প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-১৭+১৮+১৯

0
413

প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-১৭+১৮+১৯
ইসরাত জাহান তানজিলা
_____________________
শ্রাবণীর মনে ঘন অন্ধকার মেঘ জমেছে। সেই মেঘ গুলো থেকে থেকে ওর চোখ দুটো ভিজিয়ে দিচ্ছে। আর গাল বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। শ্রাবণী কাঁদতে চাচ্ছে না। কিন্তু ষোড়ষী মেয়ের বেদনার্ত হৃয়দের কান্না থামানোর মন্ত্র বা কি? একটা মানুষ এতটা পাষণ্ড কি করে হয়? অমন মানুষের সাথে এক ছাদের নিচে থাকার রূচি শ্রাবণীর সেই কবেই উবে গিয়েছিল। তবুও একটা ভালোবাসামাখা সম্পর্ক না হোক অন্তত স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক গড়তে অনেকটা চেষ্টা করেছে শ্রাবণী। বার বার ব্যর্থ হয়েছে। বাবার বাড়িতে ঠাঁই নেই, অভিমান করে কোথায়ও যাওয়ার জায়গা নেই, পায়ের নিচের মাটি নড়বড়ে; সেজন্যই সমস্ত যন্ত্রণাদি সহ্য করে পড়ে রয়েছিল ও বাড়িতে। কিন্তু সবকিছু এখন শ্রাবণীর ধৈর্য্যর বেড়াজাল ডিঙিয়ে ফেলেছে। ও রাগে, দুঃখে ভালো-মন্দ জ্ঞান শূণ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। ওই কঠিন হৃদয়ের লোকটা কি পারতো না ওকে আটকাতে? কিছুই করল না সে। একদম ভাবলেশহীন। শ্রাবণীর চলে আসাতে তার কিচ্ছু এসে যায় না। শ্রাবণীর প্রতি তার কোনো আবেগ, অনুভূতি নেই। এরকম অসুস্থ একটা সম্পর্ক বয়ে চলতে গিয়ে আজকাল শ্বাসরোধ হয়ে আসে ওর। ওর বয়সী মেয়েগুলো যেখানে এখনো হৈ-হল্লা করে বেড়ায়, সেখানে এই বয়সেই পৃথিবীর সবচেয়ে রূঢ় বাস্তবতা ওর চারপাশ ঘিরে রেখেছে। বের হতে পারছে না ও সেই কঠিন বাস্তবতা ভেদ করে। ওর চলার পথ সবদিক থেকে অমসৃণ,কণ্টকাকীর্ণ। সৃষ্টিকর্তা কেন ওর জীবনের গল্পটা এরকম দুঃখ দিয়ে সাজিয়েছে? জীবনের গল্পের উপসংহারেও কি দুঃখ লিখে রেখেছেন তিনি?

বাসায় বাজার নেই। পারভীন বেগম শুধু মাত্র ডাল রান্না করেছেন। তার মেজাজ ভয়ঙ্কর। তুহিন, নীলার প্রাইভেটের স্যারের মাস হয়ে গেছে পাঁচ দিন‌ আগে। তিনি রোজ রোজ টাকার কথা বলেন। টাকা না দিতে পারায় বাচ্চা দুইটা লজ্জায় পড়তে যেতে চায় না। সেলিম হোসেন বিছানায় পড়ে আছে। তারও চিকিৎসা চলছে না। পারভীন বেগমের রাগ শেষে দুঃখে গড়ায়। তিনি নিঃশব্দে কাঁদে। শ্রাবণী রাতে খেলো না। সেলিম হোসেনের পাশে বসে রইল। এর ভিতর শ্রাবণীর ফোন বাজলো। জয়নাল সাহেব ফোন করেছেন। শ্রাবণী সেলিম হোসেনের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে ফোন ধরলো। জয়নাল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
–‘কি হয়েছে তোমাদের মাঝে? তুমি কি পাবেলের সাথে অভিমান করে চলে এসেছো?’
শ্রাবণী চুপ করে রইল। অভিমান অতি মূল্যবান জিনিস। যেটা সবার উপর করা যায় না। অন্তত এমন মানুষের উপর করা যায় না যে অভিমানের কদর করে না। ও ঘৃণা আর অপমানে চলে এসেছে। জয়নাল সাহেব বললেন,
–‘কথা বলছো না কেন? চুপ কেন?’
শ্রাবণী আর চুপ থাকলো না। শান্ত গলায় ধীরে ধীরে সবটা বলল জয়নাল সাহেবকে। ছেলের এমন আচরণের কথা শুনে জয়নাল সাহেব লম্বা শ্বাস ফেলে বললেন,
–‘ও একটা সাইকো। ওর ভিতর কোনো আবেগ, অনুভূতি নেই। সম্পর্কের, ভালোবাসার কদর নেই, গুরুত্ব নেই ওর কাছে। ওর বিবেকবোধ পঁচে গেছে। ওর কাছে জীবন মানে যখন যা ইচ্ছা তাই করা। মানসিক ভাবে অসুস্থ ও। আমি গ্রাম থেকে ফিরেই ওকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবো।’
–‘মানিব্যাগে যে বাচ্চাটার ছবি ছিলো সে কে? উনি আগে বিয়ে করেছিল?’
–‘কার বাচ্চার ছবি ও ওর মানিব্যাগে ভরে রেখেছে‌ কে জানে। কি বলছো তুমি এসব? না, ও আগে কোনো বিয়ে করেনি।’
শ্রাবণী চাপা আক্রোশ নিয়ে বলল,
–‘আপনাদের কি মনে হয়নি যে মেয়েটার সাথে আপনার ছেলের বিয়ে দিবেন সে মেয়েটার জীবন নরক হয়ে যাবে? সব জেনেবুঝে কেন আপনারা আমার জীবনটাই ওই নরকে ঠেলে দিলেন?’
–‘আরে তুমি একটু ধৈর্য ধরো। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক করার চেষ্টা করো। এত অল্পতে ধৈর্যহারা হলে হবে?’
