প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-৩+৪

0
542

প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-৩+৪
ইসরাত জাহান তানজিলা
_____________________
শ্রাবণী হতবিহ্বল হয়ে দরজার কাছে ফ্লোরে ঢিমে ভাবে বসে রইল। মাথার ভিতর ঝিমঝিম করছে। মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। শ্রাবণীর মনের ভিতর চেপে থাকা ভয়টা সত্যি হয়ে গেল। বিয়ের পরও দুঃখ ফুরালো না বোধ হয়। সংসার শুরু না হতেই কি শেষ হয়ে যাবে? পাবেলের মা ফরিদা বেগমের চিৎকার থেমে গেল হঠাৎ করে। পুরো বাসা জুড়ে নেমে এলো নীরবতা। সবার মুখ ভার। কেউ কোনো কথা বলছে না। জয়নাল সাহেব অস্থির ভঙ্গিতে পায়তারা করছে। কিছুক্ষণ পর পায়তারা থামিয়ে বসলেন তিনি। তারপর তার ভাইয়ের ছেলে সাব্বিরকে ডাকলেন। সাব্বির পাবেলের বছর ছয়েকের ছোট। কিন্তু দুই জনের একদম বন্ধুর মত চলাফেরা। জয়নাল সাহেব গম্ভীর গলায় সাব্বিরকে জিজ্ঞেস করলেন,
–‘তুই তো নিশ্চয়ই জানিস পাবেল কোথায় আছে তাই না? কোথায় আছে ওই হতচ্ছাড়াটা? সত্যি সত্যি বল আমাকে। মেয়ের বাসার লোকদের আমি কীভাবে বলবো এসব? আমার মানসম্মান কিছু থাকবে না। লোকে আমায় নিয়ে হাসাহাসি করবে। পালানোর হলে তুই বিয়ের আগে পালাতি, বিয়ের পর কেন পালিয়েছিস?’
জয়নাল সাহেব নিজের কপাল চাপড়াতে লাগলো। সাব্বির বলল,
–‘পাবেল কোথায় আছে আমি জানি না চাচ্চু। ও আমায় কিছু বলেনি। বউ নিয়ে বাসায় আসার পর থেকে ওকে আর দেখিনি।’
জয়নাল সাহেব ভয়ঙ্কর রেগে বলল,
–‘তুই সব জানিস কিন্তু বলবি না। তোকে কিছু জিজ্ঞেস করে লাভ নেই।’
সাব্বির জয়নাল সাহেবকে বার বার বলতে লাগলো সে কিছু জানে না। শ্রাবণী দরজার পাশে বসে এসব দেখছে। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেল। শ্রাবণীর রুমের দিকে আসছে কেউ। শ্রাবণী দ্রুত ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়ালো। নিজের চেহারা যথাসম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। ফরিদা বেগম এসেছেন ক্ষিপ্ত চেহারা নিয়ে। শ্রাবণীকে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকলো সে। শ্রাবণী ভড়কে গেল। ফরিদা বেগমের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে তার রাগ শ্রাবণীর উপর। আশ্চর্য! শ্রাবণীর উপর রাগ করার যুক্তি কি? ফরিদা বেগম কোনো ভনিতা ছাড়াই শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল,
–‘তোমার বর পালিয়ে গেছে।’
একটুকু বলে থেমে গেল ফরিদা বেগম। শ্রাবণীর কাছ থেকে প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা করলো কিছুক্ষণ। শ্রাবণী কোনো উত্তর দিলো না কিংবা কোনো রকম প্রতিক্রিয়া করলো না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। ফরিদা বেগম মনে মনে অবাক হলেন নতুন বউয়ের এমন নির্লিপ্ত ভঙ্গি দেখে। তিনি বললেন,
–‘ঘুমিয়ে যাও তুমি। একা রুমে ভয় পাবে?’
শ্রাবণী আস্তে করে বলল,
–‘না।’
ফরিদা বেগম আর কিছু না বলে রুম ত্যাগ করলেন। শ্রাবণী রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে মনটা হালকা করার চেষ্টা করলো। নিজের ভাগ্যের উপর অভিমান হচ্ছে শ্রাবণীর। কনে পালানোর ঘটনা অহরহ ঘটছে। কিন্তু বর পালানোর ঘটনা বোধ হয় এই প্রথম শ্রাবণীর বেলায়ই ঘটেছে। এত কষ্টের মাঝেও হাসি পাচ্ছে শ্রাবণীর। কথায় আছে অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়। শ্রাবণীও বোধ হয় সেই অভাগাদের দলে।

বিয়ের ভারী শাড়িটা এখনো শ্রাবণীর গায়ে। সাজগোজও মুছেনি। শ্রাবণী এ বাসায় আসার কিছুক্ষণ পর এক মুরব্বি বলেছিল, বউটা গরমে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই ভারী শাড়িটা বদলে দে। সাজগোজ উঠিয়ে ফেল এবার। পাবেলের ভাবীরা সাজগোজ উঠাতে দিলো না। দেবর ফুলসজ্জায় একান্তে লাল টুকটুকে বউ দেখবে বলে। শ্রাবণী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে শাড়িটা বদলে সেলোয়ার কামিজ পড়লো। বেসিনে গিয়ে মুখটা ধুয়ে ফেলল। বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদলো। কিছুক্ষণ কেঁদে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। মনটা শক্ত করার চেষ্টা করলো। নিজের কপালের উপর রাগ করে সব কষ্ট, দুঃখকে একদম স্বাভাবিক ভাবে নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করলো।

লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো শ্রাবণী। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, নতুন দুঃখ সব মিলিয়ে ঘুম আসছে না। তবুও চোখ বুজে রইল। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো। ভোরের আজানের পরই কে যেন শ্রাবণীর দরজায় কড়া নাড়লো। কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমানোর একটা সুবিধা হলো সব খারাপ সময়, দুশ্চিন্তা ভুলে থাকা যায়। কিন্তু ঘুম ভাঙতেই যখন সব মনে পড়ে তখন বুকের ভিতর হাহাকার করে ওঠে। শ্রাবণীরও বুকের ভিতর হাহাকার করে ওঠল। ও গিয়ে দরজা খুলল। দরজার সামনে দশ-এগারো বছর বয়সী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ বাসার কাজের মেয়ে বোধ হয়। মেয়েটা শ্রাবণীকে বলল,
–‘খালাম্মা আপনারে ঘুম থেকে ওঠতে কইছে। নামাজ পড়ে নাস্তা বানাইতে কইছে।’
খালাম্মা মানে ফরিদা বেগম। শ্রাবণী ভীষণ অবাক হয়ে গেল। এ বাসায় বউ হয়ে আসলো সবে একদিন। তার উপর পাবেল নিখোঁজ। এমতাবস্থায় নাস্তা বানানোর আদেশ কীভাবে পাঠায়? শ্রাবণী নামাজ আদায় করলো। তারপর রুম থেকে বের হলো রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে। রান্নাঘর কোথায় শ্রাবণীর জানা নেই। বাসার সবাই প্রায় ঘুমাচ্ছে। শ্রাবণী আশেপাশে তাকিয়ে কাজের মেয়েটাকে খুঁজলো। মেয়েটাকেও দেখছে না এখন‌। হঠাৎ ফরিদা বেগমকে দেখলো। নিচতলা থেকে দোতলায় ওঠছেন তিনি। শ্রাবণী কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ফরিদা বেগম শ্রাবণীকে দেখতেই বলল,
–‘রান্নাঘর নিচতলায়। আসো আমার সাথে দেখিয়ে দিচ্ছি।’
শ্রাবণী হতবিহ্বল হয়ে যাচ্ছে মনে মনে এরকম আচরণ দেখে। কপালে ভাঁজ পড়লো ওর। ফরিদা বেগমের পিছনে পিছনে নিচতলায় নামলো। ফরিদা বেগম শ্রাবণীকে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। রান্নাঘরের বড় জানালাটার কপাট খুলতে খুলতে ফরিদা বেগম বলল,
–‘শুনেছি সংসারের কাজকর্মে পাকা তুমি। ছোটবেলা থেকে সৎ মায়ের সংসারে কাজ করতে করতে বড়ো হয়েছো।’
শ্রাবণী কিছু বলল না। ফরিদা বেগম আবার বলল,
–‘আমাদের বাসার সবাই খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে রুচিশীল। খারাপ রান্না কেউ হজম করতে পারে না। এ বাড়িতে রান্না শুধু ভালো হলে হবে না। ভীষণ ভালো হতে হবে। শুনেছি রান্নার হাতও ভালো তোমার।’
শ্রাবণী কোনোমতে ঠোঁট নেড়ে বলল,
–‘হুঁ।’
–‘আজকে বাসায় অনেক মেহমান। ঢের কাজ। এত লোকের নাস্তা বানাতে সময় লাগবে। হাত চালিয়ে কাজ করবে। আটটা বাজে নাস্তা করি আমরা। নিত্য তো আর এত মানুষ থাকবে না। নিত্য এত নাস্তা বানাতে হবে না। বিয়ের কয়টা দিন শুধু। এছাড়া তোমাকে নিয়ে আমরা সাত জন পরিবারে। পাবেলের দাদা-দাদী, পাবেলের বাবা, আমি, তুমি, পাবেল আর কাজের মেয়েটা। পাবেলের দাদা-দাদীর অনেক বয়স হয়েছে। এখনো বেঁচে আছে। এ বংশের মানুষ সব দীর্ঘ আয়ুর।’
শ্রাবণী আগের মতই নীরব। ফরিদা বেগব ফের বললেন,
–‘পাবেলকে নিয়ে চিন্তা করো না। ও চলে আসবে। অনেক আদরে বড়ো হয়েছে। তাই বিগড়ে গেছে। তোমার বাপের বাড়ির লোকদের এসব বলার দরকার নেই। না-কি আবার রাতেই বলে দিয়েছো?’
ফরিদা বেগমের আচরণে শ্রাবণী বিস্ময়ের সর্ব্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে গেল। বিস্ময় টুকুন হজম করে বলল,
–‘না বলিনি।’
–‘রুটি বানাবে। গরুর মাংস ভুনা করবে।’
এই বলে ফরিদা বেগম ভীষণ ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেল। তার ছেলে যে নিখোঁজ সে বিষয় নিয়ে কোনো হেলদোল কিংবা দুশ্চিন্তা দেখা গেল না ফরিদা বেগমের মুখে। তিনি একদম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সব কথা বলে গেল শ্রাবণীকে। শ্রাবণী তাকিয়ে তাকিয়ে ফরিদা বেগমের চলে যাওয়া দেখছে। ফরিদা বেগম চলে যাওয়ার পর শ্রাবণী বিস্ময়ে কিছুক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আর কিছু না ভেবে রুটি বানানো শুরু করে। শ্রাবণীর কাজের হাত অনেক চালু। আটটার মধ্যেই সব তৈরি হয়ে গেল। বাড়ির সবাই রান্নার প্রশংসা করলো। নাস্তার পর জয়নাল সাহেব শ্রাবণীকে তার রুমে ডেকে নিয়ে বললেন,
–‘তোমার বাসা থেকে তো তোমাকে কাল নিতে আসতে চাচ্ছে। পাবেল তো নিখোঁজ। তাদের এটা আমি কিভাবে বলবো?’
এইটুকু বলে জয়নাল সাহেব চুপ করে রইলেন। শ্রাবণীও কি বলবে ভেবে পেল না। খানিকক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে জয়নাল সাহেব আবার বললেন,
–‘তুমি এক কাজ করো তোমার বাসায় ফোন করে তোমাদের এখন নিতে আসতে না করে দেও। কয়েকদিন পর আসুক তারা।’
জয়নাল সাহেবের কথা মত শ্রাবণী বাসায় ফোন দিয়ে আসতে না করে দিলো। শ্রাবণী চাচাতো, ফুফাতো ভাই-বোনেরা সবাই শ্রাবণীর শ্বশুর বাড়ি আসতে চেয়েছিল। ওরা মন খারাপ করলো। কথা তো আর চাপা থাকে না। মেয়ের জামাইয়ের নিখোঁজ হওয়ার খবর সেলিম হোসেনের কানেও পৌঁছে গেল। এই নিয়ে আশেপাশের লোকজন জন নানা রকমের কথা বলছে, কানাঘুষা করছে।
_______________
শ্রাবণীর ফোন বাজছে। বাটন ফোন। বৃত্তির টাকা দিয়ে কিনেছিলো ফোনটা। অপরিচিত একটা নম্বর থেকে কল এসেছে। দুই বার রিং বেজে কেটে গেল। শ্রাবণীর এই মুহূর্তে ফোনে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তাই ফোন তুলল না। ফোনটা বাজতেই থাকলো। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে ফোনটা ধরলো শ্রাবণী।
–‘হ্যালো শ্রাবণী বলছিস? মামার ফোন থেকে নিলাম তোর নম্বরটা।’
–‘হ্যাঁ শ্রাবণী বলছি। আপনি কে যাইফ ভাই?’
–‘হুঁ। তোর হাজবেন্ড নাকি উধাও হয়ে গেছে?’
শ্রাবণী হেসে বলল,
–‘হুম।’
–‘আশ্চর্য তুই হাসছিস? আমি তো ভেবেছি তুই কেঁদে কেঁদে অজ্ঞান হয়ে গেছিস। তাই তোকে সান্ত্বনা দিতে ফোন দিলাম।’
–‘না কাঁদার প্রতিজ্ঞা করেছি।’
–‘তুই বয়সের তুলনায় অনেক ম্যাচিউরড শ্রাবণী। আচ্ছা তোর বর সাহেব পালালো কেন? আর কোথায় পালালো? পালাবেই যখন তখন বিয়ের আগে কেন পালালো না শালায়?’
–‘কিচ্ছু জানি না আমি।’
–‘তোর গলাটা ভীষণ ক্লান্ত শুনাচ্ছে।’
–‘সকালে অনেক লোকের নাস্তা বানিয়েছি তাই।’
যাইফ ভীষণ চমকে বলল,
–‘তুই নাস্তা বানিয়েছিস? বরের খোঁজ নেই। আর ওই বাড়িতে গিয়েছিস দুই দিনও হয়নি এর ভিতর নাস্তাও বানাতে হচ্ছে?’
–‘রাখছি ভাইয়া। কথা বলতে ভালো লাগছে না এখন।’
শ্রাবণী ফোন রেখে দিলো। আকাশে মেঘ করেছে। বৃষ্টি নামবে বোধ হয়। এ বছরের প্রথম বৃষ্টি। শ্রাবণী বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। বারান্দায় গ্রিল লাগানো। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে মেঘে ছেয়ে যাওয়া আকাশটার দিকে তাকালো। বিষণ্ণ দেখাচ্ছে আকাশটা। বিষণ্ণ এই মেঘলা দিনে শ্রাবণী উদাস হয়ে গেল। মাস দেড়েক পর শ্রাবণীর এসএসসির রেজাল্ট দিবে। ওর কলেজে ভর্তি হওয়ার স্বপ্নটা কি পূরণ হবে? পাবেল নামক মানুষটাও বা কোথায় নিখোঁজ হলো? কবে ফিরবে সে? কি হবে ভবিষ্যতে? সবকিছু অনিশ্চিত। প্রবলবেগে বৃষ্টি নামতে শুরু করলো। বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে যাচ্ছে শ্রাবণী।
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী(পর্ব-৪)
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
শ্রাবণীর বাসা থেকে মেয়ে নিতে আসা হলো না। দুই দিন চলে গেল। জয়নাল সাহেবের বাসার সব মেহমান বিদায় হয়েছে। পাবেলের কোনো সন্ধান মিললো না এই দুই দিনে। শ্রাবণীকে খুব বেশি চিন্তিত দেখা গেল না এ নিয়ে। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। ভবিষ্যতে ভালো-খারাপ যা হবে সব কিছু গ্রহণের অগ্রিম প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। বারংবার নড়বড়ে হয়ে যাওয়া মনটা শক্ত করার চেষ্টা করছে।

বাসার সমস্ত কাজ শ্রাবণীকে করতে হচ্ছে। তিনবেলা রান্নাবান্না করা, থালা বাসন ধোয়া, ঘর মোছা সহ যাবতীয় কাজ। দুই দিন ধরে কাজের মেয়েটাও আসছে না। ফরিদা বেগম বলেছে, মেয়েটার গায়ে জ্বর তাই আসছে না। কিন্তু শ্রাবণীর মনে হচ্ছে ফরিদা বেগম মিথ্যা বলছে। কাজের মেয়েটাকে হয়ত বিদায় করে দিয়েছে। বাড়িতে বউ থাকতে কাজের মেয়ের কি দরকার? বউ এনেছে কি শোকেসে সাজিয়ে রাখতে? বাড়ির এই সামান্য কাজ টুকুনও যদি না করে! শ্রাবণীর অনুমান এমন চিন্তা ভাবনা থেকেই কাজের মেয়েটাকে বিদায় করে দিয়েছে ফরিদা বেগম। শ্রাবণী এ বাসায় এসেছে তিন দিন হলো। এই দিনে অনেক কিছু বুঝে ফেলেছে। বিশেষ করে ফরিদা বেগমকে। ভয়ঙ্কর মহিলা। চেহারায় সব সময় কাঠিন্য ভাব থাকে। কর্কশ, রুক্ষ গলায় কথা বলেন। জয়নাল সাহেবকে এখনো বুঝে ওঠতে পারেনি শ্রাবণী। এ বাসায় আসার পর থেকে তাকে গম্ভীর মুখে চুপচাপ ড্রয়িং রুমে কিংবা বারান্দায় বসে থাকতে দেখেছে। লোকটা বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বাজারেও যাচ্ছে না। মানুষ নানান কথা বলে ঠাট্টামস্করার ছলে। ঠাট্টামস্করা জয়নাল সাহেবের কাছে বিরক্তিকর পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে এখন। বাসর রাতে তার ছেলে বউ ফেলে পালিয়ে গেছে। মানুষের কাছে ভীষণ হাস‌্যরসাত্মক ব্যাপার এটা। যদি বিয়ের কনে পালিয়ে যেত তাহলে মানুষ ছিঃ ছিঃ করত। বর পালিয়ে গিয়েছে বলেই এত হাসিঠাট্টা!

দুপুরে রান্না শেষ করে ঘেমে একাকার হয়ে গেছে শ্রাবণী। রান্নাঘরটা উত্তর পাশে হওয়ার গরম একটু বেশিই লাগে সেখানে। দুপুরের তির্যক রোদ জানালা ভেদ করে এসে সোজাসুজি গায়ে পড়ে। তার উপর আগুনের আঁচ। কয়েকদিন ধরে অস্বাভাবিক রকমের গরম পড়ছে। আবার ঝড় বৃষ্টি হবে বোধ হয়। শ্রাবণী রুমে গিয়ে ফুল স্পীডে ফ্যান ছেড়ে বসলো। লম্বা শাওয়ার নিলে এখন মন্দ‌ হয় না। শ্রাবণী নিজের লাগেজটা বের করলো। ওর সব জামাকাপড় লাগেজে। এখনো আলমারিতে রাখা হয়নি। কোথায়, কোন আলমারিতে কি রাখবে বুঝতে পারছে না। তাছাড়া আলমারি, ওয়াড্রব সব লক করা। এগুলোর চাবিও ওকে দেওয়া হয়নি। শ্রাবণী বাথরুমে গিয়ে ঝর্ণা ছেড়ে অনেকক্ষণ শব্দ করে কাঁদলো। কেন কাঁদলো তা নিজেও বুঝতে পারলো না। বুকের ভিতরটা কেমন ভারী হয়ে ওঠছে হঠাৎ করে। মন হালকা করতে কান্না দরকার সেজন্য কেঁদেছে। শ্রাবণী নিজের মনকে যতই শক্ত করার করুক মাঝে মাঝে মনটা একদম নড়বড়ে হয়ে যায়।

ফরিদা বেগমের ডাকে শ্রাবণীকে দ্রুত গোসল সেরে বের হতে হলো। দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে। টেবিলে ভাত তরকারি বাড়া হয়নি এখনো। খাবার বেড়ে দেওয়ার জন্য ডাকা হয়েছে শ্রাবণীকে। শ্রাবণী আশ্চর্য হয়ে গেল। ফরিদা বেগম টেবিলে খাবারটুকুও বাড়তে পারে না? এর জন্যও ওকে ডাকা লাগে? এরা শ্রাবণীকে একদম ঝিয়ের মত হুকুম দিচ্ছে। অগত্যা শ্রাবণী চুপচাপ খাবার বেড়ে দিলো। নিজে খেতে বসলো না। জয়নাল সাহেব বললেন,
–‘কি হলো তুমি বসছো না যে? খাবে না?’
–‘না বাবা। ইচ্ছে করছে না।’
কেন জানি শ্রাবণীর মনটা গাঢ় বেদনায় ছেয়ে আছে। ও রুমে চলে গেল। মন খারাপ হলে চুপচাপ থাকার স্বভাব শ্রাবণীর ছোট বেলা থেকেই। আরেকটা স্বভাব ছিলো গান গাওয়া। গান গাইলে মনটা কেমন ভালো হয়ে যেত। শ্রাবণীর গানের গলা ভালো। শুধু ভালো না, ভীষণই ভালো। স্কুলের অনুষ্ঠানে নাচ-গানের নামের তালিকায় শ্রাবণীর নামটা সবার আগে থাকতো। সবাই বলত, ভালো সুযোগ পেলে এ মেয়ে বড়ো গায়িকা হবে। কিন্তু ক্লাস নাইনে বসেই শ্রাবণীর গান, নাচ সব বন্ধ হয়ে গেল। সুন্দরী মেয়ে স্টেজে উঠে নর্তকীদের মত নাচ-গান করে। এ মেয়ের বিয়ে হবে না। এরকম নানান কথা সেলিম হোসেনের কানে আসতো। তাই তিনি রোষপূর্ণ হয়ে শ্রাবণীকে বললেন, আর যদি কখনো তোকে নাচ-গান করতে দেখি তো বাসা থেকে বের করতে দুই বার ভাববো না। সেই থেকেই শ্রাবণীর নাচগান বন্ধ। শ্রাবণীর ভীষণই শখ ছিলো একটা গিটারের। সে শখও পূরণ হয়নি। আজ সেলিম হোসেন নেই। গান গাইতে কোনো বাঁধা নেই। শ্রাবণী দরজা বন্ধ করে সুবীর নন্দীর সেই জনপ্রিয় গান গাইতে লাগলো,
“আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি,
আমায় আর কান্নার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই।
আমি অগ্নিগিরির কাছ থেকে জ্বলতে শিখছি,
আমায় আর জ্বালানোর ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই।”

গান গেয়েও মন ভালো হচ্ছে না শ্রাবণীর। নিজের কথা গুলো কাউকে বলা দরকার। কাকে বলবে? যাইফ ভাইকে? শ্রাবণী ফোন হাতে নিলো। যাইফের কাছে কল দিলো।
–‘আচ্ছা যাইফ ভাই একটা কথা বলুন তো উনি যদি বিয়েতে রাজি না থাকতো তাহলে পুলিশকে বিয়েটা ভাঙতে দিলো না কেন?’
হুট করে ফোন দিয়ে এমন প্রশ্ন করায় যাইফ একটু চমকে গেল। বলল,
–‘বিয়ে তোর শ্বশুর ভাঙতে দেয়নি। সে পুলিশের সাথে কথা বলে তাদের চা নাস্তা খাওয়ার টাকা দিয়ে বিদায় করেছে।’
শ্রাবণী চুপ করে রইল। যাইফ বলল,
–‘মন কি খুব বেশি খারাপ তোর? পালিয়ে যেতে বললাম গেলি না তখন। বাপের ভয়ে মুখও খুলতে পারলি না। তোর হাজবেন্ডের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি? তুই তাহলে ও বাড়িতে পড়ে আছিস কেন? বাসায় চলে যা।’
উদাস গলায় শ্রাবণী বলল,
–‘এ বাসার থেকে বাসায় গেলে অশান্তি বেশি হবে।’
শ্রাবণী একটু থেমে হঠাৎ মরিয়া হয়ে বলে ওঠল,
–‘যাইফ ভাই এখন পালিয়ে যাওয়া যাবে না? আমার ভালো লাগছে না এই জীবন। আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে।’
–‘এখন‌‌ পালিয়ে গিয়ে কি হবে? আর বাজে বকিস না। তোর হাজবেন্ড ফিরে আসার পর কি হয় দেখ। আমি তোর পাশে আছি শ্রাবণী। তুই চিন্তা করিস না। সবেমাত্র এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া একটা মেয়ে তুই। এই বয়সে কত ভয়াবহ সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তোকে। কি করার বল? জীবন যেখানে যেমন। মিলিয়ে নিতে হবে নিজেকে।’
শ্রাবণী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ফোন কেটে দিলো। মানিয়ে নিতে হবে নিজেকে। দু্ঃখী মানুষদের নিজেকে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া উপার আর কী!
_____________
সপ্তাহখানেক কেটে গেল এভাবেই। শ্রাবণী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো কালই সেলিম হোসেনকে ফোন করে বলবে ওকে নিতে আসতে। এ বাসায় আর ভালো লাগছে না। বাড়িতেও তীব্র অশান্তির ভিতর থাকতে হবে। তবুও সেখানে অশান্তির ভিতর প্রশান্তিও আছে। নিজের চেনা রুমটাতে প্রশান্তি রয়েছে। পাবেল তো নিখোঁজই। হঠাৎ শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়লো শ্রাবণীর। সেজন্য সন্ধ্যার পরই ঘুমিয়ে পড়লো। মাঝরাত! চারদিকে শুনশান নীরবতা। শ্রাবণী গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা শ্রাবণীর বার বার অনুভূত হচ্ছে দুইটা পুরুষালি শক্ত হাত ওর শরীরে বিচরণ করছে। কিন্তু গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে থাকার ফলে বিষয়টা ভালো ভাবে বোধগম্য হচ্ছে না। বার বার হাত দুইটাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। হঠাৎ শ্রাবণীর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। শরীরের উপর ভীষণ ভারী কিছু অনুভব করতে লাগলো। গলার কাছে উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া অনুভূত হলো। শ্রাবণী তীব্র আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না শরীরের উপর থাকা মানুষটার জন্য। সে শ্রাবণীর মুখ চেপে ধরলো। আর চাপা গলায় বলল,
–‘আমি পাবেল। চিৎকার করো না।’
কথাটা শুনতে পেয়েও হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করার চেষ্টা করলো শ্রাবণী। দুই চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়াতে লাগলো ওর। পাবেল আসবে কোত্থেকে? আতঙ্ক, ত্রাস, আকস্মিক ভয় শ্রাবণীর শরীরটা হঠাৎ অবশ করে দিলো। নড়তেও পারছে না, চিৎকারও করতে পারছে না এখন। লোকটা জাপটে ধরে আছে শ্রাবণীকে। শ্রাবণী কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
–‘ছাড়ুন আপনি আমায়। ছাড়ুন।’
লোকটা সত্যি সত্যি ছেড়ে দিলো শ্রাবণীকে। শ্রাবণী অন্ধকারের ভিতর দৌড়ে খাট থেকে নেমে হাঁপাতে হাঁপাতে দরজার কাছে চলে গেল। হঠাৎ অন্ধকার রুমটা আলোকিত হয়ে গেল। লোকটা লাইট জ্বালিয়েছে। সেই উজ্জ্বল আলোতে ভয়ার্ত চোখে সামনে তাকিয়ে শ্রাবণী দেখলো ওর সামনে পাবেল দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণী কয়েক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইল।
–‘আপনি..আপনি এখানে?’
পাবেল শ্রাবণীর দিকে কয়েক পা এগিয়ে আসলো। শ্রাবণীও কয়েক পা পিছিয়ে গেল। শ্রাবণীর মুখ এখনো তীব্র ভয়। পাবেল বিরক্ত গলায় বলল,
–‘বলছি তো আমি। তাও চিৎকার চেঁচামেচি করলে কেন? লাইট বন্ধ করে খাটে আসো।’
পাবেলের এমন আহ্বানে শ্রাবণী নিথর হয়ে গেল। কোত্থেকে হুট করে এসেছে এই লোকটা? যার সাথে শ্রাবণীর ভালো করেই দুই দন্ড কথা হয়নি তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে কীভাবে খাটে যাবে?
–‘কি হলো দাঁড়িয়ে আছো কেন ওখানে? আসছো না কেন?’
শ্রাবণীর পা সামনে এগোচ্ছে না। স্বামী বলে এভাবে শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়বে? বিয়ে মানে শুধুই শারীরিক সম্পর্ক? যে লোকটা বিয়ের রাতে নিখোঁজ হয়ে গেছে। এক সপ্তাহ পর এসে সে কীভাবে এমন আচরণ করে? ত্রাসে শ্রাবণীর বুকের ভিতরটা শুকিয়ে গেল। ও এক পাও সামনে আগাতে পারলো না। পাবেল হঠাৎ হাত ধরে টেনে শ্রাবণীকে খাটে নিয়ে গেল। লাইট নিভিয়ে দিলো। শ্রাবণী কিছুই বলতে পারলো না। কোনো প্রতিবাদ করতে পারলো না। পাবেলের ছোঁয়া তীব্র বিষাক্ত লাগছে। শ্রাবণীর পুরো শরীরটা পাবেল নিজের দখলে নিয়ে গেল। শ্রাবণী জড় বস্তুর মত চুপচাপ শুয়ে রইল অন্ধকারে চোখ মেলে। দুই চোখের কোটর বেয়ে জল পড়তে লাগলো শুধু।
(চলবে)