প্রিয় শ্রাবণী পর্ব -৮+৯+১০

0
438

প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-৮+৯+১০
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
সেলিম হোসেন বিমর্ষ মুখে বসে রইলেন। তিনি মনে মনে চরম বিরক্ত পারভীন বেগমের উপর। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। কারো কাছে কিছু টাকা ধার পেলে বড়ো উপকার হতো। আরেক বার চেয়ে দেখবেন সবার কাছে। নয়ত পারভীন বেগমকে বাসায় ফেরানো যাবে না। তুহিন, নীলাকে ছাড়া বাসাটা একদম ফাঁকা লাগে। এলাকার সবার জানা, সেলিম হোসেনের আয় রোজগার নেই। ধারদেনা করে চলছেন, মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। গলা সমান দেনা তার। সেসবই শোধ করতে পারছেন না। তাই নতুন করে কেউ ধার দিলো না।
শ্রাবণী রান্না করছে। সরিষা ইলিশ, মুরগীর রোস্ট, গরুর মাংস, ডিমের কোরমা, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, পোলাও। সকাল থেকে রান্না শুরু করেছে। এখন দুপুর হয়ে এসেছে। এক হাতের রান্না। তাই সময় লেগেছে। এত ঝগড়াবিবাদের পরও এসব রান্না করে খাওয়ার রুচি ছিলো না শ্রাবণীর। কিন্তু সেলিম হোসেন ওকে বড়ো অনুরোধ করে বলেছে, তুই তোর মায়ের উপর রাগ করে চলে যাস না। আমি তোর জন্য বাজার করেছি। তুই রান্না করে খেয়ে যা। আমরা দুই বাপ মেয়ে একসাথে তৃপ্তি করে খাবো। তুই যদি এসব না খেয়ে চলে যাস আমার দুঃখ রয়ে যাবে রে মা।
বাপের এমন আর্জির বিপরীতে না বলতে পারলো না শ্রাবণী। ও বলল,
–‘আচ্ছা বাবা রান্না করবো।’
সেলিম হোসেনের মন প্রসন্ন হলো। শ্রাবণী বলল,
–‘মায়ের এই অযাচিত ঝড়গাঝাঁটি তুমি সহ্য করো কিভাবে নিত্য? নাকি সহ্য করতে করতে সয়ে গেছে ?’
সেলিম হোসেন উত্তর দিলেন না। এমন হাজারো পুরুষ আছেন যারা বউয়ের ক্রোধের মুখে চুপসে যান। সেলিম হোসেনও বোধ হয় সেই পুরুষদের দলে।

সেলিম হোসেন বাসায় আসার আগেই শ্রাবণী টেবিলে খাবার সাজালো। শ্রাবণীর মনটা আজ হালকা লাগছে। ও মনে মনে আওড়ালো, বাবা তোমার এই ভালোবাসাটুকুন যদি আমি ছোটবেলা থেকে পেতাম তাহলে হয়ত নিজেকে দুঃখী মানুষের কাতারে দেখতে হতো না। তুমি আমায় বড্ড দেরী করে ভালোবাসলে বাবা। সেলিম হোসেন বাসায় ফিরলেন। তার চেহারায় চাপা দুশ্চিন্তা। মাস প্রায় শেষ। বাসা ভাড়া, গ্যাস বিল, কারেন্ট বিল, পানি বিল দিতে হবে। কারো কাছে ধার পেল না। শ্রাবণী বলল,
–‘বাবা তুমি গোসল করে আসো তাড়াতাড়ি। আমার ক্ষুধা লেগেছে।’
দ্রুত গোসল করলেন সেলিম হোসেন। খাওয়া-দাওয়া শেষে শ্রাবণী সেলিম হোসেনের হাতে সাত হাজার টাকা তুলে দিলো। সেলিম হোসেন টাকাটা নিতে চাইলেন না কিছুতেই। শ্রাবণী জোরপূর্বক তার হাতের মুঠোয় গুঁজে দিলো।
–‘তুই এত টাকা কোথায় পেলি? তুই তোর প্রয়োজনে খরচ করিস। আমার লাগবে না।’
–‘বিয়ের সময় আমার দুই ফুফু শাশুড়ি দিয়েছিল নতুন বউয়ের মুখ দেখে। আমার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি তোমার প্রয়োজনে খরচ করো। তুহিন, নীলার স্কুলের বকেয়া দিও। বাসা ভাড়া দিও। মা’কে আমি টাকাটা দেইনি কারণ তাকে আমি পছন্দ করিনা।’
শ্রাবণী এই টাকাটা অতি গোপনে রেখে দিয়েছিল কলেজের ভর্তির জন্য। কিন্তু বাপের এই দুর্দশা সহ্য হচ্ছে না ওর। এ দুই দিন সেলিম হোসেনের কাছ থেকে যতটুকু ভালোবাসা পেয়েছে তাতে সেলিম হোসেনের প্রতি ওর জমে থাকা সারাজীবনের অভিমান ধুয়েমুছে গেছে। শ্রাবণী বলল,
–‘বাবা তোমার জামাই সন্ধ্যাবেলা গাড়ি পাঠাবে। আমি চলে যাবো।’
–‘আর দুইটা দিন থাক। বাড়িতে তো কোনো জরুরি কাজ নেই। পাবেলকেও ফোন দিয়ে আসতে বল। ওর ব্যস্ততা কি এখনো শেষ হয়নি?’
–‘সে আমি বলতে পারবো না।’
–‘নাকি ওর শ্বশুর বাড়ি পছন্দ হয়নি বলে আসতে চাচ্ছে না?’
–‘আমি ওসব জানি না বাবা। তুমি কালই গিয়ে মা, তুহিন আর নীলাকে নিয়ে এসো। আমি তো চলে যাচ্ছি। এখন আর কোনো ঝামেলা হবে না। আমি আর এক বছরেও আসবো না এ বাড়িতে।’
সেলিম হোসেন বিষণ্ণ মুখে চুপ করে রইলেন। সেদিন রাতে শ্রাবণীর বলা কথা গুলো তার হৃদয়ে নাড়া দিয়েছিল। মেয়েটা চলে যাচ্ছে এক প্রকার অভিমান নিয়ে। দুঃখবোধ হচ্ছে তার।
____________
বিকালে শ্রাবণী নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। তারপর কিছুক্ষণ শুয়ে রইল। সন্ধ্যা হতে এখনো অনেক বাকি। কিন্তু ঘুম আসছে না। পাবেলের আচরণ কি বদলাবে এবার? স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক হবে ওদের মাঝে? এসব চিন্তা বার বার ঘোরপাক খাচ্ছে শ্রাবণীর মাথায়। ঘুম না আসাতে এক কাপ চা নিয়ে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালো ও। বারান্দায় সব সময়ই দখিনা বাতাস থাকে। ঠাণ্ডা বাতাসে মনটা ভালো লাগে বেশ। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। শ্রাবণী বোরখা পরে প্রস্তুত হলো। একটু পরই বোধ হয় গাড়ি এসে যাবে। জানালার ফাঁক দিয়ে বার বার রাস্তার দিকে উঁকি দিচ্ছে শ্রাবণী। বাসার সামনে কোনো গাড়ি থামছে না। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে আসলো। শ্রাবণী এখনো বোরখা গায়ে অপেক্ষা করছে। সেলিম হোসেন বলল,
–‘গাড়ি বোধ হয় আসবে না। তুই বোরখা খুলে ফেল। গরমের ভিতর বোরখা গায়ে বসে আছিস।’
শ্রাবণী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বোরখা খুলে‌ ফেলল। লোকটা বোধ হয় ভুলে গেছে গাড়ি পাঠানোর কথা। একবার কি ফোন করে জিজ্ঞেস করবে তাকে? সংকোচ হচ্ছে শ্রাবণীর। কিন্তু সেলিম হোসেন বার বার শ্রাবণীকে বলছে,
–‘পাবেলের কাছে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস কর গাড়ি পাঠায়নি কেন?’
শ্রাবণী ফোন করলো পাবেলের কাছে। পাঁচ বার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় বলল,
–‘কে?’
–‘আমি শ্রাবণী। গাড়ি পাঠালেন না কেন?’
–‘দুই বার রিং হওয়ার হওয়ার পরও রিসিভ না করলে বুঝতে হবে মানুষটা ব্যস্ত আছে। এত বার ফোন দেওয়ার কী হলো?’
একটু থেমে বলল,
–‘ড্রাইভার ব্যস্ত আজ। কাল পাঠাবো।’
এই বলে ওপাশ থেকে চট করে লাইন কেটে দিলো। এরকম একটা মানুষের সাথে সংসার করা সত্যি কি সম্ভবপর? শ্রাবণীর যদি পায়ের নিচের মাটি শক্ত থাকত তাহলে বিয়ের দুই দিনের মাথায়ই এই অসুস্থ সম্পর্কের ইতি টানতো।

শ্রাবণী শুয়ে রইল। মন ভালো লাগছে না। রাত নয়টা বাজে। নিস্তব্ধ বাসাটায় ঘড়ির কাঁটা ঘোরার শব্দটাও শোনা যাচ্ছে। যাইফ ফোন করেছে। অনেকদিন পর ফোন করেছে।
–‘অনেক দিন পর ফোন করলেন যাইফ ভাই। কেমন আছেন?’
–‘ভালো। তুই কেমন আছিস? ভার্সিটি থেকে ট্যুরে গিয়েছিলাম। ব্যস্ত ছিলাম। তবুও এর ভিতর দুই বার ফোন দিয়েছিলাম তোকে। ফোন‌ বন্ধ ছিলো।’
–‘ফোনে চার্জ ছিলো না বোধ হয়।’
–‘কোথায় আছিস তুই এখন? তোদের বাড়িতে যাসনি এখনো? তোর সংসার কেমন চলছে তাড়াতাড়ি বল?’
শ্রাবণী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ ফোনের ওপাশে গিয়ে পৌঁছল। যাইফ বুঝলো শ্রাবণী ভালো নেই।
–‘আমি এখন আমাদের বাড়িতেই আছি। পাবেল আসেননি। আমাদের দুই রুমের বাসা। কোনো প্রাইভেসি নেই সেজন্য। আমি এখানে আসার পর একবারও ফোন করেননি। শুধু কালকে ফোন করল। বলেছে আমায় নেওয়ার জন্য ড্রাইভারকে পাঠাবে। আজ সন্ধ্যায় ড্রাইভারকে পাঠানোর কথা ছিলো। কিন্তু ড্রাইভার নাকি ব্যস্ত তাই পাঠাতে পারেনি। শ্বশুর বাড়িতে ঝিয়ের মত খাটাখাটনি করছি। সারাদিন আমার কোনো খোঁজ নেয় না আমার‌ পতি। শুধু রাতে আমায় দরকার হয়। এখন আপনিই বলেন আমি কেমন আছি? আমার সংসার কেমন চলছে?’

