প্রেম তরঙ্গ পর্ব-০২

0
277

#প্রেম_তরঙ্গ
#আলিশা
#পর্ব_২

সেদিন কেউ লাশ বাহী একটা গাড়ি নিয়ে যখন বাসার গেইটে প্রবেশ করে তখন আমি বেলকনিতে দাড়িয়ে। কণা দৌড়ে যায় গাড়ির কাছে। কণার মা বাবাও চলে যায় হন্তদন্ত হয়ে। মোট দু’টো গাড়ি প্রবেশ করে বাড়িতে। একটা সময় লাশ বাহী গাড়ি হতে নেমে আসে এক ফ্যাকাশে ফর্সা তরুণ । তখন সে ছিল যেন চেরি ফলের অনুরূপ। নাক, কান, চোখ তার ছিল পুরোপুরি লাল রাঙা।চোখে ছিল জলের ধারা। এলোকেশী কণা হুট করে হামলে পড়ে তার বুকে। সে অস্পষ্ট সুরে কান্নারত কন্ঠে ভাইয়া বলে ডেকছিল ছেলেটাকে। কণার ব্রাউন চুলগুলোর দশা ছিল যাচ্ছেতাই। আমার মায়া হচ্ছিল ভীষণ। বরাবরই ওর চুলগুলো ছিল আমার পছন্দের। আমি উৎসুক হয়ে দেখছিলাম। অপর গাড়ি হতে নেমেছিল চারটে বিদেশি। মধ্যবয়স্ক এক কাপল আর দু’টো মেয়ে। সকলের চোখ মুখ জুড়ে ছিল বিষাদ আর বিষাদ।

— ও কণার ভাই, ক্যারেন।

আমার মনোযোগ যখন নিবদ্ধ ছিল অচেনা, অসম্ভব ফর্সা ছেলেটার দিকে ঠিক তখনই পরিচয় প্রকাশ করে দেয় তিতাস। সে আমার পাশে এসে দাড়িয়ে বলে ওঠে এই কথা। আমি চমকে পাশে তাকাই। তিতাস আমার ঘরে এসেছে? এমন অধিকার বা সাহস বা অনুমতি তাকে দেওয়া হয়নি! আমার চোখে তখন ছিল শঙ্কা আর অবিশ্বাস। তিতাস গুমোট মুখে বলেছিল তারপর

— বি কেয়ারফুল এন্ড কন্ট্রোল ইউর মাইন্ড।

এটুকু বলেই সে গটগট করে চলে যায়। আমি বুঝিনি তার কথার এ-মাথা ও-মাথা এবং মাঝের অংশ। তিতাস চলে যেতেই আমিও উৎসুক হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পরি। নিচে গিয়ে সেবারই প্রথম খুব কাছ থেকে দেখি ক্যারেনকে। অনেক লম্বা একটা ছেলে। অসম্ভব ফর্সা আর চমৎকার দু’টো চোখের অধিপতি অশ্রু নিবারণে ব্যাস্ত। আমি হা হয়ে দেখছিলাম। যেন ঢুকে পরতে চেয়েছিলাম ক্যারেন নামক বিদেশি ছেলেটার কষ্টের রাজ্যে। কণা-ক্যারেনের মা হারানোর বেদনা আমি যেন মিটারে মাপতে চেয়েছিলাম সেদিন। তিতাস তখন আবারও এক দমকা হাওয়ার মতো এসে উপস্থিত আমার সম্মুখে। হুট করে হাত টেনে নিয়ে যায় একটু দূরে। নিচু স্বরে অসহায়ের মতো বলে

— তিথি……

এটুকুই তার মুখের ভাষা ছিল। কিন্তু চোখের ভাষায় ছিল আরো কিছু। আমি হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রই তার সম্মুখে। চোখের ভাষা স্পষ্ট পড়ে নিয়ে তাকে বলি

— আজব তিতাস! তুমি এমন কেন? আমি সেদিন মজা করে বলছিলাম ক্যারেন অনেক সুন্দর। ওর মতো কিউট একটা বিদেশি ছেলে জামাই হওয়া মানে লাইফ ইজ ঝাকানাকা। তাই বলে তুমি সত্যি ভেবে বসবা? আশ্চর্য! আজ শোকের আসর এখানে তিতাস? এতো ওভার পজেসিভ্ হওয়া কি ঠিক?

— আচ্ছা।

তিতাস গুমোট মনে, তার গৌড়ে বর্ণের মুখে অদৃশ্য কালো ছায়া ফেলে প্রস্থান করে সেদিন আমার সম্মুখ হতে। তবুও আড়ালে, অগোচরে সে পুরোটা সময় পরখ করে গেছে আমায়। আমি অবাক ও হতাশ ছিলাম সেদিন। এতোটা সিরিয়াস কেউ কিভাবে হতে পারে? শুধুমাত্র ক্যারেনের একটা ছবি দেখে সুদূর প্রায় দুইশত দিন আগে আমি তাকে বলেছিলাম

” ইশ! ইশ! জীবনে ভয়ংকর ভুল করেছি আমি। তোমার মতো ইগো ওয়ালা ছেলের সাথে প্রেম না করে কণার বিদেশি ভাইয়ের সাথে প্রেম করতে পারলে ভালো হতো। দেশি মুলা তুমি। ঝাল বেশি। বিদেশি মুলাই ভালো। তুমি তো শুধু সারাদিন শাসনের ওপর রাখো আমায়।”

এটুকু কথাই ছিল। তখন আমি শুধুমাত্র ক্যারেনের একটা ছবি দেখেছিলাম তাও তিতাসের কাজিন হিসেবে। তিতাসের আত্মীয় সম্পর্কে জানতে গিয়ে। কিন্তু কে জানতো? আমার এ কথা এক পর্যায়ে সত্য হবে। মুখ ফুটে মজার ছলে বলা কথা বাস্তবায়িত হলো কণার জন্য। ক্যারেন সেদিন তার মায়ের জানাজা করে বাসায় আসে। তার সাথে আগত চারজন ফরেনার সেদিনই চলে যায়। তারা ছিল ক্যারেনের মামা-মামি আর কাজিন। প্রত্যেকে ছিল খ্রিস্টান। অনেক আগেই ত্যাজ্য করা হয়েছে ক্যারেনের মা’কে। যেদিন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন সেদিনই। এরপর, কেটে হেলো তিনটে দিন। কোনো এক চিরচেনা সাঁঝে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যাচ্ছিলো আকাশ পথ দিয়ে। সাত তলা বাসার চার তলার ফ্ল্যাটে চলে তখন তুমুল ঝগড়া। আমি কান্নারত কন্ঠে তিনতলায় আমার রুমে বসে। চোখে ভয়, লজ্জা আর শঙ্কার ছায়ার সাথে ঝড়ছিলো অবাধ্য জল। তিতাস আর আমি সেদিন….

— টিটি, হাতটা দাআও

ভাবনা গেলো ছুটে আমার ক্যারেনের ডাকে। আমি গাড়িতে এলিয়ে রাখা মাথা উঁচু করলাম। বন্ধ চোখ খুলে চাইলাম গাড়ির বামে। ক্যারেন গাড়ির দ্বার খুলে দাড়িয়ে আছে। আমি ঈষৎ অবাক হলাম তাকে দেখে। ভাবলাম কোথায় যেন যাওয়ার কথা ছিল? ভাবনার মাঝে একবার চাইলাম আশপাশে। চেখ ঘুরিয়ে দর্শন পর্বের মাঝে বুঝলাম আমি ক্যারেনদের বাসার সম্মুখে। মানে শশুর বাড়ি। কণাদের বাসায়। ডেকোরেশন করা হচ্ছে। আজ বাংলাদেশের নাম করা এক ডাক্তারের মেয়ের বিয়ে বলে কথা! খুব বেশিই সাজানো হবে হয়তো পরো বাড়ি।

— হেই.. কোঠায় হার-ইয়ে যাও ঠুমি? আই সেইড, টোমার হাট দাআও।

ক্যারেন এখনো তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে আছে আমা দিকে। আমি ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। বিদেশি মানুষ-ও যে এতো ঢং আর কূটনীতিক জানে তা এই ক্যারেনকে না দেখলে জানতাম না। প্রথমেই আমার সর্বাঙ্গে ধিকিধিকি আগুন জ্বলে তার চেহারা দেখে। সাদা কাগজের মতো ফর্সা মানুষটাকে দেখলেই আমার ভয়াবহ কষ্ট হয়। আমার ভালোবাসা কেঁড়ে নিয়েছে সে। দ্বিতীয়ত আমার আগুন দাউদাউ রূপে প্রজ্জ্বলিত হয় তার বাংলা ভাষার যাচ্ছেতাই উচ্চারণে। কি বলে না বলে তা কুয়াশায় ঢাকা। কোথায় কে একে এমন বাংলা শিখিয়েছে কে জানে? ভাষার মানসম্মান রাখে না!

— টিটিইইই.. আর হউ…. আর হউ… কি যেন বলে.. ঐ… ওহ! রাবিশ!

ক্যারেন হঠাৎ থতমত, বিরক্ত হলো। কোনো একটা শব্দ মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে সে। আমি পাত্তা দিলাম না। আচমকা ধুপ করে নেমে পরলাম গাড়ি থেকে। গটগট করে পা ফেলে চলতে লাগলাম সম্মুখে। বেশ কয়েক কদম। প্রায় ক্যারেন থেকে পাঁচ কদম এগিয়ে যেতেই হঠাৎ শুনতে পেলাম

— টিটিইইই… ইউ আর বআআয়ইইরাআআ

আমি বেশ দ্রুত গতিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তৎক্ষনাৎ চাইলাম পেছনে। ক্যারেন ততক্ষণে গাড়িতে উঠে পরেছে। পার্কিং-এর উদ্দেশ্যে হয়তো। দৃষ্টি তার আমাকে ঘিড়েই। মুখে মিটিমিটি হাসি তার। আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। বলল কি সে? বআআয়ইইরাআআ। মানে কি? এমন উদ্ভট শব্দ কি আদৌও আমাদের অভিধানে আছে? আমি ভাবনার খেয়াল করলাম ক্যারেন বেশ খুশি খুশি। সে তার কাঙ্ক্ষিত শব্দটা মনে করে মুখ নিসৃত করতে পেরে। কিন্তু আমি বুঝিনি! কি শব্দ এটা?

.
সকাল ন’টার দিকে ক্যারেন আমায় তার বাবার বাসায় নিয়ে এলো। আলাদা ভাবে তার সাথে আমি অন্য বাসায় থাকি। ক্যারেনের বাবারই বাসা। এখান থেকে প্রায় ত্রিশ মিনিটের দূরত্ব। সকাল হতে ক্যারেনকে চোখে পরেনি আমার। আমি ড্রইং রুমে বসে ছিলাম শুধু শক্ত মুখে। তিতাস নেই এই বাসায়। সে তার নিজের বাড়িতে। কুমিল্লাতে। বর সেজে আসবে। সেদিন তো শুধু হসপিটালে বিয়ে হলো কণা আর তিতাসের। আজ বউ তুলে নিয়ে যাওয়ার দিন। বুকটা অসহ্য রকমের পুড়ছে। দাবানল, ঘুর্ণিঝড়, শিলা বৃষ্টি যেন একত্রে শুধু হয়েছে। অসহ্য এই অনুভূতি। অসহনীয় বাস্তব এটা যে তিতাস আমায় ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে বউ করেছে।

ভাবনার মাঝে হঠাৎ শোরগোল কানে এলো। রব উঠেছে “বর এসেছে, বর এসেছে ” আমার কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো। অজান্তে হুট করে চোখ গেলো বামের ঘরে কণার রুমে। পোড়া হৃদয় আরো পড়তে চোখে ধরা দিলো রূপবতী কণাকে। সোজা চোখ পরেছে আয়নার। বেশ করে ড্রাইং রুম হতে দেখা যাচ্ছে কণা বসে আছে। মুখে তার লাজুক হাসি। লাল দোপাট্টা চোখ আড়াল করে রেখেছে। চিনচিন নয়াথা করছে আমার বুকে। আমি উঠে দাড়ালাম। চোখে পানি এলো। অস্থির লাগছে। ইচ্ছে হচ্ছে চোখটা চিরতরে বন্ধ করে নি। এসব দৃশ্য সইতে পারবো না আমি। হেঁট প্রায় দৌড়ে ছুটছিলাম আমি। আচমকা ধাক্কা খেয়াল এক মহিলার সাথে। মুহূর্তেই মরার ওপর খারার ঘা হিসেবে তিনি পরতে পরতে না পরলেও ফেলে দিলেন অজান্তে বড় মাটির ফুলদানিটা। গুড়িয়ে গেলো। ভেঙে গেলো। তিনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। আমি অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম। তবুও সব ফেলে আমি পালাতে চাইছি এই মুহূর্তে। হ্যা ঠিক করে বসলাম আমি পালিয়ে যাবো। ক্যারেন হতে পালাবো, তিতাস হতে পালাবো এবং আমি পালাবো এই কষ্ট যন্ত্রণা হতে। ইশ! কেন এরা সবাই আমার পিছু নিয়েছে। আমি চলে যাবো। বুকটা হাহাকার আমার। সেকেন্ডের কাটার সাথে পাল্লা দিয়ে যেন তরতর করে বাড়ছে আমার অস্থিরতা। হাত পা কাঁপছে। বারবার মনে হচ্ছে

” তিতাসকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। আমি সইতে পারবো না তিতাসকে অন্য মেয়ের পাশে দেখে। আমি দম ফেটে মারা যাবো।”

চলবে….

( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।)