প্রেমতরী পর্ব-০৯

0
232

#প্রেমতরী
পর্ব :- ৯
.
–ছাড়ুন, একদম আমার কাছে আসবেন না। একজন খুনির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আপনি আমার সন্তানকে মেরে ফেলেছেন, আপনার সন্তানও আজ থেকে আপনার কাছে মৃত, চলে যান এখান থেকে।
–মিষ্টি, কি বলছিস এসব?(মিষ্টির মা)
–আমি ঠিকই বলছি, একজন খুনি কখনোই আমার বাবা হতে পারে না। চলে যাও তোমরা এখান থেকে।
মিষ্টির বাবা যেনো কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলে। মেয়ের এমন কথা যেনো কলিজায় তীরের মত গিয়ে আঘাত করে।
চেয়েও যেনো বাবা আজ কিছুই বলতে পারছে না। কারন সত্যিই বাবা আজ অপরাধী।
–জেঠিমা, তোমরা কি আমায় তোমাদের কাছে রাখবে????
–কি বলছিস এসব? শান্ত হ মা, এমন করিস না।
–মামুন, তুই কি আমাকে তোর সাথে রাখবি? জেঠিমাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখ। আমি জোর করবো না।
–মিষ্টি, একটু শান্ত হ, দেখ, চাচা না জেনে একটা ভুল করে ফেলেছে। এমন করিস না।(মামুন)
–আমার সন্তানকে খুন করবে, এটা কি করে সে মাথায় আনলো? অন্যায় আমি করেছি, কিন্তু সে আমায় কষ্ট দেয়নি, সে এটা ভাবেনি যে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় কষ্টই সে আমায় দিয়েছে। এমন বাবা আমি চাই না। কি করে সে আমার বাবুটাকে মেরে ফেলেছে? কি করে পেরেছে?
মিষ্টি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে কথা গুলো তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো।
–চাচি, চাচাকে নিয়ে ঘরে যাও। ওর মাথা গরম হয়ে আছে, ও শান্ত হলে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন ঘরে চলে যাও।
মামুন চাচা আর চাচিকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দেয়।
মিষ্টি চিৎকার করে করে এখনো কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে একটু পর পর জ্ঞান হারাচ্ছে।
মামুন আর মামুনের মা মিষ্টির মাথায় পানি দেয়। জ্ঞান ফিরলেই মিষ্টি একটু পর পর কেঁদে ওঠে আর বিলাপ করতে থাকে।
মামুন, মামুনের মা বাবা সবাই মিষ্টির সাথে কথা বলে, কিন্তু মিষ্টি কারো কথার কোনো জবাব দেয় না।
পুরো দিন এভাবেই পার হয়ে যায়।
রাতে মামুন একটা প্লেটে করে মিষ্টির জন্য খাবার নিয়ে রুমে আসে।
–মিষ্টি, ওঠ খাবারটা খেয়ে নে।

–সকাল থেকে কিছুই খাসনি, আর কতক্ষণ এভাবে থাকবি?

–এই দেখ আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে আসছি, তুই না খুব করে বলতি, আমি তোকে খাইয়ে দিলে তুই সব কিছুই খেতে রাজি হয়ে যাবি।
ওমনি মিষ্টি আবার ডুকরে কেঁদে ওঠে মামুনকে জড়িয়ে ধরে।
–আমি পারিনি, পারিনি তোর আমানত রক্ষা করতে। তোর বাবুটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। মরে গেছে, ওকে মেরে ফেলেছে। ওকে নিয়ে আমি কত স্বপ্ন বুনেছি, আমায় মা মা বলে ডাকবে। সব শেষ করে ফেলেছে।
মামুন এক হাতে খাবার প্লেট, অন্য হাত দিয়ে মিষ্টিকে বুকে জড়িয়ে নেয়। নিজের চোখের পানি মিষ্টির থেকে আড়াল করে নিচ্ছে আর ভাবছে,
এখন যদি মেয়েটা আমার চোখে পানি দেখে, তাহলে ও পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। পারবে না ও নিজেকে সামলাতে।
.
–আমায় ক্ষমা করে দে প্লিজ,
–এই পাগলি, কেনো এমন করছিস?
–আমার বাবু,
–তোর বাবু আবার হবে, তখন আমরা দুজন মিলে আমাদের বাবুকে সামলে রাখবো।
–কেনো আব্বু এমন জঘন্য কাজটা করলো? আব্বুতো আমায় খুব ভালোবাসতো। আমার কথা একবারও ভাবলো না?
–আচ্ছা এসব বাদ দে না, নে হা কর। সকাল থেকে কিচ্ছু খাসনি।
–খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না, যদি এটা কোনো দুর্ঘটনা হতো, তাহলে নিজের মনকে বুঝাতে পারতাম। কিন্তু যখন জানতে পারলাম আমার জন্মদাতা পিতাই আমার সন্তান নষ্ট করে ফেলেছে, তখন আমি কি করে ঠিক থাকি? কেনো জানি আমার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে। (আবার কান্না শুরু করে দেয়)
–কেনো এমন করছিস? উনি জানতেন না এটা আমার সন্তান, জানলে কি উনি এরকম একটা কাজ করতে পারতেন? উনি হয়তো ভেবেছিলেন তুই কোথায়ও খারাপ কাজে জড়িয়েছিস। তাই উনি এই কাজটা করে ফেলেছেন।
–আমি খারাপ কাজ করেলেও কারো অধিকার নেই আমার বাচ্চা নষ্ট করার। কেনো তুই আব্বুর হয়ে ওনার অপরাধের সাফাই গাইতেছিস? আমার বাবুটার জন্য তোর কি একটুও খারাপ লাগছে না?
–কি বলছিস এসব? আমাকে কি এখন তোর মত করে কাঁদতে হবে? চিৎকার করতে হবে? পাগলের মতো আচরণ করতে হবে? তুই কি বুঝতে পারছিস তুই কি করেছিস? তোর নিজের বাবাকে কি কি বলেছিস? কতটা অসম্মান করেছিস। বাবা মায়ের সাথে কেউ এরকম ব্যবহার করে?
–আমার কোনো বাবা মা নেই, এটাই আমার পরিবার এখন থেকে। জেঠু জেঠিমাই হলো আমার বাবা মা। আর যদি তোরা আমার এই পরিবারে জায়গা দিতে না পারিস, তাহলে বলে দে, আমি চলে যাবো এখান থেকে।
ওমনি মামুন মিষ্টিকে একটা চড় দিয়ে বসে।
–কি মনে করিস নিজেকে? কেনো এমন জেদ করিস? তোর এই জেদের করনে কি কি হয়েছে জানিস? ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আমি মরতে মরতে বেচে গেছি, কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করেছি, বিয়ে গোপন থাকা অবস্থায় তোর জেদের কারনে বাচ্চা নিতে হলো। এখন আমি আমার সেই বাচ্চাটাকেও হারিয়েছি। এখন তুই আবার উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করছিস। তুই কি আমায় পাগল বানিয়ে মারতে চাস?
মিষ্টি গালে হাত দিয়ে আবার চোখের পানি ছেড়ে দেয়।
মামুন মিষ্টিকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নেয়। মিষ্টি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
–জানিস, কেনো তোকে পালিয়ে বিয়ে করেছি? সারাজীবন তোর সাথে কাটাতে পারবো এই ভরসাটা ছিলো তাই। কেনো তুই এতো জেদ করিস? আমার লক্ষ্মী বউ হয়ে থাক না। তুই না আমায় কথা দিয়েছিলি যে তোর দিকে ২য় বার আঙুল তুলে কথা বলার সুযোগ দিবি না।
–আমি আব্বুকে অনেক বেশি শুনিয়ে দিয়েছি তাই না?
–অন্নেক।
–আমি মাফ চাইবো আব্বুর কাছে।
–এইতো আমার লক্ষ্মী বউ। নে খাবারটা শেষ করে চাচার কাছে চল, দুজন মিলে ওনার কাছে মাফ চাইবো।
–আব্বু কি আমায় ক্ষমা করবে?
–কি বলে পাগলি। কোনো বাবা কি তার সন্তানের ওপর রাগ করে থাকতে পারে?
–আচ্ছা যাবো আব্বুর কাছে, আমি জানি আমার আব্বুও আমায় ক্ষমা করে দিবে।
–নে জলদি হা কর, খেয়ে নে।
মিষ্টি দ্রুত খাবার শেষ করে বাবার কাছে যায় ক্ষমা চাইতে।
.
–আম্মু, ও আম্মু।

–আম্মু, কই তুমি?
মিষ্টি এগিয়ে গিয়ে দেখে মা খাবার টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।
–আম্মু।
–কে?
–আমি, এখানে বসে আছে যে? আব্বু কই?
–এতক্ষণ এখানেই বসে ছিলো, তুই আসবি বলে এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু তুই আসলি না, একটু আগেই রুমে গেছে।
মিষ্টি বাবার রুমের দরজাটা একটু খুলে দেখে বাবা ঘুমিয়ে আছে।
–আম্মু, আব্বুতো ঘুমিয়ে গেছে।
–হুম, তুই কেনো এসেছিস?
–কি বলছো? আমার ঘরে আমি আসতে পারবো না?
–তোর ঘর? আচ্ছা আমিতো ভুলেই গেছিলাম। কঠিন হৃদয়ের মানুষ উনি, তোর জন্য ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে, নিজের বাবার সাথে এভাবে কথা বলতে পারিস তুই, আমি কখনো কল্পনাও করিনি।
–আম্মু, আমি নিজেও জানি না আমি কি বলে দিয়েছি। আমার মাথা ঠিক ছিলো না। আমি আব্বুর কাছে ক্ষমা চাইবো।
–প্রয়োজন নেই, তোর বাবা তোর ওপর রেগে নেই।
–আমি আব্বুর সাথে কথা বলবো।
–এখন ঘুমাচ্ছে, ২ দিন যাবত ওনার শরীরটা খারাপ, এখন ঘুমের মধ্যে ডাকার কোনো প্রয়োজন নেই। কাল সকালে আসিস।
–আম্মু, আমায় ক্ষমা করে দাও প্লিজ, আমি এভাবে বলতে চাইনি। রাগের মাথায় আমি খুব খারাপ কিছু বলে ফেলেছি।
–আমার শরীরটাও ভালো লাগছে না, তুই এখন যা, কাল আসিস। আমি ঘুমাতে গেলাম।
মিষ্টি ভালো ভাবেই বুঝতে পারে মা তার ওপর রেগে আছে।
তবুও আর কথা না বাড়িয়ে মন খারাপ করে মিষ্টি মামুনের কাছে ফিরে আসে।
এসে মামুনকে সবটা খুলে বলে।
মামুন মিষ্টিকে বুকে জড়িয়ে সান্তনা দেয়, বলে সকাল হলে সে নিজে যাবে মিষ্টির সাথে। চাচার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবে।
মিষ্টি কাঁদতে কাঁদতে মামুনের বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে।
ড্রিম লাইটের হালকা আলোয় মামুন মিষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে।
মিষ্টিকে কেমন যেনো বাচ্চা বাচ্চা লাগছে।
মেয়েটা রেগে গেলে কখন কাকে কি বলে সে নিজেও জানে না। পরে অবশ্য এর জন্য এসে বার বার ক্ষমা চায়।
তবুও, ক্ষমা চাইলেই কি সব ঠিক হয়ে যায়?
কারো মনে আঘাত দিলে ক্ষমা চাওয়ার পর কি আঘাত সেরে যায়?
মেয়েটাকে আর কত বোঝাবো?
এসব ভাবতে ভাবতে মামুন মিষ্টিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে।

সকালে মিষ্টি মায়ের চিৎকারের শব্দে ঘুম থেকে জেগে ওঠে।
বুঝতে পারে ওর মা চিৎকার করে কাঁদছে, মামুনও শব্দের কারনে হকচকিয়ে ওঠে।
মিষ্টি দৌড়ে মায়ের রুমে চলে যায়, ততক্ষণে বাকি সবাই সেখানে উপস্থিত।
মিষ্টি ভিতরে প্রবেশ করে দেখে মা বাবার পাশে বসে বাবার মাথাটা কোলে নিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে।
আর বাবা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, মা এতো নাড়াচ্ছে, বাবা তবুও উঠছে না।
মিষ্টি আরো কাছে গিয়ে বুঝতে পারে তার বাবা আর বেঁচে নেই।
.
.
.
চলবে………..
.
লেখক :- #A_Al_Mamun