যাইফ অরব হয়ে গেল। কি বলবে? মানিয়ে নিতে বলবে? যাইফের বিবেক বাঁধা দিচ্ছে। শ্রাবণীর দুর্দশা ওকে পীড়া দিচ্ছে। কি করতে পারে ও এই মেয়েটার জন্য? অনেকক্ষণ চিন্তামগ্ন থেকে যাইফ বলতে শুরু করল,
–‘শ্রাবণী তুই কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবি? ওই অমানুষটাকে ডিভোর্স দিতে পারবি? আমি জানি তুই পারবি না এসব কিছুই। তোর পরিবার তোকে সাপোর্ট করবে না। হয়ত এখানে ডিভোর্স হয়ে গেলে দুইদিন বাদে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিবে। সমাজের লোক তোকে বাঁকা চোখে দেখবে। তোর তো ও বাড়িতে পড়ে থাকা ছাড়া কোনো রাস্তা নেই। আর তুই তো নিজের রাস্তা নিজে তৈরিও করতে পারবি না। বিয়ের আগে যদি পালিয়ে যেতি আমি তোকে সাহায্য করতে পারতাম। কিন্তু এখন তোকে আমি কিভাবে সাহায্য করবো? তুই যে সোসাইটিতে বেড়ে ওঠেছিস সেখানে ডিভোর্স হওয়া খুব জঘন্য ব্যাপার। সে সোসাইটিতে মেয়েদের সব কিছু মানিয়ে নেওয়ার নিয়ম।’
যাইফ একটু থামলো। তারপর দৃঢ় গলায় বলল,
–‘তুই ডিভোর্স দিতে পারবি পাবেলকে? আমি তোকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিবো। তুই হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করবি।’
শ্রাবণী আঁতকে ওঠল। ঢোক গিলে বলল,
–‘না ভাইয়া এটা আমি পারবো না।’
যাইফ ভীষণ বিরক্ত হলো। যাইফ জানে শ্রাবণী এটাই বলবে। সেজন্যই সেদিন ওকে মানিয়ে নিতে বলেছে। ও যদি সেরকম বুদ্ধিমতি, তেজী মেয়ে হতো তাহলে বিয়ের আগেই পালিয়ে যেত।
–‘দেখ শ্রাবণী জীবনটা খুব ছোট। ছোট এই জীবনটা মানিয়ে নেওয়ার জন্য না। নিজের ভালো থাকার কথা ভাব। ও বাড়িতে থাকলে তোর জীবনটা নরক হয়ে যাবে।’
শ্রাবণী ঘাবড়ে যাওয়া গলায় বলল,
–‘আমি ডিভোর্স দিতে পারবো না। এসব নিয়ে ভাবাভাবির দরকার নেই।’
যাইফ ফোন কেটে দিলো। এই মেয়ের সাথে কথা বলাই বৃথা। শ্রাবণী পুনরায় কল দিলো। ভীষণ দুঃখী গলায় বলল,
–‘ভাইয়া আপনি আমার উপর বিরক্ত হচ্ছেন? আপনি ছাড়া আমার রাগ, দুঃখ গুলো বলার মত আর কেউ নেই।’
–‘তোর সাথে এসব নিয়ে কথা বলে লাভ নেই আমার। তোকে এছাড়া আরেকটা পরামর্শ দিতে পারি।’
শ্রাবণী প্রবল ব্যগ্র হয়ে বলল,
–‘কি পরামর্শ?’
–‘তোর বুড়ো বরকে প্রেমের ফাঁদে ফেল। সুন্দরী মেয়ে তুই। একটু সেজেগুজে আহ্লাদ করলে প্রেম উথলে পড়বে। প্রথম প্রথম পাত্তা দিবে না হয়ত। ধৈর্য ধরতে হবে। পাত্তা না দিতে না দিতে প্রেমে পড়ে যাবে।‌ পারবি তো?’
শ্রাবণী অসহায় গলায় বলল,
–‘কিভাবে প্রেমে ফেলবো?’
–‘ধাক্কা দিয়ে ফেলিস। গাধি কোথাকার।’
নিজের কথায় নিজেই হেসে যাইফ আবার বলল,
–‘এই ধর তোর হাজবেন্ড বাসায় ফিরলেই জড়িয়ে ধরবি। হুটহাট চুমু খাবি। গোসল করে বের হলে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছিয়ে দিবি। সে যা যা খেতে পছন্দ করে রেঁধে খাওয়াবি। তার জন্মদিনে সারপ্রাইজ দিবি। সুন্দর করে শাড়ি টাড়ি পরে থাকবি। এই তো।’
শ্রাবণী ভীষণ লজ্জা পেল। এই যাইফ ভাইটা এমন কেন? শ্রাবণীকে চুপ দেখে যাইফ আবার বলল,
–‘তোর শ্বাশুড়ির সাথে বুদ্ধি খাটিয়ে চলবি। জানিস তো মানুষ শক্তের ভক্ত, নরমের জম। তার চেয়ে সব সময় এক কাঠি সরেস থাকার চেষ্টা করবি। ও বাড়িতে একদম দুর্বল হয়ে থাকবি না।’
শ্রাবণী সারারাত ঘুমাতে পারলো না। যাইফের বলা কথা গুলো ভেবেছে শুধু। বুড়ো হরিণ প্রেমের জালে আটকাবে তো?
(চলবে)
প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-৯)
ইসরাত জাহান তানজিলা
_____________________
যাইফের‌ বলা কথা গুলো শ্রাবণীর সারা রাতের ঘুম গায়ের করে দিলো। চাপা এক উত্তেজনা আর উদ্বেগে নিমজ্জিত হয়ে ছিলো। শেষ রাতের দিকে চোখ দুটো লেগে আসছিলো। চারদিকে ফজরের আজান ধ্বনিত হচ্ছে। খানিক বাদেই শ্রাবণীর দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ। ঘুম না হওয়ার দরুন মাথাটা ভার হয়ে আছে। সবে ঘুমে চোখ লেগে আসছিলো এর ভিতর দরজার ঠক ঠক আওয়াজ শুনে শ্রাবণীর উচ্চশব্দে একটা চিৎকার দিতে ইচ্ছে হলো। বাসায় তো সেলিম হোসেন ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি এই ভোর রাতে দরজা ঠেলছে কেন? শ্রাবণী চোখ না মেলেই বিরক্ত গলায় বলল,
–‘কী হয়েছে বাবা?
–‘ওঠ তো শ্রাবণী। দেখ বাসার সামনে গাড়ি হর্ন বাজাচ্ছে। তোকে নিতে এসেছে বোধ হয়।’
সেলিম হোসেনের কথা শুনে শ্রাবণী চমকে ওঠে বসে। একটু আগেই ফজরের আজান দিলো।‌ ভালো করে ভোর হয়নি, সূর্য ওঠেনি। বাইরে এখনো অন্ধকার। এই সময়ে ড্রাইভার এসেছে? কি অদ্ভুত! শ্রাবণী বিছানা ছেড়ে ওঠে বাসার সামনে গেল। সত্যি সত্যি এক লোক গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওদের বাসার সামনে। একটু পর পর হর্ন দিচ্ছে। এই লোকটাই কি পাবেলের ড্রাইভার? শ্রাবণী ড্রাইভারকে দেখেনি এর আগে। ড্রাইভার বলল,
–‘শ্রাবণী ম্যাডাম পাবেল সাহেব আমাকে পাঠাইছে আপনাকে নিতে।’
শ্রাবণী অবাক গলায় বলল,
–‘এত সকালে? এখনো তো ভালো করে আঁধার কাটেনি।’
–‘পাবেল সাহেব এই সময়ই আসতে বলছে আমায়। আমার আরো ডিউটি আছে। সাহেবের আব্বা-আম্মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাইতে হবে।’
হঠাৎ ফোন করে শ্রাবণীকে বাসায় ফিরতে বলার কারণ তাহলে এই। জয়নাল সাহেব আর ফরিদা বেগম গ্রামের বাড়িতে যাবে। বাড়ির সকল কাজ, পাবেলের দাদা-দাদিকে দেখভাল করা এসব কারণেই শ্রাবণীকে দ্রুত বাসায় ফিরতে তাড়া দেওয়া হয়েছে। শ্রাবণী বলল,
–‘আমি সবে ঘুম থেকে উঠেছি। আপনি বাসার ভিতরে আসুন। একটু অপেক্ষা করুন। আমি দ্রুত রেডি হয়ে নিচ্ছি।’
ড্রাইভার বাসার ভিতরে গিয়ে বসলো। শ্রাবণী তাকে চা করে দিলো চটজলদি। সাথে বিস্কুট। ঘুম না হওয়ার দরুন শরীরটা কেমন টলমল করছে। শাওয়ার নিলে সতেজ লাগত। শ্রাবণী সাওয়ার সেরে চটজলদি প্রস্তুত হয়ে নিলো। সেলিম হোসেন মন খারাপ করে মেয়েকে বিদায় দিলো।

গাড়ি চলছে। আঁধার পুরোপুরি কেটে গেছে। ঘেমাচ্ছন্ন একটা সকাল। শিরশিরে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। একটু পরই বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। বৃষ্টির গায়ে তেমন তেজ নেই। গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। ড্রাইভারকে একটা কথা জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন। তাকে কি বলে সম্বোধন করবে ভেবে পেল না শ্রাবণী। ড্রাইভার সাহেব বলবে নাকি চাচা, মামা বলবে? ড্রাইভার লোকটা শ্রাবণীর বাপের বয়সী। এত বয়স্ক লোককে ড্রাইভার সাহেব বলে সম্বোধন করতে বেখাপ্পা লাগবে। সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এত ভাবছে কেন ও? ঘুম না হওয়ায় মাথাটা এলোমেলো হয়ে গেছে নাকি? শ্রাবণী হাই তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল,
–‘চাচা উনারা কবে বাসায় ফিরবে?’
ড্রাইভার বলল,
–‘কারা?’
–‘আমার শ্বশুর শাশুড়ি।
–‘তা তো আমি বলতে পারবো না ম্যাডাম।’
–‘ও। আচ্ছা চাচা আপনি আমায় আরেকটা কথা বলতে পারবেন?’
–‘কি কথা?’
শ্রাবণী মনে মনে ড্রাইভারের উপর বিরক্ত হলো। যন্ত্রের মত কেমন দায়সারা ভাবে শ্রাবণীর কথা উত্তর দিচ্ছেন তিনি। মুখের ভঙ্গির কোনো পরিবর্তন নেই। কঠিন ধাঁচের চেহারা। সামান্য হাসছেনও না। ড্রাইভাইরের এরূপ মেজাজ দেখে শ্রাবণী ফের কিছু জিজ্ঞেস করার উৎসাহ পেল না। খানিক দ্বিধা নিয়ে বলল,
–‘আপনার পাবেল সাহেব বিয়ের রাতে কেন পালিয়ে গিয়েছিল? কোথায় পালিয়ে গিয়েছিল তা তো আপনি নিশ্চয়ই জানেন তাই না? আপনি তো তার ড্রাইভার। সে কোথায় যায়, কোন মেয়ের সাথে কথা বলে তা তো আপনি নিশ্চিত জানেন।’
–‘আমি এসব কিছুই জানি না।’
–‘আপনি জানেন কিন্তু আমায় বলবেন না। আচ্ছা এটা ছাড়ুন। শুধু আরেকটা কথা বলুন। তার বান্ধবী দেখতে কি আমার চেয়ে সুন্দরী?’
ড্রাইভার এবার শ্রাবণীর দিকে তাকালেন। যেন চোখ দিয়ে মাপছে শ্রাবণীর সৌন্দর্য। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। কিন্তু শ্রাবণীর প্রশ্নের জবাব দিলো না। শ্রাবণী ব্যগ্রতা নিয়ে বলল,
–‘কি হলো বলছেন না যে?’
