্রাবণী ঠিক বুঝতে পারলো না। রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটা ঢং ঢং করে জানিয়ে দিলো রাত চারটা বাজে। শ্রাবণী পাবেলের ধারে ঘেঁষলো না। ও বিছানার মাঝে কোল বালিশ দাঁড় করিয়ে খাটের এক কোণে গুটিসুটি মেরে শুয়ে রইল।
______________
সকাল দশটায় ঘুম ভাঙে শ্রাবণীর। ঘুম থেকে ওঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে যায়। আশ্চর্য এত বেলা হলো কীভাবে! শ্রাবণীর ঘুম খুব সকালে ভাঙে। ও তড়াক করে বিছানা ছাড়ে। পাবেল এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। চেহারা ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তার। শ্রাবণী ওকে ডাকলো না। যে পরিমাণ নেশা করেছে সারাদিনেও ঘুম ভাঙবে না বোধ হয়। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই শ্রাবণীর মানিব্যাগের কথা মনে পড়লো। ও দ্রুত মানিব্যাগটা বের করে অন্য রুমে চলে গেল। রেস্তোরাঁয়, শপিংমলে টাকা পরিশোধ করার সময় তো মানিব্যাগে বিশেষ কিছুই দেখেনি। নাকি পাবেল মিথ্যে বলেছে? যে লোক লবণ শরবত খাওয়ানোর অপরাধে গায়ে বমি করতে পারে তার কাছে মানিব্যাগের জন্য এই সামান্য মিথ্যা বলা ব্যাপারই না। পুরো মানিব্যাগ খুঁজে শ্রাবণী বিশেষ কিছুই পেল না। শুধু একটা ছবি পেয়েছে। তিন-চার মাস বয়সী একটা বাচ্চার ছবি। মানুষ অতি প্রিয়জনের ছবি মানিব্যাগে রাখে। তাহলে এই বাচ্চাটা কে যার ছবি পাবেলের মানিব্যাগে? ছবিটি দেখেই বুঝা যাচ্ছে প্রায় দশ-বারো বছরের আগেকার। শ্রাবণী আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করলো। ছবিতে আরেক জন মানুষ ছিলো। যে বাচ্চাটাকে তার হাতের উপর ধরে রেখেছে। কিন্তু এখন শুধু সে মানুষটির হাত দেখা যাচ্ছে। ছবিটা কেটে মানুষটির চেহারার অংশ ফেলে দেওয়া হয়েছে। ছবিটি কেটেছে বললে ভুল হবে। কেউ রাগ করে ছিঁড়েছে। যত্ন সহকারে ধৈর্য নিয়ে কাটলে হয়ত কেউ বুঝতে পারত না এই ছবিতে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি ছিলো। রাগ করে টেনে ছিঁড়েছে বলেই বুঝা যাচ্ছে। পাবেলের গলা শোনা যাচ্ছে। ও এদিকেই আসছে। শ্রাবণী দ্রুত মানিব্যাগটা লুকিয়ে রাখলো। পাবেলকে দেখে মনে হচ্ছে তার নেশা এখনো কাটেনি। শ্রাবণীকে জিজ্ঞেস করল,
–‘শ্রাবণী আমার মোবাইল কোথায়?’
রাতে মদ খাওয়ার সময় মোবাইলটা পাবেলের পাশেই ছিলো। বমিতে মোবাইল নষ্ট হবে বলে শ্রাবণী সরিয়ে রেখেছে। শ্রাবণী রুমে গিয়ে পাবেলকে মোবাইল বের করে দিলো। পাবেল যেন কি জিজ্ঞেস করছে শ্রাবণীকে। সেদিকে শ্রাবণীর মনোযোগ নেই। ও বার বার অন্যমনস্ক হয়ে মানিব্যাগের ছবিটি নিয়ে চিন্তা করছে।
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-১৬)
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
জয়নাল সাহেবেরা গ্রামে আছেন বেশ কয়েকদিন ধরে। জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ আর ঝামেলার কারণে এতদিন থাকা। পিতৃসূত্রে পাওয়া অঢেল পরিমাণ ভূসম্পত্তি রয়েছে গ্রামে তার। চাষবাস করার মানুষ নেই। কয়েকবছর বর্গা দিয়েছিল তা ফসল ফলাদির ঠিকঠাক হিসেব পায়নি। অতিবৃষ্টিতে সফল ভালো হয়নি, রোদে পুড়ে গেছে‌ সহ নানান অজুহাত। শহরে বসে অত খোঁজ রাখা যায়? তারচে ভালো জায়গাজমি সব বিক্রি করে দিয়ে সেই টাকা দিয়ে শহরে দালান তুলে ভাড়া দিবে। মাস শেষে অনেক টাকা আসবে। ফরিদা বেগম পরিত্যক্ত বাড়িটাও বিক্রি করে দিতে চাইলেন পুরানো বেহাল জরাজীর্ণ টিনসেট ঘরটা সমেত। জয়নাল সাহেব রাজি হলেন না। তার পারিবারিক কবরস্থান রয়েছে এখানে। তাছাড়া শহরে থেকে থেকে যখন যান্ত্রিক হয়ে ওঠে তখন হুট করে গ্রামে ছুটে আসেন সামান্য অবকাশ নিতে। মৃত্যুর পর এই করবস্থানেই সমাধিত হওয়ার ইচ্ছে তার। কয়েকদিন ধরে জয়নাল সাহেবের শ্বাস ফেলার ফুরসত মিলছে না। কোর্টকাছারিতে ছুটছে কাগজপত্র ঠিক করতে।

পাবেল শ্রাবণীর জন্য মোবাইল কিনে এনেছে। অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল। শ্রাবণী এবার খুব বেশি অবাক হলো। পাবলের হালচাল কিছুই বুঝে ওঠতে পারছে না। এলোকের হালচাল বোঝার চেষ্টা করা নিতান্তই বৃথা। শ্রাবণীর বিস্ময় আঁচ করতে পেরে পাবেল বলল,
–‘এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাবা কিনে দিতে বলেছে। টাকাও সে দিয়েছে। আমি কুৎসিত হৃদয়ের মানুষ। বউয়ের প্রতি অত দায়িত্ব পালন করার মত শুদ্ধ মন আমার নেই।’

শ্রাবণী পাবেলের পাশে বসলো। কিছুক্ষণ নীরব হয়ে থাকল। তারপর বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে গাঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
–‘কেন নেই মন?’

পাবেল খাটের সাথে বালিশ ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে সিগারেট ধরালো। চোখ বুজে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ধীর গলায় বলল,
–‘সৃষ্টিকর্তা বোধ হয় চেয়েছেন আমার জীবনের গল্পটা এরকম হোক সেজন্য।’

–‘অবান্তর বললেন। সৃষ্টিকর্তা সবাইকে বুদ্ধি, বিবেক দিয়েছে। ভালো-মন্দ বাছবিচার করার বোধশক্তি দিয়েছে। সৃষ্টিকর্তা আপনাকে ভালো-খারাপ দুইটা পথ দিয়েছে। আপনি কোন পথে চলবেন সেটা তো আপনাকেই ঠিক করতে হবে।’

পাবেল নিরুত্তর। ও চোখ বুজে কপাল ঘুচিয়ে রইল। শ্রাবণী কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল উত্তরের। পেলো না উত্তর। দীর্ঘ সময় পর পাবেল বলল,
–‘আমার ঘুম পাচ্ছে খুব। কথা বলো না।’

