প্রিয়তমা পর্ব-০৪

0
426

#গল্পঃপ্রিয়তমা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৪

অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শেষে প্রীতিকে ওর বাবা ভাই নিয়ে চলে গেছে।রূপক পরে যাবে বলে জানিয়েছে।এখন শশুর বাড়ী যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে।পকেটে ফোন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাসা থেকে।আগে বাজারে গিয়ে সদাই-পাতি কিনতে হবে।নতুন জামাই বলে কথা।কি কি লাগবে সব বাবা মা লিস্ট বানিয়ে দিয়েছে সেই লিস্ট অনুযায়ী এখন সব বাজার করবে।

রূপক এসেছে অনেকক্ষণ হলো।কিন্তু প্রীতির কোনো আনাগোনা দেখা গেলোনা।বসার ঘরে থেকেই সবার সাথে কথা বলছে রূপক।প্রীতি একেবারে কোনার ঘরটায় দাদির কাছে বসে আছে।উনি হাঁটতে পারেননা বয়স হয়েছে।কিন্তু এখনো রসিকতা যায়নি।প্রীতিকে কাছে টেনে গতকাল রাতের কথা জিজ্ঞেস করলেন।প্রীতি সব বলে দিতে গিয়েও কি মনে করে চুপ রইলো।দাদি ধাক্কা মেরে বললেন,জামাইয়ের আদর,সোহাগ একলা একলাই নিবি তখন আর এই বুড়িরে দরকার পড়বেনা।প্রীতি মাথা চুলকে হাসলো।দাদি বললেন,জামাইরে আঁচলে বাইন্ধা রাখবি যাতে অন্য নারীর দিকে চোখ না যায়।আগ বাড়িয়ে তার সব কাজ করে দিবি।খাবার বেড়ে সামনে দিবি।শশুর শাশুড়ীর সাথে ভালো ব্যবহার করবি।খবরদার ওই বাড়ি থেকে যেনো কোনো নালিশ না আসে।
কোনো নালিশ আসবেনা দাদি তুমি নিশ্চিন্তে থাকো বলে দাদিকে জড়িয়ে ধরলো প্রীতি।

রাতের খাবার খাওয়ার সময় প্রীতি দাদির ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে।টেবিলে রূপককে দেখে সোজা গিয়ে ওর পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়ে।
মা সবার পাতে খাবার তুলে দিচ্ছে।প্রীতি আগে আগে রূপকের পাতে সব তুলে দিচ্ছে।মাংস দিচ্ছে তার উপর দিয়ে মাছ দিচ্ছে সাথে ডাল ও ঢেলে দিচ্ছে।রূপক না করাতেও শোনেনি।দাদির কথা মানতেই হবে তাই প্রীতি খাবার দিয়ে রূপকের প্লেট ভর্তি করছে।এখন রূপকের অবস্থা হচ্ছে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।খাবার দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু সেতো খেতে পারছেনা।পুরো প্লেট উঁচু হয়ে আছে।রূপকের কথা শুনছেনা দেখে ফারুখ রাম ধমক দিলো প্রীতিকে।
এটা খাবার দেওয়ার শ্রী?কি করেছিস তুই?তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে ওঠ।প্রীতি মুখটা পাংশুটে করে তাকালো রূপকের দিকে।আপনি কি অসন্তুষ্ট হয়েছেন খাবার দেখে?
রূপক জোর পূর্বক হেসে বলল,একদমই না তুমি খাও।

রূপক অসন্তুষ্ট হয়নি শুনে প্রীতি আবারও খাবার দিতে গেলে প্রীতির মা হাত থেকে চামচ নিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলে,চুপচাপ খাবার খা।
প্রীতি দুই লোকমা ভাত খেয়েই উঠে চলে গেলো।বিছানা ঝেড়ে শুয়ে পড়লো খাটের মাঝ বরাবর একেবারে হাত পা ছড়িয়ে।আজ রূপককে এখানে ঘুমাতে দিবেনা।সে কেনো খাবার টেবিলে বললোনা খাবার দিলে আমার সমস্যা নেই।তুমি যত ইচ্ছে খাবার দিতে পারো প্রীতি।রূপক খাবার শেষে ঢেকুর তুলতে তুলতে প্রীতির ঘরে এসে দেখলো শোয়ার মতো খাটে বিন্দু পরিমান জায়গা নেই।বসে থাকতে পারবে কিন্তু যে জায়গা আছে তাতে শোয়া একেবারেই অসম্ভব।প্রীতি হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে।রূপক গলা ঝেড়ে বলল,একপাশে গিয়ে ঘুমাও সারাদিন অনেক ধকল গেছে আমার উপর এখন আমি ঘুমাবো।প্রীতি সরলোনা দেখে রূপক ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে পাশে শুয়ে পড়লো।কিছুক্ষণ না যেতেই প্রীতি ঠাস করে হাত পা ছুঁড়ে দিচ্ছে রূপকের গায়ে।গতকাল ঠিকই ছিলো আজকে হাত পা উঠিয়ে দিচ্ছে দেখে রূপক বুঝলো ইচ্ছে করেই প্রীতি এরকম করছে।তাই চোখ বুঝে রেখেই বলল,হাত পা ছোঁড়াছুড়ি বন্ধ না করলে খাটের তলায় বেঁধে রাখবো।আস্তে আস্তে প্রীতি খাটের একপাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো।

ভোরের দিকে কন্সটেবল নিজামের কল আসায় ঘুম ভেঙে যায় রূপকের।চোখ ডলে উঠে বসে ফোন রিসিভ করে।কনস্টেবল নিজাম জানায় আজ আর্জেন্ট রূপককে থানায় যেতে হবে।কিচ্ছু করার নাই উঠে শার্ট পড়ে সোজা বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো।দরজা অব্দি গিয়ে আবার ঘরে ঢুকে প্রীতিকে ডেকে বলে গেলো সে বাসায় যাচ্ছে কাজ পড়ে গেছে।প্রীতি একবার চোখ মেলে আবারও চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেছে।
শশুর বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি ত্রিশ মিনিটের পথ।এই ভোর বেলায় গাড়ি পাওয়া যাবেনা তাই রূপক হাটা ধরলো।বাড়ি থেকে রেডি হয়ে একেবারে থানার জন্য বেরিয়ে যাবে।

সকালে নাস্তার টেবিলে সবাই রূপকের কথা জিজ্ঞেস করলো।রাজিব শেখ জিজ্ঞেস করলেন,রূপক কোথায় নাস্তা করতে আসেনি কেনো?প্রীতি পরোটা মুখে দিতে দিতে বলল,উনার কাজ পড়েছে তাই সকাল সকাল বেরিয়ে গেছেন।কেউ আর কথা বাড়ালোনা।নাস্তা করেই প্রীতি বের হলো স্বপ্না আপাদের বাড়িতে যাবে বলে।স্বপ্না প্রীতির প্রিয় একজন মানুষ।কেনো এত প্রিয় তা প্রীতির ও জানা নেই।হয়তো মেয়েটার মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে বলেই এত প্রিয়।
সুতির শাড়ির কুচি একহাতে তুলে ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে হেঁটে হেঁটে স্বপ্নাদের বাড়িতে গিয়ে উঠলো প্রীতি।গিয়ে দেখলো টিনের ঘরের সামনের উঠানে বসেই স্বপ্না কাঁথা সেলাই করছে।প্রীতি স্বপ্না আপা বলে ডাক দিলো।প্রীতির গলার স্বর কর্ণকুহরে তরঙ্গিত হতেই স্বপ্না সামনে তাকিয়ে প্রীতিকে দেখে।প্রীতি পা চালিয়ে এসে স্বপ্নার পাশে বসে।স্বপ্না প্রীতিকে শশুর বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলো।স্বপ্নার মা চুলার পাশ থেকে প্রীতিকে বলে উঠলেন,প্রীতি নাকি রে?কখন আসলি শশুর বাড়ি থেকে?

কালকেই এসেছি চাচি।তুমি কি রান্না করো?

স্বপ্নার মা বললেন তোর স্বপ্না আপা পাটিসাপটা পিঠা খেতে চেয়েছে সেটাই বানাচ্ছি।তুই বস তোর জন্যেও আনছি।প্রীতি স্বপ্নার সাথে কথায় মন দিলো।স্বপ্না কথা বলেই যাচ্ছে প্রীতি হু হা করে উত্তর দিচ্ছে আর একমনে স্বপ্নাকে দেখে যাচ্ছে।প্রীতিকে চুপ থাকতে দেখে স্বপ্না হেসে উঠে বলল,কিরে কোথায় হারিয়ে গেলি?বরের কথা মনে পড়লো নাকি?
প্রীতি ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে বলল,আচ্ছা স্বপ্না আপা তুমি এত সুন্দর কেনো?আমি আমাদের গ্রামে তোমার মতো সুন্দর আর একজনকেও দেখিনি।
মুহূর্তেই স্বপ্নার হাসিমাখা মুখে নেমে এলো কালো মেঘের ছায়া।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,তুই ও সুন্দর।দুনিয়ার সব মানুষ সুন্দর।প্রীতি বলল,তবুও তুমিই বেশি সুন্দর।
স্বপ্না ধরে আসা গলা ঝেড়ে বলল,বেশি সুন্দর হওয়া অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।দেখনা এত সুন্দর হয়েছি বলে নিজের সংসারটা ধরে রাখতে পারলামনা।শশুর বাড়ির লোকজন বলে আমার রূপই নাকি তোর দুলাভাইয়ের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।বউ বেশি রূপবতী হলে নাকি স্বামী বেশিদিন বাঁচেনা।এখন আমার সাথেও সেটাই ঘটেছে।
প্রীতি মুহূর্তেই বুঝদার হয়ে গেলো।স্বপ্নার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,এসব কথায় তুমি কান দিওনা আপা।সবই আল্লাহর ইচ্ছা।আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
স্বপ্নার মা পিঠা নিয়ে আসলেন।প্রীতি পিঠা খেয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো।

রূপক থানা থেকে ফোর্স নিয়ে এসে তাদের দিয়ে একটা জায়গা ব্লক করছে।মূলত যার জায়গা তাকেই বুঝিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা।এই জায়গা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল মারামারি চলছিল।পরে পুলিশ কেস হয় যার কারণে রূপক এখানে এসেছে।রূপক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব বুঝিয়ে দিচ্ছে সবাইকে।হঠাৎ চোখ গেলো রাস্তায় চুল ছেড়ে শাড়ির কুচি তুলে তিড়িংতিড়িং করে নাচতে নাচতে একটা মেয়ে এদিকেই আসছে।রূপক আরেকটু এগিয়ে যেতেই প্রীতিকে চিনতে পারলো।তাই সে নিজেই এগিয়ে গেলো।প্রীতিকে শাসনের সুরে বলল,শাড়ির কুচি নামাও আর চুল খোঁপা করো।প্রীতি ঘাড় বাঁকিয়ে বলল,আমি আপনার কথা শুনবো কেনো?আর মনে হচ্ছে আমি এই এলাকায় নতুন তাই আমাকে সবকিছু বিবেচনা করে চলতে হবে।
রূপক ধমক দিয়ে বলল,মানলাম তুমি এই এলাকার মেয়ে এখনতো এই এলাকার বউও হয়েছো।তো তোমার এভাবে ঘাসফড়িং এর মতো তিড়িংতিড়িং করা সাজেনা।
প্রীতি মুখ ভেঙিয়ে রূপকের কথাকে আবার রিপিট করে।রূপক আশেপাশে তাকিয়ে রাস্তার পাশের একটা গাছের চিকন ঢাল ভেঙে তাড়া করতেই প্রীতি ভোঁ দৌড় দিলো।ক্ষেতের মাঝখানে নেমে আবার পেছন দিকে তাকিয়ে দেখলো রূপক ঢাল নিয়ে পেছন পেছন আসছে।আরো জোরে ছুট লাগাতে গিয়ে পড়লো ধপাস করে।রূপক সামনে এসে দাঁড়ালো।প্রীতিকে তুললোনা।রাগ দেখিয়ে বলল,শিক্ষা হয়েছে তোমার?
প্রীতি ছলছল চোখে বাম পা ধরে খোড়া মানুষের মতো টপকে টপকে বাড়িতে এসেছে।রূপক আগের জায়গায় ফিরে গেলো।বিকালে বাসায় যাওয়ার সময় প্রীতিকে নিয়ে যাবে।

আর কতো এভাবে পড়ে থাকতে হবে আমায়?কিছু করার হলে করছোনা কেনো?ফোনে ফিসফিস করে কাউকে শাসিয়ে চলেছে রুবি।
ওপাশের ব্যক্তি বিরক্তি সুচক শব্দ করে বলল,তোকে ওখানে পাঠিয়েছি আছিস,ঘুরছিস,খাচ্ছিস এতো কিসের জ্বালা তোর?ওখানে থেকে ঠিকঠাক ভাবে ইনফরমেশন দিবি তা না করে আমাকে শাসিয়ে চলেছিস?
রুবি ক্রোধানল হয়ে বলল,চারমাস ধরে ইনফরমেশন দিয়েই যাচ্ছি।কিচ্ছুতো করছোনা শুধু শুধু আমি এখানে বেকার খাটছি।যদি একবার রূপক সব বুঝে যায় তাহলে আমার জায়গাও ওই বদ্ধ কারাগারে হবে।শেষ করে দেওয়ার হলে শেষ না করে বসে আছো কেনো?
ওপাশের ব্যক্তি রুবিকে শান্ত করে বলল,রিল্যাক্স!এত হাইপার হসনা।মাথা ঠান্ডা রেখে আমাকে সমস্ত ইনফরমেশন দে।এখন আমার মেলা কাজ বাকি আছে।ফোন রাখছি সাবধানে থাকবি।
ফোন কান থেকে নামিয়ে রুবি ছাদের দিকে এগোলো।হাজেরা বেগম রুবির পথ আটকে দাঁড়ালেন।

প্রীতি রান্নাঘরে ঢুকে তেল নিলো গরম করতে।গরম তেল পায়ে মালিশ করলে ব্যথা কমবে।ওর মা জিজ্ঞেস করলেন এরকম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে কেনো প্রীতি।
তখন প্রীতি ঝাঁঝালো কন্ঠে উত্তর দিলো,”পাগলা কুত্তা চিনো?বাড়িতে আসার সময় পাগলা কুত্তা তাড়া করে আমাকে ক্ষেতের মাঝখানে ফেলে দিয়েছে।”

প্রীতির মা ফোঁড়ন কেটে বললেন,তুই যেরকম পাগলের মতো থাকিস সেরকম পাগলা কুত্তা ও শুধু তোরে চোখে দেখে।এখন সর এখান থেকে শান্তি মতো রান্না করি।এখানে আমার সাথে লড়াই করলে খুন্তি দিয়ে গাল দাগিয়ে দেবো।
#চলবে……..

(ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।হ্যাপি রিডিং।)