প্রিয়তমা পর্ব-০১

0
981

#গল্পঃপ্রিয়তমা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#সূচনা_পর্ব

বিয়ে পড়ানোর আগ মুহর্তে আশেপাশের লোকজনের কানাঘুষা রূপকের কানে তরঙ্গিত হতে থাকলো, “মেয়ের ১৬ বছর,এখনো আঠারো হয়নি।পুলিশ হয়ে একটা অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীকে বিয়ে করে নিচ্ছে?এখন তাদের বেলায় আর আইন প্রযোজ্য নয়।”কয়েকজনের ফিসফিসানি শুনে রূপক কাজিকে বিয়ে পড়ানো বন্ধ করতে বলে সরাসরি মেয়ের বাবাকে প্রশ্ন করে ওঠে,আপনার মেয়ের বয়স কত?
রাজিব শেখ থতমত খেয়ে বললেন,কেনো বাবা প্রীতির বয়স ১৮ বছর।যারা এতক্ষণ ফিসফিস করে কথা বলছিলো তারা এবার কন্ঠে জোর দিয়ে বলল,নিবন্ধনে বয়স বাড়িয়ে দিলেই আপনার মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যাবেনা।রূপক কোনো কথায় কান না দিয়ে প্রীতির দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।তোমার বয়স কত?
প্রীতি মাথা উঁচু করে ফ্যালফ্যাল করে রূপকের দিকে তাকিয়ে রইলো।রূপক ধমকে উঠে বলল,সত্যি করে বলো তোমার বয়স কত?
প্রীতি চমকে উঠে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উত্তর দিলো,১৬ বছর নাহ্ ১৮ বছর।
ব্যস এতটুকুই যথেষ্ট ছিলো রেগে যাওয়ার।রূপক দাঁড়িয়ে গিয়ে প্রীতির বাবাকে উদ্দেশ্য করে কন্ঠে অত্যন্ত ক্ষোভ মিশিয়ে বলল,বাল্যবিবাহের অপরাধে আপনাদের সাথে কি কি হতে পারে তার ধারণা নিশ্চয়ই আছে?এর জন্য জেল হতে পারে জানেনতো?
রাজিব শেখ নিবন্ধন কার্ড দেখিয়ে বলল,এই দেখো স্পষ্ট লিখা আছে প্রীতির জন্মসাল।শুধু বাইরের লোকেদের কথায় কান দিচ্ছো কেনো?

রূপক সরুচোখে তাকিয়ে বলল,আপনারা যে বয়স বাড়াননি তার কি গ্যারান্টি আছে?
রাজিব শেখ বললেন,প্রীতিকে দেখে তোমার কি মনে হয়?ওর বয়স ১৬ বছর নাকি ১৮?সেটা তোমার বিবেককে প্রশ্ন করো।আগেই তোমরা প্রীতিকে দেখে গিয়েছো।তখন মনে হয়নি ওর ১৬ বছর তাহলে এখন মনে হচ্ছে কেনো?

প্রীতির ভাই ফারুক ফোঁড়ন কেটে বলল,তাছাড়া তুমি একজন পুলিশ অফিসার জেনে আমরা নিশ্চিয় আমাদের এতবড় বিপদ ডেকে আনবোনা।আমার বোন প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে একমাস আগেই।
এতক্ষণ যারা বলাবলি করছিলো রূপক তাদের দিকে একপলক তাকিয়ে সামনে তাকালো।মহিলাগুলো আর ওই জায়গায় দাঁড়ালেন না।যাওয়ার আগে বলে গেলেন এখন সত্য বিশ্বাস করছেননা।একই সত্যি দুদিন পর ঠিকই বিশ্বাস
করবেন।

রূপকের বাবা কাজি সাহেবকে বিয়ে পড়ানোর কথা বলেন।রূপক চুপচাপ বসে পড়ে।সব ঝামেলা চুকিয়ে তিন কবুল বলে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায় রূপক আর প্রীতি।বিদায় বেলায় প্রীতি বাবা-মাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।ফারুখ এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে এভাবে কাঁদলে সাজ নষ্ট হয়ে যাবেতো।
প্রীতি ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,সাজ নষ্ট হলে হোক যাবোনা আমি।
রাজিব শেখ চোখের পানি মুছে প্রীতির হাত তুলে দিলেন রূপকের হাতে।রূপকের বাবা রাজিব শেখকে আশ্বস্ত করে বললেন,আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন বেয়াই সাহেব।আপনার মেয়ে সুখে থাকবে,আমার পুত্রবধু নয় মেয়ে হয়ে যাচ্ছে আমার বাড়িতে।

প্রীতিকে গাড়িতে উঠিয়ে পাশের দরজা খুলে রূপকও ওর পাশে বসে পড়ে।ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিলো।প্রীতি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।রূপকের মনে এখনো কেনো জানি সন্দেহরা দানা বেঁধে আছে।প্রীতির দিকে মুখ করে শান্ত গলায় প্রীতিকে বলল,এদিকে তাকাও।প্রীতি নিচের দিকে তাকিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে।রূপক ওর দুবাহু ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে কড়া গলায় প্রশ্ন করে সত্যি করে বলোতো তোমার বয়স কত?প্রীতি কান্না কমিয়ে দিয়ে ভাঙা গলায় বলল,আমিতো বলেছি আমার বয়স ১৮ বছর।
রূপক চোখ গরম করে বলল,আমি পুলিশ সেটা জানো?
প্রীতি হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে ওঠে।
রূপক আবারো বলল আমার সাথে মিথ্যা বললে কিন্তু গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেবো।নয়তো এই জানালা দেখছোনা?চলন্ত গাড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবো।
প্রীতি ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে ওঠে বলল,আমার বয়স ১৬ বছর।
রূপক চমকে ওঠে।এতবড় ধোকা দিলো একজন পুলিশ অফিসারকে?রাগে চোখমুখ লাল করে চেয়ে রইলো প্রীতির দিকে।প্রীতি ভয়ে ভয়ে বলল,আমি ইচ্ছে করে বলিনি আমার ১৮ বছর।বাবা আর ভাইয়া বলতে বলল।
বয়সের তুলনায় বাড়তি আর স্বাস্থ্য ভালো হওয়ার দরুন প্রীতিকে দেখে বোঝা মুসকিল ওর বয়স ১৬ নাকি ১৮?

রূপক প্রীতিকে শাসিয়ে বলল,এখন তুমি যে মিথ্যে বলেছো এর পরিণাম কি হবে জানো?আমাকে আমার চাকরি হারাতে হবে সাথে জেল জরিমানা দুটোই হবে।তোমার বাবা ভাইও পার পাবেনা।ওদেরকে তো আরো আগেই শাস্তি দেওয়া হবে।
প্রীতি ভীত হয়ে থেমে থেমে বলল,কিন্তু আমিতো বলবোনা আমার বয়স ১৬ বছর।কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবো ১৮ বছর।
রূপক দুহাতে নিজের পেছনের চুল খামছে ধরে বিড়বিড় করে বলল,একটু ভয় দেখালেই যে তুমি বলে দিবে সেটা কিছু মুহূর্ত আগেই প্রমাণ হয়ে গেছে।এখন শুধু কালকের দিনের অপেক্ষা তোমার বাবা-ভাইয়ের ব্যবস্থাও আমি করে ছাড়বো।

হাজেরা বেগম পুত্রবধূ ঘরে তোলার জন্য অপেক্ষা করে আছেন।বাইরে গাড়ির আওয়াজ হতেই বাচ্চারা বউ এসেছে বউ এসেছে বলে বাইরে ছুটে যায়।গাড়ি থেকে বউকে কেউ একজন কোলে করে নিয়ে যেতে হয়।গাড়ির দরজা খুলে রূপকের বন্ধু প্রীতিকে কোলে তুলে নিতে যাবে রূপকের বাবা বাঁধা দিয়ে বলল,তুমি বিয়েরদিন নিজের বউকে কোলে নিয়ো।রূপক তুই বউমাকে ঘরে নিয়ে যা।বাবার কথামতো রূপক প্রীতিকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে যায়।নিচে অনেক নিয়মনীতি পালন করার জন্য প্রীতিকে সোফায় বসানো হয়।রুপক প্রীতিকে নামিয়ে দিয়ে বাইরে চলে যায়।সব নিয়ম-কানুন শেষ হতেই হাজেরা বেগম একটা মেয়েকে ডেকে বললেন,নতুন বউকে আপাতত একটা রুমে নিয়ে গিয়ে বসাতে।দুইটা মেয়ে এসে প্রীতিকে নিয়ে যাওয়া ধরতেই একজন ফোঁড়ন কেটে বলল,কিগো রূপকের প্রথম বউ।স্বামীকে কিভাবে দ্বিতীয়বার বিয়ে করার অনুমতি দিলে?আর নতুন বউ তুমি কিভাবে সতিনের সংসার করতে চলে এলে?
রুবি কছু বলার আগেই হাজেরা বেগম সেখানে উপস্থিত হয়ে রুবিকে চোখের ইশারা করে বললেন,তাড়াতাড়ি প্রীতিকে নিয়ে যেতে।
প্রীতিকে নিয়ে চলে গেলো রুবি।একটা ঘরে বসিয়ে বলল,তুমি বসো আমি এক্ষুনি আসছি।
প্রীতি মেয়েটার হাত চেপে ধরে বলল,আপনি কি সত্যিই উনার প্রথম স্ত্রী?
রুবি শান্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,হ্যাঁ।প্রীতি আতকে উঠে হাত ছেড়ে দিলো রুবির।হাত ছাড়া পেয়ে আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে রুবি বেরিয়ে যায়।প্রীতি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।কি শুনলো এটা?ওর সাথে প্রতারণা হলো।ওকে ঠকিয়েছে রূপক।বাবা আর ভাইয়া খোঁজ না নিয়ে কিভাবে পারলো এরকম একটা নরক যন্ত্রনায় ঠেলে দিতে?কিভাবে সতিনের সংসার করবে প্রীতি?

রুবি নিচে নেমে আসতেই ফারিহা জিজ্ঞেস করলো,নতুন বউ কিছু জিজ্ঞেস করেছে?
রুবি শান্ত চোখে চেয়ে বলল,হুম।
ফারিহা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,কি জানতে চেয়েছে?
রুবি স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো,যেটা জিজ্ঞেস করার কথা সেটাই জিজ্ঞেস করেছে।আমি ও ব্যতিক্রম কোনো উত্তর দেইনি।
ফারিহা চোখ বর বড় করে বলল,কিন্তু আম্মাকে কিছু না জিজ্ঞেস করে তুমি এসব বলতে গেলে কেনো মেয়েটাকে?
রুবি পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,একদিন না একদিন সব সত্যি ওকে জানতে হবে তাই নয় কি?
ফারিহা মৃদু চেঁচিয়ে বলল,কোন সত্যির কথা বলছো তুমি?কিসের সত্যি হ্যাঁ?
হাজেরা বেগমের ডাক পড়ায় রুবি ফারিহাকে এড়িয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো।হাজেরা বেগম রুবিকে দেখে বিরক্ত হয়ে বলল,তোমাকে ডাকিনি ফারিহাকে ডাকো।
রুবি মাথা নিচু করে বলল,ডাকছি।তারপর ফারিহাকে রান্নাঘরে ডেকে দিয়ে রুবি চলে গেলো।
ফারিহা হাজেরা বেগমের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,আম্মা!রুবি কিন্তু নতুন বউকে সবটা বলে দিয়েছে।হাজেরা বেগম বিস্পোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,কি বলছো তুমি?
ফারিহা মাথা নেড়ে ও সত্যি বলছে বোঝাতেই হাজেরা বেগম তেতে উঠে বললেন,আজই রূপকের সাথে একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বো।ওই মেয়েকে বেশি সাহস দিয়ে ফেলেছে।

রাতের সবকিছু সামলে ফারিহা সহ কয়েকজন মিলে প্রীতিকে রূপকের ঘরে নিয়ে বসালো।
সবাই চলে গেছে কিন্তু রূপকের আসার খবর নেই।দরজার নক ঘুরে উঠতেই প্রীতি নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো।রূপক আসা মাত্রই ওর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিবে।কিন্তু প্রীতিকে আশাহত করে রূপকের বদলে রুবি এসে দাঁড়ালো।
প্রীতি রুরিকে দেখেই উঠে আসলো।রুবির সামনে দাঁড়িয়ে একরাশ ক্ষোভ নিয়ে বলল,আপনি কেনো নিজের স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে করার অনুমতি দিলেন?আমার জীবনটা এভাবে কেনো ধবংস করে দিয়েছেন বলুন।আমি কিন্তু সতিনের সংসার করবোনা কিছুতেই করবোনা বলে দিলাম।রুবি প্রীতির হাত ধরে বলল,চল পাশের ঘরে।
প্রীতি অবাক হয়ে বলল,পাশের ঘরে কেনো যাবো?আমার বাসরঘর এখানে তাহলে আমি পাশের ঘরে কেনো যাবো?
রুবি শান্তভাবে বলল,আজ তোমার কোনো বাসর হচ্ছে না।চল আমার সাথে।প্রীতি হাত ঝাড়া মেরে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল,একদম আমার উপর অধিকার খাটাতে আসবেন না।এটা আমার ঘর আমি এখানেই থাকবো।
দরজা খুলে রূপক ভেতরে প্রবেশ করে বলল,নাহ তুমি এ ঘরে থাকবেনা।পাশের ঘরে থাকবে যাও ওর সাথে।
প্রীতি হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রূপকের দিকে।এতই যখন আগের স্ত্রীকে নিয়ে থাকার ইচ্ছে তাহলে ওকে কেনো বিয়ে করলো?
#চলবে?