প্রিয়তমা পর্ব-০৮

0
389

#গল্পঃপ্রিয়তমা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৮

সকালে নাস্তা শেষে প্রীতি রেডি হয়ে নিয়েছে।রূপক বাইরে অপেক্ষা করছে।প্রীতিকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে থানায় যাবে।শাশুড়ীর কাছে বলে ব্যাগ নিয়ে প্রীতি দৌঁড়ে বেরিয়ে আসে।রূপক জিপের দরজা খুলে দিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে।গাড়িতে আর কেউই কথা বলেনি।প্রীতিকে নামিয়ে দিয়ে রূপক ছুটলো থানার দিকে।
প্রথম ক্লাস হওয়ায় স্যাররা প্রথমেই সবার সাথে পরিচিত হয়ে নিচ্ছে।প্রীতির একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হয়।নিজ থেকেই মেয়েটা প্রীতির সাথে কথা বলা শুরু করে।
হাই আমি আরমিন।আর তোমার নাম কি?
প্রীতি মুচকি হেসে জবাব দিলো,আমার নাম প্রীতি।

আরমিন উৎসাহ নিয়ে বলল,ওয়াও অনেক সুন্দর নাম।তুমি আমার বন্ধু হবে?
প্রীতি ঠোঁট বাকালো।মেয়ে মেয়ে হয় বান্ধবী।আর এই মেয়ে বলছে বন্ধু?
প্রীতিকে আড় চোখে তাকাতে দেখে আরমিন বলল,কি হলো?হবে না আমার বন্ধু?
প্রীতি দাঁত বের করে হেসে দিয়ে বলল,আচ্ছা।কথা জুড়ে দিলো আরমিনের সাথে।দুনিয়ার যতসব আজগুবি কথা আছে সব বলে প্রীতি আরমিনের মাথা খারাপ করে দিয়েছে।আরমিন মনে মনে বলছে,এতক্ষণ বন্ধুত্ব করবেনা আর এখন আমার কানের পোকা সব মেরে ফেলতেছে।আল্লাহ এরে থামাও।
ক্লাস শেষ করে প্রীতি রিকশা ডেকে বাড়িতে চলে আসে।রূপক বলে দিয়েছে রিকশায় করে চলে আসতে।হেঁটে হেঁটে যেনো না আসে।দুপুরের খাবার খেয়ে প্রীতি ছাদে চলে গেলো।দোলনায় বসে দুলছে।রুবি এসে পাশে বসলো।
খুব ভালো লাগছে তাইনা?
প্রীতি খিলখিল করে হেসে উঠে বলল,হুম।দোলনায় চড়তে আমার খুব ভাল্লাগে।
রুবির হুট করেই তরুণের কথা মনে পড়লো।তরুণও তো রূপকের মতো রুবির সব আবদার পূরণ করতো।কিন্তু আফসোস রুবি শুধু অভিনয়ই করে গেলো।প্রীতিকে বললো,রূপক কি তোমাকে বলেছে ও তোমায় ভালোবাসে?
প্রীতি দোল খেতে খেতেই বলল,উনি বলেছেন আমি যদি উনার কথা শুনি তাহলে আমাকে ভালোবাসবেন।
আচ্ছা আপনি এই কথা শোনার জন্য এত উদগ্রীব হয়ে আছেন কেনো?
রুবি থতমত খেয়ে আমতা আমতা করে বলল,নাহ আমি তো এমনিতেই।আচ্ছা বাদ দেও এসব।
প্রীতি বলল,আমি কি কথা উঠিয়েছি নাকি?
প্রীতি এখনো কেনো জানি রুবিকে আপন করে নিতে পারেনি।শুধু মনে হয় এই বুঝি রুবি রূপককে কেড়ে নিবে।তাই এক বাড়িতে এতদিন থাকার পরও দুজনের মধ্যে তেমন একটা ভাব নেই।
রোদে পুরো ঘেমে যাওয়ায় প্রীতি রুমে এসে ফ্যান ছেড়ে বসলো।
রুবি ঘরে এসে অজ্ঞাত ব্যক্তিকে কল দিলো।
—————————————★

রাতের অন্ধকারে পুলিশ ফোর্স চারপাশ ঘিরে রেখেছে।সবাই আড়াল হয়ে বন্ধুক তাক করে দাঁড়িয়েছে।
মেয়েগুলোকে গাড়িতে মুখ হাত বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে।খাবার আর পানি না দেওয়ায় বসে যাওয়া ঢুলুঢুলু চোখে একজন অন্যজনের গায়ে নেতিয়ে পড়ছে।যে গাড়িতে মেয়েগুলোকে রাখা হয়েছে সে গাড়ি সামনের দিকে আসছে।কনস্টেবল নিজাম রূপককে জানিয়ে দিলো গাড়িটা আসছে।রূপক বাকিদের এলার্ট করে দিলো।
গাড়িটা সামনের দিকে আসতেই সবাই মিলে ওই গাড়িটা আটক করলো।রূপক গাড়ির তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকলো।ভেতরটা পুরো ফাঁকা কোনো মেয়ে নেই।ওহ শিট বলে রূপক গাড়ির দরজায় পা দিয়ে আঘাত করলো।সামনে এগিয়ে তার টিমকে বলল,মুভ।

এদিকে নারী পাচারকারীরা একই রকম চারটা গাড়ি নিয়েছে যাতে পুলিশের হাতে পড়লেও বুঝতে না পারে কোন গাড়িতে করে মেয়েগুলোকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
একটা গাড়ি একেকটা রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।রূপক টিম মেম্বারদের কয়েক ভাগে ভাগ করে কয়েকটা পথে পাঠিয়ে দিয়েছে।সামনের স্টেশনে কল করে সেখানের পুলিশদেরকে এলার্ট করে দিয়েছে।সামনে যেই গাড়িগুলো যাবে সেগুলো চেইক করতে।
একে একে সবগুলো গাড়ি চেইক করেও কোনো হদিস পাওয়া গেলোনা।সবাই যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে তখন রূপক নিজে ছুটলো সামনের স্টেশনে।দ্রুত গাড়ি চালিয়ে সামনের পুলিশ স্টেশনে পৌঁছালো।মাঝেমাঝে যেই কয়েকটা গাড়ি আসছে সবগুলোই চেইক করা হচ্ছে।রূপক দাঁড়িয়ে রাগে দুই আঙ্গুলে কপাল ঘষে চলেছে।সব গাড়ি চেইক করেও কিছুই পেলোনা পুলিশ।সেই স্টেশনের অফিসার এবার বলে দিলেন আর চেইক করা লাগবেনা।সব গাড়িগুলো ছেড়ে দিতে।রূপকের চোখ পরলো একটা স্কয়ার কোম্পানির ঔষধের গাড়ির উপর।গাড়িটা এখানে সোজা না এসে বাঁকা রাস্তায় টার্ন নিয়েছে।
রূপকের মনে প্রশ্ন জাগলো ঔষধের গাড়িটা সোজা মেইন রোড দিয়ে না নিয়ে ড্রাইভার বাঁকা রাস্তায় কেনো নিচ্ছে।আরেকটা গাড়ি চেইক করতে গিয়ে কিছু মনে পড়তেই রূপক ছুট লাগালো সেই ঔষধ কোম্পানির গাড়ির পেছনে।
রূপককে ছুটতে দেখে বাকি পুলিশ ফোর্স ওর পেছনে ছুটেছে।পুরো স্টেশন খালি সবগুলো গাড়ি অনায়াসে চলে যাচ্ছে।ওই ঔষধের গাড়ি থামিয়ে চেইক করে ঔষধ ছাড়া কিছুই পেলোনা।এদিকে রাস্তা খালি দেখে মেয়েগুলো যেই গাড়িতে আছে সেই গাড়ি ফুল স্পিডে টান লাগালো।প্রথমে চারটা গাড়ি দিয়ে পুলিশকে কনফিউজড করেছে।এবার স্কয়ার কোম্পানির দুটো গাড়ি দিয়ে কনফিউজড করে।যখন সবাই একদিকে ছুটলো তখন অন্য ঔষধের গাড়ি যেটাতে মেয়েগুলোকে রাখা হয়েছে সেই গাড়ি রাস্তা পার হয়ে গেলো।

এবার আর তাদের পায় কে।ড্রাইভার পিশাচের মতো হাসি দিয়ে বলল,সালার পুলিশ অফিসার।এই কামরুল দশ বছর ধরে মাইয়া মানুষ পাচারের গাড়ি চালায় কেউ ধরতে পারলোনা।আর তুই দুদিনের পুলিশ অফিসার হয়ে ধরে ফেলবি?
ভেতরে দুটো মেয়ে পিঠ দিয়ে গাড়ির দরজায় আঘাত করছে।মুখ হাত পা বাঁধা থাকায় চিৎকার চেঁচামেচি করতে পারছেনা।কনস্টেবল নিজাম গাড়িটির দিকে তাকিয়ে বলল,স্যার ঐ যে গাড়িটা যাচ্ছে?মনে হচ্ছে কেউ ভেতর থেকে ধাক্কা দিচ্ছে।রূপক কিছু না ভেবেই ওই গাড়ির পেছনে দৌঁড়ালো।বেশিদূর যেতে পারলোনা তার আগেই গাড়ি চলে গেলো।রূপক গাড়ির নাম্বার দেখে নিয়েছে।পেছনে ব্যাক করে একটা বাইক নিয়ে অন্যরাস্তা দিয়ে গিয়ে গাড়িটার পিছু ধরলো সামনে যেতে পারলোনা।কিছুদূর গিয়ে একটা বড় মাঠের সামনে গাড়িটা থামলো।সেখানে আরো তিনটে গাড়ি আছে।

রূপক ব্লুটুথ ঠিক করে নিয়ে বাকিদের জানিয়ে দিলো চলে আসতে।তারা জানিয়েছে ওরা পেছনেই আছে।
ওখানে যে তিনটা কার ছিলো সেখান থেকে চারজন লোক নেমে এসেছে।মুখ ঢাকা তাদের।দুজন মধ্য বয়স্ক আর দুজন ২৯/৩০ বছরের যুবক।পুলিশের গাড়ির আওয়াজ শুনে অজ্ঞাত চার ব্যক্তি চমকে ওঠে।কেননা ওরা যেভাবে গাড়ি নিয়ে এসেছে সেটা পুলিশের জানারও কথানা।চারদিক থেকে পুলিশ ফোর্স ঘিরে ফেলেছে।আত্মরক্ষার জন্য এবার বন্ধুকের ব্যবহার করলো ওই চার ব্যক্তি।গোলাগুলির মাঝখান থেকেই ওই চারজন কোথায় উধাও হয়ে গেছে।চারজনের মাঝে একজনকে দেখে রূপকের সন্দেহ জেগেছে।মনে হচ্ছিলো লোকটা পুলিশকেই হেল্প করার চেষ্টা করছে।কিন্তু পুলিশকেই যদি হেল্প করবে তাহলে সে এসবের সাথে কেনো জড়িত থাকবে।

চারজন পালিয়ে যেতেই রূপক গাড়ির তালা ভেঙে মেয়েগুলোকে বের করে আনে।
রাতে রাতেই পুলিশ ফোর্স দিয়ে সবাইকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়।মেয়েগুলোকে উদ্ধার করতে পারলেও আসল কালপ্রিটদের ধরতে না পেরে রাগে ক্ষুব্ধ হয়ে যায় রূপক।থানার সব ঝামেলা শেষ করে বাড়িতে চলে যায়।প্রীতি আজ এখনো ঘুমায়নি।ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে তবুও টমের মতো পারছেনা চোখের পাতায় কসটেপ মেরে চোখ খুলে রাখতে।রূপক চুপচাপ রুমে ঢুকলো।রূপককে আসতে দেখে প্রীতি উঠে দাঁড়ালো।
আপনি এত রাতে আসলেন যে?আর বাসায় আসার কি দরকার ছিলো?থাকতেন বাইরে রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়তেন।রূপক কিছু বললোনা।এমনিতেই প্রচন্ড রেগে আছে নিজের উপর কেনো অপরাধীদের ধরতে পারলোনা।তাই চুপচাপ রইলো।চাইছে না নিজের রাগ প্রীতির উপর ঝাড়তে।কিন্তু প্রীতি এক নাগাড়ে রূপককে কথা শুনিয়েই চলেছে।থামার নাম নেই।রাগ সামলাতে না পেরে টেবিলের উপরে থাকা সব কিছু নিচে ফেলে দিলো রূপক।ঝনঝন আওয়াজ করে ভেঙে গেলো টেবিলের উপরে রাখা জিনিসগুলো।হিংস্র বাঘের মতো গর্জন করে উঠে বলল,আর একটাও কথা বলবেনা।প্রীতি ভয়ে কেঁপে উঠলো।বুকে দুরুদুরু আওয়াজ হচ্ছে।সারা শরীরে কাঁপুনি ধরে গেছে।এতদিনে রূপকের এমন রূপ দেখেনি প্রীতি।রেগে ধমক দিলেও এভাবে কখনো ধমকায়নি।
রূপক ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে একটা আর্টিফিশিয়াল ফুলের টব নিয়ে সেটাও ভেঙে ফেললো।প্রীতি রূপকের ভয়ে দৌঁড়ে গিয়ে রূপককেই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।কিছুক্ষণ পর রূপক একেবারে শান্ত হয়ে গেলো।বরফের ন্যায় তার সমস্ত রাগ গলে পানি হয়ে গেলো।প্রীতিকে সামনের দিকে টেনে এনে সিঁথিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,যখন আমাকে একেবারেই চুপ থাকতে দেখবে তখন মনে করবে আমি প্রচুর রেগে আছি।সে সময় তুমি নিজেও চুপ থাকবে।আমার সাথে তখন কথা কম বলবে।সে সময় কেউ কথা বলতে আসলে নিজের রাগ কন্ট্রোল রাখতে পারিনা আমি।প্রীতির শরীরের তীব্র কাঁপুনি টের পেয়ে রূপক প্রীতিকে খাটে নিয়ে বসালো।

পরপরই প্রীতি সিটকে রূপকের কাছ থেকে দূরে সরে গেলো।খাটের এক কোনে গিয়ে গুটিয়ে বসলো।রূপক এগিয়ে গিয়ে সামনের দিকে আসা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতে গেলেই প্রীতি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে নিজেকে আরো গুটিয়ে নেয়।
রূপক আর কিছু না বলে প্রীতিকে কিছুক্ষণের জন্য একা ছেড়ে গোসলে চলে যায়।সারাদিনে অনেক দৌঁড়ঝাপ হয়েছে।শরীর কেমন নোংরা হয়ে আছে।গোসল সেরে ভালো করে চুল মুছে শুতে আসতেই দেখলো প্রীতি খাটের এক কোনে এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে।মাথার নিচে বালিশ নেই।কাঁথা বালিশ সব এলোমেলো।রূপক প্রীতির মাথার নিচে বালিশ দিয়ে ওকে সোজা করে শুইয়ে দিলো।কপালে অধর যুগলের উষ্ণ পরশ এঁকে দিলো।আনমনেই বলে উঠলো প্রিয়তমা।পরক্ষণে নিজের মনেই হেসে উঠলো।
#চলবে………