প্রিয় শ্রাবণী পর্ব -৫+৬+৭

0
454

প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-৫+৬+৭
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
পাবেল নিজের চাহিদা মিটিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। শ্রাবণীর নিথর শরীরটা বিছানার সাথে মিশে রইল। অন্তরঙ্গ মুহূর্তের পুরোটা সময় এভাবেই ছিলো ও। পাবেলের ছোঁয়ায় বিষাক্ত এক অনুভূতি হয়েছে। মনে মনে চিৎকার করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছে কখন এই সময়টুকু শেষ হবে। বিছানা ছেড়ে ওঠে অন্ধকার হাতড়ে দুর্বল পায়ে বাথরুমের দিকে গেল শ্রাবণী। বাথরুমের দরজা বন্ধ করে ভিতরে চাপিয়ে রাখা কান্না গুলোকে মুক্ত করে দিলো। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদলো। পুরো শরীরটা সাবান দিয়ে ধুয়ে পাবেলের ছোঁয়া মুছে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে শ্রাবণীর। ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসছে। বাথরুম থেকে বের হয়ে রুমে গিয়ে বাতি জ্বালানো না শ্রাবণী। বাতি জ্বালালেই ওই পাষণ্ড মুখটা চোখ পড়বে। ওই মুখটা দেখতে চাচ্ছে না ও। অনেকক্ষণ অন্ধকার রুমের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল‌। বিছানায় যেতে মন সায় দিলো না। পাবেলের পাশে শুতে অরূচি হলো। শ্রাবণী বারান্দায় চলে গেল। মনের ভিতর তীব্র অশান্তি আর যন্ত্রণা নিয়ে বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারটাতে বসেই পুরোটা রাত কাটিয়ে দিলো। যে লোকটার সাথে শ্রাবণীর আগে থেকে সামান্য কথা হয়নি, জানাশোনা হয়নি। যার প্রতি ওর কোনো আবেগ, অনুভূতি নেই। তার এই হিংস্র ছোঁয়া রোজ কীভাবে সহ্য করবে? শ্রাবণীর গলার কাছটা এখনো জ্বলছে খামচির আঁচড়ে। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পূব আকাশটা ফিকে আলোয় ভরে গেছে। শ্রাবণী বারান্দা থেকে উঠে সোজা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। দ্রুত হাতে নাস্তা বানাতে লাগলো।

ফরিদা বেগম ঘুম থেকে উঠে সর্বপ্রথম রান্নাঘরের দিকে উঁকি দেয়। চুলায় আগুন জ্বলেছে কিনা দেখার জন্য। তিনি হাই তুলতে তুলতে শ্রাবণীকে প্রশ্ন করলেন,
–‘পাবেল ঘুম থেকে উঠেছে?’
এ মুহূর্তে শ্রাবণীর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। উত্তর দিলো না ফরিদা বেগমের প্রশ্নের। ফরিদা বেগম রাগী স্বরে বলল,
–‘কি বলছি কানে যাচ্ছে না?’
শ্রাবণী ভার মুখে বলল,
–‘না ওঠেনি।’
–‘ওর জন্য চা রেডি রেখো। ঘুম থেকে উঠে চা খাওয়ার অভ্যাস ওর। চা না পেলে চেঁচাবে। দুধ চা কড়া লিকার দিয়ে। চিনি কম দিও। আর হ্যাঁ পাবেলের বেলা করে ঘুমানোর অভ্যাস ডেকো না ওকে।’
শ্রাবণী কেবল মাথা নাড়িয়ে সব কথায় সম্মতি জানালো। ফরিদা বেগমের মুখাবয়ব দেখে মনে হচ্ছে শ্রাবণীর এমন নীরস আচরণে সে যথেষ্ট বিরক্ত হচ্ছে। তিনি কপাল কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করে তাকালো শ্রাবণীর দিকে। শ্রাবণী সেদিকে নজর না দিয়ে নিজের কাজে মগ্ন থাকার ভান করলো।
–‘পাবেলের জন্য পরোটা ভাজতে তেল একটু বেশি দিও।’
–‘আচ্ছা।’
নাস্তার টেবিলে পাবেলকে ডাকতে হলো না। সে নিজেই উঠে এলো। পাবেল সাধারণ এত সকালে ঘুম থেকে উঠে না। শ্রাবণী মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছে। পাবেলের উপস্থিতি টের পেতেই তেতো একটা অনুভুতি হতে লাগলো। ভীষণ ঘৃণা জমে গেছে শ্রাবণীর এই লোকটার প্রতি। পাবেল আসতেই ফরিদা বেগম শ্রাবণীকে বলল,
–‘পাবেলের চা টা নিয়ে আসো।’
অগত্যা শ্রাবণীর চা এনে দিতে হলো। শাশুড়ির হুকুম উপেক্ষা করার উপায় নেই। পাবেলের হাতে চায়ের কাপ দেওয়ার সময় হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের। ভীষণ অস্বস্তিতে শ্রাবণীর গা গুলিয়ে যাচ্ছিলো। দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিলো। শ্রাবণী মনে মনে তীব্র অবাক হলো। ফরিদা বেগম আর জয়নাল সাহেব একদম স্বাভাবিক আচরণ করছে পাবেলের সাথে। পাবেল যে সাতদিন উধাও হয়ে ছিলো নতুন বউ রেখে সে বিষয়টা নিয়ে তারা পাবেলকে একটি কথাও বলল না। শ্রাবণী বলতে শুনেনি। রোজকার মত স্বাভাবিক ভাবেই নাস্তার টেবিলে গল্প গুজব করছে আর নাস্তা করছে। গল্প গুজবের মাঝখানে জয়নাল সাহেব হঠাৎ বলল,
–‘শ্রাবণীর বাবাকে কালকে তাহলে আসতে বলি কি বলিস? বিয়ের সাতদিন হয়ে গেল। মেয়েটা এখনো বাপের বাড়ি যেতে পারলো না। লোকে বা কি বলে।’
পাবেল বলল,
–‘আসতে বলো। শ্রাবণী গিয়ে বেড়িয়ে আসুক।’
জয়নাল সাহেব ভ্রু কুঁচকে বলল,
–‘শ্রাবণী একা যাবে? তুই যাবি না? অনেক ঝামেলা করেছিস আর ঝামেলা করিস না। দুই জন গিয়ে কয়েকদিন থেকে আয়।’
–‘সব বিষয়ে জোর খাটাবে না বাবা। আমার লাইফ আমাকে আমার মত একটু বুঝতে দেও।’
–‘তুই তো ভুল ছাড়া সঠিক জীবনেও বুঝিস নি। কাল শ্রাবণীর বাবা আসবে। তোরা দুইজন যাবি এই পর্যন্তই।’
পাবেল রেগে গিয়ে বলল,
–‘দুই রুমের একটা বাসা ওদের। বাসার ভিতর নেই কোনো পরিবেশ। কোনো প্রাইভেসি আছে ওই বাসায়? বরযাত্রীদের ঠিক মত খাওয়াতে পর্যন্ত পারেনি।’
পাবেল নাস্তার প্লেটে পানি ঢেলে উঠে গেল। জয়নাল সাহেব পাণ্ডবর্ণ মুখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইল। ফরিদা বেগম বললেন,
–‘আরে ছাড়ো তো। ও যখন যেতে চাচ্ছে না ওকে জোর করছো কেন?’
জয়নাল সাহেব চোখ লাল করে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। ক্ষিপ্ত হয়ে ফরিদা বেগমের দিকে আঙুল তুলে বললেন,
–‘তুমি একটা কথাও বলবে না। এ সংসারের এই সব অশান্তির মূলে তুমি।’
জয়নাল সাহেবও নাস্তা শেষ না করে উঠে গেল। পুরো ঘটনায় শ্রাবণী নীরব। ওর কি বা বলার আছে? ও অমনোযোগী ভাবে প্লেটে রাখা রুটি গুলো হাত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে জমা করছে কিন্তু মুখে তুলছে না। নতুন বউয়ের সামনে এমন অপমান হজম করতে পারছে না ফরিদা বেগম। তীব্র ক্রোধে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে। ফরিদা বেগমের এই তীব্র ক্রোধের মাঝে শ্রাবণী হঠাৎ প্রশ্ন করে ফেলল,
–‘মা আপনার ছেলে এই সাতদিন কোথায় ছিলো?’
ফরিদা বেগমের ক্রোধ আরো বাড়লো। চিৎকার করে বলল,
–‘যাও সেটা গিয়ে পাবেলকে জিজ্ঞেস করো। আমায় জিজ্ঞেস করছো কেন?’
পাবেলকে আর এসব জিজ্ঞেস করা হলো না শ্রাবণীর। সারাদিনে পাবেলের সামনেই পড়েনি ও। পাবেল সেই সকালে রাগ করে নাস্তার টেবিল থেকে উঠে রুমে গেছে সারাদিনে আর রুম থেকে বের হতে দেখা যায়নি তাকে। দুপুরে খেতেও টেবিলে আসেনি। দিনভর ঘুমিয়েছে হয়ত। শ্রাবণীও সারাদিন রুমের আশেপাশে যায়নি। লোকটার সামনে পড়তে ইচ্ছে হয়না ওর। আর পাবেলও শ্রাবণীর খোঁজ করেনি। রাতে খোঁজ করবে হয়ত। রাতে দরকার হবে শ্রাবণীকে। প্রতি রাতেই কি পাবেলের এই হিংস্রতা সহ্য করতে হবে? শ্রাবণীর বুক তীব্র আতঙ্কে কেঁপে ওঠে।
_________________
বিকালে জয়নাল সাহেব শ্রাবণীকে নিজের রুমে ডাকলেন। শ্রাবণী ড্রয়িং রুমে বসে বসে ঘুমাচ্ছিলো। বসে ঘুমানোর অভ্যাস আছে ওর। প্রচণ্ড ঘুম পেয়েছিল। পাবেল রুমে থাকায় রুমে যায়নি। জয়নাল সাহেব শ্রাবণীকে ডেকে নিয়ে বলল,
–‘পাবেল আমাদের একমাত্র সন্তান ছিলো। খুব বেশি আদরে বিগড়ে গেছে। যখন যা ইচ্ছা তাই করে করে। আজকাল একটু বেশিই উন্মাদ হয়ে গেছে ছেলেটা। নয়ত কেউ এভাবে নিখোঁজ হয়ে থাকে? কাল রাতে বাসায় ফেরার পর অনেক শাসিয়েছি ওকে।’
জয়নাল সাহেব এই বলে একটু থামলেন। হঠাৎ তার গলা বিষণ্ণ হয়ে গেল। বিষণ্ণ গলায় তিনি বললেন,
–‘সন্তান ছোট বেলায় অবাধ্য হলে মেরে শাসন করা যায়। কিন্তু এত বড় সন্তানকে কিভাবে শাসন করবো? সে আমার আয়ত্তে নেই। সন্তান যখন শাসনের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়, তাকে একটা কিছু বললে সে উল্টো দুইটা বলে, কথার বিপরীতে চোখ রাঙায় তখন বাবা হিসেবে নিজেকে একদম ব্যর্থ মনে হয়, তুচ্ছ মনে হয়। এভাবে চলতে চলতে এক সময় সন্তানের অবাধ্যতার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না। আমিও মানিয়ে নিয়েছি নিজেকে।’
জয়নাল সাহেব কিছুক্ষণ থেমে রইল। শ্রাবণী কি প্রত্যুত্তর করবে ভেবে পেল না। জয়নাল সাহেব আবার বললেন,
–‘ওর সাথে নিজেকে মানিয়ে নেও ধীরে ধীরে। বিয়ের আগে ছেলেদের যতই খারাপ স্বভাব থাকুক বিয়ের পর শুধরে যায়। তুমি ওকে শুধরে দেও।’
শ্রাবণী মনে মনে তাচ্ছিল্য করে হাসলো। চৌত্রিশ বছর বয়সী একজন পুরুষকে ষোলো বছরের শ্রাবণী কীভাবে শুধরাবে? কীভাবে মানিয়ে নিবে তার সাথে নিজেকে?

সন্ধ্যা হয়। শ্রাবণী রুমের বাইরে ঘুরঘুর ‌করছে। জয়নাল সাহেবের বলা কথা গুলো মস্তিষ্কে নাড়া দিচ্ছে একটু পর পর। শ্রাবণী কথা গুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। পাবেলের মত মানুষকে আয়ত্তে আনা কিংবা শুধরানো শ্রাবণীর পক্ষে‌ সম্ভব না। ফরিদা বেগম সেই সকাল থেকে নিচতলার কোণার রুমটায় গুম হয়ে আছে। নতুন বউয়ের সামনে বসে অমন আচরণ হজম করতে পারেনি এখনো। নাস্তার টেবিলে বসে শ্রাবণীদের বাড়ি যাওয়া নিয়ে পাবেলের বলা কথা গুলো শ্রাবণীর মনে নিদারুণ এক ব্যথার সৃষ্টি করেছিল। তীব্র অপমান বোধ হচ্ছিলো। ও বাসার মানুষদের কাছ থেকে ছোট বেলা থেকে যতই অনাদর, অবহেলা পাক না কেন, কোথায়ও যেন একটা মায়া রয়েই গেছে। সন্ধ্যার পর পাবেল বাসা থেকে বের হলো। শ্রাবণী হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। নিজের রুমে গেল। পাবেল কি কালকে রাতের মত আজকে রাতেও ওভাবে শরীরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে? অন্য রুমে ঘুমালে কেমন হয়? শ্রাবণীর ত্রাসিত মনটা অন্য রুমে ঘুমানোর ব্যাপারটা পুরোপুরি সায় দিলো। এ নিয়ে পাবেলের প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে সেই নিয়ে দুশ্চিন্তা হলো খানিক। ওদের রুমের পাশের রুমটা খালি পড়ে আছে। শ্রাবণী সে রুমে চলে গেল। রাতে পাবেল বাসায় আসলো। শ্রাবণীকে রুমে না দেখে বারান্দায়, ছাদে খুঁজতে লাগলো। বারান্দায়, ছাদে কোথায়ও না পেয়ে বাসার খালি রুম গুলোতে খুঁজলো। খুঁজতে খুঁজতে শ্রাবণী যে রুমে শুয়েছে সে রুমের দরজায় কড়া নাড়লো। শ্রাবণী দরজা খুলতেই পাবেল বিরক্ত গলায় বলল,
–‘সমস্যা কি তোমার? এত ন্যাকামি করছো কেন? সারাদিন রুমে আসো নি। রাতে এসে অন্য রুমে শুয়েছো। হাজবেন্ডের সাথে ঘুমাতে পারবে না তো বিয়ের কি দরকার ছিলো?’
পাবেল যথারীতি চিৎকার শুরু করে দিলো। শ্রাবণী হতবিহ্বল হয়ে গেল। এভাবে চিৎকার করলে জয়নাল সাহেব, ফরিদা বেগম শুনে ফেলবে। শ্রাবণী অস্থির গলায় বলল,
–‘আস্তে কথা বলুন দয়া করে।’
পাবেলের এমন চিৎকার শুনে ফরিদা বেগম, জয়নাল সাহেব ছুটে আসলেন। তারা আসতেই পাবেল বলল,
–‘এই মেয়ের সমস্যা কি জিজ্ঞেস করো। ও রুম রেখে এই রুমে এসে শুয়েছে কেন?’
এরকম লজ্জা আর বিব্রতকর পরিস্থিতির স্বীকার শ্রাবণী আর কখনো হয়নি। লজ্জায় মাটির গর্তে লুকাতো ইচ্ছে করছে ওর। শ্রাবণী একটি কথাও না বলে মাথা নিচু করে ওদের রুমে চলে গেল। পাবেলও শ্রাবণীর পিছনে পিছনে রুমে গেল। শ্রাবণী দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে অসহায় গলায় বলল,
–‘আপনি আমায় ছোঁবেন না দয়া করে। আপনার ছোঁয়া আমার কাছে অসহ্য লাগে।’
পাবেল চট করে শ্রাবণীর মুখ থেকে দুই হাত সরিয়ে চিবুক ধরে মুখটা সামান্য উঁচু করে বলল,
–‘তোমার এই ন্যাকা কান্না বন্ধ করো। মাথা গরম করো না আমার। আমার ছোঁয়া যদি ভালো না লাগে তাহলে তোমার শ্বশুর, শাশুড়িকে বলে এ বাড়ি থেকে বিদায় হও।’
গত রাতের মত আজও পাবেলের উগ্র আচরণ শুরু হয়। শ্রাবণী নড়বড়ে শরীরটা জাপটে ধরে পিষে ফেলতে চায়। অনুভূতিশূন্য শ্রাবণী পাথরের মত চুপচাপ সব সহ্য করে।
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-৬)
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
পরদিন সেলিম হোসেন আসে মেয়ে আর জামাই নিতে। তার সাথে আরো পাঁচ-ছয় জন লোক এসেছে। বিয়ে উপলক্ষ্যে শ্রাবণীদের বাসায় আত্মীয় স্বজন যারা এসেছিল তাদের বেশিরভাগই পরেরদিন বিদায় হয়েছে। সেলিম হোসেনের সাথে যারা এসেছে তারা কেউ সেলিম হোসেনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজন না। এলাকার লোকজন যাদের সাথে সেলিম হোসেনের সম্পর্ক ভালো। বেয়াই বাড়িতে সেলিম হোসেনের তেমন আদর, যত্ন করা হলো না। ভালো ঘরে মেয়ের বিয়ে হয়েছে, বিশাল ব্যবসা তাদের, বেয়াই বাড়িতে গেলে খাতির যত্নের কমতি হবে না। টেবিল ভরতি খানা প্রস্তুত থাকবে তাদের জন্য, কম হলেও বিশ আইটেম তো থাকবেই- সঙ্গে আসা লোকদের কাছে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি সম্পর্কে এমন অনেক রসাল গুণকীর্তন করেছেন সেলিম হোসেন। কিন্তু বেয়াই বাড়ি আসার পর তার মুখ একদম কালো হয়ে গেল। সেলিম হোসেনের সঙ্গে আসা সবাই অপমান বোধ করছে কিন্তু কেউ কাউকে বলছে না। আধা ঘন্টা ধরে তারা ড্রয়িং রুমে বসে আছে। এখন পর্যন্ত এক কাপ চা পর্যন্ত দেওয়া হয়নি তাদের। বাসার একটা প্রাণীও এসে তাদের সঙ্গ দিলো না। পাবেল একবার এসে দায়সারা ভাবে একটা সালাম দিয়ে বিদায় হয়েছে। জয়নাল সাহেবের ভীষণ জরুরী কাজ পড়েছে সে সময় দিতে পারছে না। প্রায় এক ঘন্টা পর শ্রাবণী শরবত নিয়ে আসলো। তারপর চা, সেমাই। নাস্তা বলতে এইটুকুই। দুপুরে খাবারের আয়োজনও অল্প স্বল্প। অপমানে সেলিম হোসেনের গলা দিয়ে খাবার নামছে না। তিনি একা আসলে এই অপমানের কথা গোপন রাখতেন। কিন্তু বেয়াই বাড়ির গুণকীর্তন করে যাদের সঙ্গে এনেছেন তাদের কাছে তো মাথা কাটা গেল লজ্জায়। দুপুরে খাওয়ার পরই মেয়ে নিয়ে বিদায় হলো। পাবেল গেল না শ্বশুর বাড়ি। সেলিম হোসেন বেশ কয়েকবার জোর গলায় সাধলো পাবেলকে। পাবেল বার বার ব্যস্ততার অজুহাত দেখালো। বিয়ের এতদিন পর মেয়ে বাড়ি যাচ্ছে তাও জামাই ছাড়া। লোকে বা কি বলবে? পাবেলের আচরণেও সেলিম হোসেনের মনঃক্ষুণ্ন হলো।
______________
নিজের পরিচিত রুম, চেনা পরিবেশ, চেনা মুখগুলো দেখে শ্রাবণীর মনটা সকল দুঃখ, কষ্ট ঠেলে প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল। চেনা মুখ গুলো হোক অপ্রিয় তবুও শান্তি লাগছে। শ্রাবণী বাড়িতে আসতেই আশেপাশের প্রতিবেশীরা ছুটে আসলেন। সবার প্রথম প্রশ্ন, জামাই কেন আসেনি? শুনেছি তোমার জামাই নাকি পালিয়ে গিয়েছিল? মেয়ে নিয়ে পালিয়েছিল নাকি? শ্রাবণী কারো প্রশ্নের তেমন ভালো করে উত্তর দিলো না। এত মানুষের ভিড় ওর ভালো লাগছে না এই মুহূর্তে। পাবেলকে নিয়ে করা প্রশ্ন গুলো আরো অসহ্য লাগছে। সবাই চলে যাওয়ার পর শ্রাবণী প্রথমে লম্বা ঘুম দিলো। ঘুম ভাঙলো পারভীন বেগমের ডাকে।
–‘এই অসময়ে ঘুমাচ্ছিস শরীর খারাপ করেছে নাকি?’
পারভীন বেগমের আচরণে শ্রাবণী চমকালো। এই মানুষটা সাধারণত শ্রাবণীর সাথে এত মোলায়েম স্বরে কথা বলে না। মানুষ দূরে গেলে নাকি মায়া বাড়ে। শ্রাবণীর জন্যও কি তার মায়া বেড়েছে?
–‘না শরীর খারাপ করেনি। জার্নি করে এসেছি সেজন্য ক্লান্ত লাগছে।’
পারভীন বেগম শ্রাবণীর পাশে বসলেন। বললেন,
–‘শ্বশুর বাড়ির লোকজন কেমন তোর? মন টিকেছে ও‌ বাড়িতে? আমার মেয়ের জামাই কেমন?’
শ্রাবণী একটা গোপন নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
–‘সবাই খুব ভালো। মন না টিকলে কি এতদিন থাকতে পারতাম?’
–‘ও বাড়িতে কাজকর্ম করতে হয়? শুনেছি কাজের মেয়ে আছে নাকি?’
–‘করি একটুআধটু।’
–‘তোর হাজবেন্ডের কেমন টাকা-পয়সা আছে? তোকে টাকা দেয়না?’
শ্রাবণী সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো,
–‘না।’
শ্রাবণীর মুখে না শুনে পারভীন বেগমের ভালো লাগেনি বোধ হয়। তিনি হঠাৎ সুর পাল্টে হতাশা ভরা গলায় বললেন,
–‘সামনে তুহিন আর নীলার পরীক্ষা। তোর বিয়েতে খরচ করে হাতে একদম টাকা-পয়সা নেই। আমি ভাবলাম তোর কাছে টাকা থাকবে হয়ত। তোর শ্বশুরের কত টাকা।’
শ্রাবণী এতক্ষণে পারভীন বেগমের কপট আচরণের কারণ ধরতে পারলো। ও কি বলবে তা বুঝে ওঠার আগেই পারভীন বেগম আবার বললেন,
–‘দেখ ম্যানেজ করতে পারিস কিনা। নাকি ওরা তোর সৎ ভাইবোন বলে ওদের ব্যাপারে ভাবছিস না? টাকা না থাকলে জামাইয়ের কাছ থেকে চেয়ে এনে দে।’
পারভীন বেগমের চোখ দুটো কেমন লোভী দেখালো। শ্রাবণীর এসব আলোচনা দীর্ঘায়িত করতে ইচ্ছে করছে না। তীব্র বিরক্ত লাগছে। পারভীন বেগমের এমন লোভ দেখে শ্রাবণী নিজেই লজ্জা পাচ্ছে। এই প্রসঙ্গের সমাপ্তি ঘটাতে ও বলল,
–‘আচ্ছা পারলে ম্যানেজ করবো।’
পারভীন বেগম খুশি হলেন। হাসিমুখে শ্রাবণীকে বলল,
–‘তোর কি মাথা ব্যথা করে? চা করে দিবো? মাথাটা হালকা লাগবে।’
শ্রাবণী এই মুহুর্তে একজন বহুরূপী মানুষকে দেখছে। যে তার প্রয়োজন অনুসারে রূপ বদলায়।
–‘না আমার মাথা ব্যথা করছে না। চা খাবো না।’
শ্রাবণী আবার ঘুমালো। প্রায় সারাদিন ভর ঘুমালো। সারাদিনে পারভীন বেগম কোনো কাজের জন্য ডাকলো না শ্রাবণীকে। রান্নাবান্না সহ যাবতীয় কাজ তিনি একাই করলেন। যখন শুনবে শ্রাবণী টাকা ম্যানেজ করতে পারেনি। তখন পারভীন বেগমের রূপ আবার বদলে যাবো।

ঘুম থেকে উঠে‌ সন্ধ্যার সময় গোসল করলো শ্রাবণী। ভেজা চুলে তোয়ালে পেঁচিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। পারভীন বেগম তুহিনকে দিয়ে শ্রাবণীর জন্য চা পাঠালো। দুধ চা। খেতে দারুণ। দখিনা বাতাস ঝরঝর করে বইছে বারান্দায়। সন্ধ্যা বেলায় এই ঝরঝরে শীতল বাতাসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খেতে অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করছে শ্রাবণীর। মেজাজও ফুরফুরে হয়ে গেল। অন্যদিকে পারভীন বেগমের এমন যত্নাদি দেখে মনে মনে হাসছে। শ্রাবণী কোত্থেকে টাকা দিবে তাকে? রাতে খাবার টেবিলেও শ্রাবণীর প্লেটে মাছের সবচে বড়ো মাথাটা তুলে দিলো পারভীন বেগম। মুরগীর বড় পিসটা না নিতে চাইলেও জোর করে শ্রাবণীর প্লেটে তুলে দিলেন। সমস্ত মনোবেদনা, চিত্তদাহ ভুলে আজ আরাম করে ঘুমাতে চায় শ্রাবণী। সেজন্য একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিলো। নয়ত ঘুম আসবে না। নানান চিন্তা মস্তিষ্কটাকে তাদের দখলে নিয়ে নিবে। শ্রাবণী বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজলো কেবল। এর ভিতর সেলিম হোসেন দরজার ওপাশ থেকে ডাকতে লাগল। শ্রাবণী তীব্র অনিচ্ছা নিয়ে দরজা খোলে। ঘুমের ওষুধের প্রভাবে বোধ হয় মাথাটা ভার হয়ে আসছে, চোখটা বুজে আসছে। সেলিম হোসেন বললেন,
–‘এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিস তুই?’
–‘ঘুমাইনি। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিছু বলবে বাবা?’
–‘সারাদিন তো ঘুমিয়েছিস।‌’
–‘তবুও ঘুম পাচ্ছে। তুমি কিছু বলতে চাইলে বলো।’
–‘রুমে চল। এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলা যায়?’
সেলিম হোসেন রুমে ঢুকলো। শ্রাবণী দরজার সামনেই ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। সেলিম হোসেন শ্রাবণীকে তার কাছে ডাকলেন। তারপর চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করলেন,
–‘ও বাড়ির সব কাজ কি তোকে করতে হয়? কাজের মেয়ে আছে নাকি? কই দেখলাম না তো। সব কাজ তো তোকেই করতে দেখলাম।’
–‘শ্বশুর বাড়ি বউদের কি শোকেসে সাজিয়ে রাখার জন্য নেয় বাবা? সব মেয়েদেরই কাজ করতে হয়। এ বাড়িতে থাকতেও তো প্রায় সব কাজ আমার করতে হলো।’
–‘তবুও..আমাদের বাসায় কি কাজের মেয়ে ছিলো?’
–‘ও বাসায়ও কাজের মেয়ে নেই। বিদায় করে দিয়েছে।’
সেলিম হোসেনের মুখ দেখে মনে হলো বড়ো আশ্চর্য হলেন তিনি।
–‘এসব কথা বাদ দেও বাবা। আমায় নিয়ে তোমাদের চিন্তা করতে হবে না।’
–‘পাবেল মানুষ হিসেবে কেমন? আজকে ছেলেটার আচরণ ভালো লাগেনি একদম।’
–‘জঘন্য মানুষ বাবা। কেন ভালো লাগেনি? তোমরাই তো দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছো। সুপাত্র, রাজপুত্র আরো কত কি! রাজ কপাল নাকি আমার!’
সেলিম হোসেন কিছুক্ষণের জন্য নীরব হয়ে গেলেন। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে বলল,
–‘মানিয়ে নে মা।’
–‘সারাটা জীবন তো সবকিছু মানিয়ে নিয়েছি বাবা। বাকী জীবনটাও নিবো। এটা আর বলতে হবে না তোমার। আজ তোমাদের ঠিক ভালো খাতির, যত্ন করেনি বলে আমায় এসব কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছো। ও বাড়িতে যাওয়ার সাথে সাথে যদি সতেরো পদের নাস্তা, দুপুরে টেবিল ভরতি খাবার সামনে দিতো তাহলে আর এসব জিজ্ঞেস করতে আসতে না।‌ এলাকার সবার কাছে উঁচু গলায় বলতে, আমার মেয়ের রাজ কপাল। আমি ঘুমাবো। যাও বাবা।’
সেলিম হোসেন গেলেন না। তিনি মনমরা ভাবে বসে রইলো। শ্রাবণী থেকে থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছে। হঠাৎ শ্রাবণী সেলিম হোসেনের হাত দু’টো ধরলো। তীব্র আক্রোশ, আক্ষেপ আর অভিমান নিয়ে ভেজা গলায় প্রশ্ন করল,
–‘বাবা তুমি তুহিন, নীলাকে যেমনি ভালোবাসা আমায় কেন তেমনি ভালোবাসলে না? আমার ভুলটা কোথায় বাবা? ভুল যা ছিলো আমার মায়ের ছিলো। আমি তো সাড়ে তিন বছরের অবুঝ বাচ্চা ছিলাম। মায়ের ভুলের অংশিদার তো আমি ছিলাম না। আজকে এই প্রশ্নের উত্তর তোমায় দিতেই হবে বাবা। বুঝ হওয়ার পর থেকে এই প্রশ্নটা আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।’
শ্রাবণীর দুই চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল গড়াতে লাগলো। সেলিম হোসেন স্তব্ধ হয়ে গেল। এ প্রশ্নের উত্তর বোধ হয় তিনি খুঁজে পেলেন না। নিঃশব্দে রুম ত্যাগ করলেন সেলিম হোসেন। ওই মুহূর্তে শ্রাবণী দেখলো একজন দায়িত্বহীন বাবা সন্তানের প্রশ্নের উত্তর না দিতে পেরে পালিয়ে যাচ্ছে।

শ্রাবণীর চোখ থেকে ঘুম কেটে গেল। আশ্চর্য! ঘুমের ওষুধের প্রভাবটাও নেই এখন। শ্রাবণী জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। রূপার থালার মত মস্ত বড় একটা চাঁদ আকাশে উঁকি দিচ্ছে। কি চমৎকার দেখাচ্ছে! চাঁদের আলোয় চারদিক আলোকিত। জানালা দিয়ে এক ফালি চাঁদের আলো এসে পড়ে শ্রাবণীর মুখে। শ্রাবণীর মুখটা বিষণ্ণ দেখাচ্ছে সে আলোয়। ও জানালার পর্দাটা সম্পূর্ণ টেনে সরিয়ে জ্যোৎস্নাকে অভ্যর্থনা জানালো নিজ গৃহে। জ্যোৎস্নার আলোয় গৃহটা কানায় কানায় ভরে গেল। জ্যোৎস্নার চোখে চোখ রেখে শ্রাবণী সিদ্ধান্ত নিলো ও আত্মহত্যা করবে।
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-৭)
ইসরাত জাহান তানজিলা
_____________________
শ্রাবণী এই মুহুর্তে অনুভব করলো সুন্দর এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে আত্মহত্যা করা বড়ো কঠিন। ও বোধ হয় পারবে না এই কঠিন কাজটি করতে। এত সহজে জীবনের কাছে হেরে যেতে ইচ্ছে হলো না শ্রাবণীর। পৃথিবীতে যদি কয়েকবার জন্মানোর সুযোগ থাকত তাহলে এবারের মত আত্মহত্যা করে সব যন্ত্রণা থেকে রেহাই দিতো নিজেকে। কিন্তু সে সুযোগ তো নেই। আত্মহত্যা করলে সত্যি কি মুক্তি মিলে? হয়ত দুনিয়ার মুক্তি মিলে, কিন্তু আখিরাতের মুক্তি? আত্মহত্যা করার চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল শ্রাবণী। জীবনের এই দুঃসময় পেরিয়ে হয়ত ঊষা রাঙা চমৎকার একটা ভোরের আবিষ্কার করতে পারবে শ্রাবণী। যে ভোরের নির্মল বাতাসে প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস ফেলবে।

সকাল বেলা। পারভীন বেগম রান্নাঘরে নাস্তা তৈরি করছেন। শ্রাবণী বিছানা ছেড়ে উঠে সেদিকে গেল। নিজের ইচ্ছায় সাহায্য করলো পারভীন বেগমকে। নাস্তার টেবিলে বসে পারভীন বেগম অতি আগ্রহী গলায় জানতে চাইলেন,
–‘শ্রাবণী পাবেলের কাছে টাকা চেয়েছিস? কত টাকা চেয়েছিস? টাকা দিবে বলেছে?’
টেবিলে সেলিম হোসেনও উপস্থিত। তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকালো পারভীন বেগমের দিকে। এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। পারভীন বেগম তাকে বলেনি। সেলিম হোসেন অত্যাশ্চর্য গলায় প্রশ্ন করলেন,
–‘কিসের টাকা পারভীন? কিসের টাকা চাইবে শ্রাবণী পাবেলের কাছে?’
–‘তুমি এত কথা বলো না তো। চুপচাপ নাস্তা খাও। ওটা শ্রাবণী আর আমার ব্যাপার।’
সেলিম হোসেন চুপ করলেন না। তিনি অতি উদ্বিগ্ন হয়ে শ্রাবণীকে জিজ্ঞেস করলো,
–‘কিসের টাকা চাইবি তুই পাবেলের‌ কাছ থেকে? কে তোকে টাকা চাইতে বলেছে? তোর মা?’
শ্রাবণী কিছু বলল না। ওর নীরব থাকা বুঝিয়ে দিলো পারভীন বেগম ওকে টাকার জন্য ফুঁসলাচ্ছে। সেলিম হোসেন রেগে গেলেন খুব। পারভীন বেগমকে বললেন,
–‘বিয়ের পনেরো দিন হতে পারেনি এখনো এর ভিতর শ্রাবণী পাবেলের কাছ থেকে টাকা চেয়ে এনে আমাদের দিবে?’
পারভীন বেগমও পাল্টা রেগে বললেন,
–‘বিয়েয় কত টাকা খরচ হয়েছে। ধারদেনা করেছো। সেই টাকা শোধ করবে কীভাবে? তুহিন, নীলার সামনে পরীক্ষা। স্কুলের বকেয়া অনেক বাকি পড়েছে। সেগুলো দিবে কিভাবে? সংসার চলবে কিভাবে?’
–‘বিয়েতে টাকা খরচ হয়েছে বলে সেই টাকা এখন মেয়ের জামাইয়ের কাছ থেকে উসুল করবো? তুহিন, নীলার স্কুলের বকেয়া, সংসার চালানোর খরচও কি জামাই দিবে? তুমি এই কথা আর ফের শ্রাবণীকে বলবে না।’
সেলিম হোসেনের রুক্ষ আচরণে পারভীন বেগম অবাক হয়ে গেলেন। শ্রাবণীর বিষয়ে এত উদ্বেগ, চিন্তা তো সেলিম হোসেনের আগে ছিলো না। হঠাৎ এত পরিবর্তন কিসের জন্য? পারভীন বেগম রেগেমেগে বলল,
–‘তুমি এত কথা বলছো কেন? তোমার হঠাৎ এত দরদ উথলে ওঠছে কেন? আমি কি আমাদের কথা বলে শ্রাবণীকে পাবেলের কাছে টাকা চাইতে বলেছি? শ্রাবণী ওর নিজের প্রয়োজনের কথা বলে আনবে। ওকে কি আমরা ছোটবেলা থেকে মানুষ করেনি? আমাদের ভালো খারাপ দেখার দায়িত্ব কি ওর নেই? বড়ো ঘরে বিয়ে হয়েছে ওর। চাইলেই তো আমাদের টুকটাক টাকা-পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে।’
এক পর্যায়ে এ নিয়ে খুব তর্কাতর্কির সৃষ্টি হলো পারভীন বেগম আর সেলিম হোসেনের মধ্যে। শ্রাবণী মনে মনে দুঃখে পড়ে হাসছে। যে বাড়িতে শ্রাবণীর অবস্থান ঝিয়ের মত সে বাড়ির টাকা-পয়সা নিয়ে এত দ্বন্দ্ব, কলহ। কি বিদঘুটে ব্যাপার!

পারভীন বেগম নাছোড়বান্দা। সকালের তর্কাতর্কির পরও তিনি দমলেন না মোটেও। বিকালে আবার শ্রাবণীর কাছে আসলেন। হতাশ গলায় বললেন,
–‘তোর বাপ কি পাগলের মতো আচরণ করছে দেখলি তো? লোকটার মাথাটা বোধ হয় একবারে গেছে। বয়স হয়েছে তো। উনার হাত একদম খালি। বাজারে গেলে এক কাপ চা খাওয়ার টাকাও পকেটে থাকে না। এছাড়া তো সংসারে..।’
–‘উনি বলেছে টাকা দিতে পারবে না মা। উনার হাতে এখন টাকা নেই।’
পারভীন বেগমের দীর্ঘ বিবৃতির মাঝেই চট করে কথাটা বলে ওঠল শ্রাবণী। পারভীন বেগমের কথা থেমে যায়। মুখ একদম অন্ধকার হয়ে গেল তার। বাপের বাড়িতে আসার পর থেকে ও বাড়ির কারো সাথেই কথা হয়নি শ্রাবণীর।‌ কেউ ওর খোঁজ নেয়নি। শ্রাবণীও কারো খোঁজ নিলো না নিজ থেকে। আর পাবেলের ফোন নম্বর ই জানে না শ্রাবণী। ফোন নম্বর জানলেও বোধ হয় কল করতো না। পারভীন বেগম গোমড়া মুখে দীর্ঘ সময় চুপ থাকলেন। এরপর বললেন,
–‘তুই মিথ্যে বলছিস। তুই টাকাই চাসনি পাবেলের কাছে। তোর বাবা তোকে চাইতে নিষেধ করেছে তাই না?’
নির্লজ্জ মানুষের ন্যায় পারভীন বেগমের এমন নাছোড়বান্দাপনা দেখে শ্রাবণী প্রগাঢ় বিরক্ত হলো। না চাইতেও শ্রাবণীর মুখে বিরক্ত ভাব ফুটে উঠল। পারভীন বেগম আর একটি কথা না বলে চলে গেলেন। শ্রাবণী পারভীন বেগমের এই অস্বস্তিকর আবদার থেকে রেহাই পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।
______________
এ ঘটনার পরই পারভীন বেগমের নমনীয় রূপ বদলে আগের ন্যায় হলে গেল। কারণে অকারণে রাগ দেখাচ্ছেন তিনি। শ্রাবণী সে সব গ্রাহ্য করলো না। সেলিম হোসেন দুপুরে বাসায় ফিরে শ্রাবণীকে বলল,
–‘তোকে তো তেমন আয়োজন করে কিছু খাওয়াতে পারলাম না। আজ হাতে টাকা আছে। বেশি করে বাজার করবো। তোর কি কি খেতে ইচ্ছে করছে আমায় বল মা?’
সেলিম হোসেনের এমন ভালোবাসা দেখে শ্রাবণীর মনে এক আবেগঘন মুহূর্তের সৃষ্টি হলো। ভিতরের সেই আবেগ গুলো ওর চোখে জল এনে দিচ্ছে। কাল রাতের পর থেকে একদম পাল্টে গেছে সেলিম হোসেন। শ্রাবণী আবেগতাড়িত হয়ে বলল,
–‘বাজার করার দরকার নেই বাবা। অযথা খরচা। বিয়েতে খরচা করতে গিয়ে ধারদেনা করে ফেলেছো।’
সেলিম হোসেন মেয়ের বারণ মানলেন না। তিনি বিশাল এক ব্যাগ বাজার করে আনলেন। এত বাজার দেখে পারভীন বেগমের মাথা চট করে খারাপ হয়ে গেল। থমথমে মুখে যন্ত্রের মত প্রশ্ন করলো,
–‘এত বাজার কেন এনেছো?’
–‘শ্রাবণী তো বেশিদিন থাকবে না। ওকে একটু আয়োজন করে খাওয়ানোর দরকার আছে না?’
–‘টাকা কোথায় পেয়েছো?’
–‘ধার করেছি একজনের কাছ থেকে। ছয় মাসেও না দিলে সমস্যা নেই।’
–‘ছয় মাস পরও বা তুমি টাকা কোথায় পাবে?’
–‘জোগাড় হয়ে যাবে।’
পারভীন বেগম এবার চিৎকার করে বললেন,
–‘কোত্থেকে জোগাড় করবে? বিয়ের জন্য যা ধারদেনা করেছো তার জন্যই তো পাওনাদারদের তাগিদ দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। হাতে নেই এক পয়সা। এর ভিতর বিশাল ব্যাগ ভরে বাজার করে এনেছো মেয়ের জন্য? মেয়ে এমন কি হয়ে গেছে যে তাকে মাথায় তুলে নাচতে হবে?’
এই বলে নিদারূণ ক্রোধে ভীষণ ভারী বাজারের ব্যাগটা তুলে এ রুম থেকে ও রুমে ছুঁড়ে মারলেন‌ পারভীন বেগম। ব্যাগের ভিতরে থাকা ডিম গুলো ভেঙে ফ্লোর লেপ্টে গেল। আলু, টমেটো গুলো ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বউয়ের রাগের মুখ সেলিম হোসেন চুপসে গেলেন। পারভীন বেগম উচ্চস্বরে বলল,
–‘নীলা, তুহিনের স্কুলের বকেয়া কালকের ভিতর দিতে হবে।‌ কয়েক হাজার টাকা। টাকা পরিশোধ করতে না পারলে এবার ওদের পরীক্ষা নিবে না।’
মায়ের চেঁচামেচি শুনে নীলা ছুটে আসলো। টমেটো, আলু গুলো ফ্লোরে গড়াগড়ি খেতে দেখে সেগুলো তুলে ব্যাগে ভরতে লাগলো। সেলিম হোসেন নির্বাক হয়ে বসে রইলেন। পারভীন বেগমের চিৎকার থামলো না। শ্রাবণী রুম থেকে বের হলো না। রুমে বসেই সব শুনছে। বারণ করা সত্ত্বেও কেন বাজার করলো সেলিম হোসেন? বাজার করলেই একটা অশান্তির সৃষ্টি হবে সে তো শ্রাবণীর আগে থেকেই জানা। মেয়েকে আয়োজন করে খাওয়ানোর তো দূর দুপুরে আর চুলায় আগুনই জ্বললো না। পারভীন বেগম বেজায় মেজাজ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এক প্রতিবেশীর বাসায় গিয়ে বসে থাকলেন।

রাতেও এ নিয়ে আরেক দফা ঝগড়া হলো। সেলিম হোসেন তেমন কিছু বলছেন না। পারভীন বেগমের গলাই বেশি শোনা যাচ্ছে। রাত পোহালেই ছেলে-মেয়েদের স্কুলের বকেয়া চাইলো পারভীন বেগম। এই মুহূর্তে সেলিম হোসেনের হাত একদম খালি। দুই এক দিন পর হয়ত জোগাড় করতে পারবে। কিন্তু এই দুই-এক দিন কিছুতেই অপেক্ষা করতে পারবে না পারভীন বেগম। শ্রাবণীর জন্য যদি ব্যাগ ভরে বাজার করতে পারে তো ওদের স্কুলের বকেয়া কেন দিতে পারবে না? বকেয়া দিতে না পারায় পারভীন বেগম নিজের ব্যাগ গোছাতে লাগলো। ছেলে-মেয়ে‌ নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবে। ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে সত্যি সত্যি পারভীন বেগম বাপের বাড়ি চলে গেলেন। সেলিম হোসেন মহা বেকায়দায় পড়ে গেলেন। কারো কাছে ধার চেয়েও পেলেন না। নিত্য কি লোকে ধার দিবে তাকে? শ্রাবণী কি করবে ভাবতে লাগলো। যে বাড়িতে ওকে নিয়ে এত দ্বন্দ্ব সে বাড়িতে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে। অন্যদিকে শ্রাবণীর শ্বশুর বাড়ির কেউ ওকে যেতে বলছে না। এর ভিতর বিকাল বেলা হঠাৎ অপরিচিত একটা নম্বর থেকে কল আসলো শ্রাবণীর ফোনে। শ্রাবণী ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে বলল,
–‘কে শ্রাবণী বলছো? আমি পাবেল।’
শ্রাবণী কয়েক মুহুর্তের জন্য থেমে গেল। হৃৎযন্ত্রটা জোরে জোরে ধক ধক করতে শুরু করলো। সংকোচ ভরা গলায় বলল,
–‘হ্যাঁ আমি শ্রাবণী।’
–‘বেড়ানো শেষ হয়েছে তোমার? বাসায় কি ফিরবে?’
মৃদু স্বরে কথা বলছে পাবেল। গলার আওয়াজ অসম্ভব সুন্দর শুনাচ্ছে। পাবেলের আচরণে শ্রাবণী ভীষণ চমকে বলল,
–‘হ্যাঁ ফিরবো।’
–‘কবে ফিরবে? আজ ফিরতে পারবে নাকি কাল? আমি ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিবো।’
শ্রাবণীর চমকানোর পাল্লা ক্রমশ ভারী হচ্ছে। ও একটু ভেবে বলল,
–‘কাল ফিরবো।’
পাবেল ফোন রেখে দিলো। শ্রাবণী কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বসে রইল। এই লোকের মতলবটা কি?
(চলবে)