শ্রাবণী রাগ চাপিয়ে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। এতকিছুর পরও কিভাবে ধৈর্য ধরতে বলেছেন তিনি? কঠিন ভাষায় জবাব দিলো শ্রাবণী,
–‘চৌত্রিশ বছরের একজন পুরুষকে আমি কিভাবে ঠিক করবো? সন্তান ঠিকঠাক ভাবে মানুষ করতে পারেননি আপনারা। আমি কেন ধৈর্য ধরবো?’
–‘তুমি আমার মুখে মুখে তর্ক করছো?’
–‘তর্ক করছি না বাবা। এসব কথা আপনাআপনি এসে যায়।’
–‘বাপের বাসার থেকে হাজার গুণ ভালো আছো আমার বাড়িতে। ভালো খাচ্ছো, ভালো পরছো। আর কি চাই?’
–‘এমন অশান্তি নিয়ে ভালো খেয়ে পড়েও ভালো থাকা যায় না।’
জয়নাল সাহেব ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন,
–‘আবার তর্ক করছো তুমি আমার মুখে মুখে? বয়স কত তোমার? ষোলো? এ বয়সেই এত বুঝে গেছো? ছোট ঘরের মেয়ের এনেছি মাথা নিচু করে চলবে বলে। মুখে মুখে তর্ক করার জন্য নয়। আমার ছেলেকে আমি আরো পাঁচটা বিয়ে করাতে পারবো।’

এই বলে জয়নাল সাহেব ফোন কেটে দিলেন রেগে। শ্রাবণী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সেলিম হোসেন ছটফট করছে। তার বুকের ভিতর ধরপড় করছে। শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। সেলিম হোসেনের এই দুরাবস্থা দেখে শ্রাবণীর মাথা থেকে অন্যসব দুশ্চিন্তা চলে গেল। ও অস্থির গলায় পারভীন বেগমকে বলল,
–‘মা বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলুন।’
পারভীন বেগম বললেন,
–‘টাকা কোথায় পাবে? এক পয়সাও আছে উনার? উনার মত মানুষের এভাবেই বিছানায় পড়ে মরা উচিত।’
–‘কেন উনার এভাবে মরা উচিত? লোকটা কি সারাজীবন খেটে খাওয়ায়নি আমাদের? অন্তত তিন বেলা ভাত তো খাইয়েছে।’
শ্রাবণীর গলায় ক্ষোভ। পারভীন বেগম বললেন,
–‘বাপের জন্য এত পরান পুরে তো যাও বাপকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে। জামাইয়ের তো টাকা কম নেই। চার আনা পয়সাও তো দিলে না বাপের চিকিৎসার জন্য।’
পারভীন বেগমের এসব কথা বিষক্ত ঠেকছে শ্রাবণীর কানে। ও গাড়ি ডেকে রাতের বেলায়ই হাসপাতালে নিয়ে গেল‌ সেলিম হোসেনকে। নিজের কানের স্বর্ণের দুল জোড়া বিক্রি করে দিলো। এই দুল জোড়া শ্রাবণীর মায়ের ছিলো। তিনি পালিয়ে যাওয়ার সময় সবই নিয়ে গেছেন শুধু এই দুল জোড়া বাদে। মায়ের স্মৃতি হিসেবেই রেখে দিয়েছিল শ্রাবণী। স্মৃতি রক্ষার চেয়ে বাপের চিকিৎসা জরুরি। সারারাত সেলিম হোসেনের পাশে ছিলো শ্রাবণী। ঘুমাতে পারেনি। রাতভর জেগে ছিলো। ঘুমানোর মত শান্তি মনে নেই। বিক্ষুব্ধ, অস্থির হৃদয় শান্ত হচ্ছে না কিছুতেই।

সকাল হয়। ডাক্তার আসেন। সেলিম হোসেনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। শ্রাবণীকে জানায় অবস্থা ভালো না তার। শ্রাবণী নৈঃশব্দ্যে কাঁদে। এই লোকটার উপর ছোট বেলা থেকেই তীব্র ঘৃণা ছিলো শ্রাবণীর। কিন্তু কয়েকদিনের স্নেহ, মমতায় তা মুছে গেছে। মানুষ পৃথিবী ছাড়ার আগে মায়া বাড়ায়। সেলিম হোসেনও কি মায়া বাড়িয়ে চলে যাবে? শ্রাবণী কেবিন থেকে বের হয়ে করিডোরে গিয়ে বসে। হঠাৎ পাবেলকে দেখতে পায়। পাবেল শ্রাবণীর দিকেই আসছে। পাবেল এসেই শ্রাবণীকে জিজ্ঞেস করল,
–‘শ্রাবণী বাবার কি অবস্থা?’
পাবেল এমন আচরণ করছে যেন শ্রাবণীর সাথে ওর সম্পর্ক খুবই স্বাভাবিক। পাবেল হাসপাতালে কেন এসেছে? শ্রাবণী অবাক না হয়ে পারে না। পাবেলের সাথে কথা বলতে বিস্বাদ লাগছে। ও উত্তর দিলো না। পাবেলের দিকে তাকালোও না। বেদনা ভরা মুখে মাথা নিচু করে রইল। পাবেল শ্রাবণীর পাশে বসল। শ্রাবণীর হাত ধরে বলল,
–‘দুঃখিত শ্রাবণী। আর কখনো তোমার গায়ে হাত তুলবো না।’
পাবেলের এরূপ ব্যবহারে শ্রাবণীর নিদারুণ বিস্মিয় হয়। কিন্তু প্রকাশ করে না। বিস্ময়টুকুন নিভৃতে হজম করে। নিজের হাতটা পাবেলের হাতের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নেয়। করিডোর থেকে কেবিনে যায়।‌ পাবেলও শ্রাবণীর পিছনে পিছনে যায়। পাবেলের উপস্থিতি তীব্র বিরক্তির সৃষ্টি করে শ্রাবণীর মনে। শরীর রাগে জ্বলে যায়। রাগ, জেদ সব সংবরণ করে চুপ থাকে। পাবেল বার বার কথা বলার চেষ্টা করে শ্রাবণীর সাথে। শেষ পর্যন্ত শ্রাবণী কথা বলল পাবেলের সাথে,
–‘আপনার চেহারা দেখলেই এখন আমার ঘৃণা হয়। আপনি এখান থেকে চলে যান।’
–‘আমি তোমায় নিতে এসেছি। বাসায় গিয়ে জানতে পারলাম তুমি হাসপাতালে। সেজন্য হাসপাতালে এসেছি।’
–‘আমি আপনার সাথে যাবো না।’
–‘হাজার বার যেতে বাধ্য তুমি। বাপের সংসারে তো ঠাঁই পাবে না। না গিয়ে উপায় কি?’
শ্রাবণী নিস্তব্ধ হয়ে যায়। ওর কোথায়ও ঠাঁই নেই জেনেই কি এত নিপীড়ন ওর উপর? ঠাঁই না থাকলে এবার মারা যাবে। তবুও যাবে না। এসব নিয়ে তর্কবিতর্ক করার মেজাজ ওর এখন নেই। ও চুপ থাকলো।

পাবেল হাসপাতাল থেকে গেল না। শ্রাবণীর পাশেই বসে রইল। ভাইয়ের অসুস্থতার কথা শুনে সেলিম হোসেনের বোনেরা আসলো। শ্রাবণীর বড়ো ফুফু সেলিনা চৌধুরীও এসেছে। স্বামীর চৌধুরী পদবীটা নিজের নামের সাথে জুড়ে দিয়েছেন তিনি। ভালো বিত্তশালী পরিবারে বিয়ে হয়েছে তার। যাইফও এসেছে। সেলিম হোসেনের চিকিৎসার খরচ সেলিনা চৌধুরী দিবে বলে জানালো। শ্রাবণীর মন শান্ত হলো কিছুটা। শ্রাবণীর ফুফুদের দেখে পাবেল কেবিন থেকে বের হয়ে যায়।‌ একে একে সবাইকে সালাম দেওয়া, কেমন আছে জিজ্ঞাসা করা বড়ো ঝামেলার মনে হয় পাবেলের। এখানে বসে সিগারেট খাওয়া সম্ভব না। পাবেল হাসপাতালের বাইরে বের হলো সিগারেট খেতে। শ্রাবণীকে কেবিনে দেখেই গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর বাইরে থেকে এসে দেখে শ্রাবণী কেবিনে, করিডোরে আশেপাশে কোথায়ও নেই। শ্রাবণী কোথায় গেছে জিজ্ঞেস করার মত কাউকে পেলো না। কিছুক্ষণ পরে দেখল শ্রাবণী কোত্থেকে যেন কেবিনের দিকেই আসছে। সাথে যাইফ। যাইফকে পাবেল চিনে না। সাক্ষাৎ হয়নি কখনো। যাইফের সাথে অনর্গল কথা বলছে শ্রাবণী। পাবেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল। বিরক্ত লাগছে ওর। শ্রাবণী পাবেলকে পাশ কাটিয়ে যাইফের সাথে কথা বলতে বলতে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চলে গেল।
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-১৮)
ইসরাত জাহান তানজিলা
_____________________
শ্রাবণীর মুখখানা বড়ো পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে। চোখ ঢুকে গেছে কোটরে। সারাক্ষণ মনের ভিতর চাপা দুর্ভাবনা, হৃদয়বেদনার দরুন চেহারার মন্দ এই অবস্থা। সেলিনা চৌধুরী শ্রাবণীর হাল দেখে ভাবলো অসুস্থ বাপের চিন্তায় মেয়ের এই অবস্থা। বাপের অসুস্থতা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে বটে। কিন্তু কেবল বাপের অসুস্থতা নিয়ে দুশ্চিন্তায় শ্রাবণীর এই হাল হয়নি। ও যে গোপন তীব্র একটা কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে তা যাইফ ছাড়া কেউ জানে না। সেসব সবার থেকে আড়াল করেছে। মানুষকে বলে বেড়াচ্ছে ও ভীষণ ভালো আছে। নিজের দুঃখের কথা অন্যের কাছে বলে সামান্য সহানুভূতি বৈ আর কি পাওয়া? সেলিনা চৌধুরী শ্রাবণীকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন,
–‘তোকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। রাতে ঘুমাতে পারিসনি বুঝি? বাসায় গিয়ে গোসল দিয়ে ঘুমো। শরীরটা চাঙ্গা লাগবে।’
–‘রাতে বাবার অবস্থা খুব খারাপ ছিলো। ঘুমোই কিভাবে?’
–‘বাপের জন্য তোর এত কিসের দরদ? বাবা হিসেবে কি দায়িত্ব পালন করেছে তোর? কিছুই করিনি তোর জন্য। এইটুকু বয়সে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। বাড়িতে ঝি চাকরানীর মত রেখেছে। বউয়ের কথা মতন ওঠ-বস করেছে সারাজীবন।’
–‘ভাই হিসেবে তোমাদের প্রতি কি দায়িত্ব পালন করেছে? তোমরা কেন চিকিৎসা করাচ্ছো?’
–‘কিছুই করেনি। তবুও তো এখন পরান পুড়ছে।’
–‘আমারও পরান পুড়ছে।’
–‘পাবেলকে নিয়ে বাসায় যা। বিশ্রামের প্রয়োজন তোর। বাসায় বাজার সদাই আছে তো? জামাইকে তো ভালোমন্দ রান্না করে খাওয়ানো তো উচিত।’
–‘এত ঝামেলার ভিতর ভালোমন্দ রান্না করতে হবে না‌।’
সেলিনা চৌধুরী শ্রাবণীর কথা শুনলেন না। তিনি লোক দিয়ে বাজার সদাই করালেন। শ্রাবণীর পাবেলকে নিয়ে বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। সেলিনা চৌধুরী বার বার বলার পরও ও হাসপাতালে থেকে গেল। শ্রাবণী রাতে খায়নি। সকালেও না। এখন দুপুর গড়াচ্ছে। ক্ষুধায় পেট কাতর। পাশেই একটা ভাতের হোটেল আছে। শ্রাবণী যাইফকে খেতে সাধলো। যাইফ বলল,
–‘আমারও ক্ষুধা লেগেছে। সকালে খাওয়া হয়নি। তোর হাজবেন্ড না খেলে তাকেও নিয়ে চল। বেচারা একা একা বসে আছে।’
–‘বসে থাকতে বলেছে কে? তাকে চলে যেতে বলেছি অনেকবার।’
–‘তুই কি সত্যিই চাস সে চলে যাক? তুই কি সত্যি ও বাড়িতে আর যেতে চাস না?’
শ্রাবণী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
–‘না গিয়ে উপায় কি?’
–‘তো এতো জেদ করছিস কেন?’
–‘জেদ না ভাই ঘেন্না হয়‌ তার মুখের দিকে তাকাতে।’
–‘যাকে ডিভোর্স দিতে পারবি না‌। যার বাসায় না গিয়ে তোর কোনো উপায় নেই। তার মুখের দিকে তাকাতে ঘেন্না হলে হবে?’
–‘জানি না।’
–‘তারচে আমি তোকে বলি তুই আমাদের বাসায় চল। কলেজে ভর্তি হয়ে সেখানে থেকে পড়।’
–‘সবকিছু এত সহজ না ভাইয়া। অন্তত আমার জন্য না।’
শ্রাবণী বার বার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছে মলিন মুখে। বলল,
–‘বাদ দিই এসব। চলেন খেয়ে আসি।’
যাইফ হেসে বলল,
–‘আমি যাবো না। দেখ তোর হাজবেন্ড আমাদের দিকে কি শ্যেন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তুই বরং তাকে নিয়ে যা। বেচারার ঈর্ষা হচ্ছে।’
–‘হোক।’
শ্রাবণী যাইফকে এক প্রকার জোর করে নিয়ে গেল। পাবেলকে দেখলেই ওর মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় আজকাল। যাইফ সাথে থাকলে সুন্দর একটা সময় কাটবে। এই মানুষটা ওকে বন্ধুর মতন বোঝে। হাঁটতে হাঁটতে শ্রাবণী বিষণ্ণ গলায় বলল,
–‘ওই লোকটার কাছে আমার কোনো গুরুত্বই নেই। আমাকে সে মানুষই মনে করে না। আমার শ্বশুড়ে বোধ হয় ঠেলেঠুলে পাঠিয়েছে আমাকে নিতে। নয়ত বাড়ির কাজকর্ম, রান্নাবান্না এসব নিয়ে অসুবিধায় পড়ে আমাকে নিতে এসেছে।’
–‘এটাও তো হতে পারে হয়ত তোর জন্য তার মনে অনুভূতি তৈরি হয়েছে। মিস করছিলো তোকে। সেজন্য নিতে এসেছে।’
শ্রাবণী তাচ্ছল্য করে ফিকে হেসে বলল,
–‘অনুভূতি আর সে দুইটা বিপরীত মেরুর জিনিস। সারাক্ষণ ছাঁইপাশ হাবিজাবি খেয়ে টাল হয়ে থাকে।‌ আবেগ অনুভূতির মর্ম কি বুঝবে?’
কথা বলতে বলতে হোটেলে ঢুকেই শ্রাবণী চমকে গেল। পাবেল বসে আছে হোটেলের ডান পাশের একদম প্রথম টেবিলটায়। যাইফ পাবেলকে খেয়াল করেনি। ও বলল,
–‘কি হয়েছে? সামনে হাঁট। ওপাশের টেবিলটায় বসি।’
পাবেলকে হাসপাতালে দেখে এসেছিল। ওরা কথা বলতে বলতে আস্তে আস্তে হেঁটে এসেছে। সেজন্যই পাবেল ওদের আগে পৌঁছে গেছে।‌ পাবেল তো জানতো না ওরা এখানে আসবে। ক্ষুধা লেগেছে বলে বোধ হয় এসেছে। পাবেল শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে আছে। যাইফও এবার দেখলো পাবেলকে। ও পাবেলের দিকে এগিয়ে গিয়ে সৌজন্যমূলক হেসে হাত বাড়িয়ে বলল,
–‘আমি শ্রাবণীর কাজিন।’
পাবেল স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলল,
–‘তোমরাও খেতে এসেছো নাকি?’
শ্রাবণী উত্তর দিলো না। যাইফ বলল,
–‘হ্যাঁ, কয়েক বেলা উপোস।’
ওরা এক টেবিলেই বসলো। শ্রাবণী মাথা নিচু করে নিঃশব্দে খাচ্ছে। খাওয়ার মাঝে পাবেল যাইফের দিকে তাকিয়ে বলল,
–‘দুই জন মানুষ একসঙ্গে থাকলে একটু আধটু ঝগড়াঝাঁটি হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। সেজন্য এভাবে বাড়ি ছেড়ে আসতে হবে? দেখো তোমার বোন আমার সাথে কথা বলছে না। এজন্যই এই ষোলো বছরের মেয়ে বিয়ে করতে চাইনি। মাথায় এখনো জ্ঞান বুদ্ধি হয়নি।’

শ্রাবণী অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাবেলের মুখের দিকে। এই লোকটার অভিনেতা হওয়া উচিত ছিলো। চেহারা খুব একটা ভালো না দেখে বোধ হয় হতে পারেনি। যাইফও কোনো কিছু না জানার ভান করে শ্রাবণীকে বলল,
–‘তুই রাগ করে চলে এসেছিস? আমি তো ভেবেছি মামা অসুস্থ বলে এসেছিস।’

শ্রাবণী‌ কিছু বললো না। খাওয়া শেষে হোটেল থেকে বের হয়ে পাবেল আচমকা শ্রাবণীর হাত ধরে অনুতপ্ত গলায় বলল,
–‘কথা বলছো না কেন তুমি আমার সাথে? বলছি তো আর এরকম হবে না।’

সত্যি কি আর এরকম হবে না? সত্যি কি পাবেল মন থেকে অনুতপ্ত? নাকি সব কপটতা? শ্রাবণী বলল,
–‘হাত ছাড়ুন। মানুষ তাকিয়ে আছে।’
পাবেল হাত ছাড়লো না। হাত ধরেই হাঁটছে। শ্রাবণীর জন্য কি সত্যি আবেগ, অনুভূতি তৈরি হয়েছে পাবেলের মনে? এত সহজে পাবেলকে বিশ্বাস করা যায় না। শ্রাবণীর মন এই নির্দয় লোকটার কথায় সায় দিচ্ছে না। ‌
_________________
সেলিম হোসেনের অবস্থা হাসপাতালে ভর্তি করার পর যত খারাপ ছিলো এখন তার থেকে একটু উন্নতি হয়েছে। সেলিনা চৌধুরী বললেন, তিনি আর পারভীন বেগম আজ রাতে হাসপাতালে থাকবে সেলিম হোসেনের পাশে। আর বাকী সবাইকে বাসায় চলে যেতে বললেন। শ্রাবণীকে বলল, বাসায় বাজার করা আছে। গিয়ে রান্না করিস। দুই দিন আগের ভাত-তরকারি জামাইকে খাওয়াস না। বাসায় গিয়ে রান্না করতে ইচ্ছে করলো না শ্রাবণীর। শরীরটা ক্লান্ত লাগছে। পাবেল এসেই খাটে শুয়ে পড়েছে। তার ক্ষুধা লেগেছে। বাকি সবাই অবসন্ন শরীর নিয়ে ফ্লোরে বসে আছে। হাসপাতালে রোগীর সাথে কয়েকদিন থেকে সুস্থ মানুষও রোগী হয়ে যায় বোধ হয়। শ্রাবণী সকল ক্লান্তি ঠেলে রান্নার করার জন্য ওঠলো। যাইফ বলল,
–‘তোর রান্না করতে হবে না শ্রাবণী। তুই অনেক ক্লান্ত। আজকে আমি সবাইকে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়াবো। আমি খুব ভালো খিচুড়ি রান্না করি।’
যাইফ সত্যি খিচুড়ি রান্না করলো। খেতে দারুণ হয়েছে। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লো শ্রাবণী। পাবেল খাটের পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে। শ্রাবণীকে বললো,
–‘বাড়ি কবে যাবে?’
–‘আপনি দেখছেন না বাবা অসুস্থ? আমি চলে এসেছি তাতে তো আপনার খুশি হওয়া উচিত।’
–‘আমি তো খুশিই কিন্তু আমার বাবা খুশি নন।’
শ্রাবণী আশ্চর্য হয়ে গেল আবার। ও তো ভেবেছিল ও চলে আসাতে পাবেল ওর প্রতি টান অনুভব করেছে। ওর অভাব বোধ করেছে। শ্রাবণী নীরব হয়ে রইল। পাবেল‌ বলল,
–‘আমার কাজ আছে। আমি সকালে চলে যাবো। তোমার বাবা সুস্থ হলে আমাকে ফোন দিও।’
শ্রাবণী হ্যাঁ হুঁ কিছু বলল না। পাবেল লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়লো শ্রাবণীর গা ঘেঁষে। শ্রাবণী দূরে সরে গেল। নিরাশ গলায় বলল,
–‘আমার শরীর ভালো লাগছে না। আমায় কাছে আসবেন না।’
পাবেল শ্রাবণীর কথা শুনলো। কাছে গেল না। শ্রাবণী চোখ বুজে শুয়ে রইল। ঘুম হয়নি কয়েক রাত ঠিকভাবে। তবুও ঘুম আসছে না। ও বিছানা ছেড়ে ওঠে গেল। অস্থির লাগছে ভীষণ। নিঃশব্দে ছাদের দিকে হাঁটলো। আজ ঘোর অন্ধকার বাইরে। এ বাড়িতে অন্ধকারেও হাঁটতে শ্রাবণীর অসুবিধা হবে না। শ্রাবণী ছাদের এক কোণে অন্ধকারের ভিতর গিয়ে দাঁড়ালো। ছাদের ও মাথায় খানিকটা আবছা আলো দেখতে পেলো। সেই আবছা আলোয় একজন মানুষের ছায়ামূর্তি ঠাহর হলো। শ্রাবণী কিছুটা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
–‘কে? কে?’
ছাদের ও মাথার মানুষটাও চমকে গেল। বলল,
–‘তুই এত রাতে ছাদে কেন?’
যাইফের গলা। যাইফ এগিয়ে আসলো শ্রাবণীর দিকে। শ্রাবণী বলল,
–‘এমনি। ভালো লাগছিল না তাই এসেছি।’
–‘এভাবে অন্ধকারের পেত্নির মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ঝগড়া হয়েছে নাকি আবার?’
–‘উঁহু।’
–‘তো ছাদে এসেছিস কেন?’
–‘মন ভালো লাগছে না। আপনি কি করছেন এখানে?’
–‘ঠাণ্ডা বাতাস খাচ্ছি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ফ্যানটা ভালো ভাবে চলছে না ক্যাচ ক্যাচ করছে। আজকে গরমটা একটু বেশিই পড়েছে বোধ হয়।’
–‘কতক্ষণ থাকবেন ছাদে?’
–‘কেন?’