–‘আমি এসব কিছু জানি না।’
শ্রাবণী হতাশ হলো। একটু থেমে অভিমান নিয়ে বলল,
–‘আপনি সবই জানেন কিন্তু বলবেন না। আচ্ছা না বললেন। এবার আপনার কাছে একটা অনুরোধ রাখি আমি যে আপনায় এসব জিজ্ঞেস করেছি তা আপনার পাবেল সাহেবকে বলবেন না।’
–‘আচ্ছা।’
শ্রাবণী এই রোবট টাইপ মানুষটার সাথে আর কথা বাড়ালো না। বৃষ্টি কমে গেছে। আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘ গুলো নেই এখন আর। রোদ বের হয়েছে। শ্রাবণীদের বাসা থেকে পাবেলদের বাসায় যেতে আনুমানিক সাড়ে তিন ঘন্টা লাগে। কিন্তু আজ এত সময় লাগছে কেন? সেই ভোর পাঁচটা বাজে রওয়ানা দিয়েছে। আর এখন‌ পৌনে দশটা বেজে গেছে। এই প্রশ্নটা ড্রাইভারকে করা দরকার। এভাবে এতক্ষণ গাড়িতে বসে থাকতে ধৈর্য্যে কুলোচ্ছে না। শ্রাবণী বিরক্ত হয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল,
–‘আর কতক্ষণ লাগবে? আজকে এত টাইম লাগছে কেন?’
–‘আজকে একটু ঘুরে যেতে হচ্ছে। সে সড়ক দিয়ে দ্রুত যাওয়া যায় সে সড়কে আজ মেরামতের কাজ চলছে।’
খুব সংকীর্ণ রাস্তা ধরে গাড়ি চলছে। রাস্তার পাশে পচা পানির ডোবা। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। চিপাচাপা গলি। মানুষজন তেমন নেই। গা ছমছম করা পরিবেশ। এই ড্রাইভারের হাবভাবও ভালো ঠেকছে না। শ্রাবণীর অচেতন মন ঘাবড়ে গেল। মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তা ভাবনা আসছে। শ্রাবণী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বেলা এগোরটা বেজে গেছে। আর কতক্ষন?
–‘চাচা আর কতক্ষন লাগবে বলুন তো। কোন রাস্তায় নিয়ে আসলেন আপনি চারদিকে মানুষজন কিছু নেই।’
–‘বেশিক্ষণ লাগবে না আর। বলছি তো বড় সড়কে কাজ চলছে তাই ঘুরে যাচ্ছি।’
–‘সে তো কখন থেকে বলে যাচ্ছেন বেশিক্ষণ লাগবে না। রাস্তাই তো ফুরাচ্ছে না।’
–‘ফুরাবে।’
গাড়ি আরো আধা ঘন্টা চললো। সাড়ে এগারোটা বাজে। গাড়িতে এক ভাবে বসে থাকতে থাকতে শ্রাবণীর ঘুম পেল। ও চোখ বুজে আছে। হঠাৎ গাড়ি থামার ঝাঁকুনিতে চোখ খুলল। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল পুরানো, ভাঙাচোরা, শ্যাওলা পরে কালো হয়ে যাওয়া তিনতলা একটা দালানের সামনে গাড়ি থেমেছে। শ্রাবণী বিচলিত হয়ে দ্রুত জিজ্ঞেস করে,
–‘গাড়ি এখানে কেন থামিয়েছেন?’
–‘এখানে আমার একটু কাজ আছে। আপনি বসুন।’
শ্রাবণী আংকিত হয়ে গেল। ঘেমে যাচ্ছে ও। নিঃশ্বাস বেড়ে যাচ্ছে ত্রাসে। ও কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ করে দুজন লোক ছুটে এসে ওকে গাড়ির ভিতর থেকে বের করে টেনেহিঁচড়ে সেই পুরানো দালানটার দোতালায় নিয়ে গেল। শ্রাবণী নিদারূণ ভয়ার্ত হয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার করতে লাগলো। ওর পুরো শরীর কাঁপছে। লোক দুইটা ওর মুখ চেপে ধরলো। চিৎকার করতে দিলো না। এখন শ্রাবণীর দুই চোখ বেয়ে পানি পড়ছে শুধু নীরবে। ওর মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেল। মনে হচ্ছে এসব দুঃস্বপ্ন। ঘুম ভাঙার সাথে সাথে সব মিথ্যে হয়ে যাবে। পুরো শরীর অবশ হয়ে গেল শ্রাবণীর। খুব বেশি আতংকে মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। লোক দুইটা প্রথমে ওর কাছ থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নিলো। সেই ড্রাইভারটাকে কোথায়ও দেখছে না এখন। একটা রুমে শ্রাবণীকে আটকে রাখলো। রুমটা অন্ধকার। দরজা, জানালা সব বন্ধ করা। শ্রাবণী গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলল, কোনো পুরুষ আমার শরীর ছোঁয়ার আগে আমার মৃত্যু দেও আল্লাহ।
________________
সেলিম হোসেন নিজের শার্ট ইস্ত্রি করছেন। পারভীন বেগম ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাসায় ফিরে এসেছেন। সেলিম হোসেন সকালে গিয়ে এনেছে তাদের। বাসায় এসেই পারভীন বেগমের মাথা গরম হয়ে গেল‌ সেই বাজারের ব্যাগ খালি দেখে। তিনি বাসায় না সত্ত্বেও সব রান্না করে খেয়েছে? এ বাসায় কি তাহলে তার কোনো গুরুত্ব নেই? এই নিয়ে রফাদফা করলেন সেলিম হোসেনের সাথে। শ্রাবণীর প্রতি তার এত দরদ দেখে পারভীন বেগমের গা জ্বলে যাচ্ছে। তিনি বিছানা গোছাতে গোছাতে বললেন,
