প্রিয়তমা পর্ব-০৯

0
383

#গল্পঃপ্রিয়তমা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৯

স্নিগ্ধ ভোরের আলোর ছটায় আলোকিত পরিবেশ।পাখির কলকাকলীতে মুখরিত চারপাশ।মৃদুমন্দ বাতাসে দোলা দিয়ে যায় মন।গতকাল জানালা আটকানো হয়নি তাই মৃদু বাতাসে পর্দাগুলো দুলছে।
পাশে শান্ত,স্নিগ্ধ মানব ঘুমিয়ে আছে।একমাত্র ঘুমালেই সবচেয়ে রাগি মানুষটিও শান্ত হয়ে যায়।গতকাল রূপকের রাগ দেখে প্রীতি ভয় পেলেও এখন মানুষটার প্রতি অভিমান মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।কথা বলবেনা এই মানুষটির সাথে,একদমই না।বিছানা থেকে নেমে জামাকাপড় ঠিক করে প্রীতি ওয়াশরুমে চলে যায়।

চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে আটা গুলে নিয়েছে প্রীতি।হাজেরা বেগম নামায শেষ করে রান্নাঘরে আসলেন।প্রীতিকে বলল,তুমি রুটি বেলে নাও আমি ভাজিটা বসিয়ে দিচ্ছি।প্রীতি চুলার সামনে থেকে সরে একপাশে গিয়ে রুটি বেলে দিলো।হাজেরা বেগম এক চুলায় ভাজি বসিয়ে অন্য চুলায় রুটি সেকে নিলেন।টেবিলে প্লেট সাজিয়ে রেখে প্রীতি রান্নাঘরে এসে সব খাবার টেবিলের উপর নিয়ে গেলো।
দেয়াল ঘড়িতে নজর দিয়ে দেখলো আটটা বাজতে আর কয়েক মিনিট বাকি।প্রতিদিন প্রীতি গিয়ে রূপককে ডেকে তোলে।আজ ইচ্ছে করেই গেলোনা।রুবি আস্তে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলো।রূপকের বাবা ও আসলেন।সবাই আছে রূপক ছাড়া।হাজেরা বেগম প্রীতিকে বললেন,রূপককে ডেকে আনো,আজ ডাকোনি?
প্রীতি শশুরের প্লেটে খাবার বেড়ে দিতে দিতেই মিথ্যে বলল,উনি বলেছেন আজ যেনো উনাকে না ডাকি।তখনই সিঁড়ি বেয়ে নামলো রূপক।প্রতিদিন একই সময়ে প্রীতি গিয়ে ডেকে তোলে।আজও একই সময়ে ঘুম ভেঙেছে কিন্তু ঘুমের ভান ধরে পড়ে রইলো।ভাবলো প্রীতি এসে ডেকে তুলবে।কিন্তু নাহ অনেকক্ষণ যাওয়ার পরেও প্রীতি আসলোনা দেখে রূপক উঠে পড়লো।নয়তো থানায় যেতে দেরি হবে।

প্রীতির কথা শুনে রূপক বুঝলো তার প্রিয়তমা রাগ করেই তাকে ডাকতে যায়নি।প্রীতি গাল ফুলিয়ে রেখেই নাস্তা বাড়লো।রূপক মুখ টিপে হাসলো।চেয়ার টেনে বসে পড়লো।প্রীতি রূপককে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো।রূপক প্লেট তুলে প্রীতির সামনে ধরলো নাস্তা দেওয়ার জন্যে।প্রীতি রূপককে এড়িয়ে গিয়ে হাজেরা বেগমকে বলল,আম্মা আমি চা নিয়ে আসছি আপনি বাকিদের নাস্তাটা বেড়ে দিন কষ্ট করে।
রূপকের মনঃক্ষুণ্ন হলো।মা বেড়ে দেওয়ার আগেই রূপক নিজেই প্লেটে রুটি আর ভাজি তুলে নিলো।বাকিদের বলতে প্রীতি রূপককেই বুঝিয়েছে সেটা রূপক ঢের বুঝতে পারলো।নয়তো সবার প্লেটেই নাস্তা দেওয়া শেষ।

