প্রেমতরী পর্ব-১০

0
242

#প্রেমতরী
পর্ব :- ১০
.
মিষ্টি ভিতরে প্রবেশ করে দেখে মা বাবার পাশে বসে বাবার মাথাটা কোলে নিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে।
আর বাবা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, মা এতো নাড়াচ্ছে, বাবা তবুও উঠছে না।
মিষ্টি আরো কাছে গিয়ে বুঝতে পারে তার বাবা আর বেঁচে নেই।
চিৎকার দিয়ে মিষ্টি বাবার কাছে ছুটে যায়।
চারদিকে কান্নার রোল পড়ে যায়, একটু পর পর মিষ্টি আর মা জ্ঞান হারাচ্ছে।
ডাক্তার এসে জানায় কাল রাতেই উনি হার্ট আট্যাক করে মারা গেছেন।
এদিকে পুরো বাড়ি যেনো নিমিষেই স্তব্ধ হয়ে যায়।
সব রিতি রেওয়াজ মেনে বাবাকে দাফন করা হয়।
মিষ্টিও নিমিষেই চুপ হয়ে যায়, ১ দিনের ব্যবধানে নিজের গর্ভের সন্তান ও জন্মদাতাকে হারিয়ে মিষ্টি শোকে পাথর হয়ে যায়।
অনেকে অনেক চেষ্টা করেছে মিষ্টির সাথে কথা বলার জন্য, কিন্তু মিষ্টির মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হয় না।
ঘরের বারান্দায় দেয়ালে হেলান দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে মিষ্টি, যেখান থেকে পুকুর পাড়টা স্পষ্ট দেখা যায়, পুকুরের ওপারেই বাবার কবর।
মিষ্টি সেদিকেই তাকিয়ে আছে। আর আনমনে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
.
পুরো দিন এভাবেই পার হয়ে যায়, এদিকে মিষ্টির মা জ্ঞান হারানোর পর থেকে ওনার আর জ্ঞান ফিরছে না।
ডাক্তার এসে স্যালাইন দিয়ে চলে যায়। আর বলে যায় যেকোনো সময় জ্ঞান ফিরবে।
মিষ্টি নিজ পায়ে ধীরেধীরে হেটে মায়ের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে।
মামুন আর মামুনের মা বাবা সবাই চেষ্টা করে মিষ্টিকে তোলার, কিন্তু মিষ্টির শরীরটা যেনো পাথরের চেয়েও শক্ত হয়ে গেছে, কেউ টেনে উঠাতে পারছে না।
একটু পরই মায়ের জ্ঞান ফেরে।
মাকে জড়িয়ে ধরে মিষ্টি কেঁদে ওঠে, মা মেয়ে দুজন জড়াজড়ি করে কাঁদতে থাকে।
–আব্বুকে আমি মেরে ফেলেছি। আমি মেরেছি। কেনো আমি কাল এতসব বলেছি। সব কিছুর জন্য আমিই দায়ি। আব্বু আমার ওপর এতোটা রাগ করলো? একবার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটাও দিলো না আমায়। কেনো আমি কাল এসে ক্ষমা চাইলাম না? আমার জন্যই আমার আব্বু এভাবে চলে গেলো।
–চুপ কর মা, চুপ কর। কেনো নিজেকে এভাবে দোষারোপ করছিস?
–আমায় কেনো তখন আটকালে না? যখন আব্বুকে এত কিছু বলছি তখন আমায় কেনো মারলে না? ও আম্মু, একবার আব্বুকে এনে দাও না, আমার যে এখনো ক্ষমা চাওয়া বাকি আছে। আর কখনো এমন করবো না। আব্বু যা বলবে আমি তাই করবো, আর কখনো আব্বুর কথার অবাধ্য হবো না । একবার এনে দাও না আব্বুকে।
মিষ্টির এমন কথায় ঘরের সবাই কান্না করা শুরু করে।
মামুন অনেক কষ্টে মিষ্টিকে মায়ের কাছ থেকে নিয়ে আসে।
বাচ্চাদের মতো গুটি মেরে শুয়ে আছে মিষ্টি, আর মামুন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
–মিষ্টি, ওঠ, খাবারটা খেয়ে নে। সারাদিন কিচ্ছু খাস নি।

–এই মিষ্টি, ওঠ না।
–একটু কাছে আসবি?
মামুন মিষ্টির পাশে এগিয়ে আসে।
–আমায় একটু বুকে জড়িয়ে নে না, খুব কান্না পাচ্ছে। আমি আর পারছি না।
মামুন মিষ্টিকে তুলে বুকে জড়িয়ে নেয়।
মিষ্টি হু হু করে কেঁদে ওঠে।
মামুন শক্ত করে মিষ্টিকে জড়িয়ে রাখে,
–আমার বাবাকে আমি মেরে ফেলেছি, ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটাও আমি পেলাম না।
–তুই কেনো মারতে যাবি? চাচাতো গত দুইদিন ধরেই অসুস্থ। শুধুশুধু নিজেকে দোষারোপ করিস না।
–আমার কথার আঘাত সইতে না পেরে আব্বু স্ট্রোক করছে। সেটা আমি ভালো করেই জানি।
–দেখ মিষ্টি, মৃত্যু কাউকে বলে কয়ে আসে না। কার মৃত্যু কিভাবে হবে আমরা কি তা জানি? আল্লাহ চাচার মৃত্যু এভাবেই রেখেছেন, এতে তুই কেনো নিজেকে দায়ী মনে করছিস?
–আমি আব্বুকে দেখবো।
–পাগলামো করিস না, আয় খাবাটা খেয়ে নে। সারাদিন কিছুই খাস নি।
–আমার আম্মু খেয়েছে?
–চাচির কাছে আম্মু গেছে খাবার নিয়ে। তুই ওঠ, খেয়ে নে।
–খাবার আমি কি করে খাবো? আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না। কাল রাতেও আব্বু খাবার নিয়ে আমার জন্য বসে ছিলো। আমি সময়মত যেতে পারি নি। আব্বু কত ভালোবাসতো আমায়, সবাই আব্বুকে ভয় পেত, কিন্তু আব্বু কখনো আমার সাথে একটুও উচু গলায় কথা বলেনি। এর আগেরদিন ও আমায় নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছিলো। আর আমি তার ভালোবাসার এই প্রতিদান দিলাম। আমার আর বেচে থাকতেই ইচ্ছে করছে না।
–এভাবে কাঁদিস না, চাচা কষ্ট পাবে। নিজেকে সমলা, চাচির খেয়াল রাখতে হবে না? তুই এভাবে ভেঙে পড়লে চাচিকে কে সামলাবে?
–আমায় একটু আম্মুর কাছে দিয়ে আসবি?
–হুম, আগে খাবারটা খেয়ে নে।
–আম্মুর সাথে খাবো, আম্মু এখনো খায়নি।
–আচ্ছা, কিন্তু ওখানে গিয়ে একটুও কাদবি না।
–আচ্ছা।
.
মামুন মিষ্টিকে মায়ের কাছে দিয়ে আসে।
–আম্মু ওঠো, দেখো জেঠিমা খাবার নিয়ে এসেছে। খাবে না?
–তুই খেয়েছিস?
–তোমার সাথে খাবো, ওঠো।
মা মেয়ে একসাথে খাবার খেয়ে নেয়।
খাবার শেষে মিষ্টির মা মিষ্টিকে বলে মামুনকে ডেকে নিয়ে আসতে।
মিষ্টি গিয়ে মামুনকে ডেকে নিয়ে আসে।
–বাবা এসেছিস, আয় এখানে বস।
–চাচি, কিছু লাগবে?