–‘মেয়ে কি তোমায় তাবিজ করেছে? হঠাৎ করে মেয়ের প্রতি এত দরদ আসলো কোত্থেকে? তোমাকে কালই আমি ফকিরের কাছে নিয়ে যাবো। তোমার পেট খোললে নিশ্চিত তাবিজ পাওয়া যাবে।’
সেলিম হোসেন কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না। ঝগড়া করার মেজাজ নেই তার এখন। এলাকার লোকেরাও তাকে হাসে বউয়ের সাথে নিত্য এই ঝগড়া নিয়ে। শ্রাবণী তো সেই ভোর পাঁচটায় বের হয়েছে। এখন বারোটা বেজে গেছে। এখনো কি বাসায় পৌঁছেনি ও? সেলিম হোসেন বার বার শ্রাবণীকে বলেছে, বাসায় পৌঁছে যেন শ্রাবণী তাকে জানায়। শ্রাবণী কি ব্যাপারটা ভুলে গেল? তিনি কতক্ষণ ধরে শ্রাবণীর মোবাইলে কল দিয়ে যাচ্ছে। মোবাইল বন্ধ দেখাচ্ছে। সেলিম হোসেন পাবেলের নম্বরে কল করলো এবার। ওপাশ থেকে ব্যস্ত বলছে। বিকাল হয়ে গেল। শ্রাবণীর ফোন এখনো বন্ধ। সেলিম হোসেনের চিন্তা হচ্ছে। তিনি আবার পাবেলের কাছে ফোন দিলো। পাবেল ফোন রিসিভ করলো। সেলিম হোসেন বললেন,
–‘পাবেল আমি শ্রাবণীর বাবা বলছি। শ্রাবণী কি বাসায় পৌঁছেছে?’
পাবেল চমকানো গলায় বলল,
–‘শ্রাবণী কীভাবে বাসায় পৌঁছাবে আমি তো ওর জন্য গাড়ি পাঠাইনি। ড্রাইভার গ্রামের বাড়ি গেছে বাবা-মাকে নিয়ে। বিকালে পাঠাবো শ্রাবণীকে আনতে।’
সেলিম হোসেন স্তব্ধ হয়ে গেল। হতবিহ্বল হয়ে বলল,
–‘বাবা তুমি কি বলছো? সকালেই তো তোমাদের ড্রাইভার আসলো শ্রাবণীকে নিতে। শ্রাবণী তো তোমাদের বাসায় গেছে।’
–‘আরে আপনি এসব কি বলছেন? আমি তো ড্রাইভার পাঠাই ই নি।’
সেলিম হোসেন নির্বাক হয়ে রইলেন। কি হচ্ছে এসব? পাবেল কি মিথ্যা বলছে? তার মেয়ে কি কোনো বিপদে পড়লো?
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী(পর্ব-১০)
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
সেলিম হোসেন দিশাহারা হয়ে গেল। আতংকিত মনে আওড়ালো,
–‘আমার মেয়েটার যেন কিছু না হয় আল্লাহ। সারাটা জীবন ও দুঃখ করে গেল। আমি বাপ হয়েও ওর প্রতি দায়িত্ব পালন করিনি।’
বাসার সামনের সংকীর্ণ বারান্দায় ছোট্ট একটা চৌকি পাতা আছে। সেলিম হোসেন নিস্তব্ধ হয়ে সেখানেই বসে আছে। এ মুহূর্তে তার মস্তিষ্ক পুরো ফাঁকা হয়ে গেল। ড্রাইভার বলল পাবেল তাকে পাঠিয়েছে অথচ পাবেল বিষয়টা অস্বীকার করলো। ড্রাইভার কেন মিথ্যে বলবে? পাবেল না পাঠালে ড্রাইভার কীভাবে জানলো শ্রাবণী সকালে বাড়ি ফিরবে? সেলিম হোসেনের মনে এমন অজস্র যুক্তি দাঁড়াচ্ছে। শ্রাবণীকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে পাবেল? এতক্ষণে কি মেরেই ফেলল মেয়েটাকে? সেলিম হোসেনের বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে। পাবেলের হাবভাব সেদিনই ভালো ঠেকেনি সেলিম হোসেনের কাছে। পাবেল কি চাচ্ছে না শ্রাবণীকে নিয়ে সংসার করতে?

পারভীন বেগম অনেকক্ষণ ধরে অবলোকন করছেন সেলিম হোসেনকে। বারান্দার চৌকিটায় আধ ঘন্টা ধরে একই ভঙ্গিতে বসে আছেন তিনি। বিচলিত আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারা। পারভীন বেগম যতবারই সেলিম হোসেনকে দেখছেন ততবারই তার চোখ দুটো ফার্নেসের চুল্লির মতো জ্বলে ওঠছে। এই লোকটাকে ইদানিং তিনি সহ্যই করতে পারছেন তিনি। চেহারা দেখলেই রাগ হয়। সেলিম হোসেনের হালচালও ঠিক লাগছে না। পারভীন বেগম সেলিম হোসেনের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। গলা ছেড়ে নীলাকে ডেকে বলল,
–‘নীলা তোর বাপকে বল বাসায় রান্নার তেল নেই। দুপুরে খেতে হলে তেল নিয়ে আসতে বল।’
সেলিম হোসেন তেল কিনতে সামনের গলির দোকানটাতে গেল। অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তায় হাঁটছেন আর ভাবছেন, থানায় যাবে? পাবেলের নামে মামলা করবে নাকি কিছু সময় অপেক্ষা করে দেখবেন?
তিনি আবার পাবেলকে ফোন দিয়ে বলল,
–‘শ্রাবণী কোথায় সত্যি বলো বাবা। ওকে মেরে ফেলো না।’
–‘কি সব বাজে বলছেন আপনি। বলছি তো আমি শ্রাবণীকে আনতে পাঠাইনি। আপনার বিশ্বাস না হলে আপনি আমাদের বাসায় আসুন। আমার ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করুন। শ্রাবণীকে যে ড্রাইভার আনতে গেছে সে ড্রাইভারকে তো নিশ্চয়ই আপনি দেখেছেন। আপনি আমার বাসায় এসে দেখুন আমার ড্রাইভারই সেই ড্রাইভার কি-না?’
সেলিম হোসেন অধৈর্য হয়ে বললেন,
–‘এত কথা আমি শুনতে চাচ্ছি না। আমি তোমার বাবাকে ফোন করছি।’
–‘বাবাকে কেন ফোন করবেন? আগে খোঁজ নিয়ে দেখেন আপনার মেয়ের বিয়ের আগে কারো সাথে প্রেম ছিলো কি-না। আপনার চোখে ধুলো দিয়ে হয়ত সেই ছেলের সাথেই পালিয়েছে।’
পাবেলের কথা শুনতে সেলিম হোসেনের ভালো লাগছে না। তিনি লাইন কেটে জয়নাল সাহেবের কাছে ফোন দিলেন।
–‘শ্রাবণী কোথায়? সকালে পাবেল শ্রাবণীকে নিতে গাড়ি পাঠালো। কিন্তু শ্রাবণী এখনো বাসায় গিয়ে পৌঁছেনি। আপনার ছেলে বলছে সে নাকি কোনো গাড়িই পাঠায়নি।’
জয়নাল সাহেব এসবের কিছুই জানেন না। তিনি বিস্মিত গলায় শুধু বললেন,
–‘আরে কি বলছেন এসব আপনি?’
–‘যা বলেছি আপনি কি তা শুনতে পাননি?’
–‘শুনেছি কিন্তু…।’
অতি বিস্ময়ে জয়নাল সাহেবের কথা আগাচ্ছে না। তিনি চুপ থাকলেন। মাথার ভিতর ঝিমঝিম করে ওঠল তার। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন,
–‘বেয়াই আমরা তো গ্রামের বাড়িতে এসেছি। সকালেই ড্রাইভার আমাদের দিয়ে গেল।’
–‘আমি এখন কি করবো বলুন? কোথায় খুঁজবো শ্রাবণীকে?
–‘ড্রাইভারের চেহারা মনে আছে আপনার?’
–‘পরিষ্কার মনে আছে।’
–‘আপনি ধৈর্যহারা হবেন না। আমি দেখছি।’
জয়নাল সাহেব ফোন কেটে দিলো ব্যস্ত ভাবে। বিষয়টা নিয়ে ভারি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তিনি। তার মাথা কাজ করছে না। নিজের ছেলের উপরও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না। পাবেল কি করেছে এসব? জয়নাল সাহেব নিশ্চিত হতে পারছেন না। পাবেল এতটা বিকৃতমস্তিষ্কের হয়ে গেছে?
_____________
শ্রাবণী অঘোরে ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ খট খট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই শ্রাবণী চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে বসলো। কোথায় আছে ও? এ তো নরম বিছানা। ওকে যেখানে আটকে রাখা হয়েছিল সেটা তো অন্ধকার একটা রুমে ছিলো। তারপর কি হলো? এখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিন্তু তুলোর মত নরম বিছানা, বালিশ এসব আসলো কোত্থেকে? শ্রাবণীর শরীর কাঁপছে। ভয়ে প্রাণটা বেড়িয়ে যাবে বোধ হয়। অন্ধকারেও ওর ডরালু চোখ দুটো বোকার মত চারদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কোথায় আছে ও? অন্ধকারে তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আলো জ্বেলে দিবে? কিন্তু আলো কোথায় পাবে? জড়সড় ভাবে শ্রাবণী কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইল। নড়তেও ভয় লাগছে ওর। মস্তিষ্কটাও অসড় হয়ে আছে। কিছু ভাবতে পারছে না। শ্রাবণীর হঠাৎ ছোট এক খন্ড আলো ঠাহর হলো। দরজার নিচে দেখা যাচ্ছে আলো খন্ড। এর মানে ও কোনো রুমেই আছে। রুমটার‌ বাইরে আলো জ্বলছে। সেই আলো দরজার নিচে এসে পড়েছে সামান্য। শ্রাবণী প্রচণ্ড চেষ্টা করে মনে সাহস সঞ্চয় করে বিছানা থেকে নামলো। আলোটার দিকে দুর্বল পায়ে এগিয়ে গেল। তারপর দরজাটা একটু ঠেলে দেখল বন্ধ নাকি খোলা। আশ্চর্য দরজা তো খোলা। দরজা খুলে কি বাইরে বের হবে? সাহস পেল না শ্রাবণী।‌ বাইরে বের হয়ে যদি কতগুলো ক্ষুধার্ত পুরুষের আড্ডা? এমন শঙ্কা শ্রাবণীর মন তটাস্থ। ও দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে রইলো। হাত-পা ক্রমশ দুর্বল হয়ে আসছে, বল হারাচ্ছে।

দরজার বাইরে কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কেউ এগিয়ে আসছে রুমের দিকে। শ্রাবণীর প্রাণটা এবার বোধ হয় দেহ ছেড়ে উড়াল দিবে। ও চোখ বন্ধ করে হাত-পা শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ ওর মনে পড়লো দরজাটা তো খোলা। ও ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলে লোকটা আর রুমে ঢুকতে পারবে না। কম্পিত হাতে দরজা লাগিয়ে দিলো শ্রাবণী। সেই পায়ের আওয়াজটা আর পাওয়া যাচ্ছে না এখন। শ্রাবণীর কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। খানিক বাদেই পুরুষালি গলায় কেউ ডাকলো,
–‘শ্রাবণী।’
গলাটা শ্রাবণীর পরিচিত। আগেও অনেক বার শুনেছে। কিন্তু আতংকের কারণে মনে করতে পারছে না। কে ডাকছে ওকে? একদম স্বাভাবিক ভাবে ডাকছে। শ্রাবণী কম্পিত গলায় সাহস করে বলল,
–‘কে, কে ওখানে?’
–‘আমি পাবেল। দরজা খোলো।’
পাবেল? পাবেল আসবে কোত্থেকে? তাহলে কি পাবেলই এসব করিয়েছে? এখন কি ও শ্রাবণীকে মেরে ফেলবে? শ্রাবণী নির্বাক হয়ে রইল। দরজার ওপাশ থেকে বিরক্ত গলায় আবার বলছে,
–‘দরজা আটকে রেখেছো কেন আবার? সমস্যা কী তোমার? একের পর এক ঝামেলা করেই চলেছো।’
কি বলছে পাবেল? কিসের ঝামেলা করেছে ও? শ্রাবণীর যতটুকু মনে পড়ে ও পাবেলের সাথে কোনো ঝামেলা করেনি। পুরানো সেই দালানটার খাট পালংক বিহীন রুম থেকে ও এখানে আসলো কীভাবে? ওর কিছু মনে পড়ছে না কেন? সিনেমার মত কি স্মৃতিশক্তি চলে গেছে ওর?
পাবেল দরজার ওপাশ থেকে এবার দরজা খোলার জন্য পদাঘাত করতে লাগলো। তীব্র ক্রোধ নিয়ে বলছে,
–‘সমস্যা কি তোমার? কথা বলছো না কেন? দরজা খুলছো না কেন? আমার মেজাজ আর খারাপ করো না। মেরে ফেলবো একদম।’
শ্রাবণী কিছুতেই দরজা খুললো না। ও এবার দরজার কাছ থেকে সরে অন্ধকার হাতড়ে বাতির সুইচ খোঁজার চেষ্টা করলো। এই রুমে কি বাতি আছে? খুঁজতে খুঁজতে এক সময় বাতির সুইচ পেয়ে গেল। মনে ভীষণ ভয় নিয়ে সুইচ অন করতো। সুইচ অন করতেই শ্রাবণীর চোখ থেকে বিস্ময় ঝরে পড়তে লাগলো। এ কি করে সম্ভব? কি দেখছে ও এসব? ওর মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? শ্রাবণী ধপ করে খাটে বসে পড়লো। এটা যে ওর রুম। ও এ রুমে আসলো কিভাবে? শ্রাবণীর কিচ্ছু মনে পড়ছে না। দুই হাতে মাথা চেপে কপাল কুঁচকে রাখলো ও। ওদিকে দরজার ওপাশে দাঁড়ানো পাবেল রেগে আগুন হয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে খানিকটা সংযত করলো শ্রাবণী। তারপর খাট থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই শ্রাবণীর চোখে পড়লো পাবেলের ভয়ঙ্কর চেহারাটা। পাবেল যেন চোখ দিয়েই গিলে খেয়ে ফেলবে ওকে। কেন এত রেগে আছে পাবেল? দরজা না খোলার কারণে? শ্রাবণী এ মুহুর্তে পাবেলের রাগকে তুচ্ছ করে কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করল,
–‘আমি, আমি এখানে আসলাম কিভাবে?’
পাবেল শ্রাবণীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অমর্ষিত গলায় বলল,
–‘তো কোথায় ছিলে তুমি?’
শ্রাবণী এখনো সেই খারাপ সময়ের ভয় থেকে বের হতে পারছে না। ও দিশেহারা গলায় বলল,
–‘আমি তো পুরানো একটা দালানে ছিলাম। আপনার ড্রাইভার আমায় সেখানে নিয়ে গেছে। আমাকে সেখানে আটকে রাখা হয়েছিল। আমার মোবাইল নিয়ে গিয়েছিল ওরা।’
পাবেল খাটের দিকে দেখিয়ে বলল,
–‘ওই তো খাটের ওপর তোমার মোবাইল। মিথ্যে নাটক করো না তুমি। আমার ড্রাইভার তোমাকে আনতে যায়নি। তুমি নিজের ইচ্ছেয় কোথায়ও গিয়েছো। কোথায় গিয়েছিলে তুমি? পুরানো কোনো প্রেমিকের সাথে দেখা করতে?’
শ্রাবণী বিস্মিত দৃষ্টিতে খাটের দিকে তাকিয়ে দেখলো সত্যি সত্যি ওর মোবাইল খাটের ওপর।‌ ও হতবাক হয়ে গেল। পাবেল বলল,
–‘কোথায় গিয়েছিলে তুমি সেই সকালে বাসা থেকে বের হয়ে? তোমার বাবা আমায় ফোন করে পাগল বানিয়ে ফেলছে। তোমার বাবার ধারণা আমি তোমাকে গায়েব করিয়েছি।’
–‘আপনার ড্রাইভার ভোর পাঁচটায় আনতে গিয়েছিল আমায়। আমি তো….।’
পাবেল চিৎকার করে উঠল,
–‘বন্ধ করো তোমার ফালতু প্যাঁচাল।’
শ্রাবণী থেমে গেল। অনেকক্ষণ ধরে থেমে রইল। পাবেল চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে শ্রাবণীর দিকে। শ্রাবণী চিন্তানিমগ্ন হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।
(চলবে)