প্রেম তরঙ্গ পর্ব-০৬

0
229

#প্রেম_তরঙ্গ
#আলিশা
#পর্ব_৬

সহসাই ঘুমিয়ে পরেছিলাম আমি। অতঃপর যখন চোখ খুললাম তখন আমার বিছানা জুড়ে বৃষ্টির পানির ছিটেফোঁটা। কুয়াশার ন্যায় জড়িয়ে আছে। তার ওপর হাত পরতেই গা শিউরে উঠে ঘুম ভাঙলো আমার। ঝুমঝুম শব্দে ঘর আমার মাতোয়ারা। ওপরে টিনের চালে সানন্দে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পরে সুর বুনেছে পবনে। ঘরময় আঁধার নেমেছে। অল্প, খুবই অল্প আলোতে ঘর ছেড়ে দৃষ্টি দরজা দিয়ে বাইরে রেখে দেখলাম, খাবার টেবিলে মিলি বসে আছে। ঈষৎ সুরেলা কন্ঠও কানে আসছে দেখছি? আম্মু আব্বু কি এখনো আসেনি? ভাবনা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পরলাম। বাড়িটা আমাদের দোচালা টিনের। আর দেয়াল গাঁথা ইট সিমেন্টে। মোট তিনটে বেডরুমের সম্মুখে মিলনস্থল হিসেবে ড্রয়িং রুম আকৃতির একটা দেউড়ি আছে। তার বামে রান্নাঘর আর ওয়াশরুম পুরো ঘর ছেড়ে একেবারে উঠোনে। বলাচলে এটা অন্দরমহলের মতো। এটুকু একটা কাঠের দরজা দিয়ে পৃথক করে তার সম্মুখেই দেওয়া হয়েছে আরেকটা সন্ধি কক্ষ। সেখানে আব্বুর কার্য কথা চলে। মানুষ আসে, দরবার হয়।

” আমায় ভাসাইলি রে, আমায় ডুবাইলি রে… অকুল দরিয়ার বুঝি কুল নাই রে……..”

টেবিলের ওপর রাখা অর্ধপূর্ণ পানির জগটা হাতে নিতেই মিলির গানের সুর আমার কর্ণকুহরে ঝঙ্কার তুলল। সে আমায় দেখলো। কিন্তু গান স্তব্ধ করলো না। কি না ভেবেই সে মিষ্টি হাসি ঠোঁটে নিয়ে গেয়েই যাচ্ছে গান।

“কুল নাই সীমা নাই অথৈ দরিয়ার পানি
দিবসে নিশিথে ডাকে দিয়া হাতছানি রে
অকুল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে।।

পানসা জলে সাঁই ভাসায়ে সাগরেরও বানে ।।
আমি জীবনের ভেলা ভাসাইলাম।
কেউ না তা জানে রে।।
অকুল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে।।
আমায় ডুবাইলি রে আমায় ভাসাইলি রে,”

এটুকু গাওয়ার পর মিলি লম্বা এক সুর শেষে ইতি টানলো গানের। আমার বুকে ধুকপুক ধুকপুক সুর চলছে। মিলির মাথায় ছিল একটা গাজরা। সে হুট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে মাথা থেকে গাজরা খুলে আমার মাথায় পরিয়ে দিলো। বলল হঠাৎ

— আপুনি, তুই সবসময় এমন হতভম্ব ভাব ধরে থাকিস কেন? তিতাস ভাই ঢাকা নিয়ে কি করলো বলতো? তোর এই হ্যাবলা ভাবটাই ভাঙতে পারেনি। হুহ! বিফল প্রেমিক।

মিলির কথায় ভাবটা আমার মুহূর্তেই দগ্ধান হলো। বুকের ক্ষত কেন কাঁচা হলো। মিলি জানে তিতাসের সম্পর্কে। তনে আম্মু আব্বু একবিন্দুও জানে না।

— মিলি, গান গাওয়া কোত্থেকে শিখলি?

— বলবো?

মিলির মুখে চাপা হাসি। আমি হাতের জগটা টেবিলে রেখে ওর দিকে নমনীয় দৃষ্টি রাখলাম। ছোট হওয়া সত্বেও ও আমার চেয়ে প্রায় দুই ইঞ্চি লম্বা হবে। গায়ের রংটা আম্মুর মতো, দুধে আলতা। চোখ দু’টো যেন নিখুঁত শিল্পির হাতে আকা মোহনীয় জীবন্ত চিত্র। ঠোঁট তার জাম রাঙা, খুব শীর্ষ নয় খুব মেটাও নয়। গোটা মুখটা জুড়ে যেন তীক্ষ্ণতা, স্নিগ্ধতার বসবাস। আমি মিলির পুরো মুখ থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দৃষ্টি রাখলাম ওর চোখেতে। বললাম

— কে শিখিয়েছে?

মিলি মেঘের আড়ালের সূর্যের ন্যায় উঁকি দেওয়া এক টুকরো হাসি ঠোঁটে জুড়ে নিলো। বলল তারপর ফিসফিস ধ্বনিতে

— তীন ভাইয়া।

আমি ঈষৎ অবাক হলাম। এই তীন ভাইয়া আমার বড় চাচার ছেলে। সে অসম্ভব সুন্দর গান করে। তবে সে বেচারা তো কথাই বলে না কারো সাথে। কি বড়, কি ছোট। সে আবার মিলির গানের শিক্ষক হলো নাকি? বেশ তো!

— আপু, আমি কিন্তু এই জারি ভাটি গান দিয়ে এবার জেলা পর্যায়ে গিয়েছিলাম। উপজেলায় ফার্স্ট হয়েছিলাম। তারপর জেলাতে গিয়ে সেকেন্ড।

— বাহ! কিন্তু আশ্চর্যের কথা হলো তীন ভাইয়া তোকে গান শেখালো?

— সে কি আর সাধে শিখিয়েছে? নিজের মাথার তারগুলো অক্ষত রাখাতেই শিখিয়েছে। প্রতিদিনই যেতাম আপু। ধমক টমক দিতে গিয়ে আবার দেয়নি। পেচার মতো মুখ করে থাকতো। পরে বড় আম্মা অনেক করে বলাবলি করে রাজি করাইছে। তুমি জানো? মোটে সাতটা ক্লাস নিয়েছে শুধু। তারপর ইউটিউব ধরিয়ে দিয়েছে। আমিও বলে আসছি, “প্রোফেশনাল গায়ক না বলে ক্লাস নিতে জানে না। হু!”

— সত্যিই তো! সে তো প্রফেশনাল গায়ক না। শুধু টুকটাক গান গায় স্কুল জীবন থেকে। অনেক দিন হলো শোনা হয় না তার গান।

আমার মুখায়বয়বে বিষন্নতা ছিল। মিলি আচমকা গদগদ কন্ঠে বলল

— আপু, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে না? তীন ভাইয়া কিন্তু বাসায় এখন। যাবে?

— না না! আম্মু আব্বু বাসায় নেই। যাবো না। এই বৃষ্টির মধ্যে ভিজলে জর আসবে।

আমার কথার প্রত্তুত্যরে মিলি খপ করে আমার একহাতে নিজের হাতে বন্দী করলো। দূরন্তপনা হুটহাট আকাশে বাতাসে মেলে দিয়ে সে আমায় এক ঝটকায় পেছন মুখো করে দৌড়ে চলা শুরু করলো। আমি বিষ্ময়ে হতভম্ব। মিলি অন্দরমহল পেরিয়ে আব্বুর সমাবেশের কক্ষ ছাড়লো। গ্রিলের বড়সড় গেটটা একহাতে খুলে নেমে পরলো সোজা বাড়ির বাইরে। অল্প একটু ফাঁকা জায়গা। এই সাঁঝের ঝুম বৃষ্টিতে যেন কেউ নেই কোথাও। হঠাৎই দৌড়ের দরুন হাত খোপা করে রাখা চুলগুলো উন্মুক্ত হলো আমাদের দু বোনের। মিলি তখন আচমকাই দৃষ্টি ফেলল আমার দিকে। চমকে তুলল সে আমায় একটা কথা বলে।

— আপুনি, জীবন সুন্দর। সবসময় ঘরে বন্দী থেকে নিজেকে শেষ করে দিবি না। সুযোগ পেলে মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলবি। আমি জানি না তিতাস ভাইয়ের সাথে তোর কি হয়েছে। তবে তোর মন খারাপ এটা আমি জানি। তুই মন খারাপ গুলো বৃষ্টির সাথে ঝড়িয়ে দে। এই যে আমি তোর হাতটা শক্ত করে ধরলাম। ভাব তুই একা না। তোর বোন আছে তোর কাছে।

কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে দিয়ে মিলি শক্ত করে আমার ডান হাতটা ধরলো। আমার বুকে যেন শুরু হয়েছে তোলপাড় করা ঝড়। চিরাচরিত অভ্যাস বশে কাঁপন শুরু হয়েছে হাতে পায়ে। মিলি থামছে না। ও ছুটছে ওর কোমল পায়ে তীন ভাইয়াদের বাড়ির দিকে। ভিজে চুপেচুপে সে। আমারও যেন সিক্ত হওয়া বাকি নেই গায়ের টিশার্ট, লং স্কার্ট আর ওড়নাটা।

.
যেতে যেতে সত্যিই মিলি আমায় সিক্ত গায়ে পায়ে নিয়ে এলো তীন ভাইয়াদের বাড়িতে। সদর দরজার মিনিট তিনেক ধাক্কা ধাক্কি করার পর বড় আম্মা এসে দরজা খুলে দিলো। আমাকে দেখে যেন উনি আকাশ থেকে পরলেন। কিয়ৎক্ষণ তিনি ধারা নীতি ভুলে কেমল আমাকেই দেখে গেলেন অপলক দৃষ্টিতে। মিলি হুড়মুড় করে নিজেই বড় আম্মাকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পরলো ঘরে। বড় আমায় আদর করলেন কপালে একটা চুমু একে দিয়ে। অতঃপর আবার শুরু করলেন বকাবকি। কেন এই আকাশ কাঁপিয়ে তোলা মেঘের গর্জন মাথায় নিয়ে, বৃষ্টি ফোঁটা গায়ে ছুঁয়ে তার বাড়িতে এলাম। ঠান্ডা, জ্বর আসে যদি? মিলি কানে নিলো না। সে চলে গেলো আমায় ছেড়ে এবার দোতলায়। তীন ভাইয়ার রুমের দিকে। আমি বড় আম্মার কাছে রইলাম। তিনি আমায় নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে তোয়ালে দিলেন। আফসোস করলেন শুঁকনো কিছু কাপড় না দিতে পেরে। তার এই আদর গুলো বাড়াবাড়ি নয়। সে আমার আরেক মা। আমার নানা-নানি অনেক আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। দাদা-দাদির মুখটাও আমি দেখিনি। সেই সঙ্গা ধরে আম্মু যখন আমাদের দুবোনর জন্মের পর স্কুলে চলে যেতো। আব্বু চলে যেতো কলেজে তখন তীন ভাইয়ার এই মা-ই ছিল আমাদের মা। মায়ের আদর, ভালোবাসার নব্বই ভাগই তার থেকে পেয়েছি। বড্ড ভালো মনের মা সে। হবে নাই বা কেন? তার বাবা ছিলেন তখনকার সময়ের একজন মেজিস্ট্রেট। তিনি ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল কলেজের একজন শিক্ষার্থী। পরে শুধু ভাগ্য ক্রমে প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে বড় আব্বুর হাতে হাত রেখে বাড়ি ছেড়ে চলে আসে।

চলবে….
(ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন)