প্রিয়তমা পর্ব-০৫

0
421

#গল্পঃপ্রিয়তমা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৫

রৌদ্রস্নাত দুপুর পেরিয়ে সোনালি আভা ছড়ানো বিকেলে ঘর্মাক্ত তপ্ত শরীর নিয়ে ফিরলো রূপক।রাস্তা পেরিয়ে পুকুর পাড় অতিক্রম করার সময় চোখে পড়লো এক মায়াবী মুখশ্রী।
প্রীতি ঘাটে বসে দু’পা পানিতে ভিজিয়ে পানি নিয়ে মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছে।দু’চোখের পাতা এক করে এক হাত দিয়ে মুখের পানি ঝেড়ে নিচ্ছে।চোখের মনি ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখছে।প্রীতির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রূপক নিজের মনের সাথেই বিরোধীতা করলো।মুগ্ধতা থেকে বেরিয়ে বিড়বিড় করে বলল,এর নাকি পায়ে ব্যথা অথচ দিব্বি টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।জানিনা আল্লাহ আমার কপালে কি রেখেছে।একে সোজা করতে কত কাঠখড় পোহাতে হবে আমার।
রূপককে দেখে প্রীতি ঘাট থেকে উঠে আসলো।রূপক চুপচাপ বাসার ভেতর চলে গেলো।প্রীতির মা প্রীতিকে বলল,রূপককে ফ্রেশ হয়ে খাবার খেতে আসতে বলার জন্য।যাচ্ছি বলে প্রীতি রুমের দিকে হাঁটা ধরলো।

রূপক ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ বসলো।প্রীতির মা প্রীতিকে জিজ্ঞেস করলো,তোর পায়ের ব্যথা কমেছে?
ফারুখ বাসার বাইরে থেকে বাসায় ঢুকতে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে পায়ে?
প্রীতির মা বিরক্তর সুরে বলল,আর বলিসনা আজ নাকি প্রীতিকে পাগলা কুত্তা তাড়া করে ক্ষেতের মাঝখানে ফেলে দিয়েছে।
রূপকের গলায় খাবার আটকে কাশতে লাগলো।প্রীতি একহাতে মুখ চেপে অন্যহাতে রূপককে গ্লাস বাড়িয়ে দিলো।
ফারুখ নিজের রুমের দিকে এগিয়ে হাসতে হাসতে বলল,দেখো পাগলা কুত্তা তোমার মেয়েকে আর কতবার দৌঁড়ানি দেয়।
রূপক পানি খেয়ে প্রীতির দিকে তাকালো।এই মেয়ে ওর মান সম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিবে।না না ধুলোয় মিশিয়ে দিলে ঝেড়ে ফেলা যাবে কিন্তু ওতো আগুনে জ্বালিয়ে ছাই করে দিবে।
চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই প্রীতি দুহাতে মুখ চেপে দাঁড়িয়ে রইলো।

বিকেলে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্রীতিকে নিয়ে রূপক নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।মাঝ রাস্তায় গাড়িতে রূপক প্রীতিকে শান্ত কিন্তু ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,তোমাকে আজকে পাগলা কুত্তা দৌঁড়ানি দিছে?
প্রীতি ভীত চোখে চেয়ে দ্রুত মাথা নেড়ে না জানালো।রূপক রাগ দেখিয়ে বলল,একদম কতগুলো কুত্তা ধরে এনে তোমার পেছনে লাগিয়ে দেবো।তখন আমাকে পাগলা কুত্তা বলিও।
প্রীতি মাথা নাড়িয়ে বলল,আমি কুত্তা বলিনিতো আপনাকে।আসলেই একটা কু…
চুপ!আর একটা কথা বললে নাম না জানা জায়গার গাড়িতে উঠিয়ে দেবো তোমাকে।
প্রীতি আর একটা কথাও বলেনি আসার পথে।
বাসায় ঢুকেই রূপক নিজের ঘরে চলে গেলো।সবাই প্রীতিকে নিয়ে হৈ হৈ শুরু করলো।প্রীতিও সবার সাথে আড্ডায় বসলো।অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর রূপক নিচে নেমে এসে প্রীতিকে একটা ধমক দিলো।ফ্রেশ হয়েছো তুমি?এখনো পড়নে আগের জামাকাপড় নিয়ে বসে আছো।যাও তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে পরে আড্ডা দিবে।
ফারিহা বলল,হ্যাঁ আগে ফ্রেশ হয়ে আসো প্রীতি।তারপর কথা বলা যাবে।প্রীতি মুখ ভেংচি কেটে রুমে চলে আসলো।

ঘড়ির কাঁটা এগারোটার ঘরে পৌঁছেছে।চারিদিকে অন্ধকারে ঢেকে আছে।পরিবেশ তখন একেবারে শান্ত,স্তব্ধ।কোনো কোলাহল
নেই।অন্তরিক্ষ তারায় তারায় পূর্ণ।ফারুখ দুহাত পেছনে নিয়ে একগুচ্ছ গোলাপ হাতে পায়চারি করছে স্বপ্নাদের বাড়ির পেছনের রাস্তায়।স্বপ্নার ঘরটা যেপাশে ঠিক সেপাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ফারুখ।স্বপ্না জানালার ধারে দাঁড়িয়ে প্রতিদিনই পরোখ করে ফারুখকে।কিন্তু কখনো সামনে যায়না।কি দরকার শুধু শুধু কাউকে আশা দিয়ে মায়ায় ফেলার।সেতো দ্বিতীয়বার আর কারো মায়ায় পড়তে চায়না।তাছাড়া সমাজও ঠিক স্বপ্নার দিকেই আঙ্গুল তুলবে।একটা বিধবা মেয়ে হয়ে বড়লোক বাড়ির জোয়ান ছেলেকে হাত করেছে।স্বপ্না কখনো নিজের মনকে প্রশ্রয় দিতে চায়না।
ফারুখ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নার ওড়নার কোনা দেখেই মুচকি হাসলো।
তুমি যে নিজের অজান্তেই আমাতে জড়িয়ে যাচ্ছো?সে কি তুমি জানো আমার স্বপ্নপরী?নিজেকে আড়াল করছো আমার কাছ থেকে?নিজের কাছ থেকে,নিজের অস্তিত্বের কাছ থেকে আড়াল করতে পেরেছো কি?একদিন তুমি হারবে,নিজের মনের কাছে হেরে যাবে,আমার ভালোবাসার কাছে হেরে গিয়ে ফিরবে আমার কাছে।একগুচ্ছ ভালোবাসা রেখে গেলাম তোমার জন্য।আবারো আসবো আমি,প্রতিবার গুচ্ছ গুচ্ছ ভালোবাসা রেখে যাবো তোমার জন্য।পেছন ঘুরে ফারুখ হাঁটা ধরলো তখনই স্বপ্না জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো।ফারুখ আবারো পেছন ঘুরলো।চোখাচোখি হয়ে গেলো দুজনার।স্বপ্না দ্রুত জানালা আটকে দিলো।ফারুখ আবারো হাসলো।

গায়ের শার্ট খুলে বিছানায় রাখলো রূপক।প্রীতিকে কাছে ডেকে বলল,এখানে বসো আমার পাশে।প্রীতি গুটিগুটি পায়ে এসে বসলো রূপকের পাশে।রূপক ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,তুমি কতটুকু পড়ালেখা করেছো?প্রীতি চুপচাপ উত্তর দিলো,মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি।এরপর বাবা বলেছে আর পড়তে হবেনা।তারপর বিয়ে হয়ে গেলো।
রূপক আবারো বলল,তোমার রেজাল্ট কি ছিলো?
প্রীতি খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,৩.৪১ পেয়েছি।
রূপক ভাবছে সামান্য ৩.৪১ পয়েন্ট নিয়েও কি খুশি।মনে হচ্ছে গোল্ডেন পেয়েও কেউ এত খুশি হয়না।সব বাদ দিয়ে রূপক জিজ্ঞেস করলো,আচ্ছা তুমি পড়ালেখা করে কি হতে চাও?
প্রীতি অনেকক্ষণ ভেবে তারপর বলল,উমমম!আমি টিচার হতে চাই।
রূপক কপাল কুঁচকে বলল,আচ্ছা?তো তোমার টিচার হওয়ার এত শখ কেনো?
প্রীতি নখ কামড়ে বলল,পোলাপানের সাথে থাকতে আমার ভাল্লাগে।আর ছোটবেলায় স্যাররা আমার পিঠে কড়াশ কড়াশ করে বেত ভেঙেছে এবার আমিও আমার ছাত্রদের পিঠে বেত ভাঙবো।
রূপকের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম।প্রীতির টিচার হওয়ার পেছনের কারণ শুনে।তারপর বলল,আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে তোমাকে একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দেবো এখন ঘুমিয়ে যাও।

সকালে থানায় যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিচে নামলো রূপক।প্রীতি ফারিহার সাথেই কাজে হাত লাগিয়েছে।সবাই নাস্তার জন্য চেয়ার টেনে বসলো।রাহাত কথা উঠালো সে কিছু বলতে চায় সবাইকে।বাবা মা সম্মতি দিতেই গলা ঝেড়ে রাহাত বলল,আমি কিছু দিনের জন্য ফারিহাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে চাই তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে।রাহাতের কথায় ফারিহা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো।বাবা খেতে খেতেই বললেন,তুমি যা ভালো মনে করো।এতে বউমারও ঘুরে আসা হবে।
রূপক মাঝখানে বা’হাত ঢুকিয়ে বলল,প্রীতিকেও তোদের সাথে নিয়ে যা।ওখানে মনির কলেজে ভর্তি করিয়ে দিবি।ভাবি যেহেতু যাচ্ছে আরেকটু বড় ফ্ল্যাট নিয়ে চারজনেই থাকতে পারবি।
রাহাতের মন চাইছে রূপককে ইট মেরে ফুতে ফেলতে।কোথায় নিজে বউকে নিয়ে ঘোরাফেরা করবে তা না করে ভাইয়ের রোমান্সের বারোটা বাজানোর জন্য বসে আছে।হাত দিয়ে চিমটি কেটে চাপা স্বরে রূপককে বলল,ভাই তুই আমার রোমান্সের বারোটা বাজানোর ধান্দা করছিস?সুখে থাকতে ভুতে কিলায় তোরে?
তাছাড়া আমি ফারিহাকে একসাথে নিয়ে যাচ্ছি না।কয়েকদিন থেকে চলে আসবে ফারিহা।
দুই ভাইকে ফিসফিস করে কথা বলতে দেখে হাজেরা বেগম বললেন,বড় বউমা যাচ্ছে যাক।ছোট বউমা এখানে কোনো কলেজে ভর্তি হতে পারবে।দুই বউ একসাথে চলে গেলে আমি বাড়িতে বসে থেকে কি করবো?
রূপক খাবার শেষ দিয়ে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে বলল,আচ্ছা প্রীতিকে নিতে হবেনা।ভাবি নাহয় কিছুদিন গিয়ে ঘুরে আসুক।

রূপক বেরিয়ে যেতেই পাশের বাসার একটা ১৮/১৯ বছরের ছেলে আসলো।রূপকের ফ্যামিলির সাথে ওদের সম্পর্ক খুব ভালো।ছেলেটা নানার বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করে।কালকেই বাড়িতে এসেছে।ভাবলো রূপকের মায়ের সাথে দেখা করবে।হাজেরা বেগমকে সালাম দিতেই হাজেরা বেগম মিষ্টি হেসে বলল,আরে আপ্পান কখন এলে?আসো আসো ভেতরে আসো।প্রীতি ফ্যালফ্যাল করে ছেলেটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,আপ্পান নাকি হাপপ্যান্ট?পড়নেও দেখছি হাপপ্যান্ট।ফারিহা প্রীতির মুখ চেপে ধরে বলল,এসব বলিও না।সবাই শুনলে কি ভাববে?
হাজেরা বেগম পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন,আপ্পান ও হলো রূপকের বউ প্রীতি।প্রীতি ও হলো আমাদের পাশের বাসার ছেলে নাম আপ্পান।আপ্পান হায় জানালো।প্রীতি দাঁত কেলিয়ে বলল,হায় হাপপ্যা..নাহ আপ্পান।ছেলেটা সরু চোখে প্রীতির দিকে তাকাতেই প্রীতি একেবারে এপার ওপার সব দাঁত দেখিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
——————————*
হাজেরা বেগম নিজ হাতেই রান্না করছেন।রুবি একপাশে দাঁড়িয়ে আছে।কোনো কথা বলছেনা।হাজেরা বেগম একপলক রুবির দিকে তাকিয়ে রান্নায় মন দিলেন।গতকাল কারো সাথে ফোনে কথা বলতে দেখে উনি রুবির পথ আগলে সন্দেহের চোখে জিজ্ঞেস করলেন,কার সাথে কথা বলছিলো?
রুবি নাকি ওর বান্ধবীর সাথে কথা বলছিলো।বাড়ির সবাই কেমন আছে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য।পরিবারের সবার কথা মনে পড়াটা সবাভাবিক ভেবে হাজেরা বেগম আর বেশি ঘাটালেননা।

রূপক টেবিলে কনুইয়ের ভর রেখে থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে ভাবছে,পরের ধাপে কিভাবে এগোনো যায়?আজ আবার তিনটা মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ এসেছে।এর পেছনে যে থাকার কথা সেতো আর নেই।তবে আর কে বাকি আছে এই নারী পাচারের পেছনে?একে ধরতে খুব কসরত করতে হবে।
মেয়েগুলোর পরিবার অভিযোগ করে যাওয়ার পর ওদেরকে খোঁজার কাজ চালিয়েছে পুলিশ।
সবার পরিবারের আহাজারি শুনে রূপককের নিজেরও খারাপ লাগছে।এবার থেকে আরো সেনসেটিভ হতে হবে।
#চলবে……..

(গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।হ্যাপি রিডিং।)