প্রীতি চা নিয়ে এসে নিজেও একটা রুটি নিয়ে খেতে বসলো।সবার আগেই তার খাওয়া হয়ে গেছে।গ্লাসের দিকে হাত বাড়াতেই রূপক গ্লাসটি ঠেলে দিলো প্রীতির দিকে।প্রীতি সেই গ্লাস না নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে সেখান থেকেই পানি ঢেলে খেয়ে নিলো।রূপক আড়চোখে দেখছে তার বউয়ের কাজকর্ম।বাব্বাহ্!এত রাগ মহারানীর?
নাস্তা শেষে রূপক বলল,তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও কলেজে নামিয়ে দিয়ে যাবো।প্রীতি আস্তে আস্তে কাজ করছে।যেন সে শুনতে পায়নি রূপকের কথা।রূপক ফাঁকা কাশি দিয়ে বলল,কেউ যদি কলেজে না যায় তো আমিও আজ সারাদিন বাসায় থাকবো।প্রীতি হাতের কাজ ফেলে রেখে দিলো।সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো।পাঁচ মিনিটে রেডি হয়ে নিচে নামলো।শশুর শাশুড়ীর কাছে বলে বেরিয়ে গেলো।রূপক প্রীতিকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে থানায় চলে গেলো।গাড়িতে অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু প্রীতি কথা বলেনি।

প্রীতি ক্লাসে গিয়ে দেখলো আরমিন ওর জন্য জায়গা রেখে দিয়েছে।সোজা ওর সাথে গিয়ে বসলো।এখন প্রীতির মুখ দিয়ে বারুদ ছুটছে।কথা বলতে বলতে আরমিনকে পাগল করে দিচ্ছে।আরমিন কানে হাত দিয়ে বলল,থাম বইন এবার চুপ যা।এতকথা একটা মানুষ কিভাবে বলতে পারে?
প্রীতি জোরে শ্বাস ফেলে বলল,সকাল থেকে দু-চারটে কথা ছাড়া বাড়তি একটা কথাও বলিনি।চুপচাপ থাকতে থাকতে আমার মুখ ব্যথা হয়ে গেছে তাই এখন কথা বলে মুখ ঠিক করছি।
আরমিন বলদের মতো লুক দিয়ে বলল,সিরিয়াসলি?কথা না বললেও কারো মুখ ব্যথা হয়?আর কথা বললে মুখ ব্যথা ভালো হয়ে যায়?আর কি কি টিপস আছে আমাকে দে আমি শুনি আর কাজে লাগাই।
প্রীতি ভাব নিয়ে বলল,আমার সাথে থাক আস্তে আস্তে সব শিখে যাবি।
স্যার ক্লাসে আসায় আর কথা বলা হলোনা।ক্লাস শেষ করে প্রীতি শশুর বাড়ি না গিয়ে সোজা বাপের বাড়ি চলে আসলো।প্রীতির মা প্রীতিকে দেখে অবাক হয়ে গিয়ে বললেন,কিরে তুই এসময়?
প্রীতি হালকা হেসে বলল,তোমাদের কথা মনে পড়লো তাই চলে আসলাম।প্রীতির মা শাসনের সুরে বললেন,এভাবে হুটহাট চলে আসলে শশুর বাড়ীর লোকজন কি বলবে?তাদেরকে বলে এসেছিস?
নাহ বলে প্রীতি নিজের রুমে গিয়ে ধপ করে ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে বোরকা খুললো।
প্রীতির মা রক্তচক্ষু নিয়ে মেয়ের পেছন পেছন এসে বলল,কাউকে কিছু না বলেই চলে আসলি?সত্যি করে বলতো ঝগড়া করে আসিসনিতো?প্রীতি করুণ চোখে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল,এখন কি তোমাদেরকে দেখতে আসতেও পারবোনা?আমি কি এতটাই পর হয়ে গেছি?তোমাদের সমস্যা হলে আমি এখনই চলে যাচ্ছি ও বাড়িতে।আর আসবোনা।
প্রীতির মা এবার কিছুটা নরম হলেন।কোমল কন্ঠে বললেন,ঐ দেখো মেয়ে রাগ করে।আমিতো বলেছি এভাবে শশুর-শাশুড়ী,জামাইয়ের অনুমতি না নিয়ে আসা ঠিকনা।
প্রীতি আদুরে সুরে বলল,এবার আমাকে এক কাপ চা দাও তোমার হাতে বানানো।প্রীতির মা ধমকে বললেন,এখন কিসের চা?ফ্রেশ হয়ে আয় দুপুরের খাবার সময় হয়েছে।তোর বাবা ভাই সবার সাথে একসাথে বসে খাবি।প্রীতি মাকে বলে দিলো আমার মাথা ব্যথা করছে তুমি বরং খাবারটা রুমে দিয়ে যাও।
এখন খাবার টেবিলে গেলেই ভাইয়া আর বাবার একশত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।কেন আসলো,রূপককে বলে এসেছে কিনা?এরকম হাজারটা প্রশ্ন করবে।তাই আর প্রীতি গেলোনা।

দুপুরে খাবার খেয়ে রূপক ফোন হাতে নিলো বাড়িতে ফোন করবে।সচরাচর এরকম ফোন করেনা।আজ প্রীতি রেগে আছে।কিজানি হয়তো ফোন করলে মন ভালো হতেও পারে এই ভেবে বাড়িতে মায়ের নাম্বারে কল করলো।হাজেরা বেগম রিসিভ করে,খাবার খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলো।রূপক খেয়েছি,তোমরা সবাই খেয়েছো?জিজ্ঞেস করতেই হাজেরা বেগম বললেন,হ্যাঁ আমি আর রুবি খেয়ে নিয়েছি।তোর বাবা কোন বন্ধুর বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছে।প্রীতিতো এখনো কলেজ থেকেই আসলোনা।
রূপক অবাক হয়ে বলল,এখনো প্রীতি বাসায় যায়নি?
হাজেরা বেগম না জানাতেই রূপক বলল,আচ্ছা এখন রাখছি।হয়তো ক্লাস শেষ হয়নি এখনো।মায়ের কাছ থেকে ফোন কেটে প্রীতিদের বাসার ফোনে কল দিলো।সবাই খাবার টেবিলে তাই প্রীতির মা গিয়ে ফোন ধরলো।রূপক সালাম দিয়ে ভালো আছে কিনা জিজ্ঞেস করলো।প্রীতির মা ও সালামের জবাব দিয়ে জানালো ভালো আছেন।রূপক জিজ্ঞেস করলো,প্রীতি ও বাসায় গিয়েছে কিনা?প্রীতির মা বললেন,হ্যাঁ কলেজ থেকে এখানেই এসেছে।সবার জন্য নাকি মন খারাপ করছিলো।রূপক ঠিক আছে বলে কল কেটে দিলো।

বিকালে ঘুম ভাঙতেই আড়মোড়া ভেঙে প্রীতি উঠে বসলো।আজ ভাত খেয়েই ঘুমিয়েছে।ও বাড়িতে থাকলে হয়তো ঘুমাতোনা দোলনায় বসে দুলতো।পাশে রূপককে দেখে চমকে উঠলো।রূপকের গায়ে এখনো ইউনিফর্ম।খাটে হেলান দিয়ে ফোন টিপছিলো।প্রীতির ঘুম ভাঙতে দেখে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে মিষ্টি হাসলো।
ঘুম ভালো হয়েছে?প্রীতি কপাল কুঁচকে বলল,আপনি এখানে কেনো?রূপক ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে বলল,বউ রেখে কি দূরে থাকা যায়?আমিতো তোমাকে নিতে এসেছি।প্রীতি খাট থেকে নেমে বলল,যাবোনা আমি আপনার সাথে।আপনি আপনার রাগের গোডাউন নিয়ে থাকেন।আমি কোত্থাও যাবোনা মানে কোত্থাও না।রূপক ইনোসেন্ট ফেস করে বলল,ঠিক আছে তাহলে আমিও কোথাও যাবোনা।দরকার পড়লে সারাজীবন ঘর জামাই থাকবো তবুও যাবোনা।
প্রীতি যেন আকাশ থেকে পড়লো।হতবিহ্বল চাহনিতে চেয়ে মৃদু চেঁচিয়ে বলল,কিহ?ঘর জামাই থাকবেন মানে কি?লোকে কি বলবে?আপনাকে খোঁটা দিবে,কটাক্ষ করে কথা বলবে।রূপক ঠোঁট কামড়ে হাসলো।বলল,তাতে তোমারতো কিছু যায় আসবেনা।প্রীতি নাকের ডগায় রাগ নিয়ে বলল,আপনি এখনই এখান থেকে যাবেন।এমনিতে না গেলে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবো কিন্তু।
রূপক আয়েশ করে দাঁড়িয়ে বলল,তোমার মতো দশজন আসলেও আমাকে ধাক্কা দিয়ে রূম থেকে বের করতে পারবেনা।শক্তিটুকু অযথা খরচ না করে মজুদ রাখো ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে।তুমি রেডি হয়ে নাও।আমি বরং সবার সাথে কথা বলে আসি।

রূপক রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই প্রীতিও পেছন পেছন আসলো।সোফার রুমে এসে বলল,যাচ্ছেন না কেনো আপনি?এখনো বসে আছেন কেনো?
রূপকের সোজাসাপটা উত্তর,এটা আমার শশুর বাড়ী।তাই আমি যখন খুশি আসতে পারি।
প্রীতি ফুঁসে উঠে বলল,থাকুন আপনি আপনার শশুর বাড়ি আমি বান্ধবীর বাড়িতে চলে যাবো।তখন সেখানে আপনি কিভাবে যান আমিও দেখে নেবো।রূপক সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে বলল,তোমার বান্ধবীতো আমার শালিকা তো আমিও আমার শালিকার বাড়িতে যাবো।
প্রীতি চেঁচিয়ে বলল,আপনি এখন এখান থেকে যাবেন।আমি আপনার সাথে কিছুতেই যাবোনা।অসভ্য লোক একটা।প্রীতির মা পেছন থেকে ধমকে উঠে বললেন,প্রীতি!বেয়াদবের মতো কথা বলছিস কেনো?
হাত উঁচু করে চড় মারতে আসলে রূপক প্রীতিকে আড়াল করে দাঁড়ায়।
রূপক বলল,ছোট মানুষ আমি কিছু মনে করিনা ওর কথায়।গায়ে হাত তুলবেননা আম্মা।
প্রীতি গুটিয়ে রূপকের ইউনিফর্ম মুঠো করে দাড়ালো।উঁকি দিয়ে মায়ের রক্তিম চেহারা দেখে ঢোক গিললো।
মায়ের হাতের চড় খেলে গাল ফুলে যায়।এর আগেও অনেকবার চড় খেয়ে গাল ফুলেছে প্রীতির।

রূপক আলগোছে প্রীতিকে টেনে এনে বলল,যাও রেডি হয়ে আসো।আমরা বাড়িতে যাবো,মা টেনশন করছে তুমি এখনো কলেজ থেকে ফেরোনি বলে।প্রীতি কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো বোরকা পড়তে।এখন এখানে থাকা মানেই মায়ের হাত থেকে নিস্তার নেই।মার ওর কপালে সুন্দর করে লিখা আছে।
রূপক প্রীতিকে নিয়ে রওনা দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।গাড়ি চালাতে চালাতে বলল,দেখলেতো তোমাকে কে বাঁচালো?আমাকে কথা শুনিয়েছো সেই আমিই মার খাওয়ার হাত থেকে বাঁচালাম।
প্রীতি ভেংচি কেটে বলল,এখন কি আপনাকে নোবেল দিতে হবে?
রূপক চাপা হাসলো যা প্রীতির নজরে পড়লোনা।

ফারুখ রাতে বাসায় এসে রাজিব শেখকে জানালো সে স্বপ্নাকে বিয়ে করতে চায়।তার কথা শুনে রাজিব শেখ ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন,অসম্ভব।
#চলবে……….

(ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।হ্যাপি রিডিং।)