–নারে বাবা, কিছুই লাগবে না। তোর সাথে কিছু কথা ছিলো।
–হ্যা বলো না।
–মিষ্টি, তুই একটু বাহিরে যা, মামুনের সাথে আমার কিছু কথা আছে।
মায়ের আদেশে মিষ্টি বাহির চলে যায়।
–কি এমন কথা যে মিষ্টির বাহিরে যেতে হলো।
–বাবারে, আমার মেয়েটাকে একটু দেখে রাখিস। তুই ছাড়া ওকে দেখে রাখার মতো এখন আর কেউ নেই।
–চাচি, এটা তো আমার দায়িত্ব, এ নিয়ে তুমি কোনো চিন্তা করো না। মিষ্টিকে আমি মাথায় করে রাখবো। ওর কোনো অযত্ন করবো না। তুমি, মিষ্টি, আমরা সবাই মিলে বাকি জীবনটা সুখেই কাটিয়ে দিবো।
–আমার মেয়েটা সুখে থাকলেই আমি খুশি, তোর চাচার কলিজার টুকরা ছিলো মিষ্টি। একদিন মিষ্টিকে না দেখলে উনি ঘুমাতে পারতেন না। বাকি মেয়েদের মতো মিষ্টি কষ্ট বুকে চেপে রাখতে পারে না, মেয়েটা কষ্ট একদমই সহ্য করতে পারে না।
–তুমি দেখো চাচি, মিষ্টিকে আমি কোনো কষ্ট পেতে দিবো না। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত ছায়া হয়ে ওর পাশে থাকবো।
–কাল রাতে ওর বাবা আমায় বলছিলো, ওনার যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে মিষ্টির কি হবে? ওকে কে দেখে রাখবে? খুব বড় গলায় ওনাকে বলেছিলাম, মামুন আমার মেয়েকে সুখে রাখবে। মিষ্টির কখনো অযত্ন হবে না। জানিস, ওর বাবা ওর কথায় কষ্ট পায় নি। কষ্ট পেয়েছে ওর চোখের পানি দেখে, ওকে কাঁদতে দেখে, ওর কষ্ট দেখে। হয়তো উনি এটা সহ্য করতে পারেন নি।
–আমি বুঝতে পারছি চাচি, তুমি এতো চিন্তা করো না, শুধু আমার ওপর ভরসা রাখো।
–তুই ই তো এখন আমার একমাত্র ভরসা, আমার আর কোনো চিন্তা নেই।
–চাচি, একটু বিশ্রাম নাও, সারাদিন অনেক ধকল গেছে।
–মিষ্টিকে একটু পাঠিয়ে দে।
–আচ্ছা।
.
–আম্মু, আমায় ডেকেছো?
–হুম, শোন, একদম কাঁদবি না। সবাই তো আর সারাজীবন বেচে থাকে না। নিজের শক্ত কর।
–হুম,
–জানিস!! তোর জেঠু, জেঠিমা, মামুন এরা খুবই ভালো মনের মানুষ, আমি জানি এরা কখনো তোকে অবহেলা করবে না। ছোটবেলা থেকে ওরাই তোকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। তুই যখন ছোট ছিলি, দুষ্টমি করার কারনে তোকে আমি মেরেছিলাম, যার জন্য তোর জেঠিমা আমায় একটা চড় মেরেছিলো। ২ দিন তোকে আমার কাছে আসতে দেয়নি। খুব ভালোবাসে ওরা তোকে। আমার একটাই অনুরোধ, ওদের কখনো কষ্ট দিস না। কষ্ট পেলে বা রাগ হলে চুপ হয়ে থাকবি, একদম কথা বলবি না।
–হুম।
–মামুনকে কষ্ট দিস না। ও খুবই সহজ সরল, ওকে আগলে রাখিস।
–হুম,
–অনেক রাত হয়েছে, যা ঘুমিয়ে পড়।
–আমি তোমার সাথে ঘুমাবো।
–না, বিয়ের পর মেয়েদের তার স্বামীর সাথেই থাকতে হয়। আর আমি তো আছিই, অন্য সময় ঘুমাস, এখন যা।
–আচ্ছা, তুমিও ঘুমিয়ে পড়।
–হুম।
মাকে বিদায় দিয়ে মিষ্টি মামুনের কাছে ফিরে আসে।
মামুন মিষ্টিকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
সকালে নামাজ পড়ার জন্য মিষ্টি এলার্ম দিয়ে রেখেছিলো।
সেই এলার্মের শব্দেই মিষ্টির ঘুম ভাঙে, অন্য সময় তো মা জাগিয়ে দিতো।
মিষ্টি উঠে সবাইকে নামাজের জন্য জাগিয়ে দেয়, শেষে মাকে ডাকতে মায়ের রুমে যায়।
অনেক্ষন টোকা দেওয়ার পরও মা দরজা খুলছিলো না।
শেষে মিষ্টি সবাইকে ডাক দেয়।
কোনো উপায় না পেয়ে দরজা ভাঙা হয়।
মিষ্টি ভিতরে গিয়ে দেখে মা শুয়ে আছে, কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই।
মাকে ডাক দিতে দিতে মিষ্টি মায়ের পাশে গিয়ে দাড়ায়।
তবুও মায়ের কেনো রিপ্লাই আসে না।
শেষে মিষ্টি মায়ের শরীর ঝাকি দেয়। তবুও মায়ের কেনো সাড়াশব্দ নেই।
কারো আর বুঝতে বাকি রইলো না কি হয়েছে।
বাবার পর মায়ের এই মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে মিষ্টি ওখানেই জ্ঞান হারায়।
.
.
.
চলবে………