ও আর কথা বললো না। মোবাইলটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। যাইফের নম্বরটা সেইভ করলো প্রথমে। পাবেল ঘুমালো না। একটু পর উঠে পুরো রুমটা তন্ন তন্ন করে কি যেন খুঁজলো। কি খুঁজছে শ্রাবণী জানে না। ও কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে। পাবেল উত্তর দিলো না। বিছানার জাজিম, বালিশ সব ছুঁড়ে মেঝেতে ফেলে দিলো। আলমারি, ড্রয়ারের কাপড়চোপড়ও সব বের করলো। শ্রাবণী আবার জিজ্ঞেস করল,
–‘আরে কি খুঁজছেন আপনি?’
–‘মানিব্যাগ খুঁজছি।’
শ্রাবণী চমকে গেল। মানিব্যাগ ও এই রুমে রাখেনি। মানিব্যাগটা কি দিয়ে দিবে? সেই বাচ্চাটার ছবির জন্যই বোধ হয় পাবেল এত মরিয়া হয়ে ওঠেছে। বাচ্চাটা কে? এ প্রশ্নের উত্তর জানার আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু জানতে পারবে বলে মনে হয় না। এত জলঘোলা করে এখন মানিব্যাগ দিতে গেলে পাবেল যে হিংস্র আচরণ করবে সেই আতঙ্কে ফেরত দেওয়ার সাহস পেল না। শ্রাবণী রুম থেকে বের হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর এসে দেখলো পাবেল রুমে নেই। পুরো রুমের বেহাল অবস্থা। দুই ঘন্টা লাগবে গোছাতে। শ্রাবণী বিরক্ত মুখে রুম গোছাতে লাগলো। পাবেলকে বাসায় কোথায়ও দেখছে না।
_________________
পাবেল বাসা থেকে বের হয়েছে সেই রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে। ওর জোর সন্দেহ শ্রাবণীর উপরেই। শ্রাবণীই লুকিয়েছে মানিব্যাগ। প্রথম প্রথম পাবেল মেয়েটাকে একদম বোকা বোকা স্বভাবের ভেবেছিল। কিন্তু গত কয়েকদিনে পাবেলের সেই ভাবনা বদলিয়েছে। মেয়েটা সুচতুর। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিও আছে বটে। রেস্টুরেন্টের মালিক পাবেলের পূর্ব পরিচিত। বেশ ভালো খাতিরও আছে। পাবেল ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
–‘আপনার মনে আছে আমি গত পরশু রাতে একটা মেয়েকে নিয়ে খেতে এসেছিলাম?’
কাউন্টারের লোকটা হেসে আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল,
–‘হ্যাঁ ভাই মনে আছে।’
–‘আমি মেয়েটাকে রেখে বিল না দিয়ে চলে গিয়েছিলাম সেটা মনে আছে?’
–‘হ্যাঁ মনে আছে।’
–‘আমি যাওয়ার পর মেয়েটা বিল দেওয়ার জন্য টাকা কি নিজের হাতের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বের করেছিল না-কি মানিব্যাগ থেকে?’
কি অবন্তর প্রশ্ন! এত কিছু কি সে মনে রেখেছে? ভদ্রলোক বলল,
–‘এত কিছু তো আমার মনে নেই।’
–‘আচ্ছা রেস্টুরেন্টে তো সিসি ক্যামেরা আছে। ওইদিনের ফুটেজটা দেখান।’
পাবেল ভদ্রলোককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবার বলল,
–‘কোনো রকমের অজুহাত না দিয়ে এখনই দেখান।’
ভদ্রলোক বাধ্য হয়ে দেখালো। ফুটেজে পাবেল দেখলো শ্রাবণীর এক হাতে ওর ভ্যানিটি ব্যাগ অন্য হাতে পাবেলের মানিব্যাগ। দেখার সাথে সাথেই তীব্র ক্রোধে পাবেলের চোখ বুজে এলো। ও লম্বা লম্বা পা ফেলে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেল। সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চালিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। আজ খুন করে ফেলবে শ্রাবণীকে। গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় পাবেলের চোখে পড়লো সেই বয়স্ক চায়ের দোকানি রাস্তার মাঝখানে বসে বিলোপ করছে। গত রাতে তার দোকান চুরি হয়েছে। একদম খালি পড়ে আছে দোকানটা। সেদিকে এক নজর তাকিয়ে পৈশাচিক আনন্দ পেল পাবেল। বাসায় সামনে গিয়ে থামলো গাড়ি। ক্রোধিত পাবেল এক প্রকার লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠল। শ্রাবণী রান্না করছে। রান্না ঘর থেকে ধপ ধপ আওয়াজ করে উপরে ওঠার শব্দ পেল। এভাবে দানবের মত কে আসছে? বাসার দরজা খোলা। পাবেলকে কলিং বেল বাজাতে হলো না। রান্নাঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে শ্রাবণী দেখলো পাবেল তীব্র রোষে এগিয়ে আসছে। গলা ছেড়ে চিৎকার করে লম্বা স্বরে ডাকলো,
–‘শ্রাবণী।’
শ্রাবণী ভয়চকিত হয়ে গেল।‌ কি হলো হঠাৎ? পাবেলের ডাকে সাড়া দিলো না। সাড়া না দেওয়ায় পাবেল রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। এ সময়ে শ্রাবণী রান্না ঘরেই থাকে। রান্নাঘরে গিয়েই পাবেল শ্রাবণীর গলা চেপে ধরে বলল,
–‘কত বার জিজ্ঞেস করেছি তোকে মানিব্যাগের ব্যাপারে? তোকে অনুরোধ করেছি মানিব্যাগ ফেরত দেওয়ার জন্য। তাও তুই বলেছিস তুই জানিস না।’
রাগে পাবেলের শরীর কাঁপছে। শ্রাবণীর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। আকস্মিক আক্রমনে ও হতভম্ব হয়ে গেল। পাবেল কিভাবে জেনে গেল মানিব্যাগ ওর কাছে? ও কিছুতেই পাবেলের থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। চিৎকার করতে পারছে না। কিছু বলতেও পারছে না গলা টিপে রাখার কারণে। পাবেল কিছুক্ষণ পর শ্রাবণীর গলা ছেড়ে দিলো। শ্রাবণীর দু চোখ ভিজে গেছে। ও জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলছে আর খুক খুক করে কাশছে। এবার পাবেল ওকে জোরে ধাক্কা মেরে বলল,
–‘ছোট লোকের বাচ্চা তুই টাকার জন্য মানিব্যাগ চুরি করেছিস? আরে আমার টাকার দরকার নেই। আমার শুধু মানিব্যাগটা দরকার।’
লজ্জা, অপমান, ঘৃণায় শ্রাবণীর এই মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে হলো। ও নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে চাপা আক্রোশ নিয়ে বলল,
–‘আপনি যদি আমায় রেস্টুরেন্ট ফেলে চলে না যেতেন তাহলে আমি আপনার মানিব্যাগ নিতাম না। আপনি নিজে কতটা জঘন্য কাজ করেছেন ভেবে দেখেন। আর খবরদার! বাপ-মা তুলে গালি দিবেন না।’

ও কাঁদতে কাঁদতে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেল। মানিব্যাগটা নিয়ে পাবেলের হাতে দিলো। মানিব্যাগ থেকে শ্রাবণী আট হাজার টাকা খরচ করেছে। ব্যাপারটা এতদূর গড়াবে তা বুঝতে পারেনি। ও বলল,
–‘আট হাজার টাকা খরচ করেছি আমি। দিয়ে দিবো আপনার টাকা।’
পাবেল কিছু বলল না। মানিব্যাগের ছবিরটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করার রুচি হলো না। ও চুলা বন্ধ করে ছাদে চলে গেল।‌‌ একাকী কিছুক্ষণ কান্না করা দরকার। বিষাক্ত হয়ে ওঠেছে শ্রাবণীর কাছে এই সংসার। নরক এটা। আর পারছে না ও। এভাবে জীবন চলতে পারে না। এই বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে এক্ষুণি। মনের ভিতর খুব ঘৃণা জেগেছে। নিঃশব্দে বসে বসে অনেকক্ষণ কাঁদলো। ওর মত এমন মন্দ ভাগ্য নিয়ে কেউ যেন না জন্মায়। অনেকক্ষণ কেঁদেও নিজেকে স্থির করতে পারলো না শ্রাবণী। আজ একটু বেশিই দুঃখ পেয়েছে। মনের ভিতর কষ্টের উত্তাল ঢেউ গর্জন করছে থেকে থেকে। নিজের মনকে প্রবোধ দিতে পারছে না। এবাসায় দম বন্ধ হয়ে আসছে।

শ্রাবণী ছাদ থেকে নেমে রুমে গেল। ও নিজের লাগেজ গোছাতে লাগলো। চলে যাবে‌ বাড়ি। নিজের একটা গতি খুঁজে বের করবে। পাবেল কোনো বাঁধা দিলো না। শ্রাবণী লাগেজ গুছিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। বাড়ি গেলে যদি আবার পারভীন বেগমের ঝঞ্ঝাটঝামেলা শুরু হয় তাহলে এবার একদম নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে। যেখানে দুই চোখ যায় চলে যাবে। শ্রাবণী বাড়ি পৌঁছে দেখলো সেলিম হোসেন অসুস্থ। দীর্ঘ দিন ধরে হার্টের অসুখ তার। মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেলিম হোসেন অসুস্থ সেটা শ্রাবণী জানে না। ওকে জানানো হয়নি। সেলিম হোসেনের সাথে ফোনে কথাও হয়নি বেশ কয়েকদিন যাবৎ। শ্রাবণীকে দেখেই পারভীন বেগমের মুখ কালো হয়ে গেল। ও গিয়ে সেলিম হোসেনের পাশে বসলো। সেলিম হোসেন কাতরাচ্ছে। শ্রাবণীর উপস্থিতি টের পায়নি। শ্রাবণী মৃদু গলায় ডাকল,
–‘বাবা।’
সেলিম হোসেন ওকে দেখে চমকে গেলেন। রুগ্ন মুখে ম্লান হাসলো। কাতর গলায় বললেন,
–‘শ্রাবণী তুই? এভাবে কিছু না জানিয়ে চলে এসেছিস? কোনো ঝামেলা হয়নি তো?’
সেলিম হোসেনের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। শ্রাবণী বলল,
–‘বাবা তুমি কথা বলো না। ঠিক আছে সব। কোনো ঝামেলা হয়নি।’
শ্রাবণী দীর্ঘ সময় সেলিম হোসেনের পাশে বসে বসে নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে। বাপের কাতর মুখটার দিকে তাকালেই ওর বুকের হু হু করে ওঠে।
(চলবে)