–‘আপনার সাথে গল্প করতাম।’
–‘আচ্ছা তুই কি করতে চাচ্ছিস বল তো? তুই যেহেতু বিচ্ছেদ চাচ্ছিস না সেহেতু তোর উচিত সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা। এভাবে শুধু শুধু দূরত্ব বাড়বে। তুই ছাদ থেকে যা। পাবেলকে ঘুম থেকে ডেকে তোল। বল তোর মন ভালো নেই। দুইজন গল্পগুজব কর।’
শ্রাবণী হতাশ গলায় বলল,
–‘সম্ভব না।’
পাবেলের ঘুম ভাঙে হঠাৎ। ও উঠে দেখে শ্রাবণী বিছানায় নেই। এত রাতে কোথায় গেল? পাবেল বারান্দায় শ্রাবণীকে খুঁজে না পেয়ে ছাদে গেল। ছাদে ওঠার সিঁড়িতে বসেই শ্রাবণীর গলা শুনতে পেল। এত রাতে শ্রাবণী কার সাথে কথা বলছে ছাদে? পাবেল ছাদে গিয়ে অন্ধকারে দুইটা ছায়ামূর্তি দেখতে পেল। ও লাইট মারলো সেদিকে। হঠাৎ লাইটের আলোতে শ্রাবণী চমকে গেল। পিছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখলো পাবেল দাঁড়িয়ে আছে। যাইফ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। শ্রাবণীর মুখাবয়ব একদম স্বাভাবিক। পাবেল কেমন ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রাবণীর দিকে। বলল,
–‘নিচে আসো শ্রাবণী।’
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-১৯)
ইসরাত জাহান তানজিলা
_____________________
শ্রাবণী নিচে গেল পাবেলের পিছনে পিছনে। আজ যদি পাবেল এবিষয়টা নিয়ে হট্টগোল করে তাহলে শ্রাবণীও রেহাই দিবে না। পাবেল তো যা ইচ্ছে তাই করছে। সারাক্ষণ ছাঁইপাশ গিলছে, রাত-বিরাতে মেয়ে মানুষ নিয়ে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। শ্রাবণী তো সেসব নিয়ে টু শব্দও করছে না। আর যাইফ তো কেবল শ্রাবণীর দুঃখ, যন্ত্রনা, ক্লেশময় গল্প গুলো শোনার একজন ভালো বন্ধু বৈ কিছুই না। ও অবিরত যে ব্যথা বয়ে বেড়াচ্ছে যাইফ সে ব্যথায় প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করে। ওর ডরালু, দুর্বল হৃদয়টাকে দৃঢ় করার মন্ত্র দেয়। তীব্র খড়ায় শ্রাবণীর পুড়ে যাওয়া জীবনে যাইফ বর্ষার তুমুল বৃষ্টি। এরচে বেশি কি? শ্রাবণী রুমে ঢুকতেই পাবেল দরজা আটকে দেয়। পাবেলের মুখের অভিব্যক্তি দেখে আপাতত কিছুই ধারণা করা যাচ্ছে না। সে রেগে আছে না-কি শান্ত মেজাজে আছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। পাবেল রুমে ঢুকে জামাকাপড় ইস্ত্রি করার টেবিলটার উপর বসলো। শ্রাবণীকে বলল,
–‘এত রাতে ছাদে কি করছিলে? যাও আমার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এসো।’
শ্রাবণী যা ঝামেলা ঝঞ্ঝাট এর আশা করেছিলো তা কিছু হলো না। কিন্তু এতে মে শ্রাবণী স্বস্তি পেয়েছে তাও না। শ্রাবণী চেয়েছিলো হোক ঝঞ্ঝাট আজ। সে ও ছেড়ে দিবে না। মনের ক্ষোভ গুলো সব ঝাড়বে। কিন্তু শ্রাবণীকে অবাক করে দিয়ে পাবেল চা চেয়েছে। এই লোকটা বোধ হয় মানুষকে অবাক করার অসম্ভব শক্তি নিয়ে জন্মিয়েছে। এত রাতে চায়ের তেষ্টা পেয়েছে তার। শ্রাবণী চা বানিয়ে নিয়ে এলো। পাবেল চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে শ্রাবণীকে বলল,
–‘আমি তোমায় একটা মিথ্যে বলেছি।’

পাবেলের হাবভাব বোঝার চেষ্টা শ্রাবণী বিয়ের পর থেকেই করে যাচ্ছে। সেসব চেষ্টা বিফলে গেছে। এই ভালো, এই মন্দ। এই দিঘির জলের মত শান্ত, এই সমুদ্রের জলের মত উত্তাল। শ্রাবণী বলল,
–‘কি মিথ্যে?’
–‘বাবা আমায় তোমাকে নিতে পাঠায়নি। আমি নিজ থেকেই এসেছি। বাবা তো উল্টো তোমার উপর রেগে আছে। তুমি নাকি তার মুখে মুখে তর্ক করেছো?’
–‘তর্ক করিনি। কথার প্রসঙ্গে কথা বলেছি। সেটা তর্ক হলে আমি কি করবো?’
–‘আমি তোমায় নিজ থেকে নিতে এসেছি এটা বলতে আমার বিব্রত লেগেছিল। সেজন্য বাবার কথা বলেছি।’
শ্রাবণী কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল। পাবেল বলল,
–‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমার আচরণ বুঝতে পারছো না তাই? আমি প্রচুর ড্রাগ নিই। মাথা ঠিক থাকে না। আমায় একজন অভিশাপ দিয়ে বলেছিল আমি ড্রাগ নিতে নিতে পাগল হয়ে যাবো। মনে হচ্ছে খুব শিগগিরই তার অভিশাপ লেগে যাবে।’
শ্রাবণী অনিমেষনেত্রে তাকিয়ে আছে পাবেলের দিকে। ভীষণ নমনীয়, মসৃণ কন্ঠে নির্মল, নিষ্কলুষ মানুষের ন্যায় কথা বলছে পাবেল। এই মানুষটা অত হিংস্র হতে পারে তা এখন শ্রাবণীরই মনে হচ্ছে না। পাবেলের চা খাওয়া শেষ। ও এখনো ইস্ত্রি করার টেবিলটায়ই বসে আছে। শ্রাবণী জানালার গ্রিল ধরে আনমনে দাঁড়িয়ে আছে মুখখানা অন্যদিকে ঘুরিয়ে। পাবেল হঠাৎ উঠে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো শ্রাবণীকে। শ্রাবণী অপ্রস্তুত ভাবে তাকালো। পাবেল এর আগে শ্রাবণীকে অনেক বার জড়িয়ে ধরেছে। কিন্তু এভাবে হুটহাট না। সেজন্যই বোধ হয় আজ আলাদা একটা অনুভূতি হচ্ছে। পাবেল শ্রাবণীর কাঁধে মুখ ঠেকালো। দুই হাতে আলতো করে শ্রাবণীর কোমড় জড়িয়ে ধরলো। পাবেলের উষ্ণ নিঃশ্বাস, শীতল ঠোঁটের ছোঁয়ায় শ্রাবণী কেমন নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। পাবেল এর আগে কতশত বার কাছে এসেছে কিন্তু তখন শ্রাবণীর শরীরটাকে একদলা মাংসপিণ্ড বৈ কিছুই মনে করেনি। আজ একদম ভিন্ন। এই মুহুর্তে শ্রাবণী ওর মনের ভিতর কৌতুহলের দলা পাকিয়ে থাকা কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানার সুযোগ হাতছাড়া করলো না। ও প্রথমেই জিজ্ঞেস করল,
–‘বিয়ের রাতে পালিয়েছিলেন কেন? আর সাতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাবেল স্বাভাবিক গলায় বলল,
–‘আসলে আমি চিরকুমার থাকতে চেয়েছিলাম। বিয়ে, সংসার এসবে আমার বিতৃষ্ণা রয়েছে। কিন্তু বাবা মানলেন না। বিয়ে না করলে তার জায়গাজমি সব দান করে দিবে। এমনকি বাবা তার জন্য কাগজ রেডি করতেও চেয়েছিলেন। আমার উপর বাবা প্রচুর বিরক্ত ছিলো। আমার উপর বাবার রাগটা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে বিয়ে না করলে সত্যি সত্যি যা বলেছেন তাই করতেন। রাগের অনেক কারণ ছিলো। তাছাড়া বড়ো‌ ব্যাপার ছিলো আমি তাদের একমাত্র সন্তান। আমি যদি চিরকুমার থেকে যাই তাহলে বংশের প্রদীপ জ্বলবে কিভাবে? আমার বিয়ে না করা নিয়ে বাবার যতটা না আক্ষেপ ছিলো তারচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা ছিলো তার বংশ রক্ষা নিয়ে। আমার বয়সও অনেক হয়ে গিয়েছিল। বংশের প্রদীপ জ্বালাতে আমায় বিয়ে করালেন ষোলো বছরের এক সুন্দরীকে। বাবার ধারণা ছিলো কম বয়সী, সুন্দরি বউ হলে তার ছেলে একদম আঁচল ধরে থাকবে।’
পাবেলের কণ্ঠে হালকা কৌতুক ভাব। শ্রাবণীও পাবেলের মত করে বলল,
–‘তো বউয়ের আঁচল ধরে থাকলেন না কেন?’
–‘বাবার ধারণা ভুল করতে।’
–‘বাবার ধারণা ভুল করা এতটাই জরুরি?’
–‘হ্যাঁ।’
এরপর শ্রাবণী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। পাবেল শ্রাবণীকে ওভাবেই ধরেই দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিতীয় প্রশ্নটা করলো শ্রাবণী,
–‘আপনার মানিব্যাগে একটা বাচ্চার ছবি আছে। সে কে?’
–‘প্রেম-ট্রেম ওসব আমি হাইস্কুল জীবন থেকে শুরু করেছিলাম। আমার প্রেম বেশিদিন স্থায়ী হয় না। কিন্তু কলেজ পেরিয়ে যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম তখন অনামিকা নামে একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হয়। একই ইয়ারে, একই ডিপার্টমেন্টের ছিলাম আমরা। দু’জনই অনার্স প্রথম বর্ষে। প্রেম হয় আমাদের। অনামিকা আমার হৃদয়ের সমস্ত আবেগ, অনুভূতি নিংড়ে শুষে নিয়েছিল যেটা আর কেউ পারেনি। অনামিকা ছিলো মধ্যবিত্ত, রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। প্রেমের মাস ছয়েক যেতেই ওর পরিবার ওর বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। তখন ওকে হারানোর শঙ্কায় হুট করে ঝোঁকের মাথায় দুইজন বিয়ে করে ফেলি। বিয়ের পর কেউই কারো পরিবারের কাছে বলতে পারলাম না। সাহস হলো না। আমার বাবা-মা আমায় যতই প্রশ্রয় দিক কিন্তু অনার্স প্রথম বর্ষে সবে বিয়ের কথা বলি কিভাবে? গোপনে সংসার চলতে থাকে আমাদের। বিয়ের দুই মাসের মাথায়ই বাচ্চা কনসিভ করে অনামিকা। দুইজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম যাই হোক বাচ্চাটা নষ্ট করবো না। অনামিকাকে বললাম এবার বাসায় জানাও। সে বলল, আমি মারা গেলেও বাবা-মাকে এসব বলতে পারবো না। আমায় খুন করে ফেলবে। ও জানালো না বাসায়। আমি জানালাম। কিন্তু বাসার কেউ মানলো না। বাচ্চার কথা জানাইনি, বিয়ের কথা জানিয়েছিলাম শুধু। বাবা-মা বলল, বয়সের আবেগ এটা। এরকম আবেগ কয়দিন পর ফুরিয়ে যায়। ডিভোর্স দিয়ে দেও। ঝামেলা মিটে যাবে। বাবা-মা এসব নিয়ে আমার সাথে বেশি রাগারাগী করলেন না। একমাত্র সন্তান হওয়ার কারণে আমার সব অন্যায় মেনে নিয়েছে সবসময়। রাগারাগী বেশি না করলেও আমাদের মেনেও নেয়নি। আমি ঝামেলা না মিটিয়ে ঝামেলা দীর্ঘায়িত করলাম। অনামিকা নানান অজুহাতে বছর খানেক গ্রামের বাড়িতে গেল না। ঢাকায় ওর তেমন চেনা পরিচিত কেউ ছিলো না। তাই ওর পরিবারের কানে বিয়ে, বাচ্চা এসব পৌঁছাতে পারেনি। কিন্তু দিন যত যায় ওর বাবা তত উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠল। মেয়েকে গ্রামে আসতে বলছে, আসছে না। তার মেয়ে আগে এত অবাধ্য ছিলো না। বাবা-মায়ের কথার বাইরে এক পাও নড়তো না। অনামিকার বাবা-মা ভেবে নিয়েছিল যে অনামিকার হয়ত কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে সেজন্য বাড়ি আসছে না যদি তারা জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়। এর ভিতর অনামিকার বাবা ঢাকাও এসেছিল একবার। তখন ওর প্রেগন্যান্সির চার মাস চলছে। পেট বুঝা যাচ্ছিলো না। পরীক্ষার অজুহাতে বাপের সঙ্গে বাড়িতে গেল না। আমি আমার পরিবারকে অনেক ভাবে বুঝিয়েছি। তারা তাদের সিদ্ধান্তে অনড়। আমার সব আবদার মেনে নিলেও এটা মানতে পারবেন না। তাদের উপর আমার রাগ হলো। আমাদের বাচ্চা হলো। মেয়ে সন্তান। আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিলো ওগুলো। সকল অনিশ্চিয়তা ভুলে আমরা ওকে নিয়ে মত্ত ছিলাম। আমি বাবা হয়েছিলাম। কি দারুণ অনুভূতি। নোরা নরম, কোমল ছোট্ট হাতে আমার আঙ্গুল মুঠো করে রাখতো। আমি ওর গালে নাক ডুবিয়ে আদর করতাম। ও জন্মের পর আমি পুরোপুরি বদলে গেলাম। ওর ওইটুকুন শরীরটা কাঁথায় মুড়িয়ে বুকে নিলে পৃথিবীর সমস্ত প্রশান্তি এসে যেন আমায় বুকে জড়ো হতো। ওকে নিয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করতে গেলে আমি বোধ হয় একটা লম্বা উপন্যাস লিখে ফেলতে পারবো। ওর তিন মাস হতেই আমি বাসায় জানালাম। বাসার সবার মনে হাহাকার। এ কি করে ফেললাম? ততদিনে আমি আর অনামিকা আলাদা বাসা বাসা ভাড়া নিয়েছি। যেহেতু আমি বাসা থেকে দূরে থাকতাম। বাবা-মা এতসব জানতেন না। সন্তানের কথা শুনে বাবার মন নরম হলো। তারা মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। অনামিকার বাসার সবাই অনামিকার উপর ক্ষুদ্ধ হয়ে গেল। তারা আঁচ করতে পেরেছিল কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। অনামিকার বাবা আবার ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। এটা শুনেই অনামিকার অবস্থা খারাপ। দিনরাত কান্নাকাটি করেই যাচ্ছিলো। বাবার সামনে কোন মুখে সন্তান নিয়ে দাঁড়াবে? কিন্তু ওর আর সন্তান নিয়ে বাবার সামনে দাঁড়াতে হলো না। আমাদের মেয়েটা হঠাৎ করেই নিউমোনিয়ায় মারা গেল। এরপর অনামিকার বাবা আসলেন। তিনিও সব জানলেন। মেয়েকে নিয়ে গেলেন। আমিও যেতে বললাম। কারণ ওর মানসিক অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ভাবলাম বাসায় গেলে ভালো হবে। বাসায় গিয়ে আস্তে আস্তে অনামিকা আমার সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিতে লাগল। এভাবে চলতে থাকে সম্পর্ক। হঠাৎ একদিন ডিভোর্স পেপার পাঠালো অনামিকা। তারপর ওর পরিবার বিয়ে, বাচ্চার কথা গোপন করে ওর বিয়ে দিলো। ছেলে কানাডায় থাকে। বিয়ের পর ওকে ও নিয়ে গেল কানাডায়। নোরার ছবিই ছিলো আমার মানিব্যাগে। আর অনামিকার ছবিটা ছিঁড়ে ফেলেছি। ও স্বার্থপর ছিলো। আমার জীবন থেকে অনামিকা চলে যাওয়ায় আমি শোকে খুব বেশি কাতর হয়ে যাইনি। কারণ ও ইচ্ছে করেই চলে গিয়েছিল। যে ইচ্ছে করে চলে যায় তার জন্য শোক করার মত বোকা আমি ছিলাম না। ওসব আমি ভুলে গেছি। কিন্তু বাবা হওয়ার সেই অনুভূতিটুকু ভুলতে পারিনি।’

পাবেল থামলো। তারপর দীর্ঘ নৈঃশব্দ্যতা। তীব্র নীরবতায় রুমটা ছেয়ে গেল। শুধু দেয়ালের ঘড়িটা চলার শব্দ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছে না। শ্রাবণীর কি বলা উচিত ও তা বুঝে উঠতে পারলো না। শোক প্রকাশ করা উচিত না-কি আগের বিয়ে, বাচ্চার কথা গোপন করে শ্রাবণীকে বিয়ে করেছে বলে রাগ করা উচিত? পাবেল বলল,
–‘কি হলো শ্রাবণী? উত্তর পেয়েছো তোমার?’
–‘পেয়েছি।’
–‘চুপ কেন?’
–‘কি বলবো বুঝতে পারছি না।’
–‘আর কি প্রশ্ন আছে তোমার মনে বলো?’
–‘অনামিকা আপনার জীবন থেকে চলে গিয়েছিল বলেই আপনি এরকম হয়ে গেছেন?’
–‘অনামিকা চলে যাওয়া আমার জীবনে কোনো প্রভাব ফেলেনি। ফেলতে দেয়নি। নেশা করা, প্রেম করা ওসব হাইস্কুল জীবন থেকে শুরু করেছি। এখনো চলছে। শুধু অনামিকা আমার জীবনে থাকাকালীন সময়ে ওসব ছেড়ে দিয়েছিলাম। ব্যস ওটুকুই!’
–‘আর আমায় কিডন্যাপ কেন করিয়েছিলেন?’
–‘আমি কিডন্যাপ করাইনি। আমি ওসব ব্যাপারে কিছু জানি না। আমার ধারণা ওটা তোমার মিথ্যে গল্প।’
–‘আপনার আলমারিতে একটা খয়েরি শাড়ি, রিং, ঝুমকা…।’
–‘ওগুলো আমার একটা গার্লফ্রেন্ডের জন্য কিনেছিলাম। দেওয়ার আগেই ব্রেকাপ হয়ে গেছে।’
–‘আর কোনো প্রশ্ন নেই। তবে একটা কথা জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। আজ আপনি আমার সাথে এত ভালো আচরণ কেন করছেন?’
–‘কারণ আমি তোমায় মেরে ফেলবো।’
–‘ঠাট্টা করছেন?’
–‘মোটেও না।’
(চলবে)