প্রেম তরঙ্গ পর্ব-০৫

0
212

#প্রেম_তরঙ্গ
#আলিশা
#পর্ব_৫

সকাল ছয়টায় বাসা থেকে বের হলাম। ক্যারেনের হাতের ফাঁকে গুঁজে দিয়ে এসেছি চিরকুট। আমি এই আট দিনে তার সাথে বাস করে যা জানি তাতে তার ঘুম ভাঙবে সকাল আটটায়। যখন সূর্য এসে উঁকি দেবে তার জানালা দিয়ে ঘরে। এক চিলতে আলোর চিরল রূপ এসে লেপ্টে যাবে তার চোখে মুখে তখনই তার ঘুমের ছুটি হবে। ততক্ষণে বেঘোরে ঘুমোবে। হাঁক ডাকে সহজে ছুটবে না তার ঘুম। আমি যখন পেটের দায়ে তার সাথে থাকাকালীন সময়ে রান্না করেছি কিচেনে তখন থালাবাটির ঝনঝনানি হতো ঘর কাঁপিয়ে তোলার রূপ। কিন্তু তার ঘুম ভাঙেনি। তাই বাসা থেকে বের হয়ে ততটা দুরন্তপনার ছুটছি না আমি। ধীর গতিতে পা চলছে আমার। দুঃখ গুলো উপচে পড়ছে। চোখের জল আমার অতি সহজেই আসে। আজও আসছে। তিতাসের কথা ভেবে ভেবে আমি বারংবার দগ্ধ হচ্ছি। এই শহরে তো একদিন তার জন্যই পা ফেলা হয়েছিল আমার। তারই প্রচেষ্টায়, তারই ভালোবাসার মায়ায় পরে প্রায় যুদ্ধ করে এসেছিলাম। তবে আজ কেন এমন দিন এলো? এসেছিলাম পূর্ণ হয়ে ফিরে যেতে। কিন্তু আজ আমি সর্বস্ব হারিয়ে শূন্য হাতে ফিরছি। কোথায় তিতাস? সে কি বউ নিয়ে আনন্দে প্রহর কাটাচ্ছে? সে না আমায় সেদিন কথা দিয়েছিল,

” তিথি, আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যাবো না। এই যে তুমি এখন ঢাকায়, আমি তো চিন্তামুক্ত। এবার শুধু আমাদের বিয়ে করে সকলকে চমকে দেওয়া বাকি। আমরা কিন্তু দুইবার দিয়ে করবো। একবার তুমি আর আমি সকলের অগোচরে। আর একবার পরিবার নিয়ে। ”

ভাবনার মাঝে আমি ডুকরে কেঁদে দিলাম। অবশ হয়ে আসছে আমার হাত-পা। সামনে যেন এক কদম এগোনোও দায় হলো। চিৎকার করে তিতাসকে ডাকতে ইচ্ছে করছে। আমি কিভাবে থাাকবো তাকে ছাড়া? কণার ঘুমের ওষুধের প্রভাব অলৌকিক ভাবে আমার ওপর পরে আমি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে বুঝি অনেক ভালো হতো! প্রেম মানে যেন বিষাদ! প্রেম মানে যেন ভাগ্য। আমার মতো হতভাগীর ভাগ্যে প্রেমের সন্ধি জোটেনি। জুটতে দেয়নি ক্যারেন। জুটতে দেয়নি কণা। আমি কি দোষ করেছিলাম তাদের কাছে? তিতাসকে কি আমি ভালোবাসতে পারি না? মন আমার গোপনে অহরহবার চিৎকার দিয়ে বলে যাচ্ছে, তিতাস কেন বিশ্বাস করলো না আমায়? কেন সে আমার ওপর জেদ করে রাগ নিয়ে কণাকে বিয়ে করলো?

.
সব দুঃখ বুকে তালাবদ্ধ করে অবশেষে বাসে উঠলাম। সকাল আটটার একটা বাস পেয়েছি। সিধাপথে ঢাকা থেকে রংপুর নিয়ে যাবে। সিটটা পরেছে এক ষোড়শী মেয়ের সঙ্গে। তার মা বাবাও যাচ্ছে কোথাও। মোট তিনটে সন্তানের দু’টো দম্পতি নিয়ে আছে। আর বড় সন্তানটা আমার পাশে। মেয়েটা চলন্ত বাসে আমার পাশে বসে বারংবার চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে আমার চোখে মুখে। কান্নার দরুন হয়তোবা আমার চোখ মুখ ফুলে একাকার দশা। আমি পাশ ফিরে বসলাম। জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে অর্ধখোলা জানালা টেনে সম্পূর্ণ খুলে দিলাম। মুক্ত বাতাস মুহূর্তেই এসে চোখে মুখে ঝাপটা দিয়ে গেলো। রোদ্দুরের তেজ একেবারে কম নয়। সহনীয় মাত্রায় তারা ভ্রমণরত। প্রায় মিনিট পাঁচেক দূরন্ত পনায় বাস অতিক্রম করলো পথ। তারপরই এলো বিরক্তর মুহূর্ত। যানজটের ভীরে আটকে পরলাম। চোখে মুখে চলে এলো আমার বিরক্তি। সেই বিরক্তি নিয়ে বাসের জানালার বাইরে তাকাতেই আচমকা বিদায় হলো বিরক্তি। দৌড়ে চলে এলো কষ্ট। আমার বিপরীতমুখী এক প্রাইভেট কারে বসে আছে তিতাস। আমি স্পষ্ট দেখছি। দৃষ্টি তার সম্মুখে। কপালে হাত রাখা যেন শত জনের বিরক্তিতে সে জড়ানো। আমি নিজ হাতে তড়িঘড়ি করে চোখে ঢলা দিলাম বারকয়েক। বন্ধ চোখের পাপড়ি খুলে আবারও তাকেই দেখতে পেলাম। হ্যালুসিনেশন নয় তো? আমি নিজ হাতে চিমটি কাটলাম একটা। নাহ! স্পষ্ট ব্যাথা অনুভব হলো। তৎক্ষনাৎ আরো বেগবান হলো বুকের ব্যাথা। ক্রমশ নুইয়ে পড়লো দেহ মন। শুধুই বুক জুড়ে কষ্ট আর চোখ জুরে জলের সন্ধান পেলাম। ভাবনা আমার শূন্যের কোটায় রইলো। সে বুঝি বউ নিয়ে শশুর বাড়ি যাচ্ছে? অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। বুকে অনবরত কেউ যেন ছুরি চালিয়ে যাচ্ছে। আমার দর্শন পর্বে হঠাৎ নড়ে উঠলো বাস। এতেই যেন ভূমিকম্প হলো আমার বুকের মধ্যে। তিতাস কপাল থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আশপাশে নজর করতেই আকস্মিক আমি ধরা পরলাম তার চোখে। সে যেন চমকে গেলো। আমি দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মুখে হাত চাপা দিলাম। চিৎকার করে কান্না এসে যাচ্ছে। বাস ততক্ষণে জ্যাম কাটিয়ে স্বাভাবিক গতিতে চলছে। হঠাৎ আমার মন শেষ বারের মতো দেখতে চাইলো তিতাসকে। আমি মুখ বাড়িয়ে দিলাম জানালা দিয়ে। বেশ দূরে চলে এসেছি তার গাড়ি হতে। তবে ছলছল নয়নে অস্পষ্ট এটাই দেখতে পেলাম, কেউ যেন আমারই ন্যায় সেখান হতে তাকিয়ে আছে পিছু ফিরে। আমার তো নয়নের অশ্রুতে বদনে বৃষ্টি নেমেছে। তারও কি একই দশা? বদনে না নামলেও তার বুকের মরুভূমিতে কি বৃষ্টি নামেনি? নামেনি হয়তো! যদি নামারই হতো তবে সেদিন কণাকে বিয়ে করতো না। আমার নামে লিখে দিতো না এক সমুদ্র বিষাদ।

.
প্রণয় হেতুতে হয়ে ওঠা ঘৃণার শহর পেরিয়ে এক বুক কষ্ট নিয়ে বাড়িতে আসতে আমার আছরের ওয়াক্ত পেরিয়ে গেলো। ঢাকা আজ থেকে হয়ে উঠেছে আমার কাছে এক দগ্ধান শহর। যে শহরে গিয়ে আমি ঠকে এসেছি। এক সমুদ্র বিষাদ মন কুঠিরিতে বন্দী করে এনেছি। দু’নয়নের অশ্রু ঝাড়ানোর কারণ নিয়ে এসেছি। আর ফিরতে চাই না সেই শহরে। দেখতে চাই না প্রাণপ্রিয় তিতাসকে। আজ যেভাবে পিছু ফিরে দৃষ্টি বিনিময় করেছিলাম তিতাসের সাথে, ক্রমশ বাস আমায় নিয়ে যাচ্ছিলো তার থেকে দূর গন্তব্যে। আমার মিনতি ঠিক এভাবেই যেন সময় আমায় নিয়ে যায় তার স্মৃতি ফেলে বহু বহু দূরে।

শুনশান নীরব কাঁচা পাকা বাড়ি আমাদের। ঠিক গাঢ় গ্রাম নয়। শহরের আঁচ আর গ্রামের ছায়া নিয়ে গড়ে ওঠা এক এলাকা। পাকা রাস্তায় গাড়ির আনাগোনা বেশ। আমাদের বাড়ির সম্মুখ পথটা দিয়েই লোকে বাজারে ছোটে। মূল সড়কে উঠে দূর দূরন্তের পথ ধরে। আমার ছোট পরিবারে আমিসহ চারজন সদস্য। বাড়িতে এসে শুধু ছোট বোনকে পেলাম। আম্মু প্রাক-প্রাথমিকের একজন শিক্ষিকা। আব্বু এলাকার স্থানীয় এক কলেজের শিক্ষক। সাথে উনি এলাকার চেয়ারম্যান। দু’জনের কেউই বাসায় নেই। বোন মিলি আমাকে দেখে প্রথমেই থমকে গেলো। তারপরই তার ছুটে এসে জড়িয়ে ধরা। তার এসএসসি পরীক্ষার গল্প। কি করলো না করলো জুড়ে দিলো সব কথা। আমি আমার বিষন্নতার সাগর হতে যেন মিনিটের মধ্যে উঠে এলাম। মিলিটা যে আমার ম্যাজিক। বোরখা ছেড়ে ফ্রেশ হতে হতে শুনলাম তার দীর্ঘ বক্তব্য। অতঃপর সে দৌড়ে চলে গেলো আমার খাওয়ার ব্যাবস্থা করতে। আমি নিজ ঘরে এসে ব্যাগ রেখে গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়। একেবারে গোসলটা করে নিলে অবশ্য ভালো হতো। কিন্তু ওঠার ইচ্ছে হচ্ছে না। চোখ ক্রমশই তেল বিহীন বাতির ন্যায় নিভু নিভু করছে। বন্ধ করে নিলাম দু চোখ অবলীলায়। ঘুমের রাজ্যে পারি জমানোর পথে হুট করে যেন দেখা হয়ে গেলো আবারও তিতাসের সাথে। তারপর ক্যারেনের সাথে। একে একে চোখের সম্মুখে ভেসে উঠলো ফেলে আসা কিছু দৃশ্য। মন কল্পনায় গড়ে নিলো, ধরে বসলো তিতাস বুঝি বেশ ভালোই আছে। সামলে নিয়েছে নিজেকে! আর ক্যারেন? সে কি ঘুম থেকে উঠে আমায় খুঁজেছে আশেপাশে? হদিস না পেয়ে বুঝি সেও বেশ খুশি হয়েছে। আমি আপদ নিজ হতেই বিদায় হয়েছি। তার কার্যসিদ্ধি হয়েছে কতই না নির্ভেজালে!

চলবে…..

( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন)